আনকংকার্ড
–সমারসেট মম
(অপরাজিতা)
অনুবাদ—বর্ণালী জানা সেন
লোকটা আবার রান্নাঘরে এল। আর মানুষটা তখনো মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। ওঠার শক্তি নেই। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে আর গোঙাচ্ছে। মোক্ষম মার দেওয়া হয়েছে তাকে। আর দেওয়ালে পিঠটা ঠেসান দিয়ে ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে মহিলা। চোখে মুখে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে সে তাকিয়ে আছে উইলির দিকে। উইলি মানে ওই লোকটার বন্ধু। লোকটা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মহিলা। উইলি বসে আছে টেবিলের ওপর। হাতে তার রিভলভার। পাশে আধ খালি মদের গেলাস। হ্যান্স টেবিলের কাছে গিয়ে নিজের গেলাসটা ভরে একচুমুকে গিলে ফেলল পুরো মদ। হ্যান্সকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করে উইলি… ‘মনে হচ্ছে কোনো সমস্যায় পড়েছ’? হ্যান্সের মুখে রক্তের দাগ। গালে পাঁচটা নখের দাগ একেবারে আমূল বসে গেছে। গালে একবার হাতটা ঘসে নেয় সে… ‘ ও মাগী পারলে আমার চোখদুটোকেও উপড়ে নিত…শালী খানকী’। আমাকে এক্ষুনি একটু আয়োডিন লাগাতে হবে। তবে ও শালীর এখনও হুঁস আছে। এবার তুমি যাও। তোমার পালা এবার’।
‘ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার কি যাওয়া উচিত। আমাদের কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে’।
‘ বোকার মতো কথা বোলো না। তুমি না মরদ। দেরি হচ্ছে সেটা কি আমাদের দোষ? আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি’।
পশ্চিম দিগন্ত থেকে অস্তরাগের নরম আলো জানালা দিয়ে রান্নাঘরে এসে পড়েছে। একটু দোনামনা করে উইলি। সে ছোটখাটো মানুষ। পাতলা মুখ। গায়ের রঙ বাদামি। এমনিতে সে ড্রেস ডিজাইনার। তবে হ্যান্সের কাছে সে ছোট হতে পারবে না। হ্যান্স তাকে নপুংসক খোজা ভাববে এটা কিছুতেই হতে পারে না। হ্যান্স যে দরজা দিয়ে বেরিয়েছিল টেবিলে থেকে উঠে সেদিকে সে পা বাড়ায়। তাকে ওই দরজার দিকে যেতে দেখে মহিলা এক আর্তনাদ করে তার পথ আটকাতে যান…, ‘ না না অমনটা করবেন না’।
মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে হ্যান্স। নিজের শক্ত মুঠিতে মহিলার কাঁধ ঝাঁকিয়ে এক ধাক্কায় দেওয়ালের দিকে ঠেলে দেয় হ্যান্স। টাল সামলাতে না পেরে গোত্তা খেয়ে মাটিতে পড়েন মহিলা। উইলির রিভলভারটা কেড়ে নিতে তাক করে দাঁড়ায় হ্যান্স… ‘ খবরদার এক পাও কেউ নড়বে না’। ফরাসিতে বললেও তার কথায় জার্মান টান স্পষ্ট। উইলিকে মাথা নেড়ে দরজাটা একবার দেখিয়ে দেয় সে… ‘ তুমি যাও কাজটা সেরে এসো। আমি এদের দেখে নেব’।
উইলি দরজা দিয়ে ঢুকেই পরমুহুর্তেই বেরিয়ে এল… ‘ মেয়েটা যে পুরো বেহুঁস’
‘ তাতে কী?’
‘ না না আমি এটা পারব না। এটা ভালো দেখায় না’।
‘ পারবে না মানে? মেয়েমানুষের হদ্দ একখানা’ ।
রাগে উইলির মুখখানা লাল হয়ে যায়… ‘ এবার চল আমরা ফিরে যাই’।
হ্যান্সের চোখে মুখে বিরক্তি… ‘ এই পুরো বোতল শেষ না করে আমি কোত্থাও নড়ব না’।
এখানে তার বেশ আরামই লাগছে। আরো খানিক্ষণ থেকে গেলে হয়। সেই সকাল থেকে মোটর বাইক নিয়ে চরকিপাক খেয়ে খেয়ে আর ভালো লাগছে না। পা দুটো টনটন করছে। ভাগ্যিস আর বেশিদূর যেতে হবে না। সেই সয়সঁ। দশ পনেরো কিলোমিটারের বেশ বই তো নয়। উফফফ এখন যদি একটা নরম বিছানা পাওয়া যেত! টানটান হয়ে শুয়ে পড়ত সে। মেয়েটা যদি অমন গোয়ার্তুমিটা না করত তাহলে তো ওসব কিছুই ঘটত না। তারা তো পথ হারিয়ে ফেলেছিল। মাঠে একজিন চাষিকে জিগ্যেস করতে সে আবার ভুল রাস্তা দেখিয়ে দিল। এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে এই খামারবাড়িটাই দেখতে পেল তারা। ভাবল এখানে একবার জিগ্যেস করে নেওয়া যাক। তাদের এমন কিছু তো বদ মতলব ছিল না। রেজিমেন্ট থেকে বলেই দিয়েছে এই ফরাসিরা নিজেদের মাত্রার মধ্যে থাকলে ওদের সঙ্গে একটু ভাবসাব করতে। মেয়েটিই দরজা খুলেছিল। সেও তো ক্যাটক্যাট করে শুনিয়ে দিল সয়সঁর রাস্তা নাকি সে চেনে না। তাই তো তারা দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। আর ওই মহিলা, মনে হয় মেয়েটির মা…তাঁরও তো বেজায় দেমাক। বাড়িতে শুধু বাপ, মা আর মেয়ে। সবে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে ওদের। টেবিলের ওপর মদের বোতলটা দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি হ্যান্স। তেষ্টায় যেন ছাতি ফেটে যাচ্ছে। সকাল থেকে একফোঁটা জল পড়েনি পেটে। ওদের কাছে শুধু তো মদই চেয়েছিল সে। তাও আবার উইলি বলেছিল দাম মিটিয়ে দেবে। উইলি ছেলেটা মন্দ নয়। তবে মনটা বড্ড নরম। অমন মেনিমুখো হয়ে থাকলে চলে নাকি! তারা এখন রাজা। এদেশের প্রভু। এই দেশটাকে জিতে নিয়েছে তারা। তাদের সামনে ফরাসি সেনার তো ল্যাজেগোবরে অবস্থা। আর ওই ব্যাটা ইংরেজ। তাদের অবস্থা তো আরো করুণ। একেবারে ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে। যারা জিতেছে তারা সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। তারা যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। উইলি প্যারিসে কোন এক পোশাক নির্মাতার দোকানে দু বছর কাজ করেছে। উইলি ফরাসিটা ভালোই জানে বটে। এই জন্যই তো চাকরিটা জোটাতে পেরেছে। কিন্তু চাকরিটা পেয়ে কেমন যেন একটা হয়ে গেছে। সব হেরো লোকজন কোথাকার। সবকিছুতে ক্ষয় ধরেছে এদের। এই হেরো ঘুণপোকায় ধরা জাতটার সঙ্গে জার্মানরা কখনো থাকতে পারে? চাষির বউ তাদের জন্য দুটো মদের বোতল অবশ্য এগিয়ে দিয়েছে। পকেট থেকে কুড়ি ফ্রাঁ বের করে উইলি অবশ্য তাঁর হাতে ধরিয়েও দিয়েছিল। তার বিনিময়ে একটা শুকনো ধন্যবাদ জানানোরও প্রয়োজন মনে করলেন না মহিলা। উইলির মতো অত ভালো ফরাসিটা বলতে পারে না হ্যান্স। কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খায়। কিন্তু নিজের কথা অন্যদের বোঝানোর জন্য যতটুকু জানা দরকার ততটুকু সে জানে। ওই কাজ চালানোর মতো। উইলির সঙ্গে তাই সবসময় ফরাসিতেই কথা বলে সে। উইলি তার ভুলগুলো শুধরে দেয়। উইলিকে তার এত দরকার হয় মাঝে মাঝে যে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব না করে উপায় ছিল না। সে জানে উইলিও তাকে মনে মনে সমীহ করে। না করে উপায় আছে? এমন রাজপুত্তুরের মতো চেহারা তার। লম্বা পেটানো শরীরে দুটো আকাশনীল চোখ। চওড়া কাঁধ। একমাথা কোঁকড়ানো সোনালি চুল।
আর এই লোকগুলোর এত আস্পর্ধা! তাদের ঢুকতে দেখেও কোনো আদর আপ্যায়ন নেই। হ্যান্স তো তাদের বলেছিল সে নিজেও চাষির ছেলে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে সেও আবার খেতিবাড়ির কাজই করবে। তাকে মিউনিখের একটা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। মা ভেবেছিলেন ছেলে হবে মস্ত ব্যবসায়ী। কিন্তু ওই স্কুলে মন বসেনি তার। ম্যাট্রিকুলেশনের পরই সে কৃষি কলেজে গিয়ে নাম লেখায়।
এর মাঝেই ঢুকে পড়ল মেয়েটা… ‘আপনারা এখানে রাস্তা জানতে এসেছিলেন। জেনে গেছেন। এবার মদটা শেষ করে দয়া করে কেটে পড়ুন’। মেয়েটার দিকে আগে ভালো করে লক্ষ্যই করেনি হ্যান্স। দেখতে শুনতে একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু রোগা ক্ষয়াটে চেহারায় দুটো ডাগর নীল চোখ আর বাঁশির মতো নাক আলাদা করে চোখে পড়ে। মেয়েটার মুখ যেন একটূ বেশিই ফ্যাকাশে। জামাকাপড়ও অতি সাধারণ। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা আসলে যেমন তাকে ঠিক তেমনটা দেখাচ্ছে না। মেয়েটার ভেতরে কী যেন একটা রয়েছে যা ঠিক প্রকাশ করা যায় না। যুদ্ধ যবে থেকে শুরু হয়েছে তবে থেকেই ফরাসি মেয়েদের কথা অনেক শুনেছে সে। তাদের মধ্যে এমন একটা কিছু রয়েছে যা নাকি জার্মান মেয়েদের মধ্যে নেই। চিক আর উইলি তো তাই বলেছে। কিন্তু কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে ফরাসি মেয়েদের মধ্যে? উইলি জবাব দিতে পারেনি। শুধু বলেছে এটা বুঝতে গেলে তাদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে হবে। আশ পাশ থেকে অনেক কথাই কানে এসেছে উইলির। এই মেয়েরা নাকি শুধু টাকা পয়সা চেনে…তারা নাকি খুব কড়া ধাতের। ওসব নিয়ে ভাবে না হ্যান্স। এক হপ্তার মধ্যেই তো তারা প্যারিসে যাবে। তখন নিজেই পরখ করে দেখবে ফরাসি মেয়েদের এই রহস্য। হাই কমান্ড নাকি প্যারিসে তাদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থাও করে রেখেছে।
এবার তাড়া দেয় উইলি… ‘চটপট গেলাসটা শেষ কর…আর এখান থেকে চল’। কিন্তু এখন আর উঠতে ইচ্ছে করছে না হ্যান্সের। কেমন যেন আলসেমিতে পেয়ে বসেছে। মেয়েটার সঙ্গে একটু আলাপ করার লোভ সে সামলাতে পারে না… ‘ তোমাকে দেখে কিন্তু চাষাভুষোর মেয়ে বলে মনে হয় না’।
‘তাতে কী?’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে মেয়েটি।
এবার সাফাই গায় মেয়েটির মা… ‘ও কিন্তু শিক্ষিকা’।
‘তার মানে তুমি অনেক পড়াশোনা করেছ তাই না?’
মেয়েটা মুখটা একটু বেঁকিয়ে কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে নেয়। কিন্তু হ্যান্সকে থামায় কে? তার মাথায় তো নেশা চড়ে বসেছে। ভুলভাল ফরাসিতে সে বকবক করেই যায়… ‘তোমাদের বুঝতে হবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। তোমাদের ফরাসিদের কাছে এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতেই পারত নাকি? আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করিনি তোমরা করেছ। এখন এই দেশটাকে আমরা একটু ভদ্র সভ্য বানাব। আমরা এখানে শৃঙ্খলা আনব। তোমাদের দিয়ে আমরা কাজ করাব। তখন তোমরা বুঝতে পারবে কীভাবে প্রভুকে সম্মান দিতে হয়…তোমরা বুঝবে নিয়ম শৃঙ্খলা আসলে কাকে বলে’।
অসহ্য রাগে হাত মুঠো করে ফেলে মেয়েটি। তার চোখে আগুন। কিন্তু মুখে তার কোনো কথা নেই।
আবার কথার মাঝে ঢুকতে হয় ঊইলিকে… ‘হ্যান্স তোমার নেশা চড়ে গেছে’।
‘ চোপ…কে বলে আমি মাতাল অ্যাঁ? আমি তো ওদের শুধু বাস্তবটা বোঝানোর চেষ্টা করছি। আসল অবস্থাটা তো ওদের জানা দরকার’।
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না মেয়েটি। চেঁচিয়ে উঠল সে…‘উনি তো ঠিকই বলেছেন। আপনি মাতাল। এবার দয়া করে যান’।
‘ ও বাবা তুমি জার্মান বোঝ দেখছি। ঠিক আছে চলে যাব। তার আগে তুমি একটা চুমু দাও দিখি’।
মেয়েটি একটু ভয় পেয়ে দু পা পেছোয়। কিন্তু পালাবে কোথায়? শক্ত করে তার হাতটা পেঁচিয়ে ধরে হ্যান্স। প্রাণপন চেঁচায় মেয়েটি… ‘বাবা…বা…বা’। মেয়ের বাপ ঝাঁপিয়ে পড়ে হ্যান্সের ওপর। বুড়ো মানুষ গায়ের জোরে পারবে কেন? মেয়েটির হাতটা ছেড়ে এবার হ্যান্স বুড়োটাকে সজোরে মারে এক ঘুষি। বুড়ো মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে। পালাতে যায় মেয়েটি। হ্যান্স জাপটে ধরে তাকে। মেয়েটি লোকটার মুখে ঠাটিয়ে মারে এক চড়। মার খয়ে মিটিমিটি হাসে হ্যান্স…হায়নার হাসি… ‘ কোনো জার্মান সেনা তোমাদের চুমু খেতে চাইলে তোমরা এমনটাই করো বুঝি। এর দাম তোমাকে দিতে হবে’। মেয়েটিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায় দরজার বাইরে। মেয়েকে বাঁচাতে এবার মা পথ আটকে দাঁড়ায়। হ্যান্সের জামা ধরে টেনে মেয়েকে উদ্ধার করতে চায়। মেয়েটিকে এক হাতে শক্ত করে ধরে আরেক হাতে মাকে দেয় জোর ধাক্কা। মা আছাড় খেয়ে পড়ে দেওয়ালে।
বিপদ বুঝে চেঁচিয়ে ওঠে উইলি… ‘ হ্যান্স…হ্যান্স এ কী করছ’?
‘ চোপ শালা’।
মেয়েটির চেঁচানি থামেতে তার মুখে একটা হাত ঢুকিয়ে দেয় হ্যান্স। তারপর টানটা টানতে নিয়ে যায় মেয়েটিকে। এই ভাবেই ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছিল হ্যান্স। কিন্তু তার কী দোষ? নিজের এই অবস্থার জন্য মেয়েটি নিজেই দায়ী। তাকে থাপ্পড় মারার সাহস হয় কী করে ওই মেয়ের! মেয়েটি যদি ভালোয় ভালোয় একটা চুমু দিয়ে দিত তবে সেও আর কথা বাড়াত না। দিব্যি চলে যেত। মেয়ের বাপটা তখনো পড়েছিল মাটিতে। তাঁর বোকা বোকা মুখটা দেখে বেজায় হাসি পেয়ে গিয়েছিল হ্যান্সের। আর মেয়ের মা-টা দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে কান্না কান্না মুখে এমন ভাবে তাকিয়েছিল তা দেখে তো হ্যান্সের আরো হাসি পেয়েছিল। ওই বুড়ি ভেবেছিল এবার বুঝি তাঁর পালা? বোধহয় না। ফরাসি একটা প্রবাদের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার … ‘এই তো সবে শুরু। অত কাঁদার মতো কিছু হয়নি বুড়ি মাগী। আজ নয় কাল তো এটা হতই’।
এবার প্যান্টের পকেটে হাতটা ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা থেকে একশ ফ্রাঁর একটা নোট বের করে সে… ‘ এই টাকাটা রাখুন। আপনার মেয়েকে একটা নতুন জামা কিনে দেবেন। ওই জামাটা একদম ছিঁড়ে খুঁড়ে গেছে তো’। টেবিলের ওপর নোটটা রেখে হেলমেটা মাথায় চড়িয়ে উইলিকে ডাক দেয় সে… ‘এবার চলো’। দরজাটা দড়াম করে ঠেলে মোটর বাইকে ভটভটিয়ে চলে গেল তারা।
যেন একটা ঝড় বয়ে গেল এতক্ষণ। এবার মেয়ের হাল দেখতে বসার ঘরে ঢুকলেন মা। মেয়ে ডিভানের ওপর চিত হয়ে শুয়ে। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে তার।
তিনমাস পর আবার সয়শঁতে আসার সুযোগ হল হ্যান্সের। এতদিন বিজয়ী বাহিনীর সঙ্গে সে কাটিয়েছে প্যারিসে। সেখানে চলেছে বিজয়োৎসব। আর্ক দে ট্রিয়মপোতে সে বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। রেজিমেন্টের সঙ্গে প্রথমে ত্যুর…তারপর বরদ্যঁতে গেছে সে। যুদ্ধ টুদ্ধ বিশেষ হয়নি। ফরাসি সেনারা সব যুদ্ধবন্দী। তাদের অভিযান যে এত সফল হবে হ্যান্স ভাবতেই পারেনি। যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর সে টানা এক মাস কাটিয়েছে প্যারিসে। বাভারিয়াতে নিজের বাড়িতে প্যারিসের পিকচার পোস্টকার্ড পাঠিয়েছে। বাড়ির সবার জন্য কত উপহার কিনেছে। উইলি এই শহরটাকে হাতের তালুর মতো চেনে। তাই তাকে এখানেই পোস্টিং দেওয়া হল। হ্যান্স আর বাকিদের আবার পাঠিয়ে দেওয়া হল সয়শঁতে। পুরোনো রেজিমেন্টে। শহরটা বেশ সুন্দর ছিমছাম। খাবার দাবার অঢেল। তার ওপর শ্যাম্পেনের ছড়াছড়ি। ফুর্তির জীবন। সয়শঁতে ফেরার নির্দেশ শুনে অদ্ভূত একটা ভাবনা খেলে গেল হ্যান্সের মাথায়। ওই মেয়েটার সঙ্গে দেখা করতে গেলে কেমন হয়। যে মেয়েটাকে একদিন সে জোর করে ভোগ করেছে তাকে আরেকবার দেখলে বেশ মজাই হয়। মেয়েটার জন্য একজোড়া সিল্কের মোজা সে নিয়ে যাবে। তারপর পুরোনো সব কথা ভুলে যা হয় একটা মিটমাট করে নেবে। পুরোনো রাগ আর পুষে রাখার কোনো মানেই হয় না। আর এই এলাকায় তার অনেক জানাশোনা। ওই চাষির বাড়িটা খুঁজতে তেমন বেগ পেতে হবে বলে তো মনে হয় না।
সেদিন বিকেলে কোনো কাজ ছিল না তার। সিল্কের মোজাজোড়া পকেটে পুরে বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। সেদিন ভরা শরত। ঝকঝকে নীলাকাশ। মেঘের লেশমাত্র নেই। দিনটা ভারি সুন্দর। গ্রামের এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় সে বাইক নিয়ে চলল। সেপ্টেম্বর পড়ে গেছে। রাস্তার ধারে পাতায় ভরা পপলার গাছগুলোকে দেখে কে বলবে এখন শরত। আর কিছুদিন পরেই শুরু হয়ে যাবে পাতা ঝরার দিন। মাঝে একটু ভুল পথে সে চলে গিয়েছিল। সে যাই হোক রাস্তা খুঁজে চাষির ওই খামার বাড়িতে পৌঁছতে আধ ঘন্টার বেশি তার লাগেনি। রাস্তার একটা নেড়ি কুত্তা তাকে দেখে চিৎকার জুড়ে দিল। দরজার কাছে টোকা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না সে। দরজার হাতলটা ঘুরিয়ে সটান ঘরে ঢুকে পড়ল। প্রথমেই নজর পড়ল মেয়েটির দিকে। টেবিলে বসে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছে। উর্দি পরা সেনা দেখেই একলাফে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটি… ‘ কী চান আপনি এখানে’? হ্যাঁ এবার লোকটাকে চিনতে পেরেছে সে। ছুরিটাকে শক্ত করে হাতে ধরে দেওয়ালে সিঁটিয়ে গেল সে… ‘ আপনিই তো সেই জানোয়ার!’
‘আরে আরে অত রেগো না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। দেখো তো তোমার জন্য কেমন সুন্দর সিল্কের মোজা এনেছি’।
‘ যা এনেছেন নিজের সঙ্গেই নিয়ে যান। আর এখন বিদেয় হোন এখান থেকে’।
‘ বোকার মতো কথা বোলো না। ছুরিটা ফেলে দাও। বেশি জেদ করলে ওটা তোমার গায়েই লাগবে কিন্তু। আমাকে ভয় পেয়ো না’।
‘আমি আপনাকে ভয় পাই না’। নিজের অজান্তেই ছুরিটা পড়ে গেল তার হাত থেকে। নিজের হেলমেটটা খুলে আরাম করে বসল হ্যান্স। পা দিয়ে ছুরিটাকে নিজের দিকে টেনে নিল।
‘ তোমার কয়েকটা আলু ছাড়িয়ে দেব’?
কোনো উত্তর দেয় না মেয়েটি। হ্যান্স মাটি থেকে ছুরিটা তুলে নিয়ে বাটি থেকে একটা আলু তুলে নিয়ে খোসা ছাড়াতে শুরু করে। দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে রয়েছে মেয়েটি। চোখে তার তীব্র ঘৃণা। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে সে… ‘অমন রেগে আছ কেন বলো তো মাইরি। আমি তোমার এমন কিছু ক্ষতি করিনি। সেদিন আমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। শুধু কি আমার? রেজিমেন্টের সব্বার। ওরা সব বলছিল ফরাসি সেনাদের নাকি হারানো যায় না…আর ম্যাগিনট লাইনের কথাও বলছিল’…একটু থেমে মিটিমিটি হাসে সে… ‘ তারপর পেটে মদ পড়লে মাথার ঠিক থাকে নাকি? তোমার তো আরো বেশিও ক্ষতি হতে পারত। সবাই তো বলে আমি দেখতে শুনতে ভালোই’। দুচোখে আগুন নিয়ে লোকটাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নেয় মেয়েটি।
‘ চলে যান এখান থেকে’।
‘ আমার ইচ্ছে না হলে তো যাব না’।
‘ আপনি যদি না যান তাহলে সয়শঁতে আমার বাবা যাবে আপনাদের জেনারেলের কাছে। গিয়ে নালিশ করবে’।
‘ তাতে আমার কাঁচকলা হবে। এখানকার লোকজনদের সঙ্গে মিশতে…তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে জেনারেলই নির্দেশ দিয়েছেম আমাদের…তা তোমার নামটি কী বলতো?’
‘ তা জেনে আপনার কী হবে?’
মেয়েটির চোখে ধিকি ধিকি আগুন। দুটো গালে যেন শরীরের সব রক্ত এসে জমা হয়েছে। মেয়েটিকে দেখতে মন্দ নয়। সেদিন মদের ঘোরে ভালো করে সে খেয়াল করেনি। সে তো মেয়েটার তেমন কিছু ক্ষতি করেনি! মেয়েটার মধ্যে একটা কী যেন আছে…ঠিক বর্ণনা করা যায়না। দেখে মনে শহরের কোনো আধুনিকা। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে বলে মনেই হয় না। মেয়েটি তো শিক্ষিকা…সেদিন ওর মা তো তাই বলেছিল বটে। মেয়েটি কিন্তু বেশ। ওর সঙ্গে আরেকটু নাহয় গুলতানি করা যাক। তাতে একটু আমোদও হবে। নিজের মাথার সোনালি কোঁকড়ানো চুলে একবার কায়দা করে হাত বুলিয়ে নেয় সে। মুখে আমায়িক হাসি। এ অবস্থায় তাকে দেখলে কত মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত এখন। এমন সুযোগ! এই গ্রীষ্মে রোদে পুড়ে মুখটা আরো বাদামি হয়েছে তার। তাই তার চোখদুটকে এ্খন লাগে ঘন নীল… ‘ তা তোমার মা বাবা কোথায়?’
‘ খেতে কাজ করছে’।
‘ উফফ খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে আমার। আমার একটু রুটি, চিজ আর এক গেলাস মদ দাওতো দেখি। আমি দাম মিটিয়ে দেব’।
মেয়েটি বিদ্রূপের হাসি হাসে… ‘ চিজ? ওই জিনিসটা গত তিনমাস ধরে চোখেও দেখিনি। আমাদের তিনজনের খাওয়ার মতো রুটিও নেই ঘরে। বছর খানেক আগে ফরাসি সেনারা আমাদের ঘোড়াগুলোকে নিয়ে গিয়েছিল। এখন তোমরা জার্মানরা আমাদের সবকিছু কেড়ে নিচ্ছ…আমাদের গরু, শুয়োর, মুরগি…স…ব’।
‘ কিন্তু তার জন্য তো তোমাদের দাম মিটিয়ে দেওয়া হয়’।
‘ মানে? ওই কাগজের টাকা কি আমরা চিবিয়ে চিবিয়ে খাব?’… চোখের জল আর বাঁধ মানে না মেয়েটির।
‘ তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে?’
‘ না না…আমরা শুধু আলু, রুটি, সালগম আর লেটুস খেয়েও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারি। একেবারে রাজার হালে। কাল বাবা সয়শঁতে গিয়ে দেখবে একটু আধটূ ঘোড়ার মাংস পাওয়া যায় কিনা’।
‘ শোনো…আমি কিন্তু খারাপ মানুষ নই। আমি তোমাদের চিজ এনে দেব। পারলে একটু হ্যামও আনব’।
‘ আপনার দয়ার দান আমাদের চাইনা। উপোস করে মরে যাব তাও আপনার আনা খাবার ছুঁয়েও দেখব না’।
‘ ঠিক আছে দেখা যাবে…আবার দেখা হবে ম্যাডাম’…টুপিটা গলিয়ে উঠে পড়ল হ্যান্স। তাদের রেজিমেন্টে নিয়ম খুব কড়া। ইচ্ছে হলেই গ্রামের দিকে সে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারে না। দশদিন বাদে একটা কাজ পড়ায় আবার ওইদিকে যাওয়ার সুযোগ হল তার। এবারও কোনো কিছু না বলে সে সোজা ঢুকে পড়ল বাড়িতে। আজ চাষি আর চাষির বউ বাড়িতেই রয়েছেন। রান্নাঘরে কাজ করছেন তাঁরা। দুপুর হতে চলল। মহিলা উনুনে কিছু একটা বসিয়ে খুন্তি দিয়ে নাড়ছেন। আর তার স্বামী চেয়ারে বসে। তাকে দেখে একটুও অবাক হলেন না তাঁরা। মেয়ের কাছ থেকে সেদিন তার আসার খবর নিশ্চয়ই শুনে ফেলেছেন। মুখে তাঁদের কোনো কথা নেই। কোনো তাপ উত্তাপও নেই। মহিলা তার রান্নাতেই ব্যস্ত। আর ভদ্রলোক গোমড়া মুখে টেবিলের অয়েল ক্লথটার দিকে ঠায় তাকিয়ে।
‘ সুপ্রভাত…ভালো আছেন তো?’ একমুখ হেসে নিজেই কথা শুরু করল হ্যান্স… ‘আমি আপনাদের জন্য একটু উপহার এনেছি’। এই বলে হাতের প্যাকেটটা খুলে ফেলল সে। তার মধ্যে থেকে বেরোলো বেশ খানিকটা ভালো চিজ, একটু পর্ক আর দু-টিন ভর্তি সার্ডিন’। জিনিসগুলো একবার দেখলেন মহিলা। তাঁর লোভ চকচকে চোখদুটো দেখে মনে মনে বেশ মজাই পেল হ্যান্স। ভদ্রলোক এখনও গোমড়া মুখে বসে। একগাল হেসে এদের সঙ্গে একটু আলাপ জমানোর চেষ্টা করে হ্যান্স… ‘ দেখুন প্রথম দিন আমাদের মধ্যে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গিয়েছিল। তবে আপনাদেরও অমনটা জোরাজুরি করা উচিত হয়নি’। ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকেই তাকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে মেয়েটি… ‘আপনি এখানে কী করছেন শুনি?’ তার আনা জিনিসগুলোর ওপর এবার মেয়েটির চোখ পড়ে। জিনিসগুলো হাতে দিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে মারে মেয়েটি… ‘আপনার জিনিস আপনিই নিয়ে যান। চলে যান বলছি’।
হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে মেয়েটির মা… ‘ অ্যানেট পাগলামি কোরো না’।
‘ ওঁর দেওয়া কোনো জিনিস নেবনা আমরা’।
‘ এগুলো সব আমাদের দেশের জিনিস। ওরা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। এই সার্দিন দেখছিস। এগুলো সব বোরদ্যঁ থেকে এসেছে’। জিনিসগুলো আবার কুড়িয়ে নেন ভদ্রমহিলা। হ্যান্সের ঘন নীল চোখে তাচ্ছিল্যের হাসি… ‘ ও তোমার নাম তাহলে অ্যানেট। বাবা মা একটু খাবেন তাও তোমার সহ্য হচ্ছেনা? তুমিই তো সেদিন বললে তিন মাস নাকি তোমরা চিজ পাওনি। আজ অবশ্য হ্যাম পাইনি। তবে যেটুকু পেরেছি এনেছি’।
মাংসের টুকরোটা তুলে নিয়ে বুকে আঁকড়ে ধরেন ভদ্রমহিলা। পারলে ওটাতে একটা চুমুই দিয়ে দিতেন’। অ্যানেটের চোখে জল… ‘ ছি মা ছি। কী লজ্জা!’
‘ ওহ তুমি থামো তো দেখি। এই একটু চিজ আর পর্কের মধ্যে কোনো লজ্জা নেই’।
এবার বসে আয়েস করে একটা সিগারেট ধরায় হ্যান্স। তার পর প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেয় বুড়ো মানুষটার দিকে। লোকটা একটু দোনামনা করে বটে। কিন্তু এই লোভ সামলানোও যে তাঁর কাছে খুব মুশকিল। একটা সিগারেট বের করে নিয়ে প্যাকেটটা তিনি ফিরিয়ে দেন লোকটাকে।
‘ আরে না না ওটা আপনার কাছেই রাখুন। আমি তো এই জিনিস আরো অনেক পাবো’। সিগারেটে সুখটান দেয় হ্যান্স। তার নাক দিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলী বেরিয়ে আসে… ‘ আচ্ছা আমরা বন্ধু হতে পারিনা। যেটা হয়ে গেছে সেটা টো আর ফিরিয়ে নিতে পারি না। আসলে যুদ্ধের সময় কোনোকিছু ঠিকঠাক চলেনা। আপনি বুঝতে পারছেন তো? অ্যানেট লেখাপড়া জানা মেয়ে। ও কি আমায় একটু ভালোভাবে বুঝতে পারে না? আমাকে একজন মাঝে মাঝেই সয়শঁতে যেতে হবে। আপনাদের জন্য আমি কিছু না আনব। শহরের লোকজনের সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব করার জন্য আমরা কত চেষ্টাই করি। কিন্তু ওরা আমাদের ধারে পাশেই ঘেঁসতে দেয় না। রাস্তায় যখন ওদের পাশ দিয়ে হাঁটি তখন একবার ফিরে তাকায় না পর্যন্ত। যাই বলুন ওটা একটা স্রেফ দুর্ঘটনা। সেই সময় আমি উইলির সঙ্গে এসেছিলাম। আমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। অ্যানেটকে আমি নিজের বোনের মতই মনে করব…সম্মান দেব’।
‘ আপনি কেন এখানে আসতে চান। কেন আপনি আমাদের মধ্যে নাক গলাচ্ছেন? দোহাই আপনার আমাদের ছেড়ে দিন’…আবার চেঁচিয়ে ওঠে অ্যানেট।
এখানে সে কেন আসতে চায় নিজেও জানেনা হ্যান্স। একটু বন্ধুত্ব, মানুষে মানুষে বন্ধুত্বের জন্য সে যে ব্যাকুল হয়ে আছে এটা সে এদের সামনে বলতে চায় না। সে যখন সয়শঁতে যায় তখন কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। সবার চোখে মুখে এক তীব্র বিদ্বেষ। ফরাসিগুলো এমন ভাবে তাকায় যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই। তখন মনে দিই লোকগুলোর মুখে এক ঘুষি চালিয়ে। এদের এই অবহেলা, অছেদ্দা তার এত খারাপ লাগে মাঝে মাঝে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। এমন কোনো জায়গায় সে যেতে চায় যেখানে সবাই তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলবে। আদর আপ্যায়ন করবে। না, অ্যানেটের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। সে যে নারীর কল্পনা করে অ্যানেটের মধ্যে তার কিছুই নেই। তার স্বপ্নসুন্দরীরা হবে লম্বা চওড়া তারই মতো নীল নয়না। তাদের ভারী বুকে থাকবে নিষিদ্ধ আকর্ষণ। আর তার মতই সোনালি চুল থাকতে হবে তাদের। মেয়েরা হবে লম্বা…স্বাস্থ্যবতী… সুন্দর সুন্দর পোষাকে নিজেদের পুরোটা ঢেকে রাখবে…তবেই না তাদের দিকে ফিরে তাকাবে হ্যান্স।
কিন্তু রোগা ক্ষয়াটে মেয়েটার মধ্যে কী যেন একটা রয়েছে…ভাষায় ঠিক বলা যায় না। তার ওই রক্তশূন্য মুখ, লম্বা পাতলা ঠোঁট আর দিঘিকালো চোখের মধ্যে এমন একটা কিছু রয়েছে যা দেখে বুকের ভেতরটাও শিউরে ওঠে। সেদিন সবকিছু কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ঘটে গেল। জার্মান সেনার জয়ে এমনিতেই টগবগ করে ফুটছিল তারা। সারাদিনে ঘোরাঘুরিতে এত ক্লান্তির পরেও সারা শরীরে একটা অদ্ভূত রোমাঞ্চ হচ্ছিল তার। তার ওপর খালিপেটে অতগুলো মদ পড়াতে মাথার আর ঠিক ছিল না তার। নাহলে এরকম রোগাভোগা মেয়েকে সে ছুঁয়েও দেখে না।
আবার সে খামারবাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেল দিন পনোরো পর। সে যে খাবারগুলো আগের দিন নিয়ে গিয়েছিল সেগুলো ওই বুড়ো বুড়ি নিশ্চয়ই গোগ্রাসে গিলেছে। কিন্তু অ্যানেট কি খেয়েছে? তবে এমনটাও তো হয়ে পারে সে ওই বাড়ি থেকে বেরোনো মাত্র মেয়েটাও বাবা-মার সঙ্গে খেতে বসে গেছে। এই ফরাসিগুলো এমনটাই হয় বটে। এদের না আছে কোনো নীতি…না আছে কোনো আদর্শ। মুফতে জিনিসপত্র পেলেই এরা বর্তে যায়। ওরা খুব দুর্বল…কোনো মনের জোর নেই। মেয়েটা তাকে দু চক্ষে দেখতে পারেনা…প্রাণপনে ঘেন্না করে তাকে। কিন্তু খাবার জিনিসের ওপর রাগ দেখিয়ে কী লাভ? সারাদিন তারা মন জুড়ে রইল ওই রোগা মেয়েটা। মেয়েটির কথাই বার বার মনে পড়ে যায় তার। মেয়েটা তাকে এত ঘেন্না করে ভেবেই তার বুকের ভেতরটা কেমন চিন চিন করছে। কষ্ট হচ্ছে তার। এমনিতে মেয়ে মহলে সে খুব জনপ্রিয়। তাকে পাওয়ার জন্য সম মেয়েই পাগল। আচ্ছা এই মেয়েটাও কি কোনোদিন তার প্রেমে পড়তে পারে। ভেবেই খুব মজা হল তার। তাহলে সেই হবে মেয়েটার প্রথম প্রেমিক। মিউনিখের কলেজের ছেলেরা বিয়ার নিয়ে জোর আড্ডা বসাত। ওদেরই কেউ একজন বলেছিল বটে প্রথম প্রেমিকের মতো আর কাউকে অত ভালোবাসতে পারে না মেয়েরা। সে যখন যে মেয়েকে চেয়েছে তাকেই সে পেয়েছে। এ কাজে কোনোদিন বিফল হয়নি সে। একটা ধূর্ত হাসি খেলে যায় হ্যান্সের চোখে।
আবার বেশ কিছুদিন পরে চাষির বাড়িতে যাওয়ার মওকা পেল সে। নিজের সঙ্গে চিজ, মাখন, চিনি, একটু কফি আর এক কৌটো সসেজ নয়ে মোটর বাইক হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। এবার বাড়িতে সে অ্যানেটকে দেখতে পেল না। সে নাকি বাবার সঙ্গে খেতে কাজ করছে। বাড়িতে রয়েছে শুধু মা। তিনি উঠোনে কাজ করছিলেন। হ্যান্সের সঙ্গে জিনিসপত্র দেখেই মুখটা তাঁর আলো হয়ে উঠল। তিনি তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন। খাবারের প্যাকেটটা খোলার সময় হাতটা কেঁপে উঠেছিল মহিলার। তারপর প্যাকেট খুলে জিনিসপত্রগুলো দেখে তাঁর চোখে জল… ‘ তুমি খুব ভালো’।
‘ আমি কি একটু বসতে পারি?’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই’… এই বলে জানালা দিতে বাইরেটা আড়চোখে দেখে নিলেন একবার। এর অর্থ হ্যান্সের বুঝতে বাকি রইল না। তিনি দেখে নিতে চাইছেন আশে পাশে তাঁর মেয়ে রয়েছে কিনা।
‘ আপনাকে এক গেলাস মদ দেব?’
‘ তাহলে তো খুব ভালো হয়’। সব বুঝতে পারছে হ্যান্স। খাবারের লোভে এই মহিলা তার সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে চাইছেন…যদিও এখনও তাঁর মনে কিছুটা দ্বিধা রয়েছে। তা ভালো। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে খন। জানালা দিয়ে তিনি যেভাবে আড়চোখে তাকালেন তাতে করে তো মনে হয় তিনি হ্যান্সেরই দলে।
‘ আপনাদের সেদিন পর্কটা ভালো লেগেছিল?’ জিগ্যেস করে হ্যান্স।
‘ উফফ কী ভালো যে খেলাম সেদিন! অনেক দিন পর’।
‘ এর পরের বার আরো কিছুটা আনার চেষ্টা করব… অ্যানেট খেয়েছে? ওর ভালো লেগেছে?’
‘ আপনি যা যা দিয়ে গেছেন ও কিচ্ছু ছুঁয়েও দেখনি। ও বলল সে উপোস করে মরে যাবে…তাও এই খাবার খাবে না’।
‘ বোকামি আর কাকে বলে!’
‘ আমিও ওকে তাই বলেছি। খাবার যখন সামনেই রয়েছে তখন সেটা না খেয়ে রাগ দেখানোর কোনো মানে নেই। খাবার তো খাবারই। খাবারের ওপর রাগ দেখানো কেন রে বাপু?’
মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে মহিলার সঙ্গে অনেক কথা হল তার। কথায় কথায় অনেক কিছু জানতে পারল হ্যান্স। এই মহিলার নাম মাদাম পেরিয়ার। হ্যান্স জানতে চাইল তাঁদের পরিবারে আর কি কেউ আছে? মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁদের এক ছেলেও ছিল। যুদ্ধ বাধার পর তাকেও সেনা দলে নাম লেখাতে হল। সেখানেই সে মারা গেছে। না না কেউ তাকে মারেনি। ছেলেটা নিউমোনিয়া বাধিয়ে বসেছিল। তারপর ন্যান্সি-তে এক হাসপাতালে সে মারা যায়।
‘ খুব খারাপ লাগছে শুনে’…ভদ্রমহিলাকে সহানুভূতি জানায় হ্যান্স।
‘ সে মরে গিয়ে একদিক থেকে বোধহয় ভালোই হয়েছে। বেঁচে থাকলে সে কষ্ট পেত বেশি। আমার ছেলেও ছিল অনেকটা অ্যানেটের মতো। অ্যানেটের মতোই তার তেজ। ফ্রান্সের হারের এই যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারত না…হে ভগবান আমাদের এভাবে ঠকালে কেন?’
‘ তাহলে পোল্যান্ডের লোকগুলোর জন্য যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন কেন? ওরা আপনাদের কোন আত্মীয় হয় শুনি?’
‘ তা বা ঠিক বলেছেন। হিটলারকে আমরা যদি পুরো পোল্যান্ড দখল করে নিতে দিতাম…তাহলে উনি হয়তো আমাদের রেহাই দিতেন’।
এবার হ্যান্স উঠে পড়ে… ‘খুব শিগগীরই আবার আসব। পর্কের কথাটা মাথায় রাখব’।
হঠাৎই হ্যান্সের ভাগ্যটা খুলে গেল। তাকে পাশের শহরে একটা কাজ দেওয়া হল। সেখাবে হপ্তায় দুদিন যেতে হবে তাকে। তার মানে আরো ঘন ঘন সে ওই খামার বাড়িতে যেতে পারবে। যখনই সে ওই বাড়িতে যায় তখনই কিছু না কিছু নিয়ে যায়। কিন্তু অ্যানেটের সঙ্গে এখনও তার আদায় কাঁচকলায়। মেয়ে পটানোর অনেক কৌশল জানা আছে তার। কিন্তু অ্যানেটের বেলায় সেসব কিছুই কাজে দেয় না। বরং তাতে অ্যানেটের রাগ আরো বাড়ে। পাতলা ঠোঁটদুটো চেপে এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মেয়েটা তার দিকে চায় যে সে যেন একটা নরকের কীট। বেশ কয়েকবার মেয়েটা তাকে এমন ভাবে তাকে তাতিয়েছে যে তার মনে হয়েছে গলাটা টিপে মেয়েটাকে একেবারে শেষ করে দেয়।
সেদিন বাড়িতে একাই ছিল মেয়েটা। তাকে দেখে মেয়েটা পালাতে চায়। কিন্তু সে পথ আটকে দাঁড়ায়… ‘ এখানেই দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে’।
‘ যা বলার বলুন। আমি একা মেয়েমানুষ, আমাকে তো রক্ষা করার কেউ নেই’।
‘ আমি তোমাকে একটা সোজাসাপটা কথা বলতে চাই। দেখো আমাকে হয়তো এখানে অনেকদিন থাকতে হতে পারে। ফরাসি সেনারা খুব বিপাকে পড়েছে। অবস্থা দিন দিন আরো খারাপই হবে। আমি তোমাদের কাজে লাগতে পারি। তুমিই বা অমন জেদ ধরে বসে আছ কেন। মা-বাবার মতো বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করতে পারছ না?’
একথা বা ঠিক। ও বুড়ো তার সঙ্গে মোটের ওপর একটা রফা করে নিয়েছে। খুব যে গলে পড়েছেন তা নয়। মুখটা এখনও বাংলার পাঁচই করে রাখেন। তবে তার সঙ্গে ভদ্রভাবেই কথা বলেন। তিনি একদিন হ্যান্সকে একটা তামাক এনে দিতে বলেছিলেন। হ্যান্স এনে দিয়েছে। তিনি দাম দিতে চেয়েছেন। হ্যান্স নেয়নি। তখন তিনি ধন্যবাদও জানিয়েছেন। হ্যান্সের কাছ থেকেই তিনি সয়শঁর সব খবরাখবর নেন। হ্যান্স তাঁকে যে খবরের কাগজটা এনে দিয়েছে সেটা তিনি প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে নিয়েছেন। হ্যান্স নিজেও চাষির ছেলে। তাই সে খেতিবাড়ির অনেক কিছুই জানে। তাঁদের মধ্যে চাষ বাস নিয়েও কথা হয় এখন। হ্যান্সদের খামারটা খুব একটা বড় নয় আবার খুব ছোটও নয়। খেতের মধ্যে একটা বড় খালও রয়েছে। সেখান থেকেই সেচের জল মেলে। অনেক গাছ পালা রয়েছে সেখানে। জমিও খুব উর্বর। চাষবাস ভালো হয়। আবার সেখানে পশু চারণের জন্য আলাদা করে জমিও রয়েছে। হ্যান্সের কথা শুনে বুড়ো মানুষটা বার বার তাঁর দুর্ভাগ্যের কথা বলেন। জমিতে কাজের জন্য কোনো মুনিষ নেই…সার নেই…বলদ্গুলোকে সব কেড়ে নিয়ে গেছে সেনারা। এবারে আর কিচ্ছু চাষ বাস হবে না। না খেয়ে মরতে হবে তাঁদের। হ্যান্স মন দিয়ে শোনে। বুড়ো মানুষটার জন্য কষ্ট হয় তার।
‘ বাবা-মার মতো আমিও কেন বুদ্ধি করে চলতে পারি না আপনি জানেন? তাহলে দেখুন’।
এই বলে নিজের ঢিলেঢালা জামাটা টানটান করে ধরে অ্যানেট। জামার ওপর স্পষ্ট দেখা যায় তার স্ফীত পেট। নিজের চোখকে আর বিশ্বাস হয়না হ্যান্সের। তার মনে দারুণ তোলপাড়। কী বলবে সে মাথায় আসে না। চোখমুখ লাল হয়ে যায়।
‘ তার মানে তুমি অন্তঃসত্ত্বা!’
চেয়ারের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়টি। কান্নায় বুক ভেসে যায় তার… ‘ কী লজ্জা! কী লজ্জা!’
হ্যান্স একলাফে তার কাছে গিয়ে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে চায়… ‘আমার কথাটা শোনো সোনা’। মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে ঠেলে দেয়… ‘আমাকে একদম ছোঁবেন না…চলে যান, চলে যান বলছি এখান থেকে…এই ক্ষতিটা করেও কি আপনার শান্তি হয়নি?’ এই বলে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় মেয়েটি। কয়েক মিনিট স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল হ্যান্স। মাথাটা তার ঘুরছে। মাথার ভেতর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বাইকটা নিতে ধীরে ধীরে সয়শঁতে ফিরে এল সে। রাতে বিছানার শুয়ে চোখে ঘুম আসে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছটফট করে যায়। অ্যানেটের স্ফীত শরীরটা বার বার চোখের সামনে ভেসে আসে তার। মেয়েটা যখন চেয়ারে বসে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিল তখন তাকে বড় মায়া হয়েছিল হ্যান্সের। ওই মেয়েটার গর্ভে বেড়ে উঠছে তারই সন্তান…তার শরীরের অংশ। মাঝে একবার তন্দ্রা মতো আসে। পরের মুহূর্তেই সে আবার চমকে জেগে ওঠে। হে ভগবান এ কথাটা কেন মাথায় আসেনি তার। আজ গুলির আঘাতের মতো বুকে এসে বিঁধল সত্যিটা। মেয়েটাকে ভালোবাসে সে। সে এতদিন নিজেও বুঝতে পারেনি নিজের মনকে। এখনো যে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মেয়েটার কথা সে অনেক ভেবেছে…কিন্তু ঠিক ওভাবে নয়। মেয়েটাকে সে জিতে নেবে…মেয়েটা তার রূপ যৌবনের ফাঁদে পা দিয়ে তার প্রেমে একদিন হাবুডুবু খাবে একথা ভেবেই মনে মনে খুব মজা পেয়েছে সে। যাকে সে জোর করে একদিন ভোগ করেছিল সে নিজে এসে তার কাছে ধরা দিচ্ছে এর চেয়ে বড় জয় তার কাছে আর কী হতে পারে? সব মেয়েই তার কাছে সমান। অ্যানেটকে সে আলাদা করে দেখেনি কোনো। সে যেমন মেয়ে পছন্দ করে অ্যানেট তো তেমন নয়। সে এমন কিছু আহামরি সুন্দরীও নয়। এমন কিছুই নেই মেয়েটার মধ্যে যা তার মন কাড়তে পারে। তবু মেয়েটা কেন বার বার হানা দিচ্ছে তার চিন্তায়। কেন সে সারাক্ষণ শুধু মেয়েটার কথাই ভাবছে। ভাবতে গিয়ে খুব কষ্টও হচ্ছে। বুকের ভিতর কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আসছে। এটাই বুঝি ভালোবাসা? হ্যাঁ ঠিক…এটাই ভালোবাসা। নাহলে বুকের ভেতরটা এমন আনচান করছে কেন? সে প্রেমে পড়েছে। একথা ভেবেও সুখ। এত সুখের অনুভূতি তার আগে তো হয়নি। মেয়েটাকে বুকে তুলে নিতে ইচ্ছে করছে তার। মেয়েটার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে মন চাইছে। তার কান্নাভেজা ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে ওর সব কষ্ট শুষে নিতে ইচ্ছে করছে। পুরুষ যেভাবে একটা নারীকে কামনা করে সেভাবে সে চায়না মেয়েটাকে। সে তো শুধু ওর কষ্টটাকে ভাগ করে নিতে চায়। সে তো চায় মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি হাসুক। সত্যি তো মেয়েটার হাসিমুখ সে তো কেনোদিন দেখেইনি। সে মেয়েটার চোখে খুশির ঝিলিক দেখতে চায়। মেয়েটার চোখদুটো কিন্তু ভারি সুন্দর। কী যেন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ওই টানাটানা ডাগর চোখে।
তিন দিন সয়শঁর বাইরে বেরোতে পারেনি সে। রেজিমেন্টের কাজ ছিল অনেক। এই তিন দিন…তিন রাত্রি তার কীভাবে যে কেটেছে! তার মনজুড়ে শুধু অ্যানেট, অ্যানেট আর অ্যানেট। শুধু অ্যানেট আর তার অনাগত সন্তান। আর কোনো চিন্তা নেই মনে। শেষ মেশ ও বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ মিলে গেল তার। সে মেয়ের মায়ের সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলতে চায়। আজ ভাগ্য তার সহায়। বাড়ির কাছেই রাস্তার ধারে দেখা হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে। একটু কাঠ কুড়োতে বেরিয়েছিলেন। পিঠে কাঠের মস্ত বড় বোঝা চাপিয়ে ধীর পায়ে তিনি বাড়ির দিকে চলেছেন। তাঁকে দেখে বাইকটা থামায় হ্যান্স। সে খুব ভালোভাবেই জানে ভদ্র মহিলা খাবার দাবারের লোভেই তার সঙ্গে একটু ভালোভাবে কথাবার্তা বলেন। আর কোনো কারণ নেই। তাতে অবশ্য হ্যান্সের কিছু যায় আসে না। মাদাম পেরিয়ার তার সঙ্গে অন্তত ভদ্র ব্যবহার করেন এই তার কাছে যথেষ্ট। আর যতদিন তার কাছ থেকে উনি কিছু না কিছু আদায় করে নিতে পারবেন ততদিন তিনি এমন ভেজা বেড়ালের মতই থাকবেন। সে ভদ্রমহিলার কাছে গিয়ে বলে… ‘আপনার সঙ্গে একটূ কথা আছে। আপনি আগে পিঠ থেকে বোঝাটা নামান। ভদ্রমহিলা তাই করেন। আজকের দিনটা একদম ভালো নয়…চারদিকটা কেমন যেন ধোঁয়াটে। আকাশের মুখ ভার। তবে ঠান্ডা বিশেষ নেই।
‘ আমি অ্যানেটের ব্যাপারে সব জানি’।
চমকে ওঠেন ভদ্রমহিলা… ‘ তুমি কী করে জানলে? ও তো তোমায় জানাতে বারণ করেছিল’।
‘ সে নিজেই আমাকে বলেছে’।
‘ সেদিন এই দারুণ উপহারটা আমাদের দিয়ে গেছ বটে’!
‘ সত্যি আমি জানতাম না। আপনি আমায় আগে বলেননি কেন?’
এবার গড়গড় করে নিজের কাহিনি বলে যান ভদ্রমহিলা। তাঁর গলায় কোনো ক্ষোভ নেই…কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। ভাবলেশহীন গলায় শুধু নিজেদের দুঃখের বারোমাস্যা বলে যাওয়া। বাছুর বিয়োনোর সময় গরু মরা বা বসন্তের তুষার ঝড়ে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো এটাকেও নিজেদের দুর্ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছেন তাঁরা। সেভাবেই মনকে তৈরি করে নিয়েছেন। সেদিনের সেই ভয়ংকর ঘটনার পর কয়েকদিন বিছানা থেকেই উঠতে পারেনি অ্যানেট। সঙ্গে ধূম জ্বর। বাবা-মা ভেবেছিলেন মেয়ের মাথাটাই বুঝি গেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাগলের মতো চেঁচিয়ে যেত সে। আশে পাশে কোনো ডাক্তার বদ্যি নেই। গাঁয়ের যে ডাক্তার ছিলেন তাঁকেও ধরে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনির কাজে। এমনকী সয়শঁতেও মোটে দুজন ডাক্তার। তাঁদেরও বয়স হয়েছে। সম্ভব হলেই তাঁরা এ বাড়িতে আসতে পারেন না। তাঁদের শহর থেকে বেরোনো মানা। জ্বর কমে এল কিন্তু মেয়ের শরীর আর সারে না। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাও নেই। যেদিন সে বিছানা ছাড়ল সেদিনও সে এত দুর্বল…মুখ চোখ একেবারে ফ্যাকাসে। ওর দিকে চাইলেও কষ্ট হয়। এই আঘাত সে সহ্য করতে পারেনি। এই ভাবে একমাস কাটল…দুমাস…কিন্তু মাসের সেই ঘটনাটা আর ঘটল না। অ্যানেট প্রথমে অত কিছু ভাবেনি। এমনিতে ওটা তার একটু অনিয়মিতই হয়। কিন্তু মায়ের চোখ বলে কথা! প্রথম সন্দেহটা হল মায়েরই। তিনি মেয়েকে জিগ্যেস করেন। ভয়ে…আতংকে দুজনেরি বুক শুকিয়ে যায়। তাও অতটা নিশ্চিত হতে পারেননি তাঁরা। তাই বুড়ো বাপকে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু তিনমাস কেটে যাওয়ার পর আর কোনো সন্দেহের অবকাশই রইল না।
তাদের একটা পুরোনো গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতেই হপ্তায় দুদিন খেতের শাক সবজি…আনাজপাতি নিতে সয়শঁর বাজারে বেচতে যেতেন মাদাম পেরিয়ার। তারপর জার্মান সেনা শহর দখল করল। তাঁদেরও বিক্রিবাট্টা বন্ধ হয়ে গেল। যেটুকু এখন ফলন হয় তা বিক্রি করতে অতদূরে যাওয়া পোষায় না। তার ওপর পেট্রোলের আকাল। এবার এই বিপদের দিনে মা-মেয়েতে গাড়িতে করে চলল শহরে…ডাক্তারের খোঁজে। শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শুধু সেনাদের সাঁজোয়া গাড়ি। রাস্তার সর্বত্র জার্মান সাইনবোর্ড। সরকারি অফিসগুলোর ফরাসিতে লেখা সাইনবোর্ডে জার্মান কমান্ডিং অফিসারের সই। বেশিরভাগ দোকানপাটের ঝাঁপ ফেলা। যে বুড়ো ডাক্তারকে তারা চিনত তাঁর কাছেই গেল প্রথমে। তিনিই জানিয়ে দিলেন সেই সত্যিটা। মায়ের সন্দেই ঠিক। অ্যানেট অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তার ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। গর্ভপাতের মতো পাপ তিনি করবেন না। অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল তারা। ডাক্তার শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন… ‘শোনো মেয়ে তোমার মতো আরো অনেকে রয়েছে। তুমি একা নও। তোমাকে সহ্য করতেই হবে’। আরেকজন ডাক্তারের কথা তারা জানত। অগত্যা তাঁর সন্ধানেই যেতে হল। সে ডাক্তারের বাড়ির বেল বেজে গেল। কেউ দরজা খোলে না। অনেকক্ষন পর কালো পোশাক পরা এক মহিলা নেমে এলেন। তাঁর মুখ একেবারে শুকিয়ে এতটুকু। তারা ডাক্তারের খোঁজ করতে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন ভদ্রমহিলা। ডাক্তারকে নাকি জার্মান সেনারা ধরে নিয়ে গেছে। ওদের সন্দেহ ডাক্তার নাকি কোনো গুপ্ত সমিতির সদস্য। ডাক্তারকে পণবন্দি করে রেখেছে সেনারা। যে ক্যাফেটেরিয়ায় জার্মান সেনারা আড্ডার আসর বসাত সেখানে নাকি এক বোমা বিস্ফোরণ হয়। তাতে বেশ কয়েকজন জার্মান সেনা মারা যায়, কয়েকজন আহতও হয়। একটা নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে অপরাধী যদি ধরা না দেয় তাহলে পণবন্দি ডাক্তারকে গুলি করে মারা হবে। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হয় প্রাণে বেশ দয়ামায়া আছে। মাদাম পেরিয়ার তাঁদের সমস্যার কথা জানাতে ভদ্রমহিলা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন… ‘জানোয়ার সব’। অ্যানেটের দিকে তাকিয়ে তাঁরও বড় মায়া হল… ‘ আমার সোনা মেয়ে…কী ঝড়টাই না যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে’। ভদ্রমহিলা তাঁদের শহরের এক ধাইমার ঠিকানা দিলেন। সেই ধাইমার কাছে গিয়ে বলতে হবে ওই ভদ্রমহিলার কথা। ধাইমা কিছু ওষুধ দিলেন। ওষুধ খেয়ে দিন দিন মেয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি প্রাণটা বেরিয়ে গেল। সে ওষুধে কোনো কাজ হয়নি। অ্যানেটের পেটে রয়ে গেল সেই ভয়াবহ দিনের চিহ্ন।
এই অবধি বলে থামলেন মাদাম পেরিয়ার। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে হ্যান্স।
‘ আচ্ছা কাল তো রবিবার। আমারও তেমন কিছু কাজ নেই। কাল আপনাদের বাড়ি গিয়ে কথা বলব। কাল দারুণ কিছু একটা নিয়ে যাব আপনাদের জন্য’।
‘ আমাদের বাড়িতে সূঁচ নেই। তুমি গোটাকয় এনে দিতে পারবে’।
‘ আমি চেষ্টা করব’।
ভদ্রমহিলা পিঠে কাঠের বোঝাটা আবার চাপিয়ে পা টেনে টেনে এগোলেন বাড়ির দিকে। হ্যান্স ফিরে এল সয়শঁতে। এবার আর মোটর বাইকটা নিল না সে। একটা পুশ বাইক ভাড়া করে তার কেরিয়ারে খাবার দাবার বাঁধা ছাঁদা কয়ে রওনা দিল পরের দিন। এবারের প্যাকেটটা একটু ভারিই হয়েছে বটে। সে একটা শ্যাম্পেনের বোতলও ঢুকিয়েছে তাতে। সন্ধ্যের দিকে সে খামার বাড়িতে চলে এল। ইচ্ছে করেই সে এই সময়টায় এসেছে…যাতে বাড়িতে সবাইকে পাওয়া যায়। বাড়ির ভেতরে রান্নাঘরটায় বেশ আরাম। মাদাম পেরিয়ার উনুনে কিছু একটা রান্না করছেন। আর তাঁর স্বামী প্যারিসের একটা খবরের কাগজ মন দিয়ে পড়ছেন। অ্যানেট উনুনের ধারে তার ছেঁড়া মোজাতে রিফু করছে। প্যাকেটটা খুলতে শুরু করে হ্যান্স… ‘ এই দেখুন আমি আপনাদের জন্য সূঁচ এনেছি… আর অ্যানেট তোমার জন্য এগুলো এনেছি দেখো’।
‘ আমার কিচ্ছু চাই না’।
‘ সত্যিই কিছু চাই না। বাচ্চার জন্য তোমায় এখন অনেক জিনিস বানাতে হবে যে’।
এবার মুখ খোলেন মাদাম পেরিয়ার… ‘ উনি তো ঠিকই বলছেন অ্যানেট। আর আমাদের বাড়িতে তো কিচ্ছু নেই’।
অ্যানেট তার সেলাই থেকে মুখ তোলে না। আর হ্যান্সের আনা প্যাকেটটা দেখে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে তার মায়ের।
তাঁকে দেখে একটু মুচকি হাসে হ্যান্স… ‘এই দেখুন আজ একটা শ্যাম্পেনও এনেছি। আমি আপনাদের একটা কথা বলতে চাইছিলাম। মানে আমি একটা কথা ভেবেছি…’। এই বলে একটু দোনামনা করে সে। কীভাবে যে কথাখানা পাড়বে! অ্যানেটের মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে সে… ‘ মানে মানে কীভাবে কথাটা শুরু করি বুঝতে পারছি না। সেদিনের ঘটনার জন্য আমার অনুশোচনার শেষ নেই অ্যানেট। সেদিন আমার কিন্তু দোষ ছিল না। পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যে…তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে না অ্যানেট’।
অ্যানেট বিষাক্ত চোখে একবার চায় তার দিকে… ‘কোনোদিনো নয়, কক্ষনো নয়। আমাকে নিজের মতো একটু শান্তিতে থাকতে দিন না। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েও আপনার শান্তি হয়নি?’
‘ আমি তো এটাই বলতে চাইছি। আমি তোমার জীবন নষ্ট করিনি। আমি যেদিন শুনলাম তুমি মা হতে চলেছ…সেদিন অদ্ভূত একটা অনুভূতি হয়েছিল আমার। আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। এখন সবকিছু বদলে গেছে জানো? এখন আমার মনে মনে বেশ একটা গর্ব হয়’।
‘ গর্ব?’…আবার একটু বিষ উগরে দেয় অ্যানেট।
‘ আমার এই বাচ্চাটা চাই অ্যানেট। তুমি যে এটাকে নিকেশ করতে পারোনি সেটা ভেবেই খুব আনন্দ হচ্ছে আমার’।
‘ একথা বলার সাহস হল কী করে আপনার?’
‘ আমার কথাটা তো একটু শোনো। খবরটা জানার পর থেকে মাথায় আমার আর অন্য কোনো চিন্তা নেই। খালি একটা কথাই ভাবছি আমি। ছ মাসের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। এই বসন্তেই ওই ইংরেজগুলোকে একেবারে উচিত শিক্ষা দিয়ে দেব। ওদের অবস্থা এখন খুব করুণ। তারপর রেজিমেন্ট থেকে আমি ছাড়া পেয়ে যাব। তখন তোমাকে বিয়ে করব’।
‘ আমাকে বিয়ে করবেন? কেন?’
হ্যান্সের রোদে পোড়া বাদামি মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। এই কথাটা সে ফরাসিতে বলতে পারবে না…এটা তাকে তার নিজের ভাষাতেই বলতে হবে… ‘ ইচ হেবে দিচ’।
এ কথার কিছু মাথামুন্ডু বুঝতে পারেন না মাদাম পেরিয়ার… ‘ উনি কী বলছেন অ্যানেট?’
খিল খিল করে হেসে ওঠে অ্যানেট… ‘ উনি বলছেন উনি নাকি আমায় ভালোবাসেন… হা হা হা’। আর হাসির দমক বেড়েই চলে। পাগলের মতো সে হেসেই যায়। আর চোখের জলে মুখ ভেসে যায়। মাদাম পেরিয়ার গিয়ে মেয়ের দুগালে কষিয়ে থাপ্পড় মারেন।
‘ ওর কথায় পাত্তা দেবেন। সব হিস্টিরিয়া। ওর অবস্থা তো আপনি বুঝতেই পারছেন’।
এবার নিজেকে একটু সামলে নেয় অ্যানেট।
‘ দেখো আমাদের বিয়ের পাকা কথার জন্য আমি একটা শ্যাম্পেনও এনেছি’।
‘ আমি যে আর কী বলব…এই রকম মূর্খদের আছে আমরা হেরে বসে আছি সেটা ভেবেই আমার লজ্জা হয়’।
হ্যান্স তার নিজের ভাষায় বলেই যায়। তাকে আর থামানো যায় না… ‘ আমি যেদিন শুনলাম তোমার শরীরে বেড়ে উঠছে আমার রক্ত মাংস সেদিন থেকেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি আমি। বিশ্বাস করো। বাজ পড়ার মতই চমকে উঠেছিলাম আমি। কিন্তু এখন ভাবি আমি বোধহয় প্রথম দিনই তোমার প্রেমে পড়েছি’।
‘উনি কী বলছেন?’…কিছু বুঝতে না পেরে মেয়েকে শুধোন মাদাম পেরিয়ার।
‘ এমন কিছু নয়’।
এবার নিজের ভাষা ছেড়ে আবার ফরাসিতেই ফিরে আসে হ্যান্স। অ্যানেটের বাবা মাকে সে তার কথা বোঝাতে চায়… ‘ তোমার বাবা মা মত দিলে আমি তোমাকে এখনই বিয়ে করব। আমি কিন্তু কোনো হাঘরে ছেলে ভেবো না। আমার বাবার যথেষ্ট টাকা কড়ি আছে। আর আমাদের সমাজে তাঁর একটা সম্মানও রয়েছে। আমিই বাড়ির বড়ছেলে। তোমার কোনোকিছুর অভাব হবে না’।
‘ তুমি কি ক্যাথলিক?’ জিগ্যেস করেন মাদাম পেরিয়ার।
‘ হ্যাঁ আমি ক্যাথলিক’।
‘ তাহলে তো মিটেই গেল’।
‘ আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। সেখানকার মাটিতে সোনা ফলে। মিউনিখ আর ইন্সব্রুকের মাঝে এমন উর্বর জমি আর নেই। আর এর সবটাই আমাদের। সত্তরের যুদ্ধের পর এই জমি কিনেছিলেন আমার ঠাকুরদা। আমাদের একটা গাড়ি আর রেডিও আছে। ও আর হ্যাঁ আমাদের টেলিফোনও রয়েছে’।
অ্যানেট তার বাবার দিকে চায়… ‘ সব ছলচাতুরিই উনি জানেন’। তার গলায় স্পষ্ট ব্যঙ্গ। এবার সে হ্যান্সের দিকে তাকায়… ‘ আমার তো এখন আনন্দে নেত্য করা উচিত তাই না? বিদেশিরা এসে আমার দেশ দখল করল আর আমিও কুমারী অবস্থায় মা হয়ে গেলাম। কী মজার কথা না? আমার তো দুহাত তুলে নাচা উচিত এখন!’
এমনিতে বেশি কথা বলেন না বাড়ির কর্তা। কিন্তু এবার আর আর মুখ না খুলে পারেন না… ‘ তুমি যে একটা ভালো প্রস্তাব দিয়েছ আমি মেনে নিচ্ছি। গত যুদ্ধে আমিও লড়েছি। যুদ্ধ একটা মারাত্মক জিনিস। যুদ্ধের সময় এমন অনেক কিছু ঘটে যায় এমনি সময়ে যা ভাবাই যায় না। মানব চরিত্র বড় বিচিত্র। দেখো আমরা আমাদের ছেলে হারিয়েছি। এই মেয়েই আমাদের সম্বল। ওকে আমরা দূরে যেতে দিতে পারব না’।
‘ আপনার মনে যে এই চিন্তাটাই আসবে সেটা আমি জানতাম। আপনার সমস্যার সমাধানও আছে আমার কাছে। আমিই এখানে থেকে যাব’।
অ্যানেট একবার লোকটাকে দেখে নেয়।
‘ তুমি কী বলতে চাও?’… এবার মাদাম পেরিয়ারের প্রশ্ন।
‘ আমার আরেক ভাই রয়েছে। সে বাবার কাছে থেকে খেত খামারের কাজ করতে পারবে। এই দেশটা আমার ভারি পছন্দ। একটু চেষ্টা করলে আপনাদের জমিতেও কিন্তু ভালো ফসল হবে। যুদ্ধ শেষ হলে অনেক জার্মানই এখানে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাবে। আপনাদের দেশে যা জমি আছে তা চাষ করার মতো দেশে আর লোক থাকবে না। ওই সেদিন সয়শঁতে একজন বলছিলেন যে দেশে চাষবাস করার মতো লোক নেই। তাই দেশের তিনভাগের একভাগ জমি এমনি এমনিই পড়ে রয়েছে। কোনো চাষ আবাদ হয় না’।
বুড়ো বুড়ি নিজেদের মধ্যে চাওয়াচায়ি করে। অ্যানেট দেখে মস্ত বিপদ। বাবা মা এবার গলেই যাবে। ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে তাঁরা তো এমনটাই চাইছিলেন। বাড়িতে এক জোয়ান শক্ত সমর্থ জামাই আসবে। বুড়ো বয়সে তাঁদের দেখাশোনা করবে। তাঁরা তাহলে নিশ্চিন্তে জীবনটা কাটাতে পারবেন। মাদাম পেরিয়ার আর না বলে থাকতে পারে না… ‘তাহলে তো হয়েই গেল। তোমার প্রস্তাবটা নিয়ে তো আমাদের ভাবতে হয়’।
এই শুনে চেঁচিয়ে ওঠে অ্যানেট… ‘ থামো…আর একটাও কথা বলবে না’। এবার সে আগুন চোখে তাকায় হ্যান্সের দিকে… ‘ আপনার বোধহয় জানা নেই আমার বিয়ের পাকা কথা হয়ে রয়েছে। আমি আগে যেখানে পড়াতাম সেখানকার ছেলেদের স্কুলে ও পড়াত। যুদ্ধ শেষ হলে আমরা বিয়ে করব। ও আপনার মতো সুঠাম…রূপবান নয়। খুবই সাধারণ সে। ছোটখাটো রোগাসোগা। কিন্তু ওর মুখে যে মেধার আলো রয়েছে সেটাই ওর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। ওর বিরাট মনটাই ওর শক্তি। ও বর্বর নয়। ও সভ্য সুশিক্ষিত। হাজার বছরের সভ্যতার উত্তরাধিকার রয়েছে ওর মধ্যে। আমি ওকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি’।
মুখটা কালো হয়ে গেল হ্যান্সের। অ্যানেটের মনও যে অন্য কোথাও বাঁধা থাকতে পারে সে কথা তো তার মাথাতেও আসেনি।
‘ সে এখন কোথায়?’
‘এখন তার কোথায় থাকার কথা? জার্মানিতে। যুদ্ধবন্দী হয়ে জার্মানির জেলে অনাহারে পচে মরছে। আর এদেশে বসে তোমরা চর্ব চোষ্য গিলে চলেছ। আমি আপনাকে ঘেন্না করি। একথাটা বলে বলে মুখ ব্যথা হয়ে গেছে আমার। আর কতবার বলতে হবে? আপনি এখন আবার ক্ষমা চাইছেন? কক্ষনো ক্ষমা করব না আপনাকে। আপনি এখন ক্ষতিপূরণ দিতে এসেছেন? মূর্খ কোথাকার!’
এক ঝটকায় মুখ সরিয়ে নেয় অ্যানেট। তার মুখেচোখে দারুণ একটা উৎকণ্ঠা… ‘ হে ভগবান আমি যে একদম শেষ হয়ে গেলাম। ওর মন অনেক বড়। ও আমাকে ক্ষমা করে দেবেই। কিন্তু কোনোদিন তো ওর মনে সন্দেহ জাগতে পারে যে আপনার ওই মাখন, চিজ আর সিল্কের মোজার লোভে আমি নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে। উফফফ ভাবতেই পাগল পাগল লাগছে আমার। শুধু কি আমি? আমার বাচ্চাটার কী হবে? আমাদের মাঝখানে আপনার ওই বাচ্চা। একটা জার্মান বাচ্চা! তার চেহারাও নিশ্চয়ই আপনার বড়সড় হবে…মাথায় সোনালি চুল…নীল চোখ…এ বাচ্চার কী পরিচয় দেব আমি? হে ভগবান আর কত সহ্য করতে হবে আমাকে?’ একছুটে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরের বাকি তিনজনের মুখে আর কোনো কথা যোগায় না। শ্যাম্পেনের বোতলটার দিকে করুণ ভাবে চায় হ্যান্স। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়ে। তার পেছন পেছন বাইরে আসেন মাদাম পেরিয়ার। ছেলেটার সঙ্গে তিনি একটু একান্তে কথা বলতে চান… ‘ তুমি যা বললে সত্যি? তুমি ওকে সত্যি বিয়ে করবে?
গলাটা খাদে নামিয়ে জবাব দেয় হ্যান্স… ‘ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আমি ওকে ভালোবাসি’।
‘ আর তুমি আমার মেয়েকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবে না তো? তুমি এখানেই থেকে খামারের কাজকম্ম দেখাশোনা করবে তো?’
‘ আমি কথা দিচ্ছি’।
‘ দেখো বাবা অ্যানেটের বাপের বয়স হয়েছে। আর কদিনই বা উনি আছেন? দেখো বাড়িতে থাকলে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নিত হত। আর এখানে সব তোমার’।
‘ হ্যাঁ তাও বটে’।
‘ দেখো অ্যানেট কোথাকার কোনো স্কুল টিচারকে বিয়ে করবে…আমরা একদন মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু মেয়ের গোঁ। তখন আমার ছেলেও বেঁচেছিল। সে তো সবসময় বোনের পক্ষে। সে বলল “ অ্যানেট তার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করবে। তোমাদের এত আপত্তি কীসের?” এখন তো পরিস্থিতি একদম বদলে গেছে। আমাদের ছেলেও আর নেই। অ্যানেট চাইলেও তো একা একা এই চাষবাসের কাজ সামলাতে পারবে না’।
‘ তারপর বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করে দিতে হলে আপনাদের যে কী মনের অবস্থা হবে তা আমি বুঝতে পারি। নিজেদের জমি জিরেতের প্রতি মানুষের যে কী মায়া সে কি আমি আর জানি না’?
হাঁটতে হাঁটতে তারা বড় রাস্তায় পৌঁছে গেল। হ্যান্সের হাতটা আলতো করে চেপে ধরেন মাদাম পেরিয়ার। শক্ত সবল ওই দুহাতে তিনি একটু যেন ভরসা খুঁজতে চান… ‘ তাড়াতাড়ি এসো আবার’। একটা কথা হ্যান্স বুঝে গেছে এই মহিলা এখন পুরোপুরি তার পক্ষে। সয়শঁ যাওয়ার পথে এই কথাটা ভেবে হ্যান্স মনে মনে একটূ সান্ত্বনা পায়। অ্যানেট যে কাউকে মন দিয়ে রেখেছে সে কথাটা ভেবেই মনটা একটু তেতো হয়ে যায়। তবে একটাই যে রক্ষে। সে ব্যাটা এখন যুদ্ধবন্দী। সে ছাড়া পাওয়ার অনেক আগেই বাচ্চাটা হয়ে যাবে। বাচ্চাটা হলে অ্যানেটের মনও হয়তো বদলে যাবে। নারী চরিত্র বোঝা খুব কঠিন। কেন তাদের গ্রামের ওই যে ওই মহিলা…বরকে চোখে হারাত সে। সবাই এনিয়ে কত ঠাট্টা তামাশা করত। তারপর যে না বাচ্চাটা হল অমনি তার ভোল বদলে গে। বরের দিকে আর ফিরেও তাকায়। বাচ্চাকে নিয়েই তার দুনিয়া। এমন যদি হতে পারে অ্যানে বেলায় তার উল্টোটাই তা হবে না কেন? সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন তো অ্যানেট বুঝতে পারবে সে একজন ভদ্র সভ্য ছেলে। রাস্তার লোফার নয়। মাথাটা চেয়ারে হেলিয়ে মেয়েটা যখন বসেছিল তখন মায়ায় বুক ভেসে গিয়েছিল হ্যান্সের। কী সুন্দর কথা বলে সে। ভাষার ওপর কী দখল! কত সাধারণ ভাবে…কোনো ভনিতা না করে সে কথা বলে। থিয়েটারের কোনো অভিনেত্রী তার অভিনয় ক্ষমতা উজাড় করে দিয়েও তার মতো করে কথা বলতে পারবে না। এটা তো স্বীকার করতেই হবে এই ফরাসিরা যেমন সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলে তা আর কেঊ পারবে না। মেয়েটার মাথার খুব বুদ্ধি। তার দিকে তাকিয়ে মেয়েটে যখন লাভা উগরে যায় তখনো কী মিষ্টি লাগে তার কথা শুনতে। সে নিজেও পড়াশোনায় মন্দ ছিল না বটে কিন্তু এই মেয়ের কাছে সে দাঁড়াতেই পারবে না। মেয়েটার ভেতরে সংস্কৃতি আছে…রুচিবোধ রয়েছে… ‘আমি তো ওর পাশে গবেট একখানা’…গাড়িটা চালাতে চালাতে চিৎকার করে বলে সে। মেয়েটা কী যেন বলেছিল সেদিন সে নাকি লম্বা, চওড়া, সুন্দর। ওর মনে কিছু না থাকলে ও কি এমন করে বলত? সে তো আরো বলেছিল বাচ্চাটারও চুল হবে সোনালি…চোখদুটো নীল। তারমানে তার সুঠাম চেহারা, গায়ের রঙ মেয়েটার মনেও বেশ ছাপ ফেলেছে। নিজের মনেই একটু হেসে হ্যান্স… ‘ আচ্ছা দেখা যাক। আর কিছুদিন যাক। দেখাই যাক না সবুরে মেওয়া ফলে কিনা’।
মাঝে কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়। সয়শঁতে রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার একটু ভাবতে বসেন তিনি বয়স্ক মানুষ। হেসে খেলে মজা করেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে যান। বসন্তের জন্য যা খাবার মজুত আছে তা যথেষ্ট। শুধু শুধু খাবারের জন্য ছেলেগুলোকে ছুটিয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না। জার্মান কাগজগুলোতে তো জোর লেখা লেখাই চলছে… ‘ এই লুফতয়াতের যুদ্ধেই ইংরেজদের একেবারে মাজা ভেঙে যাবে’। সবার চোখে এখন অদ্ভূত আতংক। জার্মান ডুবোজাহাজগুলো ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। সে দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে মরছে। এবার একটা বড় সড় বিপ্লব দেখা দেবে বলে মনে হয়। তবে যা মনে হয় গ্রীষ্মের আগেই যুদ্ধ টুদ্ধ সব শেষ হয়ে যাবে। জার্মানরাই হবে এই দুনিয়ার প্রভু। হ্যান্স বাড়িতে চিঠি লিখে জানাল যে সে একটি ফরাসি মেয়েকে বিয়ে করবে। মেয়েটার বাবার খুব ভালো চাষের জমিওলা খামার রয়েছে। সেটাও সেই পাবে। সে ভাইকে জানাল সে বাড়ির জমি জমার অংশ সে নেবে না। তার বদলে সে টাকা নিয়ে নেবে। ভাই যেন সে টাকাটা তাকে দিয়ে দেয়। তার জন্য প্রয়োজন হলে ধার করুক। আর তাছাড়া যুদ্ধের সময় জমি যেভাবে জলের দরে বিকোচ্ছে তাতে ভাইও আরো খানিকটা জমি কিনে রাখতে পারবে। এতে ভাইয়েরই লাভ। সব জমিজমা তারই দখলে থাকবে।
আবার একদিন সময় করে সে পেরিয়ারদের খামারে যায়। বুড়ো মানুষটাকে তার অনেক পরিকল্পনার কথা বলে। খামারটাকে আবার ঢেলে সাজাতে হবে। অনেক নতুন জিনিসপত্র আনতে হবে। জার্মান হিসাবে তার প্রভাব খাটিয়ে সে ওসব যোগাড় করে দিতে পারবে। এই মোটর ট্রাক্টরটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। এ দিয়ে আর কাজ চলে না। সে জার্মানি থেকে নতুন একটা নিয়ে আসবে। একটা মোটরচালিত লাঙলও নিয়ে আসবে। জমিতে ভালো ফলনের জন্য বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে কাজে লাগাতে হবে। মাদাম পেরিয়ারের কাছ থেকে পরে সে জেনেছে তাঁর স্বামী নাকি বলেছে… ‘হ্যান্স ছেলেটা খারাপ নয়। ও অনেক কিছু জানে’।
মাদাম পেরিয়ার তাকে একেবারে আপন করে নিয়েছেন। ফি রোববার দুপুরের খাওয়াটা এ বাড়িতেই সারবার জন্য মাদাম পেরিয়ার অনুরোধ করেন তাকে। তার হ্যান্স নামটাকে ফরাসিতে জ্যঁ করেছেন ভদ্রমহিলা। হ্যান্স সব কাজে তাঁকে সাহায্য করতে রাজি। অ্যানেটের শরীর ভারী হয়ে আসে। সে আর বেশি কাজকম্ম করতে পারে না। মাদাম পেরিয়ারকে হাতে হাতে সাহায্য করতে হ্যান্সের ভালোই লাগে। তবে এত চেষ্টা করেও অ্যানেটের মন সে পায় না। সে কঠিন মুখে চুপচাপ বসে থাকে। পারত পক্ষে কোনো কথা বলে না। একেবারে সরাসরি প্রশ্নের উত্তরে হুঁ হাঁ করে সু্যোগ পেলেই নিজের ঘরে গিয়ে সেঁধোয়। কনকনে ঠান্ডার যখন আর নিজের ঘরে থাকতে পারে না তখন রান্নাঘরে উনুনের কাছে বসে সেলাই করে নয়তো বই পড়ে। কিন্তু হ্যান্সের দিকে একবারও তাকায় না…যেন তার কোনো অস্তিত্ত্বই নেই। অ্যানেটের স্বাস্থ্য ফিরেছে। এখন তাকে অনেক ভরা ভরা লাগে। তার গালে এখন লালচে লাভা। সে সত্যিই সুন্দরী…মনে মনে ভাবে হ্যান্স। আসন্ন মাতৃত্ব তাকে এমন একটা পরিপূর্ণতা দিয়েছে যে হ্যান্স তার দিক থেকে এখন আর চোখ ফেরাতে পারে না।
সেদিনও সে খামার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। রাস্তায় মাদাম পেরিয়ারের সঙ্গে দেখা। তিনি হাত দেখিয়ে থামালেন হ্যান্সকে। কোনো রকমে গাড়ির ব্রেক কষে সে। তাকে দেখেই মাদাম পেরিয়ার একতু সতর্ক করে দেন… ‘ আমি তোমার জন্য এখানে এ…ক ঘণ্টা অপেক্ষা করছি। ভাবলাম তুমি হয়তো আর আসবে না। তুমি আজ ফিরে যাও। পিয়ের মারা গেছে’।
‘ পিয়ের কে’? অবাক হয় হ্যান্স।
‘ পিয়ের গ্যাভিন। ওই যাকে বিয়ে করবে বলে অ্যানেট গোঁ ধরে বসেছিল’।
শুনে এক কোষ রক্ত চলকে ওঠে হ্যান্সের বুকে। এ যে মেঘ না চাইতে জল। এবার তাকে ঠেকায় কে?
‘ অ্যানেট কি খুব ভেঙে পড়েছে?’
‘ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি সে। আমি একটু কথা বলতে গেলাম আমাকে ধাক্কা দিয়ে থেকে বের করে দিল। আজ তোমাকে দেখলে বুকে ছুরিও বসিয়ে দিতে পারে। বুঝেছ?’
‘ ও মারা গেছে তাতে আমার কী দোষ? তা কীভাবে এই খবরটা পেলেন?’
‘ পিয়েরের এক বন্ধু চিঠি লিখে জানিয়েছে। সেও যুদ্ধবন্দী ছিল। তবে সে কোনোরকমে সুইজ্যারল্যান্ড হয়ে পালাতে পেরেছে। আজ সকালেই চিঠিটা পেয়েছি। জেলে ওদের খাবার দাবার দিত না। সেইজন্য বন্দীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। বিক্ষোভের নেতাদের সব গুলি করে মারা হয়। পিয়ের তারই মধ্যে একজন হতভাগ্য’।
হ্যান্স চুপ করে থাকে। তব মনে মনে খুশিই হয়। উচিত শাস্তি হয়েছে ব্যাটার। জেলটা কি তোদের খানাপিনা আর মৌজমস্তি করার জায়গা নাকি?’
‘ অ্যানেটকে সামলে নেওয়ার সময় দাও। ওর মনটা একটু শান্ত হলে আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। আমি তোমাকে চিঠিতে সব জানাব…তখন তুমি এসো’।
‘ আপনি কিন্তু আমার দলে তাই না?’
‘ সে আর বলতে। আমি আর আমার স্বামী দুজনেই রাজি। আমরা অনেক আলোচনা করেছি তোমাকে নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতেই পারে না। আমার স্বামী তো আর মূর্খ নন। উনিও বলেছেন ফ্রান্সের এই সময় একটু নরম হয়ে সহযোগিতা করা উচিত। আমি তো তোমাকে পছন্দই করি। ওই টিচারের চেয়ে তুমি অনেক ভালো স্বামী হবে অ্যানেটের…আমার এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। তারপর বাচ্চাটা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে’।
‘ আমি কিন্তু ছেলেই চাই’…একটু আব্দার করে হ্যান্স।
‘ হ্যাঁ ছেলেই তো হবে। আমি গুনীনের কাছে দুবার গেছি। সবাই বলছে ছেলেই হবে’।
‘ ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি আপনাদের জন্য কতগুলো খবরের কাগজ এনেছি। প্যারিসের তিনটে খবরের কাগজ ভদ্রমহিলার হাতে তুলে দেয় হ্যান্স। তারপর বাইকটা ঘুরিয়ে চলে যায়।
প্রতিদিন সন্ধেয় নিয়ম করে খবরের কাগজ পড়েন বুড়ো পেরিয়ার। তিনি কাগজে পড়েন অনেক কথা। ফ্রান্সকে এবার একটু বাস্তববাদী হতে হবে। হিটলারের সঙ্গে হাত মেলানোই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। নাহলে অনেক মাশুল দিতে হবে। সমুদ্রের সর্বত্র জার্মান ডুবো জাহাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ইংরেজদের ধরাশায়ী হওয়া এখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। আমারেরিকাও এখন পুরোপুরি তৈরি নেই। ইংরেজদের সাহায্যে তারা আসবে কিনা সে নিয়ে এখনও মনস্থির করে উঠতে পারেনি। ফ্রান্সের সামনে নাকি এখন সুবর্ণ সুযোগ। তারা জার্মানদের দিকে একটু হাত বাড়িয়ে দিলেন সব সমস্যার সমাধান। ইউরোপে আবার নিজের পুরোনো সম্মান ফিরে পাবে ফ্রান্স। কোনো জার্মান কিন্তু কাগজে এইসব কথা লেখেনি। লিখেছে ফরাসিরাই। কাগজে আরো লিখেছে ফ্রান্সের ধনী মানুষজন আর ইহুদিরা নাকি একদন ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের গরিব গুর্বোরা তখন মাথা তুলে দাঁড়াবে। এইসব পড়ে মাথা নাড়েন বুড়ো পেরিয়ার। ওরা ঠিকই লিখেছে যে ফ্রান্স মূলত কৃষি প্রধান দেশ। খেটে খাওয়া চাষিরাই এদেশের মেরুদন্ড।
পিয়েরের মৃত্যুর খবর আসার পর দশ দিন কেটে গেছে। সেদিন সন্ধেয় খাওয়া দাওয়ার সময় মাদাম পেরিয়ারই কথাটা তুললেন অ্যানেটের কাছে। স্বামীর সঙ্গে এ নিয়ে শলা পরামর্শ হয়ে গেছে তাঁর… ‘ আমি কিন্তু হ্যান্সকে চিঠি লিখেছি দিনকয় আগে। ওকে বলেছি কাল আসতে’।
‘ ভালোই হল কথাটা জেনে। কাল তাহলে আমি আমার ঘরেই থাকব’।
‘ শোনো বাছা এখন আর বোকামি করার সময় নেই। তোমাকে এখন বাস্তবটা স্বীকার করে নিতে হবে। পিয়ের আর নেই। ও মৃত। হ্যান্স তোমাকে ভালোবাসে…বিয়ে করতে চায়। ওকে দেখতে শুনতে ভালো। ওকে স্বামী হিসেবে পেলে তো যেকোনো মেয়েই বর্তে যাবে। ওর সাহায্য ছাড়া খামারটাকে নতুন করে সাজাব কেমন করে? ও ওর নিজের টাকা দিয়ে একটা ট্রাক্টর কিনবে…লাঙল কিনবে। যা হয়েছে হয়ে গেছে। পুরোনো কথা সব বাদ দাও দেখি’।
‘ তুমি শুধু শুধুই তোমার মুখ ব্যথা করছ। আমি আগেও রোজগার করেছি। এখনও চাইলে রোজগার করে নিজের পেট চালিয়ে নিতে পারব। আমি ওকে একদম সহ্য করতে পারি না…ঘেন্না করি ওকে। ওর ওই অহংকার…আর আর হামবড়া ভাব দেখলে গা জ্বালা করে আমার। আমার ওকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে…ও মরলে আমি একটূ শান্তি পাই। ও যেভাবে আমার ওপর অত্যাচার চালিয়েছে তেমনি দগ্ধে দগ্ধে মারতে চাই ওকে। ওকে শাস্তি দেওয়ার একটা উপায় খুঁজে পেলে শান্তিতে মরতে পারব আমি’।
‘ পাগলামি কোরো না অ্যানেট’।
বাবা আর চুপ করে থাকতে পারেন না এবার… ‘ তোমার মা তো ঠিক কথাই বলেছে। আমরা হেরে গেছি। আমাদের তার ফল ভোগ করতে হবে। বিজয়ী পক্ষের সঙ্গে আমাদের একটা সমঝোতা করে নিতে হবে। ওদের চেয়ে আমাদের বুদ্ধি ঢের বেশি। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারলে আমাদেরই লাভ বেশি। ফ্রান্সের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণ ধরে গেছে। ওই পয়সাওয়ালা লোক আর ইহুদিগুলোই তো দেশটাকে শেষ করে দিল। কাগজ টাগজ একটু পড়… নিজেই সব জানতে পারবে’।
‘ তুমি কি ভাবো কাগজের ওই ছাই পাঁশ লেখা আমি একটাও বিশ্বাস করি? জার্মানদের কাছে যে কাগজ বিক্রি সেগুলো ছাড়া ও তোমাকে অন্য কোনো কাগজ দেয় বলে তুমি মনে কর? আর যারা ওসব লেখে সবকটা বেইমান…শালা সব বেইমান। উন্মত্ত জনতার হাতে গণ ধোলাই খেলে ওদের উচিত শিক্ষা হবে। জার্মান পয়সার লোভে নিজেদের একেবারে বিকিয়ে দিয়েছে…শালা শুয়োর’।
মেয়েকে বোঝাতে বোঝাতে এবার একটু বিরক্ত লাগে মাদাম পেরিয়ারের… ‘ ছেলেটা তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে বলত? হ্যাঁ তোমার ওপর জুলুম করেছে। মদের ঘোরে ওর কি তখন মাথা ঠিক ছিল? তুমি একা নয় যার সঙ্গে এই ঘটনা ঘটেছে…এমন ঘটনা এর পরেও ঘটবে জেনে রেখো। তোমার বাবাকেও তো সে কী মারটাই না মেরেছে। কিন্তু তোমার বাবা কি মনে কোনো রাগ পুষে রেখেছে?’
‘ হ্যা ওটা একটা দুর্ঘটনা…আমি আর ওসব মনে রাখতে চাই না’…এবার আর না বলে পারেন না বুড় পেরিয়ার।
বিদ্রূপ ভরে একটু হাসে অ্যানেট… ‘ তোমার চার্চে গিয়ে পাদ্রি হওয়া উচিত ছিল। তোমার মন একেবারে খাঁটি ক্রিশ্চিয়ানের মতো। তুমি বা সবাইকে ক্ষমা করে দিতে পার’।
এবার গর্জে ওঠে মাদাম পেরিয়ার… ‘তাতে ক্ষতি কী হয়েছে? নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য কী না করেছে ছেলেটা। ও যদি না থাকত এই কয়েক মাস তোমার বাবা তামাক পেতেন কোত্থেকে? ওর দয়াতেই আমাদের খাবার জুটছে। নাহলে তো না খেয়েই মরতাম’ ।
‘ তোমাদের যদি বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান থাকত তাহলে ওই খাবারের প্যাকেট ওর মুখেই ছুঁড়ে মারা উচিত ছিল তোমাদের’।
‘ কেন? ওই খাবার কি তুমি খাওনি…ভাবের ঘরে চুরি কোরো না’।
‘না, কক্ষনো না’।
‘ তুমি যে মিথ্যে বলছ সেটা তুমি নিজেও জানো। ওর আনা চিজ, মাখন, সার্ডিন তুমি খাওনি বটে কিন্তু স্যুপ তো খেয়েছ। স্যুপের মধ্যে আমি যে মাংস মিশিয়ে দিয়েছিলাম সেটা যে ওরই আনা তুমি জানতে না বুঝি? আজ রাতেই তো স্যালাড খেলে। ও ওই তেলটা এনে না দিত ওটা তোমায় শুকনো খেতে হত’।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলে অ্যানেট… ‘ আমি জানি। আমি সব জানি। কিন্তু নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। খিদেয় আমার পেট জ্বলে যাচ্ছিল। আমি জানি ওর মানা মাংস তুমি স্যুপে দিয়েছে। আমি জানি ওর আনা তেলটা দিয়েই তুমি স্যালাড বানিয়েছ। আমি খেয়ে চাইনি বিশ্বাস করো। আমি খেতে চাইনি। কিন্তু খিদেরচোটে আমি লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। ওগুলো আমি খাইনি মা। আমার মধ্যে যে পশুর খিদেটা রয়ে গেছে সেই সব খেয়েছে’।
‘যাই বলো আর তাই বলো তুমি খেয়েছ’।
‘ হ্যাঁ মা লজ্জায়, ঘৃণায় মাটিতে মিশে গেছি আমি। প্রথমে ওরা ট্যাংক, কামান, প্লেন দিয়ে আমাদের মেরুদণ্ডটা ভেঙে দিয়েছে। আর এখন যখন আমাদের উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই তখন আমাদের অনাহারে রেখে আমাদের মনের জোরটাও নষ্ট করে দিচ্ছে’।
‘ আর অত নাটক করতে হবে না। তুমি লেখাপড়া জানো তাও তোমার কোনো বুদ্ধি সুদ্ধি হল না। আগের কথা ভুলে যাও। আর নিজের বাচ্চাকে তার বাপের পরিচয়টা অন্তত দাও। জমিতে কাজ করার একটা লোক পাওয়া যায়? ও এখানে এসে চাষবাসের দায়িত্ত্ব নিলে আমাদের অন্তত দুজন মুনিষের খরচ বেঁচে যাবে। একেই বলে বাস্তববোধ বুঝেছ?’
বড় ক্লান্ত লাগছে অ্যানেটের। আলতো করে কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে চুপ করে যায়। তিন জনেও মুখেই কোনো কথা নেই। ঘরজুড়ে এক ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা।
পরের দিন হ্যান্স আসে। তার দিকে করুণ ভাবে চায় অ্যানেট। কোনো কথাও বলে না। গ্যাঁট হয়ে বসেই থাকে। হ্যান্সের মুখে হাসি ফোটে… ‘ আমাকে দেখে তুমি যে আজ ছুটে পালালে না সেজন্য ধন্যবাদ’।
‘ আমার মা বাবা তোমাকে আসতে বলেছেন। কিন্তু ওরা একটু গ্রামের দিকে গেছেন। তাতে আমার অবশ্য ভালোই হয়েছে। আপনার সঙ্গে আলাদা করে আমার কিছু কথা রয়েছে। বসুন’।
নিজের কোট আর হেলমেটটা খুলে টেবিলের আরো কাছে চেয়ারটাকে নিয়ে বসে হ্যান্স।
‘ আবার বাব-মা চায় আমি যেন আপনাকে বিয়ে করি। খাবার দাবার ঘুষ দিয়ে… লম্বা চওড়া কথা বলে আপনি ওঁদের মন জিতে নিয়েছেন। আপনি ওঁদের যে কাগজ এনে দেন তাতে যা লেখা থাকে সেসব ওঁরা চোখ কান বুজে বিশ্বাস করে। কিন্তু আমি আপনাকে কোনোদিনও বিয়ে করব না। বুঝেছেন? আপনাকে স্রেফ ঘেন্না করি। আমি যে কোনো মানুষকে এতটা ঘেন্না করতে পারি সেটা আমি নিজেও আগে জানতাম না’।
‘ এবার আমি একটু জার্মানে কথা বলি। আমি কী বলছি আশা করি তুমি সব বুঝতে পাবে’।
‘ আমাকে শিখতে হয়েছে। কারণ আমি জার্মান পড়াতাম। স্টুটগার্টের এক বাড়িতে দুটো বাচ্চা মেয়ের গভর্নেস ছিলাম আমি। ওখানে দু বছর কাজ করেছি’।
নিজের মাতৃভাষায় কথা শুরু করে হ্যান্স। তবে অ্যানেট সব উত্তর ফরাসিতেই দেয়।
‘ আমি তো তোমাকে ভালোবাসিই। কিন্তু সেইসঙ্গে সম্মান করিও খুব। তোমার চলন বলন , তোমার ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ…সবকিছু মিলে তুমি একদম আলাদা। তোমার মধ্যে একটা এমন কিছু আছে যা আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারি না। তাই তো তোমাকে এত শ্রদ্ধা করি আমি। এখন তো আমাদের মাঝে কোনো বাধা নেই তাও তুমি বিয়ে করবে না কেন? পিয়ের তো আর নেই’।
‘ ওর নাম আপনি উচ্চারণ করবেন না…তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে’…গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে অ্যানেট।
‘ না না তা নয়। আমি শুধু এটাই বলছি পিয়ের মারা গেছে সেটা ভেবে আমারও খুব খারাপ লাগছে’।
‘ মারা গেছে মানে? জার্মানির জেলে ওদের ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে’।
‘ সময় তোমাকে সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। জানো তো আমরা যখন আমাদের কোনো প্রিয়জনকে হারাই তখন মনে হয় এই শোক থেকে যাবে জীবনভর। কিন্ত সময়ের চেয়ে বড় ওষুধ আর নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব শোক ফিকে হয়ে যাবে। তুমি কি চাওনা তোমার সন্তান তার বাবার পরিচয় পাক’।
‘ আমি যদি অন্য সব কথা ভুলেও যাই তাহলেও এটা কখনো ভুলব না যে আপনি জার্মান আর আমি ফরাসি। একমাত্র জার্মানরা আপনার মত মূর্খ হতে পারে। আপনি কী বোঝেন না এই বাচ্চাটা সারাজীবন আমার কাছে কলংক হয়েই থাকবে। আপনি কি মনে করেন আমার কোনো বন্ধু বান্ধব নেই। একটা জার্মান সেনার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আমি কীভাবে তাদের দিকে মুখ তুলে চাইব? তাই আমি বলছি আমা্র কলংক নিয়ে আমায় একাই থাকতে দিন। এই একটা জিনিস ভিক্ষে দিন আমায়। আপনি চলে যান এখান থেকে। আর কক্ষনো নিজের মুখ দেখাবেন না’।
‘ কিন্তু বাচ্চাটা তো আমারও। আমি আমার বাচ্চাকে চাই’।
‘ আপনি?’ অ্যানেট হতবাক… ‘ মদে চূর হয়ে যে কান্ডটা আপনি ঘটিয়ে বসেছেন তার জন্য এত চিন্তা কেন আপনার?’
‘ তুমি বুঝবে। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছে…খুব আনন্দ হচ্ছে আমার। আমি বাবা হচ্ছি। আমি যেদিন জানলাম আমারই ছোট্ট একটা অংশ তোমার শরীরে বেড়ে উঠছে সেদিন থেকে প্রেমে পড়ে গেছি তোমার। প্রথম প্রথম আমারও বিশ্বাস হত না…আমি কি সত্যিই প্রেমে পড়েছি? আমি কী বলছি তুমি বুঝতে পারছ তো? যে বাচ্চাটা আসছে সেই আমার কাছে সবকিছু। উফফ আমি বুঝতে পারছি না…কীভাবে তোমায় বলি। আমি প্রথমে নিজেও বুঝতে পারিনি’।
ভালো করে মানুষটাকে দেখে নেয় অ্যানেট। চোখদুটো চকচক করে ওঠে তার। তার চোখে মুখে যেন যুদ্ধজয়ের হাসি। এবার খিল খিল করে একটু হেসে নেয় সে… ‘ আমি বুঝতে পারছি না তোমাদের জার্মানদের পাশবিকতাকে বেশি ঘেন্না করব নাকি তোমাদের ওই বোকা বোকা আবেগকে!’ মেয়েটার কথা কানে গেলনা হ্যান্সের। সে নিজের চিন্তাতেই মগ্ন… ‘ আমি আমার ছেলের কথাও ভাবি সবসময়’।
‘ ও আপনি তাহলে ধরেই নিয়েছেন যে ছেলেই হবে’।
‘হ্যাঁ আমি জানি ছেলেই হবে। আমি ওকে কোলে নেব। আঙুল ধরে ধরে হাঁটতে শেখাব। ও যখন বড় হবে তখন আমি যা যা জানি সব শেখাব ওকে। ওকে ঘোড়ায় চড়তে শেখাব। তোমাদের খামারের পুকুরে মাছ আছে না? আমি ওকে মাছ ধরতেও শেখাব। ছেলেকে নিয়ে গর্বে বুক ভরে যাবে আমার। সবচেয়ে ভালো বাবা হব আমি’।
অ্যানেট একদৃষ্টে চেয়ে থাকে লোকটার দিকে। এসব কী বলছে ও? তার মুখ পাথরের মতো কঠিন। মনে মনে এক ভয়ঙ্কর খেলা চলছে তার। অ্যানেটের দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হাসি হাসে হ্যান্স… ‘ তুমি যখন দেখবে আমাদের ছেলেকে আমি কেমন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি…তখন তুমিও আমায় ভালোবাসতে পারবে। আমি তোমার খুব স্বামী হব দেখে নিও।
থমথমে মুখে আরো একবার লোকটার দিকে চায় অ্যানেট।
‘ অ্যানেট তুমি কি একটাও মিষ্টি কথা বলবে না আমার সঙ্গে’।
রাগে ফুঁসে ওঠে অ্যানেট। দুটো হাত মুঠো করে ধরে… ‘ দেখুন লোকে আমায় ঘেন্না করতে পারে। কিন্তু আমি এমন কিছু করতে পারি না যাতে নিজের ওপরই আমার ঘেন্না হয়। আপনি সবসময় আমার শত্রুপক্ষ। ফ্রান্সের মুক্তি কবে আসে শুধু সেই দিনটা দেখার জন্য আমি বেঁচে আছি। হয়তো পরের বছর ফ্রান্স স্বাধীন হবে। নয়তো তার পরের বছর… কিংবা তিরিশ বছর পর। আমার দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। অন্যেরা যে যা খুশি করতে পারে। কিন্তু আমার দেশের শত্রুর সঙ্গে আমি কখনই হাত মেলাতে পারি না। আমি আপনাকে ঘেন্না করি। আর যে বাচ্চাটাকে আমার পেটে গুঁজে দিয়েছেন তাকেও সমান ঘেন্না করি। হ্যাঁ আমরা হয়তো আজ হেরে গেছি। কিন্তু একদিন না একদিন আপনি বুঝবেন আমাদের জয় করা যায়না। আমরা অপরাজেয়। এবার আপনি যান। আমি মনস্থির করে নিয়েছি। এই দুনিয়ার কিছুই আর আমার মন আর বদলাতে পারবে না’।
খানিক্ষণ চুপ করে থাকে হ্যান্স… ‘ তুমি কি ডাক্তার দেখিয়েছ? আমি সব খরচাপাতি দেব?’
‘ কী ভেবেছেন আপনি? আমি আমার এই কলঙ্কের কথা গোটা গ্রামে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বলতে যাব। যা দরকার হবে আমার মা-ই সব করবে’।
‘ কিন্তু আমি ভাবছিলাম যদি কোনো অঘটন ঘটে?’
‘ আপনি নিজের চরকায় চেল দিন না মশাই’।
অগত্যা এবার উঠতেই হয় হ্যান্সকে। দরজাটা বন্ধ করে সে ধীরে ধীরে বড়রাস্তার দিকে । জানালা দিকে তার যাওয়ার পথের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে অ্যানেট। লোকটা যে কথাগুলো বলে গেল সেগুলো মনে করে চোখ মুখ হিংস্র হয়ে উঠল তার। আজকের মতো এমন অনুভূতি তার আগে কখনো হয়নি… ‘ হে ভগবান শক্তি দাও আমায়’। লোকটা যখন রাস্তার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল তখন তাদের পোষা কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে তার পিছু নিল। এই কুকুরটার সঙ্গে ভাবসাব করতে গত কয়েক মাসে অনেক চেষ্টা করেছে হ্যান্স। কিন্তু কুকুরটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারেনি। কুকুরটাকে সে যখনই আদর করতে গেছে সে ব্যাটা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আরো বেশি করে চেঁচিয়েছে। আজও কুকুরটা তার পেছনে লেগেছে। আজ সত্যিই তার মনটা ভালো নেই। মাথায় আজ খুন চেপে বসল তার। কুকুরটাকে ঝেড়ে মারল এক লাথি। কুকুরটা ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশের ঝোপে। তারপর কোনো রকমে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল। জানালা দিয়ে সব দেখে অ্যানেট… ‘ জানোয়ার একটা! সব মিথ্যে, সব মিথ্যে। কুকুরটাকে যে রক্ষা করব সে শক্তিও আজ আমার নেই’। দরজার পাশে ঝোলানো আয়নাটার দিকে চায় সে। নিজেকে ভালো করে দেখে নিয়ে একটু হাসে… সে হাসি বড় হিংস্র… বড় নিষ্ঠুর।
মার্চ পড়ে গেছে। সয়শঁর সেনা ঘাঁটিতে এখন শুধু কাজ আর কাজ। ওপরওয়ালারা পরিদর্শনে এলেন। তারপর চলল ট্রেনিং এর পালা। চারদিকে বাতাসে অনেক গুজব। কোথাও যে একটা যেতে হবে সেটা তারা ভালোমতই বুঝতে পারছে। কিন্তু সেটা ঠিক কোথায় তা আন্দাজ করতে পারছে না। কেউ কেউ ভাবে ইংল্যান্ডের ওপর শেষ আঘাত হানতেই যেতে হবে তাদের। আবার কেউ বলে তাদের যেতে হবে বল্কানে। কেউ বলে বলে ‘না না বল্কান ন্য…ইউক্রেনে যেতে হবে’। হ্যান্স এখন খুব ব্যস্ত। নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। অনেক কষ্টে মাসের দ্বিতীয় রবিবার খামার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ করে উঠতে পারে সে। কনকনে ঠান্ডা বাইরে। চারদিক কেমন যেন ধোঁয়াটে। আজ খুব বরফ পড়বে বলে মনে হয়। গ্রামটা কেমন যেন গুটিয়ে রয়েছে…প্রাণহীন নিস্পন্দ। তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেন মাদাম পেরিয়ার… ‘ তুমি এসেছ বাবা। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম তুমি আর বেঁচে নেই।
‘ আমি আসতে পারিনি। আমাদের যেকোনো দিন চলে যেতে হবে। জানিনা ঠিক কবে’।
‘ আজই বাচ্চাটা হল…তোমার ছেলে হয়েছে’।
হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে হ্যান্সের। আনন্দের চোটে মাদাম পেরিয়ারকে জড়িয়ে ধরে দু গালে চুমু দিয়ে দেয়… ‘ রবিবারের জাতক। খুব চওড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে আমার ছেলে। এই আনন্দে একটা শ্যাম্পেন খোলা যাক। আর অ্যানেট কেমন আছে?’
‘ এই অবস্থায় যেমন থাকার কথা। তবে ওর খুব বেশি কষ্ট হয়নি। কাল রাতে ওর ব্যথা। আজ ভোর পাঁচটার মধ্যেই সব মিটে যায়’।
এ বাড়ির কর্তা উনুনের সামনে বসে পাইপ টানছিলেন। হ্যান্সের ওই আলো ঝলমল মুখ দেখে তিনিও খুশি হন… ‘প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার অনুভূতিটাই একদম আলাদা’।
ওদিম থেকে কলকলিয়ে ওঠেন মাদাম পেরিয়ার… ‘ জানো তো বাচ্চাটার একমাথা চুল। তোমার মতই সোনালি। তুমি বলেছিলে না বাচ্চার চোখ নীল হবে। আর দেখো সেটাই হয়েছে। আমি এত মিষ্টি বাচ্চা আর দেখিনি। ও ওর বাবার মতোই হবে’।
আনন্দে ডগমগো হয়ে ওঠে হ্যান্স… ‘উফফফ আমার কী আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না…চারদিকের সবকিছু কত সুন্দর। আমি অ্যানেটের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই’।
‘ ও তোমার সঙ্গে দেখা করবে কিনা জানি না। তারপর তোমাকে দেখে যদি রেগে মেগে যায় তাহলে বাচ্চাকে ঠিকমত দুধও দেবে না। আমি ওকে আর এখন ঘাঁটাতে চাই না’।
‘ না না আমার জন্য ওকে বিরক্ত করার দরকার নেই। ও আমার সঙ্গে দেখা করতে না চাইলেও কিছু বলার দরকার নেই। কিন্তু বাচ্চাটাকে আমাকে দেখতে দিন। অন্তত এক মিনিটের জন্য’।
‘দাঁড়াও দেখি আমি কী করতে পারি। আমি বাচ্চাটাকে নীচে আনার চেষ্টা করছি’।
মাদাম পেরিয়ার ওপরে যান। কিছুক্ষন পরেই সিঁড়িতে ধুপধাপ আওয়াজ পান তাঁরা। দৌড়ে নীচে নেমে আসেন মাদাম পেরিয়ার। পাগলের মতো রান্নাঘরে ছুটে যান তিনি। তাঁর মুখে আতংক… ‘ ওরা ঘরে নেই। অ্যানেটও নেই আর বাচ্চাটাও’। ভয়ে চিৎকার ওঠেন হ্যান্স আর বুড়ো পেরিয়ার। তারা তিনজনেই ছুট লাগান ওপরে। ঘরের ময়লাটে আসবাব, লোহার খাট, সস্তার আলনায় এসে পড়েছে বিকেলের মরা আলো। ঘরে সবকিছু আছে…নেই শুধু মা আর বাচ্চা। ‘কোথায় গেল ও’ … ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠেন মাদাম পেরিয়ার। তিনি বারান্দায় এসে দরজা খুলে মেয়ের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকেন… ‘অ্যানেট… অ্যানেট এ কী পাগলামি হচ্ছে শুনি?’
‘ হয়তো বসার ঘরে রয়েছে’। এই বসার ঘরে সাধারণত কেউ যায় না। সেখানে গিয়েও তাঁরা দেখেন ঘর ফাঁকা’। দরজাটা খুলতেই বরফ ঠান্ডা বাতাস তাঁদের মুখে ঝাপ্টা মেরে যায়। ভাঁড়ার ঘরেও দরজাটাও খুলে দেখেন তাঁরা। কেউ নেই।
‘ ও নির্ঘাৎ বাইরেই গেছে। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটে গেছে।
এই উদ্বেগ আর সহ্য হয় না হ্যান্সের ‘ কিন্তু ও কীভাবে বাইরে গেল?’ ভয়ে শুকিয়ে আসে হ্যান্সের গলা।
‘ নিশ্চয়ই সামনের দরজা দিয়ে…আমরা বুঝতেই পারিনি, ছি ছি’। কঁকিয়ে ওঠেন বুড়ো পেরিয়ার। তিনি ঠিকই ধরেছেন। সামনের দরজার খিলটা বাইরের দিকে আটকানো।
বিলাপ করতে বসেন মাদাম পেরিয়ার… ‘ এ কী পাগলামি মেয়ের! এই ঠান্ডায় বেরোলে ও কি আর বাঁচবে?’
‘ আমাদের এবার খুঁজতে বেরোনো উচিত’। এই বলে রান্নাঘরের দিকেই ছুটে যায় হ্যান্স। এই রান্নাঘর দিয়েই সে বরাবর ঘরে ঢোকে। অন্যরাও তার পেছন পেছন যায়… ‘এদিকের রাস্তাটা কোথায় গিয়ে পড়েছে?’
‘ ওই তো পুকুরের দিকে’… ভয়ে মুখ সাদা হয়ে যায় মায়ের। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর… ‘আমার খুব ভয় করছে…খুব ভয় করছে আমার’।
হ্যাঁচকা মেরে দরজাটা খোলে হ্যান্স। দরজাটা খুলতেই অ্যানেট এসে ঘরে ঢোকে। গায়ে কোনো গরম জামা নেই। রাতপোশাকের ওপর ফিনফিনে ফুলকাটা একটা গাউন। সারা গা ভিজে সপসপ করছে তার। মাথার চুল এলোমেলো। দু একগুছি চুল ঘাড়ের কাছে কাছে লেপ্টে রয়েছে। তার মুখ একদম ভূতের মতো সাদা। মেয়েকে দেখেই মাদাম পেরিয়ার তার হাতটা জাপটে ধরেন… ‘ কোথায় ছিলে এতক্ষণ। ওহহহ পুরো গা যে একদম ভিজে সপ সপ করছে! এ কী পাগলামি শুনি?’ মেয়ে জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। তারপর তার চোখ পড়ে হ্যান্সের দিকে… ‘আপনি একদম ঠিক সময়েই এসেছেন দেখছি’।
‘ বাচ্চাটা কোথায়?’…চেঁচিয়ে ওঠেন মাদাম পেরিয়ার।
‘ আমি এক্ষুনিই ঝামেলাটা মিটিয়ে এলাম। আমার ভয় হচ্ছিল পরে যদি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি! তখন যদি আর সাহস করে উঠতে না পারি!’
‘ অ্যানেট কী করেছ তুমি?’
‘ আমার যা করার কথাছিল সেটাই করেছি। বাচ্চাটার গলাটা টিপে পুকুরের জলে চুবিয়ে ধরলাম। ছটফট করতে করতে বাচ্চাটা একসময় নিঃসাড় হয়ে হয়ে গেল’।
তাড়া খাওয়া পশুর মতো আর্তনাদ করে ওঠে হ্যান্স। মুখে দুহাত চেপে কোনোমতে টলতে টলতে বেরিয়ে যায় দরজা দিয়ে। মুখে আর তার কোনো কথা সরে না। পাশের চেয়ারটায় এলিয়ে পড়ে অ্যানেট। দুহাতে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
‘অপরাজিতা’ গল্পটি সমারসেট মমের ‘ আনকংকার্ড’ গল্পটির অনুবাদ।
দারুন!