চিঠি

আমার মমতাময়ী

আমার মমতাময়ী

-রীণা চ্যাটার্জী

 

আমার মমতাময়ী,

সম্বোধনের অধিকার আমার নেই,তার আগেই ছিন্ন হয়ে যাবে আমাদের নিবিড় বাঁধন। আজই তো সেই চরম দিন, পরীক্ষার ফল জানা যাবে। তোমার না কি আমার? বোধহয় আমার… এর ওপর আমার জীবন নির্ভর করে আছে যে! আমার আসার ঘোষণায় যে তোমার সফলতা আংশিক প্রমাণ হয়েছে- শুধু অপেক্ষা জানার তুমি সম্পূর্ণ হবে কি না?

পারলাম না ‘মা’ তোমাকে বোধহয় সম্পূর্ণ করে যেতে,কারণ ফলপ্রকাশ হলেই আমার অস্তিত্ব মুছে দিতে তোমাকে বাধ্য করা হবে.. আমি যে ‘কন্যা ভ্রুণ’ মা! তোমার না দেখা, অজানা তোমারই দুহিতা। আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তোমাকে আবার অবতীর্ণ হতে হবে নতুন পরীক্ষায় সফল হবার জন্য একটি ‘পুত্র-সন্তান’ এর প্রতীক্ষায়।

আমার আসার ইচ্ছা,আশা তোমার কাছেও জানতে চাওয়া হয়নি… আমি তো জন্ম লগ্ন থেকেই বলি। এসেছিলাম হয়তো মিলনের আবেশে… কিভাবে ছিনিয়ে নেবে জানি না মা! অজানা ভয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষায় অন্তিম মুহূর্তের। মাতৃস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে অভয় দেবে,সেই সৌভাগ্যের সময় যে ললাটে নেই। জানি মা তোমার ও কষ্ট হবে আমার জন্য শরীরে মনে…

তবে জানো মা- এই বোধহয় ভালো… তোমার, তোমার সঙ্গে আরো অনেক নারীর অন্তরের নীরবে অশ্রুপাত দেখে মনে হচ্ছে শুরুতেই শেষ হয়ে যাওয়া ভালো। নাহলে সারাজীবনের সাথী তো ভয়, গ্লানি, পরাধীনতা, এই তো তোমাদের পাওনা। যদি এমন হতো আমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে তুমি নির্বিঘ্নে, সকলের আনন্দের শরিক হয়ে আমি আসতাম… কতটা নিশ্চিত থাকতে পারতে আমাকে নিয়ে? ইচ্ছা থাকলেও মন সায় দিতো না… যেমন পারেন নি তোমার মা, তাঁর মা, অগুণতি কত শত সহস্র মা। ‘নখের আঁচড়’, ‘দাঁতের কামড়’ থেকে বাঁচতে তোমার নিরলস প্রয়াস তোমাকে আরো অশান্তির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করতো রোজ, স্বাধীন স্বাভাবিক ছন্দে বাঁচার যে অধিকার নেই আমাদের (ব্যতিক্রম অবশ্য আছে)। তাই অঙ্কুরে বিনাশ ই শ্রেয়।

কিন্তু প্রশ্ন থাকছেই মাগো এই অবোধ মনে… তুমি এলে, তোমার মা এলো,আরো কত মা এলো কত যুগ যুগ ধরে এই পৃথিবীতে… কিভাবে, কোন মহানুভবতায় তোমরা বেঁচে গেলে,বড়ো হলে… সে সব বিভিন্ন চিন্তাধারা, ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি, পরিবেশ। কেউ তোমরা সফল হলে,কেউ বিফল, কেউ প্রতিবাদী,কেউ মুখ বুজে মেনে নিলে সব। কত যুগ তো কেটে গেল– তোমরা সবাই কেন এক হয়ে ভয়হীন,ক্লেদহীন এক পৃথিবী গড়ে তুলতে পারলে না, যেখানে তোমাদের মতামত, আশা , আকাঙ্খা সমান অধিকার পেত। আমাদের ও চলে যেতে হতো না এইভাবে..! তোমরা সমবেত হতে পারলে না কেন? আজো যদি তোমাদের ইচ্ছার প্রতিফলন পরনির্ভরশীল হয়– জন্মের বাঁধনে ডেকো না মা। তাই বা বলি কি করে! সেই স্বাধীনতা তো তোমরা পাও নি …। একটি কথা মনে বারবার আসছে, অপরাধ নিও না,”নারী শূন্য হোক এই ধরিত্রী”। ভালো থেকো বলবোনা বিদায় ক্ষণে… শুধু বলি সবলা হোও, স্বাধীন হোও, স্বীকৃতি নিয়ন্ত্রণে রেখো। সময় আসন্ন,আমাকে  নিশ্চিহ্ন করে দেবার সব আয়োজন সম্পূর্ণ… ফলাফল ঘোষিত যে সবার সামনে। আমাকে চিরতরে মুছে দিয়ে ইচ্ছা সফলের জয়টীকা পড়বে সবাই… তোমার নীরব অশ্রু, এইটুকুই আমার এই ক্ষুদ্র অস্তিত্বের পাওনা।আসি, বিদায়..

তোমার অনাগতা।

Loading

4 Comments

  • Jyotsna Bhhattacharya trivedy

    অপূর্ব লেখা,,, চরম বাস্তবে র নিদারুন ভয়াবহতা র নিপুন ছবি আঁকা হয়েছে লেখার আঙ্গিকে… আবার ও বলি অসাধারন….

  • রীণা চ্যাটার্জী

    লেখা দিয়ে যদি চেতনা ফিরে আনা যেত,তবে সার্থক হতো কলমের আচড়… পরপর ঘটনায় মনে হয় আমাদের এই প্রয়াস ব্যর্থ… ভাবতে হবে হয়তো অন্য কিছু।

Leave a Reply to Jyotsna Bhhattacharya trivedyCancel reply

<p>You cannot copy content of this page</p>