তোমাকে বিদায়

তোমাকে বিদায়

-অমল দাস

 

 

বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে রাত এগারোটা নাগাদ বাড়ি ফেরে বিকাশ ও স্ত্রী  সুতপা সঙ্গে চার বছরের শিশু অয়ন। পোশাক বদলানোর সময় বিকাশ পকেট থেকে মোবাইল বার করে টেবিলে রাখতেই দেখে কুড়ি টি মিস্‌ কল হয়ে আছে বিদিশার। বিদিশা সুতপার বোন, সেই সুত্রে বিকাশের শ্যালিকা। মিস কল দেখে বিকাশ কিছুটা আশ্চর্য – “ তোমার বোন আজ হঠাৎ আমায় ফোন করেছে,  তাও এত বার, কি ব্যাপার ? দু’বছর কোন কথাও নেই, ফোনও নেই আমার সাথে, আজ কেন” ?

সুতপা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলে ওঠে “ দেখনা একটা ফোন করে কি হয়েছে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো? এত বার কেন করল আমিও তো বুঝতে পারছিনা”।

 

বিকাশ ফোন করে কিছু বলার আগেই ওপ্রান্ত থেকে বিদিশা বলে ওঠে -“আপানার ভাই অমিতেশ বিষ খেয়ে  আপনাদের জমির পাশেই পড়ে আছে , ওকে বাঁচান”।

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত এই খবরে বিকাশ চমকিত হয়ে ওঠে। সে সভয়ে জানতে চায় –“ তুমি জানলে কি করে”?

-বিষ খেয়ে আমায় ফোন করেছিল অমিতেশ, ৬ টার সময়।

– তুমি আমকে ফোনে পাওনি তো অন্য কাউকে বললে না কেন ? সর্বনাশটা শেষ পর্যন্ত করেই ছাড়লে?

এই বলে বিকাশ ফোন ফেলে দিয়ে তড়িঘড়ি বড় দাদা নিলয় কে সঙ্গে নিয়ে আরও দুজন প্রতিবেশী নিয়ে জমির দিকে ছুটেতে লাগল।

হইহুল্লোর আনন্দ নিমেষে কিভাবে বিষাদ হয়ে ওঠে তা এখানেই বোঝা যায়। চারিদিকে হাওয়া নেই তবু যেন এক অনিশ্চয়তার প্রবল ঝড় বয়ে চলেছে রায় পরিবারের অন্তরে। বৃদ্ধ মা মৃদুলা দেবী ছোট ছেলের জীবন আশঙ্কায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তাকে বড় বৌমা ঝুমা ও সুতপা সান্তনা দেওয়ার অনর্গল মিথ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু মায়ের মন কি সে বারণ মানে ? তাই তো করুণ সুরে গলা থেকে তার আর্তি ঝরে পড়ে -“ অমি…তে…শ সন্ধ্যা….য় বিষ খে…..য়ে পরে আছে….., মেয়েটি  আমা…..দের জানাতে  পারলনা …..? ওকে কি আর আমি ফিরে পাবো…. ? ‘ও’ তো অমিতেশের জীবন টাই ছিনিয়ে নিল…….”।

 

প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে বিকাশ ও নিলয় ভাই অমিতেশকে জমি থেকে উদ্ধার করে রাত ১২.৩০ নাগাত রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে পৌছাল। তখনো অমিতেশের প্রাণ  জীবিত  কিন্তু খুবই কঠিন পরিস্থিতি, শরীরটা সম্পূর্ণ মৃত । ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা  দিয়ে কোলকাতা নিয়ে যেতে বললেন । বিন্দুমাত্র দেরি না করে একটি এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তারা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মেডিকেল হাসপাতালে পৌছতেই ডাক্তার জানিয়ে দেন বড্ড দেরি হয়ে গেছে, আর কিছু নেই। বিকাশ কান্নায় ভেঙে পড়ে । তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে আবেগ মিশ্রিত বেদনার সূর “যদি ওর সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতাম…., আমি কোন বাঁধা না দিতাম…… তবে হয়ত ছোটোকে আজ হারাতাম না, এ সবের জন্যে আমি দায়ী…. , আমি অপরাধী…..”।

 

চাকদাহ দিদির বাড়িতে বেড়াতে আসার সুত্র ধরেই দিদির দেওর অমিতেশের সাথে আলাপ জমে উঠে বিদিশার ।ধীরে ধীরে তা একে অপরের চাওয়া পাওয়া পর্যবসিত হয়। বসন্তের খোলা আকাশে সাদা মেঘের মত ভেসে বেড়াতে তাদের আর বিরাম ছিলনা। কখন কৃষ্ণনগর কখন কল্যাণীর মুক্ত বাতাসে কখন বা চারদেওয়ালের আড়ালে ওদের প্রেমের শিকড় পৌঁছে গিয়েছিল মাটি ভেদ করে গভীর পাতালে। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিশিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল একে অন্যের হয়ে বেঁচে থাকবে এই বিশ্বাসে। ফোনের সুরতাল ধরেই বহু রাত অতিক্রান্ত হয়েছে অনিদ্রায়। বেসরকারি চাকরী তবুও অফিসের কাজের শত চাপের মধ্যেও অমিতেশ বিদিশার খবর নিতে ভোলে নি কখন.. কোন দিনও না।

 

হঠাৎ এই উড়ন্ত কবুতর জুটিকে নিচে নামিয়ে আনে বিকাশের সিদ্ধান্ত । অমিতেশ বিদিশাকে বিয়ে করতে চায়, সেই প্রস্তাব দেওয়া মাত্র বিকাশ আপত্তি জানিয়ে বসে এই  সম্পর্কে। একই পরিবারে দুই বোন! সেটা বিকাশ আশা করেনা…হয় তো বা অন্য কিছু । সুতপাও এই সম্পর্কে  রাজী ছিলনা, সরাসরি কিছু না বললেও হাবভাবে বুঝিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। কারন সুতপার পরিবার বিদিশাকে সরকারি চাকুরীজীবী কোন পাত্রের হাতে দিতে চায়। এই নিয়ে অমিতেশ ও বিকাশের মধ্যে কথা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছে, যৌথ পরিবার হয়েও একসাথে খেতেও বসত না তারা। অমিতেশও জেদ ধরে বসে বিদিশাকেই বিয়ে করবে, নয়ত না।

ভাইয়ে ভাইয়ে এই টানা পোড়নে মা ব্যকুল ও চিন্তিত হয়ে ওঠে। সে অমিতেশ কে বলে –“ অমি! তুই যদি বিদিশাকেই বিয়ে করবি তবে ওকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যা । একই ছাদের তলায় থেকে ভাইয়ে ভাইয়ে তোরা অশান্তি করিস  না”। অমিতেশ আক্ষেপের সুরে মাকে বলেছিল “ মা তুমিও আমায় অন্য কোথাও যেতে বলছ …! এ বাড়িতে আমার কি কোন অধিকার নেই…?। আমার ভালো মন্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কি আমার নেই ? যদি থাকে ! তবে আমাতে তোমাদের আপত্তিটা  কীসের..”?

অমিতেশ যে টাকা আয় করে তাতে সে ঘর ভাড়া নিয়ে বিয়ে করে সংসার তৈরি করতেই পারে। সেই আশা নিয়েই ঘর ভাড়া করে সেদিন মাকে বলেছিল “মা আমি চলে যাচ্ছি”।

মন্দিরে বিয়ের সমস্ত রকম ব্যবস্থা করে অমিতেশ বিদিশাকে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে বলে । কিন্তু কোন এক ঘুমন্ত দৈত্য আজ জেগে উঠবে ওদের মাঝখানে সে আশা কি কখন করেছিল অমিতেশ! চরম সময় বিদিশা জানিয়ে দেয় পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে এভাবে সে বিয়ে করতে পারবে না। নিমেষে অমিতেশের স্বপ্নে বাঁধানো ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। যেন হাত পা বেঁধে কেউ ওকে মাঝ সমুদ্রে ডুবিয়ে আসে। যেন মাথাটা বার করে সমস্ত শরীর মাটিতে কবর দিয়ে রেখেছে কেউ, কেবল নিঃশ্বাস চলছে শরীর অসার। যে দরদী একই মর্মে মরমি, যার শ্বাসে শ্বাস মিলিয়ে শরীর হয়েছিল একাকার, সেই ! যে জীবনে মরণে সঙ্গ দেওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল, যে গাছতলে বাঁধতে চেয়েছিল ঘর সে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিনে ,জীবন গড়ার দিনে এভাবে ফিরাবে মুখ তা কস্মিনকালেও ভাবেনি । অমিতেশ অনুনয় বিনয়ের মাধ্যমেও বোঝাতে চেয়েছিল বিদিশাকে! কিন্তু অমিতেশের যে আজ দিন নয়, চতুর্দিক শূন্য, অন্ধকার, অন্তরে হাহাকার। হৃদয়ের সুকুমার প্রেমকোষ গুলি সব মৃত এতক্ষণে।

 

এই লাঞ্ছনায় মর্মাহত সে । প্রেম যুদ্ধে অমিতেশ পরাজিত সৈনিক । সে সন্ধ্যায় ব্যর্থ যুদ্ধরণে বিষ খেয়ে আত্মত্যাগ করতেও পিছপা হল না। বিদিশাকে সে শুধু বলল –“ বিদায় তোমায় , তুমি ভালো থেকো, আমি চললাম”।

অমিতেশ যেন মাকে বলা কথাটাও সত্যি করে দিয়ে গেল- “মা আমি চলে যাচ্ছি”।

 

বিদিশা গত তিন বছরে অমিতেশের ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠেছিল, অমিতেশও বিদিশার  ছায়া সঙ্গীর রূপ নিয়েছিল। একই ডালে ফুটন্ত দুটি গোলাপ হয়েছিল তারা।

বিদিশার সিদ্ধান্ত কেন বিপরীতে গেল তা অমিতেশের অজানাই হয়ে রইল। বিদিশা তো পালপাড়াতেই থাকে, সর্ব সাকুল্যে তিন কিলোমিটার হবে চাকদাহ থেকে, সে চাইলেই নিজে ছুটে আসতে পারত, সে তো চাইলেই অমিতেশ কে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারত। সে তো পরিবারের অন্য কাউকে বা অমিতেশের কোন বন্ধুকেও জানাতে পারত। কিন্তু বিদিশা নির্বিকার হয়ে রইল সেই সন্ধ্যায় । শেষ যাত্রায় শ্মশান যাত্রী হয়েও সে এলনা  তার প্রিয় ‘অমি’ কে বিদায় জানাতে। বিদিশা কি এক ফোঁটাও বেদনাশ্রু ঝরিয়েছিল ওর চারদেওয়ালের অন্দরে ? বিদিশা কি আদৌ কিছু হারিয়েছে ওর জীবন থেকে? সে বিদিশাই জানে!

তবে যদি কেউ হারিয়ে থাকে সে হল মা, শূন্য হল চিরতরে মৃদুলা দেবীর কোল।

 

 

 

Loading

Leave A Comment