জানালা
–এডিথ হোয়ার্টন
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন
ওই জানালাটা তাঁর বড় প্রিয়। জানালা দিয়ে বাইরের এমন কিছু আহামরি দেখাও যায় না। তবে যা দেখা যায় মিসেস ম্যানস্টেরকাছে তাই ঢের। জানালার ওপারের জগতটা তাঁর কাছে ভারি সুন্দর। নিউ ইউর্কের এই বোর্ডিং এর চার তলায় জগদ্দল পাথরের মতো সেই কবে থেকে থিতু হয়ে বসেছেন তিনি। পাশের রাস্তার ধারে সবসময় জঞ্জালের গাড়ির আনাগোনা। ফুটপাথে যেটকু ফাঁকা জায়গা আছে তাতে কুইন্টাস কার্টিয়াসের মতো মানুষওবুরবক বনে যেতে পারে। মিসেস ম্যানস্টের স্বামী মারা গেছেন অনেক দিন। তিনি ছিলেন বিরাট এক পাইকারি দোকানের ক্লার্ক। স্বামী চলে যাওয়ার পরে বড় একা হয়ে পড়েছেন মিসেস ম্যানস্টে। থাকার মধ্যে মধ্যে ছিল এক মেয়ে। সেও বিয়ের পর ক্যালিফোর্নিয়া চলে গেছে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে নিউ ইয়র্ক আসার ধকল তার পোষায় না। মিসেস ম্যানস্টে চাইলে অবশ্য মেয়ের কাছে যেতে পারেন। কিন্তু এতদিন দূরে দূরে থাকার পর মা-মেয়ের বাঁধনটা কেমন যেন আলগা হয়ে গেছে। সেই টানটা আর নেই কারো। দুজনের মধ্যে যোগাযোগ বলতে কখনো সখনো মামুলি দু একটা চিঠি। মেয়ে লেখে দায়সারা ভাবে। আর মা লেখেন অতি কষ্টে। ডান হাতে এখন আর জোর পান না তিনি। বাতে হাতটা পুরো অকেজো হতে বসেছে। মেয়ের কাছে যাওয়ার জন্য যদি কখনো মনটা উচাটনও হয় এই চারতলা সিঁড়ি ভেঙে রাস্তায় নামার কথা ভাবলেই গুটিয়ে যান তিনি। বয়স বাড়ছে। শরীরে সেই তাকতও নেই আর । তাই নিউ ইয়র্কের বোর্ডিং-এর এই নির্জন বাসকেই নিজের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন তিনি।
সত্যি কথা বলতে এমনিতে খুব একটা একা নন তিনি। এখনো জনা কয়েক বন্ধু কষ্ট করে হলেও দেখা করে যায় তাঁর সঙ্গে। কিন্তু দিনদিন তাঁদের আনাগোনাও কমছে। সবারই তো বয়স হচ্ছে। লোকজনের সঙ্গে খুব একটা মিশতে পারেন না তিনি। যতদিন স্বামী ছিলেন তাঁকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন মিসেস ম্যানস্টে। অন্য কোনো সঙ্গী সাথীর দরকার হয়নি। গ্রামে গিয়ে থাকার বড় সাধ ছিল তাঁর। কত স্বপ্ন দেখতেন তিনি…তাঁর গ্রামের বাড়িরে একটা মুরগি খামার থাকবে…সামনে থাকবে একটা বাগান। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চাওয়াটাও ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। কিন্তু নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা নিঃসঙ্গ মানুষটার মধ্যে পশুপাখি…গাছপালার প্রতি নিবিড় ভালোবাসাটা সেই রয়েই গেছে। এই ভালোবাসার জন্যই তো ওই জানালাটার পাশে তাঁর সারাক্ষণ সেঁটে থাকা। জানালা কী যে অত দেখেন কে জানে। আর কারো চোখে তো তেমন কিছুই পড়ে না। অতি বড় রসিকজনও এই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় হতাশ হবেন। কিন্তু ওই জানালাটাই সে মিসেস ম্যানস্টের জগত। তাঁর বাক্স মতো জানালায় যত্ন করে আইভি লতা আর লিলি লাগিয়েছেন তিনি। লিলির চারাগুলো তেমন পুষ্ট হয়নি অবশ্য। জানালা দিয়ে এই বোর্ডিং-বাড়ির উঠোন দেখার চেষ্টা করেন তিনি…কিন্তু ভালো করে দেখতে পাননা। জানালার নীচে এইলান্থাসের ডালপালাগুলো শুধু নজরে পড়ে। বছরের শুরুতেই ডিসেনট্রার ঝোপে গোলাপির উচ্ছাস। মানুষের হার্টের মতো দেখতে ফুলগুলোর গোলাপি আভায় মাতোয়ারা হয়ে যান তিনি।
তবে আশে পাশের বাড়িগুলোর উঠোনের দিকেই তাঁর নজর যায় বেশি…সেখানেই তাঁর যত আগ্রহ। বোর্ডিং বাড়ির লাগোয়া উঠোন কত আর ঝকঝকে তকতকে হবে! সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটা দিনে উঠোন বেয়ে সারি সারি জামা কাপড়, ছেঁড়াখোঁড়া টেবিল ক্লথ শুকোয়। এতে অবশ্য কিছু যায় আসেনা মিসেস ম্যানস্টের। যা দেখার এর মধ্যে থেকেও তা দেখে নেনতিনি । কোনো কোনো উঠোন জুড়ে আবার রাবিশের স্তূপ। পায়ের চলার মোরাম-পথে ইতিউতি ঘাস গজিয়েছে শুধু। বসন্তের কড়া রোদের দিনেও গাছের শীতল ছায়া মেলে না…ওই সারি সারি মেলা কাপড় চোপড়ের ছায়াই যা সম্বল। এই ম্যাড়ম্যাড়ে উঠোনগুলো একদম তাঁর পছন্দ হয় না। গাছ গাছালিতে ভরা উঠোনগুলোই তার বড় কাছের। তবে এখন অনেক কিছুই তাঁর চোখে সয়ে গেছে। ধুলোভরা রাস্তা…জঞ্জালের ঢিবি…এখানে ওখানে ছড়ানো বোতল, ভাঙাচোরা জিনিসপত্র দেখে আজকাল আর কিছু মনে হয় না। হাঁসের মতোই দুধ আর জল আলাদা করতে শিখে গেছেন তিনি। এই নোংরা…এলোমেলো জায়গার মাঝে যা কিছু সুন্দর…মনোরম শুধু সেটুকুই ছেঁনে নেন ।
এই তো আজ পাশের উঠোনে এমন এপ্রিলের দিনে ঘন নীল আকাশের পানে কেমন সাদা পাপড়ি মেলে দিয়েছে রাজকীয় ম্যাগনোলিয়া! তার পর মে মাসে শুরু হবে উইসতারিয়ার উৎসব। ওই ওদিকের উঠোনের বেড়াটা ছেয়ে যা্বে বেগুনি ফুলে। বড় বড় পাতার আড়াল ভেদ করে মাথা তুলবে গোছা গোছা হর্স-চেস্টনাট। হলদে আর গোলাপির সাজে সেজে উঠবে প্রকৃতি। আর জুন মাস এলেই ঠিক উলটো দিকের উঠোনে সকলের নজরের আড়ালে অবহেলায় আলগোছে বেড়ে উঠবে লাজুক সিরিঞ্জা। কোনো বাধার কাছেই হার মানবে না সে…যে করেই হোক নিজের মাথাটা বাড়িয়ে দেবে আলোর পানে।
গাছপালা, লতাপাতা নিজের মিসেস ম্যানস্টের আগ্রহ হয়তো একটু বেশিই কিন্তু তা বলে আশে পাশের বাড়ির মানুষগুলোকে নিয়েও কৌতূহল তাঁর কিছু কম নেই। উলটো দিকের ডাক্তারের বাড়ির জানালায় সরষে-রঙা পর্দাটা দেখে মুখটা বেজার হয়ে গেছে তাঁর। এই সেদিনই নতুন লাগানো হল পর্দাটা। বাড়ির রঙের সঙ্গে একদন মানাচ্ছে না ওটা। তবেওই নীচের পুরোনো ইঁটের বাড়িটায় নতুন রঙের পোঁচ পড়ায় বেজায় খুশি হয়েছেন তিনি। আশে পাশে বাড়িগুলোর লোকজন অবশ্য এই পেছনের জানালার দিকে বিশেষ আসেন না। তাই মোলাকাতও হয় না তাঁদের সঙ্গে। তবে চাকর বাকরদের দেখা মেলে হামেশাই। কাজের মেয়েগুলো বড্ড ক্যাঁচর ম্যাঁচর করে বটে। ওদের হাবভাব…রকম সকম একদম পছন্দ হয় না মিসেস ম্যানস্টের। তবে যে বাড়িটায় নতুন রঙ হল সে বাড়ির রাঁধুনি মেয়েটা কিন্তু বেশ। মালকিন হরদম ওর ওপর চেঁচাচ্ছে…গালাগালি দিচ্ছে তাও মেয়েটার মুখে কোনো রা নেই। রাত হলে সে আবার লুকিয়ে লুকিয়ে রাস্তার বেড়ালদের খাওয়ায়। মেয়েটাকে বড় ভালো লাগে মিসেস ম্যানস্টের। বড় মায়া হয় ওর জন্য। আবার ওই যে ওপাশের বাড়ির কাজের ছুঁড়িটার কাণ্ড দেখে একবার মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সে বেটি দু দি…ন টিয়াপাখিটাকে খাবার দেয়নি। তিন দিনের দিন আর চুপ করে থাকতে পারেননি মিসেস ম্যানস্টে। বাতে প্রায় পঙ্গু হাত নিয়েই কোনো রকমে একটা চিরকুটে লিখে ফেললেন… ‘ ম্যাডাম আপনার টিয়া তিন দিন কিছু খায়নি’। তার একটু পরেই ছোলার বাটি নিয়ে হাজির হলেন সে মহারানি!
জানালার ধারে চুপ করে থাকতে থাকতে মনটা কোণ দিকশূন্যপুরে হারিয়ে যায় তাঁর। পড়শিদের উঠোন…চারপাশের ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে তাঁর দৃষ্টি চলে যায় অনেক অনেক দূরে…ওই মিনারটা যেখানে আকাশে গিয়ে মিশেছে। বাদামি পাথরের চূড়াটা যখন গোধূলির রাঙা আলোয় ডুবে যায় তখন ইউরোপের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে তাঁর। সেই কবেকার কথা। ঝাপসা স্মৃতিগুলো ছায়াছবির দৃশ্যপটের মতো মনে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে সেই গির্জার চূড়ো আর মায়াবি আকাশের কথা। তাঁর মধ্যে আসলে একটা শিল্পী মন লুকিয়ে রয়েছে। যে রূপ-রং-রসে তিনি মজে থাকেন সাধারণ চোখে আবার তা ধরা পড়ে না। প্রথম বসন্তের সবুজ বনানী তাঁর যত প্রিয়, ততটাই তাঁর মন কাড়ে বরফ-ভেজা দিনের শেষে ধোঁয়াটে বিবর্ণ আকাশের গায়ে জেগে থাকা ন্যাড়াডালপালাগুলোর অনুপম ভাস্কর্য।
রোদ ঝলমলে মার্চের দিনে মনটা খুশিয়াল হয়ে ওঠে তাঁর। বরফের ব্লটিং পেপারের ওপর চুঁইয়ে পড়া একফোঁটা কালির মতো জেগে ওঠে সবুজ মাটি। মন তাঁর মাতন লাগে। আরো যেন ভালো লাগে কুয়াশাচ্ছন্ন দূর আকাশের গায়ে নিষ্পত্র…অথচ প্রাণোচ্ছল ডালপালার জাফরি…শীত-আকাশের গায়ে যেন কোনো বিচিত্র শিল্পকলা। ওই দূরে কল-কারখানার চিমনির ধোঁয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কারখানা বন্ধ হলে ধোঁয়াও থাকে না আর। মনটা উশখুশ করে মিসেস ম্যানস্টের। খালি মনে হয় কী যেন একটা নেই।
জানালার ধারেই কেটে যায় তাঁর বেশিরভাগ সময়। এখানে বসেই তিনি একটু পড়াশোনা করেন…উল বোনেন। কতগুলো যে মোজা বুনে ফেলেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এই জানালার ধার…জানালার বাইরে ওই চারপাশের দুনিয়াটা ছাড়া তাঁর চলে না। নিঃসঙ্গ ওই দ্বীপটার মতোই অবস্থা তাঁর…চারপাশে সমুদ্র ছাড়া যার কোনো অস্তিত্বই নেই। মাঝে মাঝে দু একজন দেখা করতে আসে বটে তখন আবার তাঁর মহা মুশকিল। জানালাটা থেকে কিছুতেই চোখই সরাতে পারেন না তিনি। পাশের বাড়ির জানালার ঝাড়পোঁছ…কিংবা ওদিকের বাড়ির ফুলের বাগানের মধ্যে একটা সবুজ পাতা দেখতেই হয়তো ব্যস্ত ছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন ওটা কি হায়াসিন্থ! এমন গভীর চিন্তার সময় কেউ যদি এসে ডাকে মনে মনে একটু বিরক্তই হন তিনি। কিন্তু কী আর করা! অতিথি এসে বকম বকম করে। নিজের নাতি নাতনির গল্প করে। তিনি মন দিয়ে শোনার ভান করে যান। এদের সঙ্গে ঠিক মন খুলে মিশতে পারেন না তিনি। তাঁর মন যে পড়ে থাকে ওই উঠোনের দিকে…সেখানকার লোকজনেদের দিকে…হায়াসিন্থ, ম্যাগনোলিয়া আর টিয়াপাখিটার দিকে। ওই যে কাজের মেয়েটা লুকিয়ে রাস্তার বেড়ালদের খাওয়ায়…সরষে রঙা পর্দার ওপারে যে ডাক্তার ভারী ভারী জার্নাল পড়েন…এঁরাই যে তাঁর পরম বন্ধু। তার মন জুড়ে থাকে অস্তরাগের আলোয় রাঙানো আকাশ-ছোঁয়া ওই মিনার। আর কেউ না…আর কিচ্ছু না।
এপ্রিল পড়ে গেছে। সেদিন জানালার ধারে তাঁর প্রিয় জায়গাতে বসেছিলেন মিসেস ম্যানস্টে। উল কাঁটা সব পাশে ছড়ানো। চোখ তাঁর আকাশের দিকে। আকাশের গায়ে সাদা মেঘেদের ভেলা। চোখ আর তাঁর সরে না। হঠাৎই দরজায় ঠকঠক। বোর্ডিং-এর মালকিন এসেছেন দেখা করতে। মালকিনকে অত পাত্তা টাত্তা দেন না মিসেস ম্যানস্টে। তবে তিনি দেখা করতে এলে ওপরে ওপরে যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রাখেন। ওই নীল আকাশ আর পাশের বাড়ির ম্যাগনোলিয়ার গাছটার থেকে নজর সরিয়ে আর কিছুতেই যেন মিসেস স্যাম্পসনের সাদামাটা মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি!
‘ এবার কত তাড়াতাড়ি ম্যাগনোলিয়া ফুটেছে দেখুন তো! কী অবাক কাণ্ড তাই না মিসেস স্যাম্পসন?’ আজ আর নিজের উত্তেজনা কিছুতেই চেপে রাখতে পারলেন মিসেস ম্যানস্টে। নাহলে এমনিতে তাঁর এই দুনিয়ার ভাগ কাউকে দিতে চান না তিনি। কেনইবা দেবেন! তাঁর এই উদ্ভট শখের কথা তাঁর অতিথিদের মাথায় ঢুকবে না। আর তাছাড়া মনের কথা অত ভালো করে প্রকাশ করতেও পারেন না তিনি। কখন কোন শব্দটা বলা উচিত মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যায় তাঁর।
‘ কী যেন বললেন মিসেস ম্যানস্টে?’ অবাক হলেন মালকিন। ঘরটা ভালো করে দেখে নিলেন তিনি। কিন্তু কোথায় ম্যাগনোলিয়া?
‘ না মানে আমি পাশের বাড়ির…ওই মিসেস ব্ল্যাকের উঠোনের ম্যাগনোলিয়া গাছটার কথা বলছি’।
‘ ওহ তাই নাকি? ওখানে কোনো ম্যাগনোলিয়া আছে জানতাম না তো!’ আলগোছেই কথাখানা বলেন মিসেস স্যাম্পসন। এবার অবাক হওয়ার পালা মিসেস ম্যানস্টের। কী বলেছেন উনি! ঠিক পাশের বাড়িতেই একটা ম্যাগনোলিয়া গাছ রয়েছে…আর উনি এতদিন দেখেননি!
‘মিসেস ব্ল্যাকের কথা উঠতে মনে পড়ে গেল। পরের সপ্তাহেই তো ওঁর বাড়ির কাজ শুরু হচ্ছে। বাড়িটাকে এবার অনেকটা নাকি বাড়িয়ে নেবেন উনি’।
‘ উনি কী করবেন?’
‘ আরে বাড়ির এক্সটেনশন…বাড়িটাকে ওদিকে একটু বাড়িয়ে নেবেন’। ম্যাগনোলিয়ার গাছটার দিকে দেখিয়ে দেন মিসেস স্যাম্পসন… ‘ আপনি জানেন না? আমি তো তাই শুনলাম। মিসেস ব্ল্যাক ওই পুরো উঠোন জুড়ে বাড়িটাকে বাড়িয়ে নেবেন। এই মাগ্যি গণ্ডার বাজারে কোথা থেকে যে অত পয়সা পাচ্ছেন কে জানে! তবে উনি বরাবরই নতুন বাড়ি বানানোর জন্য পাগল। সেভেন্টিন্থ স্ট্রিটে ওঁর একটা বোর্ডিং হাউস ছিল…সেটায় আবার সখের ঝুল বারান্দা…এটা সেটা কারুকাজ করতে গিয়ে তো একেবারে দেউলিয়া হতে বসেছিলেন। ভেবেছিলাম যা হোক একটা শিক্ষা ওঁর হয়েছে। কিন্তু কোথায় কী! আমার মনের হয় এটা ওঁর একটা নেশা…ঠিক মদের মতো। যাইহোক যা শুনলাম সামনের সোমবার থেকেই তো বাড়ির কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে’।
মুখটা সাদা হয়ে যায় মিসেস ম্যানস্টের। তিনি বরাবরই ধীরে থেমে থেমে কথা বলেন। তাই কথা বলার মাঝে তিনি আজ তিনি কতবার যে থমকালেন তা লক্ষ্যই করলেন না মালকিন। অনেক কষ্টে শেষ মেষ একটাই কথা বলতে পারলেন মিসেস ম্যানস্টে… ‘নতুন বাড়ির দেওয়ালটা কত উঁচু হবে’?
‘ এ আবার কেমনতরো কথা! পুরোনো বাড়ির ছাদের সমানই উঁচু হবে…আর নয়তো কী!’
আবার একটু থামেন মিসেস ম্যানস্টে… ‘ না মানে ওখানে কাজ শুরু হলে তো আপনার খুব ঝামেলা হবে’।
‘ তা তো হবেই। কিন্তু কী আর করা যাবে। কেউ নতুন নতুন বাড়ি বানাতে চায় আমি কোন আইনে তাকে আটকাব?’
সে কী আর মিসেস ম্যানস্টে জানেন না। খুব জানেন তিনি। তাই চুপ করে থাকেন। এবার মুখ খোলেন মিসেস স্যাম্পসন… ‘আমার আর কিছু করার নেই। তবে আমি যদি চার্চের লোক হতাম তাহলেও মিসেস ব্ল্যাককে পথে বসতে দেখেও একটুও দুঃখ পেতাম না। ঠিক আছে ভালো থাকবেন মিসেস ম্যানস্টে। আপনাকে এত হাসি খুশি দেখে খুব ভালো লাগল’।
‘হাসি খুশি’! কথা ব্যঙ্গের মতো শোনায় মিসেস ম্যানস্টের কানে। মালকিন চলে যাওয়ার পরে আবার তিনি একা। জানালার দিয়ে একবার উঁকি মারেন তিনি। আজকের দিনটা কী সুন্দর। নীল আকাশের বুকে থোকা থোকা জলহারা সাদা মেঘ। নরম রোদের আলোয় এইলানথাস গাছটাকে লাগছে হলদেটে সবুজ। হায়াসিন্থগুলোতে কুঁড়ি ধরেছে…দুদিন পরেই ফুল ফুটবে। আর ম্যাগনোলিয়ার কী বাহার! দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়…যেন পাথর কুঁদে বানানো কোনো নিপুণ ভাস্কর্য। দিন কয়েকের মধ্যেই শুরু হবে উইস্তারিয়ার মেলা…তারপরে ডালি সাজিয়ে আসবে হর্স চেস্টনাট। কিন্তু এই আনন্দযজ্ঞে শুধু বঞ্চিত রয়ে যাবেন তিনি। তাঁর চোখের সামনে উঠে যাবে ইঁট, কাঠ, পাথরের দেওয়াল। ওই মিনারটাও হারিয়ে যাবে তাঁর কাছে থেকে। অন্ধকার হয়ে যাবে তাঁর দুনিয়া। রাতের খাবারটা আর দাঁতে কাটতে পারলেন না তিনি…ফিরিয়ে দিলেন যেমন কে তেমন। জানালার ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন । আকাশের মুঠো মুঠো আবির ছড়িয়ে সুয্যি গেল পাটে। চরাচর জুড়ে নামে অন্ধকার। রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেই কাটালেন তিনি। ঘুম এল না একফোঁটা।
ভোর না হতে হতেই আবার তিনি জানালার ধারে। আকাশে মুখ আজ ভার। সেইসঙ্গে বৃষ্টি। মেঘ-ছেঁড়া মরা আলোয় প্রকৃতি আজ অন্য সাজে। তাছাড়া গাছ-গাছালিগুলোর জন্যও তো একটু বৃষ্টি-বাদলা দরকার। নীচের এইলানথাসের পাতায় ধূলোর পরত পড়েছে। এই তো সেদিনই দেখলেন তিনি।
‘এখান থেকে তো চলেই যেতে পারি আমি’। জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি। জানালা থেকে মুখটা সরিয়ে নিজের ঘরটাকে একবার ভালো করে জরিপ করে নেন । হয় তাকে চলে যেতে হবে…নয়তো এখানে থেকেদগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে। দুটোর মধ্যে যাই হোক না মৃত্যু তার অনিবার্য। এটাই বুঝি তাঁর নিয়তি। জানালাটা ছাড়া যদিও এই ঘরের তেমন মূল্য নেই তাঁর কাছে তবুও এই ঘরটা কীভাবে যেন মিলে মিশে গেছে তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গে। এই ঘরে সতেরো বছর হয়ে গেল তাঁর। এই ঘরের প্রতিটা আনাচ কানাচ, ওয়াল পেপারের দাগ, কার্পেটের একটা ছোট্ট ফুটো স…ব তাঁর ভীষণ চেনা। জানালা দিয়ে রোদটা তেরছা ভাবে এখন পড়েছে ঘরে। তাকের বইগুলোয় খুব ধূলো পড়েছে। তাঁর আইভি লতা আর লিলির চারাটা এই জানালা ছাড়া কেমন করে বাঁচবে! এই জানালাতেই থাকতে থাকতে তারা বুঝে নিয়েছে কোন দিক করে সূর্যের পানে তাকাবে তারা… ‘এখানেই যে শিকড় গজিয়ে গেছে আমাদের সবার। কোথায় যাব আর!’
বিকেলের দিকে বৃষ্টি থামে। মেঘের চাদরের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে বৃষ্টি ভেজা নীল আকাশ। বিকেলের সোনা রোদে ঝিকিয়ে ওঠে এইলাথাসের ঝাড়। মাটিতে সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে ফুলের বাগান।
রবিবারে বিকেলে বেসমেন্টে বোর্ডারদের খাবার দাওয়ার আয়োজন করছিলেন মিসেস ব্ল্যাক। এমন সময় পরিচারিকা এসে জানিয়ে গেল গেল এক বয়স্ক মহিলা দেখা করতে চান। কালো বর্ডার দেওয়া ভিজিটিং কার্ডে আগন্তুকের নাম … ‘মিসেস ম্যানস্টে’। নামটা দেখেই চিনতে পারেন তিনি… ‘মিসেস স্যাম্পসনের বোর্ডার এখানে আবার কী মনে করে! উনি কি তবে মিসেস স্যাম্পসনের বোর্ডিং ছেড়ে আমার এখানে উঠতে চান। তবে এক্ষুনি তো আর হবে না। বাড়িটা বাড়ানো হলে সামনের বছর ওঁকে একটা ঘর দিতে পারব। দিনা…ওঁকে বল ওপরে আসতে…আমি এক্ষুনি আসছি’।
মিসেস ব্ল্যাকের হলঘরে দামি দামি সব শোপিস…চেয়ারের গায়ে ঝলমলে রেশমি চাদর। এ বাড়িতে এসে অতিথির মতো বসতে পারবেন না তিনি। কাজ সেরে মিসেস ব্ল্যাক যখন হলঘরে আসেন তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে মিসেস ম্যানস্টে। ধূলো ভর্তি রেজিস্টারটা খুলে একবার চোখ বুলিয়ে নেন মিসেস ব্ল্যাক…দেখা যাক যদি এনাকে একটু জায়গা করে দেওয়া যায়। আগন্তুকের দিকে একটু এগিয়ে যান তিনি… ‘ আসুন আসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন। বসুন আপনি’। মিসেস ব্ল্যাকের গলায় উপচে পড়ে ভরপুর আত্মবিশ্বাস। এই বাজারে যিনি নতুন করে বাড়ি তৈরি করতে পারেন এই আত্মবিশ্বাস তাঁকে সাজে বই কী। অগত্যা বসতেই হয় অতিথিকে।
‘ বলুন মিসেস ম্যানস্টে কী করতে পারি আপনার জন্য?…আমার বোর্ডিং তো এখন ভর্তি। তবে বাড়িটা বাড়িয়ে নেওয়ার পর…’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ওই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে এসেছি। আমার তেমন টাকাকড়ি নেই। সারা জীবনে সুখ পাইনি কখনো। আমার কথা একটু না শুনলে আপনি ব্যাপারটা ঠিক বুঝবেন না’।
এসব কী হাবিজাবি বকতে শুরু করেছেন এই মহিলা। মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না মিসেস ব্ল্যাক।
‘ জানেন জীবনে যা চেয়েছে তা কোনোদিন পাইনি। একটার পর একটা স্বপ্ন ভেঙে গেছে আমার। কত সখ ছিল গ্রামে গিয়ে থাকার। মনে মনে কত রঙিন কল্পনা করেছি। কিন্তু সে সখ আমার পূরণ হয়নি। আমাদের ঘুপচি ঘরের জানালা দিয়ে রোদ আসত না। দিনের পর দিন আলো না পেয়ে আমার গাছগুলো সব মরে গেল। বিয়ের পর মেয়েও দূরে চলে গেল। তাছাড়া ওর হাবভাব… চিন্তা ভাবনা একদম আলাদা। আমার সঙ্গে মেলে না। সতেরো বছর আগে স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে গেলাম আমি। সেই থেকে মিসেস স্যাম্পসনের বোর্ডি-এই রয়েছি। এখন বয়স হয়েছে। শরীরও নড়বড়ে। হাতে পায়ে আর জোর পাই না। ঘর থেকে বেরোতেও পারি না বিশেষ। ওই আবহাওয়া ভালো থাকলে… শরীরে জুত পেলে তবে হয়তো এক আধদিন হয়তো বেরোই। বুঝতেই পারছেন ওই জানালাটা মানে চারতলার পেছনের জানালাটা আমার কাছে কত দামি। ওই জানালা দিয়েই জগতটাকে দেখিআমি’।
‘ ঠিক আছে মিসেস ম্যানস্টে আপনার কোনো চিন্তা নেই। আপনাকে পেছনের দিকের ঘরই দেবো…মানে বাড়ির কাজ শেষ হয়ে হয়ে গেলে একটা নতুন ঘর…’
‘ কিন্তু আমার ওই ঘর ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাই না…আমি পারবই না যেতে’…একেবারে আর্তনাদ করে ওঠেন মিসেস ম্যানস্টে… ‘ না মানে আমি আপানাকে বলছিলাম কি আপনার বাড়িটা এদিকে বেড়ে গেলে আমি জানালা দিয়ে কিচ্ছু দেখতে পাব না। কিচ্ছু না। আপনি কি বুঝতে পারছেন?’
মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি মহিলার। এ তো বদ্ধ পাগল। তবে মিসেস ব্ল্যাক সেই পুরোনো প্রবাদটা খুব ভালোমতোই জানেন পাগলদের সঙ্গে বেশ একটু তামাশা করতে হয়।
‘ ইসস তাই নাকি’…নিজের চেয়ারটাকে একটু পেছনে ঠেলে দেন মিসেস ব্ল্যাক… ‘ এটা তো খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা তো আমি একদম ভেবে দেখিনি। বাড়িটা হলে আপনার তো খু…ব অসুবিধা হবে। জানালা দিয়ে আর কিছুই দেখতে পাবেন না আপনি। আহারে’।
‘ আপনি বুঝেছেন তো?’ উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসে মিসেস ম্যানস্টের।
‘ হ্যাঁ নিশ্চয়ই বুঝেছি। আমার খুব খারাপ লাগছে জানেন তো। তবে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা নিজেদের মধ্যে একটা মিটমাট করে নেব’
চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে ওঠেন মিসেস ম্যানস্টে। ওদিরে দরজার দিকে আরো একটু সরে যান মিসেস ব্ল্যাক।
‘ মিটমাট করে নেবেন! মানে আপনি আপনি আমার কথায় বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত বদল করতে পারেন! ওহ মিসেস ব্ল্যাক আপনি আমায় বাঁচালেন। ব্যাংকে আমার দু হাজার ডলার মতো রয়েছে। তার থেকে মোটামুটি ধরুন…মানে এই ধরুন হাজার ডলার আমি আপনাকে দিয়ে দিতে পারি…মানে আপনি যদি রাজি…’ আর কথা শেষ করতে পারেন না মিসেস ম্যানস্টে। চোখ থেকে অঝোর ধারা নামে।
‘ শুনুন… শুনুন মিসেস ম্যানস্টে…আপনি একদন চিন্তা করবেন না। আমরা নিশ্চয়ই একটা রফা করে নেবখন। কিন্তু আজ আর আপনাকে বেশি সময় দিতে পারছি না। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। বোর্ডারদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আসলে এই সময়টায় দম ফেলার ফুরসৎ পাই না’।
দরজার ছিটকিনিটা খুলে সবে যেই না তিনি পালাতে যাবেন অমনি মিসেস ম্যানস্টে উঠে এসে শক্ত করে চেপে ধরে তাঁর হাত… ‘ আপনি কিন্তু স্পষ্টাস্পষ্টি কিছু বললেন না মিসেস ব্ল্যাক। আপনি কি আমার প্রস্তাবটা মেনে নিচ্ছেন’।
‘ ওটা নিয়ে আমায় একটু ভাবতে হবে মিসেস ম্যানস্টে। আমি নিশ্চয়ই ভাবব। পৃথিবীর কোনো কিছুর জন্য আপনাকে আমি কষ্ট দেব না’।
‘ কিন্তু আমি যা শুনলাম কাল থেকেই আপনার বাড়ির কাজ শুরু হচ্ছে’…মিসেস ব্ল্যাকের মুখের কথায় ঠিক ভরসা করে উঠতে পারেন না তিনি।
একটু ইতস্তত করেন করেন মিসেস ব্ল্যাক। এখন যা হোক কিছু একটা বলে এই বুড়ির হাত থেকে বাঁচতে হবে… ‘ না না কাল থেকে কাজ শুরু হবে না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আজ রাতেই ঠিকাদারকে আমি জানিয়ে দেব’। মিসেস ম্যানস্টে আরো শক্ত করেন তাঁর হাতের বাঁধন। কিছুতেই পালাতে পারে না মিসেস ব্ল্যাক।
‘ মিসেস ব্ল্যাক, আপনি আমায় ঠকাচ্ছেন না তো?’
এই কথার কী জবাব হয়! তোতলাতে শরু করেন মিসেস ব্ল্যাক… ‘ আরে না না। আপনি আমাকে এত খারাপ ভাবতে পারলেন!’
মিসেস ম্যানস্টের হাতের মুঠি আলগা হয়ে আসে। হলঘর দিয়ে বেরোনোর সময় নিজের মনেই বিড়বিড় করেন … ‘এক হাজার ডলার’। অশক্ত নড়বড়ে পায়ে মাঝে মাঝেই হোঁচট খেয়ে পড়েন। রাস্তার রেলিংটা ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নেন।
ওদিকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন মিসেস ব্ল্যাক। তড়িঘড়ি দরজায় খিলটা তুলে দেন… ‘ আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল দেখছি। ওই মহিলার মাথায় যে এত ছিট রয়েছে আগে জানতাম না তো! সবসময় কেমন ভেজেবেড়াল সেজে থাকেন! আর হাবভাব তো পুরো উঁচু ঘরের মহিলাদের মতো!’
রাতে সেদিন বড় আরামে ঘুমোলেন মিসেস ম্যানস্টে। হাতুড়ি পেটার টং টং আওয়াজে পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। এক ছুটে জানালার কাছে গিয়ে তাঁর তো চোখ কপালে। মিসেস ব্ল্যাকের উঠোনভর্তি মিস্ত্রি, কুলি…কামিন। কেউ কেউ রান্নাঘর থেকে ভারি ইঁট বয়ে আনছে উঠোনে…কেউ না আবার পুরোনো বাড়ির কাঠের ব্যালকনিগুলো ভাঙতে ব্যস্ত। অনেক সখ করে বাড়ির প্রতিটা তলায় কাঠের ব্যালকনি বসিয়েছিলেন মিসেস ব্ল্যাক। এখন সেগুলো পুরোনো…সেকেলে। কথা রাখেননি মিসেস ব্ল্যাক। ভীষণ ঠকে গেছেন মিসেস ম্যানস্টে। এ বাড়ির মালকিন মিসেস স্যাম্পসনকে পুরো ব্যাপারটা জানালে কেমন হয়! না থাক। কী হবে আর জানিয়ে। ভাঙাচোরা মন নিয়ে স্খলিত পায়ে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়েন তিনি। আর জানালার ধারে তিনি যাবেন না। ওদিকে উঠোনে কী হচ্ছে না হচ্ছে আর ফিরেও তাকাবেন না।
বিকেলের দিকে মনটা আবার আনচান করে। ওদিকে কী হল না হল বড় জানতে ইচ্ছে করে। সবচেয়ে খারাপ খবরটার জন্য মনকে তৈরি করে নেন। বিছানা থেকে উঠে জামা কাপড় পরে নেন। আজকাল জামা-কাপড় পরাটাও তাঁর কাছে বড় ঝক্কি। জামার বোতাম লাগাতে গিতে হাত কেঁপে যায় বারবার। বোতামের ঘরগুলো ভালো করে চোখেও দেখতে পান না।
আবার জানালার ধারে গিয়ে বসেন তিনি। ও বাড়ির উঠোনে কুলি কামিনরা ব্যালকনির ওপরের অংশ ভেঙে ফেলেছে। উঠোনে এখন সারি সারি ইঁট। কই এত ইঁট তো সকালে ছিল না। হুমদো মুখো এক চ্যাংড়া ছেলে একটা ম্যাগনোলিয়া ফুল ছিঁড়ে নেয়। একবার গন্ধ শুঁকেই সেটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পরে মাথায় ইঁট নিয়ে আরেক কুলি ফুলটা মাড়িয়ে চলে যায়।
ওই দুই ছোঁড়ার মধ্যে আরাম করে পাইপ টানছেএকজন । তাই দেখে হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে অপরজন… ‘ দেখো জিম এখানে কিন্তু দেশলাই কাঠি টাঠি ফেলো না। একবার ওই কাগজের বস্তায় গিয়ে পড়লে আর আর দেখতে হবে না। পুরো বাড়ি জ্বলে যাবে’।
মিসেস ম্যানস্টে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন ও বাড়ির কাঠের ব্যালকনির নীচে বস্তা বস্তা কাগজ আর রাবিশ।
সন্ধে নেমে আসে। মিস্ত্রিদের কাজ বন্ধ হয়। কমলালেবুর মতো সূর্যটা আকাশে রঙ ছড়িয়ে দিগন্ত রেখার ওপারে হেলে পড়ে। ওই দূরের মিনারটার গায়েও লাগে গোধূলির রঙ। আঁধার ঘনিয়ে এলে জানালার পর্দাটা টেনে দেন মিসেস ম্যানস্টে। এবার লন্ঠনটা জ্বালতে হবে। যন্ত্রের মতো লন্ঠনটা বের করে তেল ভরে আগুনটা ধরান তিনি। এই কাজটা রোজ নিজের হাতেই করেন তিনি। লন্ঠনটা জ্বালিয়ে কেরোসিনের ডিবেটা রেখে দেন কুলুঙ্গিতে। এখনো খানিকটা কেরোসিন রয়েছে ওর মধ্যে। ঘরে ছড়িয়ে পড়ে লন্ঠনের নরম আলো। এই শান্ত সন্ধেয় এ ঘরের বাসিন্দার মতোই তাঁর যত বইপত্র, ছবি, তাঁর হাতে লাগানো সব গাছও যেন ঝিমিয়ে পড়ে। রোজকার মতো টেবিলের কাছে চেয়ারটা টেনে আবার উল কাঁটা নিয়ে বসেন মিসেস ম্যানস্টে।
সে রাতেই চোখের পাতা এক হয় না তাঁর। বাইরে হাওয়ার শোঁ শোঁ গর্জন। কালো মেঘের আড়ালে তারারা সব মুখ ঢেকেছে। হাতের কাজ ফেলে বার বার জানালার কাছে ছুটে যান মিসেস ম্যানস্টে। জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখেন। উলটো দিকের বাড়ির জানালায় শুধু লন্ঠণের টিমটিমে আলো। সে আলোও নিভে যায় খানিক পরে। পিচ কালো অন্ধকারে ঠাওর করা যায় নাকিছু । এক চিলতে আলোও নেই কোথাও। এরই মধ্যে রাত পোশাকের ওপর ঝটাপট পাতলা ড্রেসিং গাউনটা চাপিয়ে নেন তিনি। একটা স্কার্ফ জড়িয়ে নেনমাথায় । কুলুঙ্গি থেকে চুপিচুপি কেরোসিনের ডিবেটাও নিয়ে নেন। আর জামার পকেটে নেন কয়েকটা দেশলাই কাঠি। দরজা খুলে পা টিপে টিপে বাইরে বেরোন তিনি। সিঁড়ির ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকার হাতড়ে নামতে থাকেন তিনি। হলঘর থেকে গ্যাসের বাতির ক্ষীণ আলো ভেসে আসে। তিনি নেমে আসেন অন্ধকার বেসমেন্টে। যাক এবার একটু শান্তি। এখানে তাঁর পায়ের আওয়াজ আর কেউ শুনতে পাবে না। আর দেরি না করে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসেন উঠোনে। বাইরে বেরোতেই বরফ-ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা মেরে যায় তাঁর চোখে মুখে। হাড়েও যেন কাঁপন ধরে যায়। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে তিনি এগিয়ে চলেন তাঁর লক্ষ্যে।
দমকলের পাগলা ঘণ্টিতে ভোর তিনটে-তে ঘুম ভেঙে গেল গোটা পাড়ার। মিসেস ব্ল্যাকের বাড়ির উঠোনে দমকলের গাড়ি। মিসেস স্যাম্পসনের বোর্ডারদেরও চোখে মুখে আতংক। জানালা দিয়ে সবার নজর মিসেস ব্ল্যাকের বাড়ির দিকে। মিসেস ব্ল্যাকের বাড়ির পেছনদিকের কাঠের ব্যালকনিতে আগুন লেগেছে। জানালাটা হাট করে খুলে দিয়ে আগুনের ধ্বংসলীলা দেখেন মিসেস ম্যানস্টে। তাঁর পরনে এখনো সেই ফিনফিনে ড্রেসিং গাউন।
দমকলের চেষ্টায় আগুন তো নিভে গেল কিন্তু বাড়ির বাসিন্দাদের মন থেকে সেই ভয় আর গেল না। যে যেই পোশাকে ছিলেন সেই অবস্থাতেই কোনো রকমে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে বেড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। আগুন নেভার পর হলঘরে জড়ো হয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে যায় তাঁদের। এ নির্ঘাৎ কোনো ফচকে ছোঁড়ার কাজ। শুধু জানালার কাচ ভেঙে আর শান্তি হচ্ছিল না ব্যাটাদের।
এই অগ্নিকাণ্ডে মিসেস ব্ল্যাকের কতটা ক্ষতি হল জানা নেই তবে মিসেস ম্যানস্টে একেবারে শয্যা নিলেন। এই বয়সে নিউমোনিয়া! রীতিমতো চিন্তার কথা। ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। গলা ঘড় ঘড় করে। শরীরের আর দোষ কী! এই ঠান্ডার দিনে একটা পাতলা গাউন চাপিয়ে জানালা দিয়ে অমন ঝুঁকে পড়লে এমনটা তো হবেই। বয়সটাও তো দেখতে হবে নাকি…রায় দিয়ে যায় বোর্ডিং-এর অন্য বাসিন্দারা। মিসেস ম্যানস্টের অবস্থা বেশ খারাপ…কিন্তু কতটা খারাপ সেটা ডাক্তার এসে জানিয়ে দেওয়া মাত্রই মুখ শুকিয়ে যায় সবার। এতটা বাড়াবাড়ি ভাবতে পারেননি তাঁরা। মিসেস স্যাম্পসনের টেবিলের চারধারে সবার জোর আলোচনা চলে। এমনিতে মিসেস ম্যানস্টের সঙ্গে কারোরই বিশেষ দহরম মহরম নেই। তিনি বরাবরই সবাইকে একটু এড়িয়েই চলেন। অন্যদের চেয়ে নিজেকে একটু উঁচুতলার ভাবতেন তিনি। বাকিরাও তাই তাঁর ধারপাশ মাড়াত না। কিন্তু তাও তাঁর এই বিপদের দিনে সবার মন আজ ভার। এতদিনকার সঙ্গী সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে। একজন মহিলা তো বলেই ফেলেন… ‘আজ ওঁর জায়গায় আমি থাকতে পারতাম…আপনিও থাকতে পারতেন’।
কিন্তু এই ঠান্ডায় কারো গায়ে আঁচ লাগল না শুধু মিসেস ম্যানস্টে এই ভয়ানক অসুখটা বাধিয়ে বসলেন। তাঁর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যায়। নিঃসঙ্গ না হয়েও সারাজীবন তিনি যেমন একা রয়ে গেছেন তেমনি মৃত্যুশয্যাতেও আজ তিনি একেবারে একা। রুগির দেখাশোনার জন্য একজন ভালো ট্রেইনড নার্সকে পাঠালেন ডাক্তার। মিসেস স্যাম্পসন পা টিপে টিপে সময়ে সময়ে রুগির ঘরে আসেন। দেখাশোনা করে আবার চলে যান। কিছুই বুঝতে পারেন না মিসেস ম্যানস্টে। তাঁর চোখে সব ঝাপসা। সব স্বপ্নের মতো। কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়েছেন তিনি। মেয়ের ঠিকানা জিগ্যেস করা হলে শুধু ঘাড় নাড়েন। মাঝে মাঝে কান পেতে কোনো শব্দ শোনার চেষ্টা করেন যেন। সব লক্ষ্য করে নার্স। কোনো আওয়াজ না পেয়ে আবার নেতিয়ে পড়েন।
পরদিন সকালে অবস্থা আরো খারাপ হয়। রুগির শ্বাস বুঝি আর চলেনা। বিপদ বুঝে মিসেস স্যাম্পসনকে ডেকে আনে নার্স। বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলছে রুগি। শোনার জন্য নার্স আর মিসেস স্যাম্পসন দুজনেই কান পেতে দেয়… ‘ আমাকে একটু তুলে ধরো…একটু তুলে ধর আমাকে’…ফিসফিসিয়ে ওঠে রুগি।
দুজনে ধরাধরি করে টেনে তোলে তাঁকে। নিজের অসাড় নড়বড়ে হাতখানা রুগি বাড়িয়ে দেয় জানালার দিকে।
‘ ওহ ওই জানালার কথা বলছেন উনি। উনি বোধহয় জানালার পাশে একটু বসতে চান। ওইখানেই তো উনি বসে থাকতেন সারাক্ষণ। এখন ওখানে একটু বসলে আর বেশি কী ক্ষতি হবে বলুন’… গলা ধরে আসে মিসেস স্যাম্পসনের।
‘এখনআর কিছুতেই কিছু যায় আসে না’…জানিয়ে দেয় নার্স।
দুজনে মিলে ওরা জানালার ধারে রুগিকে নিয়ে গিয়ে তাঁর প্রিয় চেয়ারটায় বসিয়ে দেয়। এই তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ। বাইরে বসন্তের ঝলমলে সকাল। দূরের ওই মিনারটায় আজ লেগেছে সোনা রোদের ছোঁয়া। ম্যাগনোলিয়া আর হর্স-চেস্টনাটের গাছটা এখনো যে ছায়ায় ঢাকা! মিসেস ব্ল্যাকের উঠোনে কেউ নেই আজ। খাঁ খাঁ করছে সব। পোড়া কাঠগুলো যেমন কে তেমনই পড়ে রয়েছে। তার মানে মিস্ত্রিরা আর কাজ শুরু করেনি। ম্যাগনোলিয়া গাছে নতুন ফুল ফুটেছে আরো কয়েকটা…যেন কোনো শিল্পীর নিপুণ হাতে গড়া ভাস্কর্য এক। জানালার বাইরে জগতটা রয়ে গেছে ঠিক আগের মতো। কোথাও কোনো বদল হয়নি।
এবার দমবন্ধ হয়ে আসে রুগীর। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে। তিনি ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করেন… ‘জানালাটাকে খুলে দাও। বাইরের আলো দেখতে দাও আমায়’। কেউ বোঝে না তাঁর ইশারা। জানালাটা যদি খোলা যেত তাহলে হয়ত তিনি এইলানথাসের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগত তাঁর…সেই গন্ধে মাতাল হয়ে আবার হয়তো তিনি আগের মতো প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারতেন। তবে যাই হোক জানালা দিয়ে তিনি তাঁর দুনিয়াটাকে দেখে নিয়েছেন। সবকিছু রয়েছে আগের মতো। দূরে ওই বুঝি দেখা যায় সোনার মিনার। আকাশটা আজ বড্ড বেশি নীল। ম্যাগনোলিয়ারাও আজ উন্মুখ হয়ে রয়েছে আলোর পানে।
মিসেস ম্যানস্টের মুখে স্মিত হাসি। আজ আর কোনো খেদ নেই তাঁর। আস্তে আস্তে মাথাটা হেলে পড়ে তাঁর। সব শেষ।
সেদিনই আবার শুরু হয় মিসেস ব্ল্যাকের বাড়ির কাজ।
- ‘জানালা’ গল্পটি এডিথ হোয়ার্টনের ‘মিসেস ম্যানস্টে’জ ভিউ’ গল্পটির অনুবাদ।