দূরত্ব
-অমল দাস
বৃদ্ধাবাসের বাগানটায় অমরেশ বাবু রোজই বয়সের তুলনায় অধিক শ্রম নিয়োগ করেন । তাঁকে বারন করা হয়না তা নয় কিন্তু কিছুতেই তাঁকে বোঝান যায় না। বাগান পরিষ্কার করা থেকে পাচন ঘর সর্বত্রই তাঁর অবাধ বিচরণ। এবং এই কারনেই সকলের কাছে অমরেশ বাবু প্রিয় পাত্র। বয়স মেরে কেটে সত্তর বাহাত্তর হবে বোধ হয় । তবে দেখে বোঝার উপায় নেই, রোজ প্রাতে যোগার অভ্যেসে বহুলাংশেই সতেজ মনে হয়।
আজ সকালের মর্নিং ওয়াক একটু বেশিই ক্লান্তি এনেছে , তাই বাগানের মাঝে আমগাছটায় ঘেরা বেদীর উপরে বসে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে লাগল।
-অমরেশ বাবু ! আপনাকে কত বার বারন করলাম যে এভাবে আর এই বয়সে ছোটাছুটি করবেন না । কিন্তু আপনি মশাই কোন কথাই শুনছেন না। কিছু একটা অঘটন হয়ে গেলে কি হবে ভেবেছেন?
অমরেশ বাবুকে ক্লান্ত হাঁপাতে দেখে এই আবাসের আবাসিক নিমাই বাবু তাঁর পাশে এসে বসে কথা গুলো বলতে থাকেন।
-নিমাই বাবু আমার আর আছে কি বলুন , হারানোর আর শোক নেই পাওয়ারও আশা নেই কিছু। যে টুকু অর্থ আছে তা এই আবাসনে দিয়ে চলে যেতে পারলেই হয়।
-মশাই কি… ভুল বকছেন ? আপনি এখনও কত শক্তপোক্ত । আপনি নেই নেই করে আরো ১০-১৫ বছর অনায়াসে কাটিয়ে দেবেন।
-নিমাই বাবু অনায়াসে কাটানোর কথা মুখে ভালো লাগে , বাস্তবটা বড়ই যন্ত্রণা দায়ক । এবং সেই যন্ত্রণা বুকে নিয়েই ৪০ বছর কাটিয়ে দিলাম গভীর নীরবে। এখন চলে যাওয়ার পালা, যত দ্রুত যাব তত বেশিই ওর সান্নিধ্য পাব।
– কার সান্নিধ্যের কথা বলছেন ? আপনার মাথা কি গেল ? কি উল্টো পাল্টা বলছেন বলুন তো?
-নিমাই বাবু মাথা আমার চল্লিশ বছর আগেই খারাপ হয়েছিল, নয়তো এক ফুটফুটে সরল মনের সহধর্মিণীকে ছেড়ে কি আমি সন্তান চাইতাম ? মাথা খারাপ তো হয়েই ছিল, তাই আজ এখানে পড়ে আছি। এ আমার পাপেরই শাস্তি ।
এই বলে এক নিঃশ্বাস ছাড়লেন অমরেশ বাবু, যেন নিঃশ্বাসে এক দীর্ঘ দিনের জমায়িত পাপ বোধ বেরিয়ে এলো সন্তর্পণে। যা নিমাইও বাবুও উপলব্ধি করতে পারলেন। তাই প্রশ্ন করেই বসেন- অমরেশ বাবু কি বলছেন কীসের পাপ?
-মশাই আমি কার কাছে যেতে চাই জানেন ? সে আমার মাধুরী । যাকে আমি চল্লিশ বছর আগেই হাত ছাড়া করেছি ইহ জগত থেকে। সে থাকলে হয় তো আমার আজ এই অবস্থা হতো না।
গভীর আগ্রহ নিয়ে নিমাই বাবু জানতে চান কি হয়েছিল ? কেন ছেড়ে দিলেন?
অমরেশ বাবু মুচকি হেসে বলে চলেন , আমি কি আর ছেড়েছি এ যে নিয়তির খেলা।
-একটু খুলে বলুন কি হয়েছিল ?।
অমরেশ বাবু বলে চলেন – মাধুরী কে আমি ভালবেসেই বিয়ে করেছিলাম , বিয়ের বছর খানেক পর মাধুরীর জটিল রোগ ধরা পরে। ডাক্তার জানায় সে মা হতে চাইলে প্রাণ সংশয় হতে পারে। আমিও বেশ সাবধানী ছিলাম কোন মতেই মাধুরীকে হারাতে চাইনি । কিন্তু মাধুরী সে আমাকে সন্তানহীনতায় দেখতে চায়নি তাই আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই সে গর্ভ ধারণ করে বসে।আর যত দিনে আমি জেনেছি তত দিনে আর উপায় ছিল না ।
কথা বলতে বলতে অমরেশে বাবুর চোখ ছলছল করে উঠে। তবে তিনি থেমে থাকলেন না আরও বললেন- ডাক্তার ধরে আমি মাধুরীকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ওর জিদ আর সন্তান চাহিদার কাছে আমি শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে যাই , ওকে আমি হারিয়ে ফেলি চিরতরে।
তবে ওর শেষ ইচ্ছা বা দাবীটা আজও আমার কানে বাজে। মাধুরী আমাকে বলেছিল , ‘আমার সন্তান ছেলে বা মেয়ে যাই হোক তুমি যেন আগলে রেখো মাধুরীর উপহার মনে করে”।
আমি পারিনি মাধুরীকে প্রতারিত করতে ওকে যে আমি আজও ভালোবাসি। ছেলে প্রতুল যখন ছোট্ট, কোলে করে চামচে দুধ খাওয়াতাম, আঙুল ধরে হাঁটা শেখাতাম, কাজের সময় সঙ্গে নিয়ে অফিস যেতাম , মা নেই তবু প্রথম মা বলা-ই শিখিয়েছিলাম , চাকরি ছেড়ে ব্যবসা নিলাম যাতে ছেলের স্কুল আসা যাওয়ায় সমস্যা না হয়। মাধুরীর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে মানুষ করতে লাগলাম। এই সবের মধ্যে কখন যেন নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছিলাম , ভুলেই গিয়েছিলাম আমার একটি জীবন আছে আমার একটি সংসার আছে । চাইলে আমি বিয়ে করতেই পারতাম, প্রতুলকে তার নতুন মায়ের হাতে তুলে দিতে পারতাম। কিন্তু ভয় ছিল ছেলে অবহেলার পাত্র না হয়। মাধুরী উপর থেকে ক্ষুণ্ণ না হয়। বেছে নিলাম বিপত্নীক জীবন। উজার করে দিলাম নিজেকে সন্তানের প্রতি।
সে এখম মস্ত মানুষ! আমার তৈরি ঘরেই আমি অমানুষ , সে এখন তার কর্পোরেট জীবনে মগ্ন আর গৃহে পত্নী ধর্মে জ্যান্ত । আমি বাতিল , আমি অবাঞ্ছিত । খোকা আমায় বড় যত্ন করেই বাতিল করেছে। বুদ্ধি করে এই সুন্দর বয়স্ক স্বজন হারা মহামিলনের আবাসনে রেখে গেছে , সেটাও এক বড় পিতৃ প্রেম । তবে মাধুরীকে আমি দুঃখী করব না , ওর সন্তানের মাথার ছাদ কেড়ে নেব না….. ওর মাথার ছাদও কেড়ে নেব না……. ।
অমরেশ বাবু একবার আকাশ পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন, মাধুরী আমাকে তোমার কাছে নাও আমি আর দূরত্ব সইতে পারছিনা , আমাকে কাছে টেনে নাও…. আমাকে কাছে টেনে নাও…….
এই বলতে বলতে অমরেশ সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন । নিমাই বাবু বেদীতে বসেই ভাবনায় ডুবে যান, ভরা যৌবনে সাথীহারা আর বৃদ্ধ বয়সে আপনহারা ভবের এই যন্ত্রণা যে কেন সৃষ্টি হল ? তার কোন জবাব যেন নেই….. কারো কাছেই নেই…….।
জবাবটিই সত্যি অজানা…
একদমই বাস্তব
ভালই ।
ধন্যবাদ