হেঁচকী

হেঁচকী
-মানিক দাক্ষিত

কি গেরোয় পড়লাম। থামার নাম নাই। হেঁচকী উঠছে তো উঠেই যাচ্ছে। হেঁচকীর চোটে আমি দুলছি, খাট দুলছে,গোটা বাড়ী দুলে উঠছে। সারাদিন — সারা রাত। আজ নিয়ে তিন দিন। বাড়ীর লোক বিপদের আশু সম্ভাবনা দেখলো।
পাড়ার লোকেরা প্রমাদ গুনলো ; বুঝে নিল–শক্ত ব্যামো।
আর বেশীক্ষণ নয়। অচিরেই পটল তুলবো। আমায়
দেখার জন্য বাড়ীতে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ভিড়। লোকে
লোকারণ্য! সবার মুখে সমবেদনার ঝড়। আহা! মানুষটা
বড্ড ভাল ছিল। বড় তৃপ্তি পেলাম। মরার আগে দেখে
গেলাম–পাড়ার লোকেদের এক-আকাশ ভালবাসার দৃশ্য।
বড় ছেলে সময় নষ্ট করতে চায় না। এক্ষুনি সুপার স্পেশালিটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করাতে চায়। বহুকষ্টে শিবনেত্রে বড়ছেলেকে কাছে ডাকতেই জলভরা চোখে আমার পাশে এসে বসলো। আমি তার হাতখানা বুকের মধ্যে রেখে অনুনয়ের সুরে বললাম–“আমায় নার্সিংহোমে ভর্তি করিসনে বাবা। ওরা আমাকে তো মারবেই, তোদেরকেও ধনে-প্রাণে মারবে। প্রাণে না মারলেও পথের ভিখিরি করে ছেড়ে দেবে। তুই বরং বাড়ীতে একটা ভাল ডাক্তার ডেকে আন।

ছেলের আবার হোমিওপ্যাথীতে এলার্জী।বিশ্বাস নাই। ঐ দু-এক ফোঁটা ওষুধে কিস্যু হয় না। তারকাছে সবটাই বুজরুকি।

নামকরা মেডিসিনের ডাক্তার এলেন। দেখলেন। ভ্রু কুঁচকে একরাশ চিন্তামুখে বললেন–পেসেণ্টের অবস্থা তো দেখছি ভাল নয়। মনে হচ্ছে–কিডনীটা একেবারে ড্যামেজ হয়ে গেছে। প্রেসক্রিপশানে ওষুধ, একগাদা টেস্ট লিখে কড়কড়ে চারটে ৫০০ টাকার নোট পকেটে গুঁজে বিদেয় হলেন।
কপাল মন্দ, কিছুই হলো না। ওষুধ পেটে পড়া মাত্রেই
ওষুধের চাবকানি আর কড়কানিতে হেঁচকীর মাত্রা বেড়ে গেল। বন্ধ হল ওষুধ। পরীক্ষায় হাজার বারো গেল কিন্তু কিছুই ধরা পড়লো না। পাড়ার পদীপিসি হাঁক ছেড়ে বলল, “ওরে, এ রোগ অষুদে সারবে নি। শরীলে হাওয়া নেগেচে। ঝাঁড়ফুক করতি হবে।” ঝাঁড়ফুক হল। কিছুই হল না। শরীর ক্রমশ নিস্তেজ। খাওয়া ঘুম বন্ধ। মনে হল হয়তো আজই শেষ রাত।
অবশেষে গিন্নির তত্‍পরতায় রাত এগারোটায় ডাকা হল হোমিওপ্যাথিক মলয় ডাক্তারকে। এলাকায় বেশ নাম-ডাক আছে। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই হলেও মনে হবে ষাটের কোটায়।
সৌম্যদর্শন। এসে সব শুনে কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে মস্ত বড় একটা ধমক দিয়ে পেটের পিলে চমকে
দিলেন। চীত্‍কার করে বললেন, “জানো, তুমি এ-পাড়ার
কত মানুষের ক্ষতি করেছো? তোমার কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।” আমি হতভম্ব। মাথায় বজ্রাঘাত! ঘেমে নেয়ে উঠলাম। দুর্বল শরীরে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবো……অমনি আবার ধমক–“একদম চুপ, কোন কথা নয়। ভিডিও ফুটেজ আছে ক্লাব সেক্রেটারীর কাছে।

দেখতে পাবে তুমি কাল-ই। নাও হাঁ করো–জিভ বার করো।”
জিভের মধ্যে পরপর তিনফোঁটা ওষুধ ফেলে বললেন,
মুখ বন্ধ করো।” আমি গোবেচারী মানুষ। নিপাট ভদ্রলোক।
কারোর ক্ষতি করবো–আমি ভাবতেই পারি না। ভয়ে আমি বাকরূদ্ধ! এদিক ওদিক উথাল পাথাল করছি। পাশ ফিরে শুলাম। দেখি হেঁচকীটা আর উঠছে না। যতরাজ্যের ঘুম নিমেষেতে আমার চোখে নেমে চোখ দুটিকে বন্ধ করে দিলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে উঠে আমি বিস্ময়ে হতবাক। আমার হেঁচকী আর নাই। আমি একদম স্বাভাবিক। আমি নিজেকে নিজে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার আনন্দে বিছানায় লাফিয়ে চীত্‍কার করে উঠলাম–কোথায় তোমরা? এসো, দেখে যাও, আমি আরও কিছুদিন এই সুন্দর পৃথিবীতে থাকার অনুমতি পেয়ে গেছি।

হারিয়ে যেতে বসা গোটা বিশ্বটা এই মূহুর্তে আমার কাছে বড় সুন্দর বড় মধুর, একান্ত আপন। বড্ড ভাল লাগছে।

Loading

4 thoughts on “হেঁচকী

  1. কৃতজ্ঞচিত্তে আন্তরিক ধন্যবাদ ও একরাশ শুভেচ্ছা।

  2. ভীষণ ভালোলাগলো, ছোটবেলাতে যখন গল্প পড়তাম তখন এমনই গল্পের স্বাদ পেতাম. আজ আবার আপনার গল্পে সেই স্বাদ পেলাম.

Leave A Comment