বদল
-চিন্ময় মহান্তী
১
তখনও মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় হয় নাই । বৃদ্ধ কানাইলাল উঠানের আমগাছটির তলে টুল পাতিয়া বসিয়া বাটিতে খানিক সরিষার তৈল লইয়া সারা গাত্রে ঘষিয়া ঘষিয়া মাখিতেছেন । তাহার বড় খোকা নিমাই একটি চৌকো প্যাকেট হাতে ঘরে ঢুকিতেছে দেখিয়া কানাইলাল তাহাকে তাহার নিকটে ডাকিয়া জানিতে চাহিলেন , ” বড় খোকা তোর হাতে ওটা কি ? ” বড় খোকা কাঁচুমাঁচু করিয়া উত্তর দিল , ” একটা ভালো মোবাইল কিনলাম বাবা , তোমার বৌমা অনেকদিন থেকে চাইছিল । ”
” আচ্ছা । তোর মোবাইলে তার চলছিল না । ইস্পেশাল চাই । দাঁড়া বুঝবি , কালবৈশাখীতে গরমের ধানশিষ সব সাদা দেখাচ্ছে । সংসারে টান পড়লেই বুঝবি ! ” বলিয়া রাগে গজগজ করিতে করিতে বৃদ্ধ কানাইলাল গামছাটি কোমরে কষিয়া বাঁধিয়া লইয়া স্নানের নিমিত্তে রায় পুষ্করিণীর অভিমুখে চলিলেন । নিমাই বাপের উপদেশে যে বিরক্ত হইয়া ঘরে ঢুকিল তাহা যে কেহ তাহার মুখ দেখিলেই বুঝিতে পারিতেন । ঘরে ঢুকিয়া প্যাকেটটি তাকে রাখিয়া সে ধেড়ে গলায় ডাকিল , ” বিনতা , ও বিনতা , বলি একবার এদিকে এসো । ” তাহার স্ত্রী রন্ধনগৃহ হইতে বলিল , ‘ যাই । ‘
” আরে তাড়াতাড়ি আসবে তো । ” বলিয়া নিমাই ঘর মধ্যস্থিত একটি চেয়ারে ধপ্ করিয়া বসিয়া পড়িল । তাহার স্ত্রী আঁচলে হাত মুছিতে মুছিতে ঘরে ঢুকিয়া নিমাইয়ের নিকট গিয়া বলিল, ‘ বলো । ‘ নিমাই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিল , ” তোমার কথা মতো মোবাইল কিনতে গিয়ে আজ বাবার কাছে কথা শুনতে হলো । তুমি কি জানো না সংসারটা চাষের উপর নির্ভর । ফালতু বিলাসিতা আমাদের চলে না । ” নিমাইয়ের কথার ঝাঁজ শুনিয়া মনে হইল , কেহ সর্পের লেজে পা দিয়াছে আর সর্পটি ফোঁস ফোঁস করিয়া তাহার পায়ে চোট মারিয়া আপনার আত্মরক্ষা করিতেছে । বিনতা অধোবদনে নিমাইয়ের কথার ঝাঁজ হজম করিতেছিল । এমত সময় তাহাদের একমাত্র কন্যা বিনি আসিয়া কাঁধ হইতে ব্যাগটি নামাইয়া পিতার রক্ত চক্ষু দেখিয়া কিছু বলিতে সাহস করিল না । সে নত মস্তকে বাহির হইয়া গিয়া তাহার কলেজ পড়ুয়া ভগ্নী রিনির নিকট গিয়া তাহার হাত হইতে শামুকগুলি লইয়া সস্নেহে বলিল , ” নে নে আমিও ছড়িয়ে দি । এতোগুলো তুই একা ছাড়াতে পারবি না । ” রিনি দিদির মুখপানে একবার চাহিয়া পুনরায় আপন কর্মে মগ্ন হইল । বিনির আবদারে বিনতা যে স্বামীর নিকট একটি ভালো ফোনের আবদার করিয়াছিল তাহা গোপন করিয়া নিমাইয়ের বাক্য ঝাঁজ সহ্য করিয়া লইয়া সে পুনরায় রন্ধন গৃহে প্রবেশ করিল । নিমাই ক্রোধে গজগজ করিতে করিতে অবগাহনের উদ্দেশ্যে রায় পুষ্করিণীর অভিমুখী হইল ।
বৃদ্ধ স্নান সমাপন করিয়া আসিয়া গামছাটি উঠানের বেড়ায় মেলিয়া দিয়া আমগাছটির তলে পূর্বস্থিত টুলটিতে বসিয়া গৃহের প্রতি মুখ করিয়া উচ্চস্বরে ডাকিলেন , ” কই রে নিতাই একবার এদিকে আয় তো । ” নিতাই , কানাইলালের কনিষ্ঠ পুত্র । সে ঘর হইতে পিতার ডাক শুনিতে পায় নাই । দাদুর ডাকে পিতা আসিতেছেন না দেখিয়া নিতাইয়ের কন্যা রিনি শামুকগুলি দিদির হেফাজতে দিয়া পিতাকে ডাকিতে গেল । নিতাই একটি খাটিয়ায় শুইয়া গান শুনিতে শুনিতে প্রাতের ক্ষেতকর্মের ক্লান্তি উপশম করিতেছিল । দাদুর তলব হইয়াছে ইহা কন্যার নিকট শুনিয়া সে তড়িঘড়ি উঠিয়া পিতার নিকট গিয়া তাহার তলবের কারণ জানিতে চাহিল । কানাইলাল পুত্রের প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” এবার থেকে সংসারের আয় ব্যয়ের হিসাব তুই রাখ । ” নিতাই বিস্মৃত হইয়া পিতার এরূপ সিদ্ধান্তের কারণ জানিতে চাহিল । কানাইলাল এক পুত্রের নিকট আরেক পুত্রের অপরিমিত ব্যয়ের কথা সবিস্তারে বলিলেন । সমস্ত শুনিয়া নিতাই বলিল , ” কিন্তু বাবা , এখনই এরূপ আচরনে দাদা মনক্ষুন্ন হবে । ” বৃদ্ধ পুত্রের যুক্তি মানিতে সম্মত হইলেন না । অগত্যা নিতাই পিতার প্রস্তাবপত্রে শীলমোহর লাগাইয়া পুনরায় আপন কক্ষে প্রবেশ করিল । পিতা এবং পুত্রের সমস্ত বাক্যালাপ বিনতা রন্ধনশালা হইতে কান পাতিয়া শুনিতেছিল । স্নান সারিয়া নিতাইয়ের বধূ মিনতিকে রন্ধনগৃহাভীমুখে আসিতে দেখিয়া বিনতা খুন্তি লইয়া রন্ধনে ব্যস্ত রহিয়াছে এইরূপ একটি ভাব করিল । তাহার এই অভিনয় যদি কোনো নামী অভিনেত্রী দেখিতেন তিনিও পরাজয় স্বীকার করিয়া লইতেন ।
মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করিয়া সকলেই উঠিয়া পড়িয়াছে । দুই বধূ এঁটো বাসন লইয়া পুষ্করিণীর ঘাটে ধুইতে গিয়াছে । বৃদ্ধ কানাইলাল তাহার কক্ষের দেওয়ালে টাঙানো আপন বধূর ফোটোটির দিকে তাকাইয়া বিড়বিড় করিয়া বলিতেছেন , ” জানো কমলা তোমার বড় খোকা আজ আর আমার বাধ্য নেই । সে স্বাধীন হয়েছে । এখন আর কোনো কাজ করতে সে আমার অনুমতি নেয় না । ” বৃদ্ধের এই বিলাপ তাহার স্বর্গগতা স্ত্রী শুনিতে পাইলেন কিনা বলিতে পারি না । কিন্তু একজন শুনিতে পাইল সে নিতাইয়ের কন্যা । সে কিছু একটা বলিতে দাদুর নিকট আসিতেছিল কিন্তু দাদু মনকষ্টে রহিয়াছেন বুঝিয়া দরজা হইতেই প্রস্থান করিল ।
২
পৃথিবীর বক্ষে আঁধার নামিয়া আসিতেছে । পাখিরা আপন আপন বাসায় ফিরিয়া আসিতেছে । গৃহাভিমুখী গবাদিপশুর খুরের ধূলি শান্ত বাতাসে পাক খাইতে খাইতে কোথায় বিলীন হইয়া যাইতেছে । বৃদ্ধ এখনো কক্ষ ছাড়িয়া বাহির হন নাই । গৃহের সকল সদস্যই একবার করিয়া দরজা হইতে গোপনে আড়ি পাতিয়া দেখিয়া লইয়াছে , তিনি তাকিয়ায় হেলান দিয়া কিছু একটা ভাবিতেছেন । কেহ কিছু বলিতে সাহস করে নাই । অবশেষে গৃহের গুমোট ভাব কাটাইতে রিনি হস্তক্ষেপ করিল । সে দাদুর নিকট গিয়া বলিল , ” দাদু চা খাবে এসো । ” বৃদ্ধ চিন্তার ঘোর কাটাইয়া রিনিকে বলিলেন , ‘ চল । ‘ তিনি বাহিরে আসিয়া বারান্দায় বসিয়াই দুই পুত্রকে তলব করিলেন । দুই পুত্র আসিয়া তাহার নিকটে বসিল । রিনি দাদুর জন্য চা লইয়া আসিল । রিনির হাত হইতে চায়ের পেয়ালাটি লইয়া বৃদ্ধ নিমাইয়ের প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” বড় খোকা তুই সংসারের আয় ব্যয়ের হিসাব তোর ভাই কে বুঝিয়ে দে । ” নিমাই পূর্বেই বুঝিয়াছিল ইহাই তলবের মুখ্য কারণ। সে স্নান সমাপন করিয়া আসিয়া যখন আপন কেশ প্রসাধন করিতেছিল তখনই তাহার স্ত্রী আসিয়া উক্ত ব্যাপারে নিতাইয়ের সহিত তাহার পিতার আলোচনাটি সবিস্তারে বর্ননা করিয়াছে । কিন্তু ইহা বলে নাই যে নিমাইয়ের ভ্রাতা ইহাতে আপত্তি করিয়াছিল, পিতা তাহার আপত্তি না মঞ্জুর করিয়াছেন । তখন হইতেই নিমাইয়ের মনে ভ্রাতার প্রতি একটি বিরাগ জন্মাইয়াছে । যাহা সে ভ্রাতার নিকট প্রকাশ করে নাই । পিতার আদেশ মতো নিমাই সংসারের সমস্ত হিসাব , খাতা খুলিয়া বুঝাইয়া দিল। নিতাই দাদার মুখপানে চাহিয়া দেখিল তাহার বদন শুষ্ক দেখাইতেছে , যাহার উপর অপমানিত হইবার একটি স্পষ্ট রেখা ফুটিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু পিতার মুখপানে চাহিয়া সে দাদাকে সহানুভূতি দেখাইতে সাহস করিল না। এ স্থলে নিজ হাতে সংসারের আয় ব্যয়ের হিসাব রাখিবার একটি সুপ্ত বাসনা যে তাহার অন্তরে রহে নাই তাহা বলিলে নিতান্তই মিথ্যা বলিতে হইবে। যৌথ সংসারে থাকিয়া আপন কর্তৃত্ত্ব ফালাইতে কে না চাহে ! নিতাইও যে অনুরূপ তাহা উক্ত সময় তাহার বদন অবলোকন করিলে যে কেহ সম্যক অনুধাবন করিতে পারিতেন।
হিসাব বুঝাইয়া দিয়া নিমাই আপন কক্ষে প্রবেশ করিয়া হস্তে মস্তক স্থাপিত করিয়া শুইয়া পড়িল তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে বিনতাও প্রবেশ করিয়া নিচু স্বরে বলিল , ” কি গো শুয়ে পড়লে যে ? ” নিমাই সেইরূপ শুইয়াই বলিল , ” তোমার কথা শুনতে গিয়েই এমন অপমানে পড়তে হলো। ”
” আমি কি অন্যায়টা করেছি শুনি। তোমার মেয়েই তো সেদিন বললো , ‘ মা , বাবাকে বলো না একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিতে নইলে আমার বান্ধবী মহলে সন্মান একেবারে ধুলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে , ‘ আমি তো তাই এতো জেদ করে বসলাম। ” নিমাই নরম স্বরে বলিল , ” তুমি তো জানো আমাদের সংসারে দুটো মেয়েই বড় হয়ে উঠছে , তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে ; তুমি মেয়েকে তো এটা বোঝাতে পারতে। ” নিমাই নরম স্বরে কথা বলিতেছে দেখিয়া বিনতার বাক্যের অগ্রগতি হইল , সে বলিল , ” যৌথ সংসার থেকে মেয়েকে সব কিছু দিয়ে না রাখলে যখন একার সংসার হবে তখন কি দিতে পারবে! যত পারবে মেরে মুরে জমিয়ে নেওয়া আর সখ মিটিয়ে নেওয়াই ভালো। এত উদার হলে এযুগে চলে না। ” বিনতা তাহার স্বামীর কর্ণে যেরূপ মন্ত্রনা প্রবেশ করাইতে লাগিল তাহা আদি মহাকাব্যে বর্নিত মন্থরা দাসীও করিত কিনা বলা দুরূহ। নিমাই স্ত্রীর এইরূপ বাক্যে কিঞ্চিৎ বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল , ” তুমি তো আগে এমন বলতে না ইদানীং হঠাৎ …..” বিনতা এত তাহার স্বামীর প্রশ্নের অসমাপ্ত অংশ না শুনিয়াই জবাব দিল , ” অনেক তো সাধু সেজে দেখলাম , এই সংসারে শুধুই খেটেই গেলাম , নিজের কোনো সখ আল্হাদই মেটাতে পারলাম না। আর যেই মেয়ের সখ মেটাতে গেলাম অমনি তোমার বাবা তোমার হাত বেঁধে দিলেন। তাহলে আর সংসারের কথা ভেবে কি লাভ ! তার থেকে নিজের আখের গুছানো ভালো নয় কি ! ” নিমাই কি বুঝিল পত্নীর বাক্যের সমর্থনে শুধু ‘ হ্যাঁ ‘ শব্দটি উচ্চারণ করিয়া চুপ করিল । তাহাকে দেখিয়া এইরূপ লাগিতেছে যে , মধ্যাহ্ন ভোজোনের পূর্বের সেই ক্রুদ্ধ সর্প স্ত্রীর সম্মুখে অপমান নামক একটি লাঠির ঘায়ে নিহত হইয়া শুষ্ক রজ্জুবৎ পড়িয়া রহিয়াছে ।
বারান্দা হইতে ছোট বৌ , বিনতাকে উদ্দেশ্য করিয়া ডাকিল , ” দিদি আটা মাখা হয়ে গেছে , রুটিগুলো করে নি এসো । ” তাহার ডাক শুনিতে পাইয়া বিনতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাহিরে আসিয়া বলিল , ‘ চল । ‘ নিমাই সেইরূপ শুইয়া থাকিতে থাকিতে নানান চিন্তা করিতে লাগিল । একবার ভাবিল , আগামী কল্যই পৃথক হইয়া যাইবে কিন্তু বিবাহযোগ্যা কন্যা এবং আপন ভাঁড়ারে সঞ্চিত শূন্য অর্থরাশির কথা মনে পড়িতেই সে সিদ্ধান্ত বদল করিয়া লইল । স্ত্রীর কথাকে মান্যতা দিয়া সর্বশেষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইল যে যৌথ সংসারে থাকিয়া কিছু অর্থ সঞ্চিত করিবে । তাহার স্ত্রী বিনতা রন্ধনগৃহ হইতে ডাকিল , ” বিনি মা , তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয় , খেয়ে নে । ” তিন বাপ ব্যাটা পাশপাশি খাইতে বসিল কিন্তু অদ্যকার পরিবেশ পূর্বের অনান্য দিন হইতে পৃথক বলিয়া দৃশ্য হইল ।
৩
বৃদ্ধ কানাইলালের সংসারের সেইদিনের গুমোট পরিবেশ কাটিয়া একটি স্বাভাবিক ছন্দ আসিয়াছে । নিমাই আপনার অন্তরে অপমানের আগুন জ্বালাইয়া রাখিয়াও মুখে একটি শীতলতার প্রলেপ লাগাইয়া আপন সিদ্ধান্ত চরিতার্থ করিবার মতলব করিতেছে । দুই ভাই মিলিয়া ক্ষেত হইতে গরুর গাড়িতে করিয়া ধান আনিয়া খামারে পলুই নির্মান করিতেছে । দুই বধূও রন্ধনের ফাঁকে মধ্যে মধ্যে তাহাদের সহিত হাত লাগাইতেছে । ইহা দেখিয়া কাহারও বুঝিবার ক্ষমতা নাই যে কয়েকদিন পূর্বেই ইহাদের সংসারে একটি ঠান্ডা লড়াই হইয়া গিয়াছে ।
এই বৎসর গরমে ধান একেবারে ভালো হয় নাই , চাষের খরচ ওঠাই মুশকিল , ইহা গ্রামের সকলের মুখে মুখে আলোচ্য বিষয় হইয়াছে । বৃদ্ধ কানাইলাল আমগাছটির তলে বসিয়া পলুইয়ের দিকে চাহিয়া বিষন্ন হইয়া তাহার কনিষ্ঠ পুত্রকে ডাকিলেন । পুত্র তাহার নিকটে আসিয়া বলিল , ” বলো বাবা । ” বৃদ্ধ পুত্রের প্রতি চাহিয়া শুষ্ক কন্ঠে বলিলেন , ” সংসারের খরচ একটু ভেবে চিন্তে করিস বাবা , দেখেছিস তো ধানের কি অবস্থা , বর্ষার ধান না হওয়া পর্যন্ত একটু টেনে টুনে চলতে হবে । নাতনি দুটো বিয়ের যোগ্যা হয়ে উঠেছে সেটা মাথায় রাখিস । তোর দাদা যদি দশ হাজার টাকা দিয়ে মোবাইল না কিনতো তাহলে ঐ টাকায় মাস তিনেক সংসার চলে যেতো । ” ‘ ঠিক আছে বাবা ‘ বলিয়া পিতাকে সমর্থন করিয়া নিতাই উঠিয়া যাইতে গিয়া দেখিল তাহার দাদা দুই বস্তা ধান সাইকেলে লইয়া কোথায় যাইবে বলিয়া দাঁড়াইয়া আছে, সে নিকটে আসিতেই নিমাই বলিল , ” দে টাকা দে , ধান ভানাতে নিয়ে যেতে হবে ।” নিতাই কড়চা হইতে একটি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া দিল । নিমাই সাইকেল ঠেলিয়া বাহির হইয়া গেল ।
দুই বস্তা ধান লইয়া সাইকেল ঠেলিতে ঠেলিতে নিমাই পাড়ার মুদি দোকনে হাজির হইল । পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী একটি বস্তা খুলিয়া অর্ধেক ধান ওজন করিয়া দিল । দোকানদার সুযোগ বুঝিয়া চলতি বাজার দর অপেক্ষা কিঞ্চিত স্বল্প মূল্য প্রদান করিতেই নিমাই বলিল , ” দাম কম দিচ্ছো যে । ” দোকানদার টাঙি মচে তা দিতে দিতে বলিল , ‘ ‘ খুচরো ধান দিলে একটু কম দাম নিতে হবে । ধানের ধুলো বাদ যাবে তার উপর সটেজ আছে । ” নিমাই স্পষ্ট বুঝিল দোকানদার প্রদর্শিত কারণের সহিত স্বল্প মূল্যের কোনো সম্পর্ক নাই । তথাপি মনে মনে ভাবিল , ” দোকানদার দু পয়সা মেরে আর কি করবে আমি তো অনেকটাই পেলাম । তা ছাড়া চিৎকার করলে লোক জানা জানি হয়ে যাবে । ” সে টাকা গুছাইয়া লইয়া ধান ভানানোর নিমিত্তে কলের উদ্দেশ্যে চলিল । দোকানদার গোঁফে তা দিতে দিতে বিড়বিড় করিয়া বলিল , ” তোরা যদি সংসার বধ না করিস তো আমি বড়লোক হবো কি করে । ” অল্প কয়েকটা টাকায় মোহিত হইয়া সংসারের যে এক বৃহৎ ক্ষতি করিয়া দিল তাহা অষ্টম ফেল নিমাই অনুধাবন করিতে পারিল না ।
ধান ভানাইয়া ঘরে ফিরিয়া অতি সন্তর্পনে চারিদিকে চাহিয়া নিমাই দেখিল পিতা এবং ভ্রাতা কেহই ঘরে নাই । এই সময় উভয়েই স্নান করিতে যায় তাই এই সময়টিকেই সে গৃহে প্রবেশের মোক্ষম সময় স্থির করিয়া প্রবেশ করিয়াছে । সাইকেল হইতে চালের বস্তা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখিয়া সে আপন কক্ষে প্রবেশ করিল । তাহার স্ত্রী তাহাকে ঢুকিতে দেখিয়া একটি মগে করিয়া জল লইয়া আসিল । স্ত্রী হাত হইতে জলের মগ লইয়া জল পান করিয়া পুনরায় সে মগটি স্ত্রীর হাতে দিল । বিনতা মগটি লইয়া রন্ধনগৃহে যাইতে উদ্যত হইতেই নিমাই তাহার হাত ধরিয়া বলিল , ‘ দাঁড়াও । ‘ পকেট হইতে কড়কড়ে দুইটি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া স্ত্রীর হাতে দিতেই বিনতা স্বামীর মুখের প্রতি চাহিয়া মৃদু হাসিয়া নোট দুইটি বালিশের ওয়াড়ের খোলে রাখিয়া বাহির হইয়া গেল । নিমাই খাটিয়ায় শুইয়া পড়িল । তাহার বিবেক আসিয়া মনের দরজার কড়া নড়িয়া প্রশ্ন করিল , ” তুই তো এমন ছিলিনা নিমাই তাহলে আজ কেন এমন প্রতারনার আশ্রয় নিলি ? ” নিমাই ব্যক্তিগত চাহিদার দোহাই দিয়া আপন পিতাকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া শান্তি পাইল ।
বৃদ্ধ কানাইলাল স্নান সমাপনান্তে প্রাত্যহিকের ন্যয় অদ্যও তাহার প্রিয় আমগাছটির ছায়ায় টুল পাতিয়া বসিলেন । রন্ধনে বিলম্ব রহিয়াছে এই সংবাদ তিনি নাতনি রিনির নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছেন । দাদার পশ্চাতে পশ্চাতে নিতাইও বাহির হইয়াছিল । একটি ব্যাগ হাতে সে প্রবেশ করিল । পিতার প্রতি চাহিয়া দ্রুত ঘরে ঢুকিয়া গেল । বৃদ্ধ দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ স্পষ্ট বুঝিলেন নিতাই তাহাকে কিছু গোপন করিল । তিনি বুঝিলেন অর্থের হিসাব হস্তান্তর ফলপ্রসূ হয় নাই । সন্দেহের বশবর্তী হইয়া তিনি নিতাইকে তলব করিলেন । সে আসিতেই তিনি ক্রুদ্ধ স্বরে বলিলেন , ” কি ওটা ? লুকিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেলি । ” নিতাই আমতা আমতা করিয়া বলিল , ” তোমার নাতনির জন্য একটা চুড়িদার নিয়ে এলাম , দু’ দিন পর কলেজে কি একটা পোগ্রাম আছে ,সবাই নতুন পোশাক পরবে বলছিল তাই । ” বৃদ্ধ বলিলেন , ” ওর তো অনেক ভালো পোশাক রয়েছে, তারপরও ……”
” না , মানে …”
” ছিঃ ! তোকে ভালো ভেবেছিলাম । শেষে তুইও অবুঝের মতো কাজ করলি । আসলে তোরা হাতে টাকা থাকলেই খরচ করার জন্য ছটফট করিস । দে যা টাকা পয়সা আছে আমার হাতে দে । তোদের কাউকে আমার বিশ্বাস নেই । ”
নিতাই অধোবদনে ঘরে ঢুকিয়া সংসার খরচের জন্য সঞ্চিত অর্থ আনিয়া পিতার হস্তে সমর্পন করিল ।
বৃদ্ধ কানাইলাল সেই অর্থ লইয়া আপন কক্ষে ঢুকিয়া স্ত্রীর ফোটোটির নিকট গিয়া বিলাপের স্বরে বলিতে লাগিলেন , ” কমলা আমি তোমার দুই ছেলেকেই মানুষ করতে পারিনি কমলা । ওরা ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে । তোমার সাজানো সংসারের ভালো মন্দ বোঝালেও বুঝতে চায় না কমলা । ” তাহার দুই চক্ষু অশ্রু সিক্ত হইল । রিনি দাদুকে ভোজনের নিমিত্ত ডাকিতে গিয়া দেখিল , তিনি কাঁদিতেছেন । সে সদ্য কলেজ হইতে আসিয়াছে তাই কান্নার কারন অনুধাবন করিতে না পারিয়া , আপন ওড়না দিয়া দাদুর অশ্রু মুছিয়া বলিল , ‘ চলো দাদু খেয়ে নেবে । ‘ বৃদ্ধ রিনির সহানুভূতিতে পুলকিত হইয়া কিছু একটা বলিতে গেলেন -তাহার দুই ওষ্ঠ ফাঁকা হইল কিন্তু কোনো বাক্য বাহির হইল না , শুধু দুইটি চক্ষু চাহিয়া রহিল । রিনি উচ্চস্বরে ডাকিল , ” বাবা …….বাবা ………। ”