মুক্ত গদ্য

মেয়েরা- সেকাল একাল

মেয়েরা- সেকাল একাল
জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য (ত্রিবেদী)

 

আমি যেদিন জন্মালুম দিনটা ছিলো কোজাগরী পূর্ণিমা, ভরসন্ধ্যে বেলা ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর।
আঁতুর ঘর থেকে সুতীব্র কান্নার আওয়াজ,  সাথে সাথেই ঠানদির চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা– ও দাইমা, কি হয়েছে?

সাথে পিসি ঠাম্মার ও একই জিজ্ঞাসা, ও দাই দিদি , বলো না,,, ছেলে হলো?
দাইমা সসংকোচে একটু গলা তুলে বললেন,-ঘরে নক্ষী এয়েছে গো —!!

—- এবার ও..! গলায় নুন দিয়ে শেষ করো। আর কতো লক্ষী আসবে? অলুক্ষুণে অপয়া বৌ জুটেছে একখান ! বছর বছর মেয়েই বিয়োচ্ছে । কতোবার কইলুম বিশেরে, বাবা, আর এক খান বৌ আন। ওই শাঁখারি পাড়ার ভূবন চক্কোত্তির মেয়ে, আহা রূপে গুণে সাক্ষাৎ লক্ষী ঠাকরুন। ও মেয়ে দেখলিই বোঝা যায়, পুত্রবতী নিয্যস । কিন্তু, সে ছেলে আমার শুনলে তো..!
কয় কি, একটার বেশী বে করবো না, তাতে ছেলে হয় বেশ, না হয় তাও বেশ…শোনো দিকি ছেলের কতা,
আর এ বেটীরে দেখো ! এ তো বছর বছর… হায় আমার পোড়া কপাল…। এখন বংশ রক্ষে হবে কি করে গো..! মরে এক ফোঁটা জলও পাবোনি…!

আমি মায়ের পঞ্চম কন্যা সন্তান, অবশ্য এখন আমরা সংখ্যায় চারজনই, কারণ আমার আগেরটিকে আঁতুড় ঘর থেকেই শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে, আমার অসুস্থ, দূর্বল মায়ের ক্ষণিক অসাবধানতায়।।

আর আজ সত্তর /৭০ বছর পর ও… একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের দোরে কড়া নাড়ছি যখন, তখনও সেই একই ছবি দেখি—

সেদিন পেপারে পড়লাম, এক মা তার সদ্যজাত কন্যা সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করেছেন।  অদ্ভুত আশংকায়,ঘৃণায় বুক কেঁপে উঠলো… এরা কি মা…!!

আরো শুনলাম, এক স্বামী, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ডক্টর এর কাছে গিয়ে বলছেন, আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, সোনোগ্রাফিতে জেনেছি গর্ভে কন্যা সন্তান, দয়া করে অ্যাবরশন…
ডাক্তার তো এই মারে কি সেই মারে। কিন্তু কারণ শোনার পর, তিনিও নিশ্চুপ ক্ষণিক।
তাদের বক্তব্য, মেয়ে হলে বড়ো সমস্যা, এই নির্মম পিশাচ সমাজ এর হাত থেকে তাকে রক্ষা করবো কেমন করে?
ছোটোবেলায় হয় তাকে কাকা, মামা, তুতো দাদারা, অথবা পাড়ার বড়ো কেউ আদরের ছুতোয় খোবলাবে। আর একটু বড় হলে, শহরে হায়নার অভাব নেই!

আমি কর্মসূত্রে থাকি বাইরে, মাসে দু মাসে বাড়ি আসি। গৃহে আমার বৃদ্ধা মা আর স্ত্রী। কে সামলাবে ? রক্ষা করবে বলুন ওই কোমল,কচি প্রাণ ? তার চেয়ে অঙ্কুরেই বিনাশ …!

কিছুদিন আগে একটি মেয়েকে বলতে শুনেছি, মেয়ে সন্তান লালন করা যার তার কর্ম নয়। অনেক বুকের পাটা লাগে, প্রচুর সাহস না থাকলে….!  কিন্তু সত্যি সাহস থাকলেই কি রক্ষা হয়..?  আসলে দিন যতোই বদলাক সমাজ উন্নত থেকে উন্নততর হোক— কিন্তু মেয়েরা তো সেই একই আছে। নারী শরীর — নরম, লোভনীয়, সুস্বাদু–
কথায় আছে, “অপনা মাসে হরিনী বৈরী” — এতো তাই..
হরিণ যেমন নিজের সুস্বাদু মাংসের জন্যই শিকারীর লালসার শিকার হয়, মেয়েরাও তাই…! সুস্বাদু নারী মাংসের লোভেই তো যতো অপকীর্তি।  তাই তো ছাড় পায় না সাত মাসের শিশু বা সত্তর এর বৃদ্ধাও। হোক না সে মাংস একটু কম স্বাদু, তবু নারী মাংস তো…!

পায় না ছাড় H.S. Topper ও… হরিয়ানার শহরতলীর সেই রোগা,কালো,শান্ত,মেধাবী ছাত্রীটি,, সন্ধ্যেবেলা টিউশন পড়ে ফিরছিলো, মুখ চেপে মাঠে টেনে নিয়ে গিয়ে বারো জন মিলে —না না, এক বা দু ঘন্টা নয়, আটচল্লিশ ঘন্টা, পুরো দুটি দিন,
নরখাদকগুলো আঁচড়ে কামড়ে, চিবিয়ে চুষে খেলো…. কি আশ্চর্য, তাতেও সে জ্যান্ত…
কথায় আছে না, কৈ মাছের জান,, মেয়েরা নাকি তাই…! কি অসীম সহ্যশক্তি ওই ঊনিশ বছরের দুবলা পাতলা মেয়েটির । এতো কিছুতেও নিঃশেষ হয়নি তার প্রাণশক্তি।।

আসলে আমরা মেয়েরা তো তাই ! অসীম সহ্যশক্তি নিয়েই আমরা আসি এই ধরায়, বিধাতা হয়তো এমন বিষম অত্যাচার সহ্য করার জন্যই এতো সহ্যশক্তি দিয়ে পাঠান। মোদ্দা কথা এই সত্তর বছর আগেও মেয়েরা যা ছিলো, আজ এই একবিংশ শতাব্দীর অতি আধুনিক, উন্নত, শিক্ষিত এক সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়েও– মেয়েরা সেই একই অবস্থায়–অবাঞ্ছিত, দূর্বল, শুধুমাত্র সুস্বাদু লোভনীয় মাংসের তাল… পুরুষের চোখে আজ ও…

Loading

2 Comments

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

You cannot copy content of this page