গল্প

চিরকূট বিভ্রাট

 চিরকূট বিভ্রাট
-চিন্ময় মহান্তী

 

স্ত্রীর হাতের আয়রন করা নীল সাদা ডোরাকাটা শার্টটি গায়ে দিয়ে, সকাল আটটার সময় বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে পড়লেন প্রণবেশ। প্রণবেশ সান্যাল ফুড সাপ্লাই অফিসে ক্লার্কের পদে কর্মরত রয়েছেন। সকাল দশটায় অফিস যাওয়ার আগে তার নিত্যদিনের  কাজ গিন্নীর নির্দেশমতো বাজার করে দেওয়া। রাস্তায় বেরিয়ে ইউনাইটেড ব্যাংকের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে তার নজর আটকে গেল একটি বিশেষ দৃশ্য দেখে। ক্যাশ কাউন্টারের জানালার নীচ হতে শুরু করে প্রায় পাঁচশ মিটার অবধি রাস্তার উপর অজস্র চিরকূট সারি সারি নামানো। সেই চিরকূটগুলি যাতে হাওয়ায় উড়ে না যায় তার জন্য একটি করে ছোটো পাথর চাপানো হয়েছে তাদের বুকে। প্রণবেশ কৌতুহলী হয়ে ঝুঁকে দেখলেন চিরকূটে শুধু নাম লেখা রয়েছে অমুক রায় তমুক মোহন্ত। চিরকূট হতে মুখ তুলে আশেপাশে চেয়ে দেখলেন অন্য দিনের তুলনায় চায়ের দোকানগুলিতে অনেক বেশি ভিড়। আফিস থেকে ফিরে বিকেলে তিনি এই এলাকার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেন কাজেই সব দোকানদার তার পরিচিত। তিনি একটি চায়ের দোকানে এসে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন , ” হ্যাঁ রে বিল্টু ব্যাংকের সামনে নাম লেখা এতো চিরকূট কেন ? ” বিল্টু কেটলি থেকে মাটির ভাঁড়ে গরম চা ঢালতে ঢালতে বলল , ” ওটা চাকরির ফর্ম তোলার লাইন , দশটার আগে তো ব্যাংক খুলবে না তাই লাইনে না দাঁড়িয়ে এইভাবে লাইন দিয়ে যে যার মতো নাস্তা চা খাচ্ছে। ” ” ওঃ আচ্ছা ” বলে প্রণবেশ বাজারের উদ্যেশ্যে চলে গেলেন।

ঘরে ফিরে তার স্ত্রীকে এই অভিজ্ঞতার কথা বলতেই তিনি বললেন , ” পেয়েছো তো বাবার অকাল প্রয়াণের চাকরি , লাইন দিয়ে ফর্ম তোলার ধকল তুমি কি বুঝবে। বর্তমান যুগের ছেলেপিলেদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ‘ ” তা ভালো ” বলে প্রণবেশ বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। বাথরুমের ভেতর হতে শাওয়ারের জল পড়ার আওয়াজ শোনা গেল।

প্রণবেশের একমাত্র ছেলে এই বছর কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দেবে , কিন্তু আজ দু’তিন দিন হলো সে জ্বরে ভুগছে। এদিকে পরীক্ষার ফর্ম দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রথমে ফর্ম না তুললে পরে যদি না পাওয়া যায় এই আশঙ্কায় প্রণবেশের স্ত্রী অফিস ফেরত প্রণবেশকে ডেকে বললেন , ” শোনো না কাল খোকার এস .এস .সি -র ফর্মটা তুলে এনো। ” প্রণবেশ বললেন , ” ও আর এমন কি বা ব্যাপার , কাল ব্যাংক খুললে প্রথমেই নিয়ে আসবো। এখন আপাতত একটু চা বানিয়ে আনো। ” তার স্ত্রী চা বানাতে চলে গেলেন।

পরেরদিন খুব ভোরে উঠে প্রণবেশ একটি সাদা কাগজে নাম লিখে বেরিয়ে পড়লেন। তার সেই পূর্ব পরিচিত ইউনাইটেড ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের জানালার নিচে রাস্তায় লক্ষ্য করে দেখলেন , না একটাও চিরকূট জমা পড়েনি। তিনি মনে মনে আনন্দিত হয়ে চিরকূটটি জানালার নিচে মাটিতে রেখে একটি ছোটো পাথর চাপা দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।

সকাল ন’ টা বাজে। প্রণবেশের স্ত্রী প্রণবেশকে বললেন  ” কই গো যাও , খোকার ফর্মটা তুলে আনো। ” স্ত্রীর তাড়া খেয়ে প্রণবেশ সোফা থেকে গা ঝেড়ে ওঠেন।

ব্যাংকে পৌঁছে তিনি দেখেন , ট্রেনের বিশটা বগি পরিমান দীর্ঘ লাইন। প্রণবেশ ক্যাশ কাউন্টারের জানালার সামনে গিয়ে দেখেন তার রেখে যাওয়া চিরকূট বেচারা জনতার পদাঘাত  সহ্য করতে না পেরে কোথায় কেটে পড়েছে। তিনি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার দেখা পেলেন না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ক্যাশ কাউন্টারের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে লোককে বললেন , ” বলি মশায় এই জায়গাটা আমার। আমি ভোরে এসে এখানে চিরকূট রেখে গিয়েছিলাম। ” ভদ্রলোক তার কথা শুনে হো হো করে হেসে বললেন , ” আরে মশায় আমি গতকাল রাত্রে চিরকূট রেখে গেছিলাম ।” প্রণবেশ সেই ভদ্রলোকের রাখা চিরকূট দেখতে চেয়ে বললেন , ” কই দেখান তো দেখি কেমন আপনি চিরকূট রেখে গেছিলেন ?  আমি তো আমার আগে কোনো চিরকূট থাকতে দেখিনি। ” ভদ্রলোক আবারো হো হো করে এক গাল হেসে বললেন , ” মশায় আপনার চিরকূট যেমন এখন হাওয়া খেতে গেছে আমারটাও বোধ হয় তখন সেটাই করছিল , তাই আপনি দেখতে পাননি। চিরকূট যখন নেই যান পিছনে গিয়ে লাইন দিন। প্রণবেশ সান্যাল পরে এসে লাইনের সামনে ঢোকার ধান্দা করছেন ভেবে লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন , ” ও মশায় ওখানে কি করছেন ? যান লাইনের পিছনে দাঁড়ান। ” বেগতিক বুঝে প্রণবেশ চুপি চুপি লাইনের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চিরকূট বিভ্রাটের শিকার হয়ে তিনি লজ্জিত বোধ করতে লাগলেন। একমাত্র ছেলের কথা চিন্তা করে এবং খালি হাতে ফিরে গেলে স্ত্রীর মুখ ঝামটার সম্মুখীন হতে হবে ভেবে প্রণবেশ ধীরে ধীরে লাইনের তালে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগোতে লাগলেন। নিজের মন স্থির করার জন্য তিনি এক থেকে একশত পর্যন্ত উল্টো দিক থেকে গুনতে লাগলেন। কিছুক্ষন এইভাবে চলার পর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের মধ্য হতে গুঞ্জন উঠল আর মাত্র দশটি ফর্ম আছে , সেগুলি শেষ হলেই আজকের মতো ফর্ম দেওয়া শেষ হবে , কাল আবার ফর্ম এলে দেওয়া হবে। গুঞ্জনের প্রভাবে প্রণবেশের বিষণ্ণ মুখ দেখা গেল।

Loading

2 Comments

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

You cannot copy content of this page