বর্ষা যখন জীবনজুড়ে
-অঞ্জলি দে নন্দী
বর্ষার জল ঝরে, সারা জীবনজুড়ে, দুনয়ন থেকে। বিয়ে হল। কলকাতার, ধনী ব্যবসায়ী বাবার, সুন্দরী কন্যা। পাত্র বি কম পাস। বেসরকারী চাকুরীরত। হুগলীর, কিন্তু ভাড়া থাকে দুজনে হাওড়ায়। চার বছরে, প্রথমে একটি মেয়ে, বিয়ের এক বছর পরে, ও তার তিন বছর পর আর একটি ছেলে হল। এদের মাঝে হুগলীর, চৈতন্যবাটী, গ্রাম থেকে পড়তে এল ভাই। দাদাবৌদির মাঝে ভাঙ্গন এল। ভাই রয়ে গেল। বউ ও সন্তানরা চলে গেল সেই গ্রামে। এর আগে বউটি কখনও গ্রাম দেখে নি। পরে আর এক ভাই গেল দাদার কাছে থেকে পড়তে, হাওড়ায়। এখানে গ্রামে, শাশুড়ি, শ্বশুর, তিন ননদের নির্যাতনে কাটে বউটির জীবন। এরপর, …….প্রথম মেয়ে, তার তিন বছর পর ছেলে, এরা তো হাওড়ার, সালকিয়াতে থাকার সময়ই হয়েছিল, এবং তার তিন বছর পর, গ্রামে থাকতে থাকতে আর এক মেয়েরও মা হল, সেই কোলকাতা নগরীর মেয়ে, হুগলীর গাঁয়ের বধূটি। হ্যারিকেনের আলো। ইলেক্ট্রিক ফ্যান নেই। ওঃ কি কষ্ট! হাত পাখায় হাওয়া করে করে, গরমে মেয়েদের ও ছেলেকে রাতে ঘুম পাড়ায়। সারারাত চলে, মায়ের ডানহাত। কয়েক বছর পর তাই সে হাত যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগলো। তবুও টিউব অয়েলে পাম্প করে করে দশ মিনিট হেঁটে রোজ সকালে ও বিকালে, বড় বড়, লোহার দশ বালতি করে জল তোলে, এইই ডান হাত। স্বামী প্রতি শনিবার রাতে আসে আর রবিবার বিকালে চলে যায়, হাওড়ায়। পায়খানা নেই, তাই, পত্নী রাতে খায় না। একা রাতে দূরে মাঠে মল ত্যাগ করতে যাবে কি করে? কেউ তো তাকে সাথে করে নিয়ে যাবে না! সে যেখানে শোয়, সে ঘরটি, বেশ অনেকটা দূরে। ও বাড়িতে, বাড়ির অন্য সবাই শোয়। দিনে বউটি সেখানে রান্না করে। সবাইকে খেতে দেয়। আর রাতে দূরে শুতে যায়, বাচ্চাদের নিয়ে। বর্ষায় ছাতা মাথায়। বালতি করে জলও বয়। বাচ্ছাদেরও কাদায় নামায় না। কোলে করে নিয়ে যায়। বিছানায় ছাদ থেকে বর্ষার জল পরে। কড়ি, বর্গার, চুন, সুরকির, চৌকো চৌকো টালি সেট করা, ছাদ তো। অনেক কালের পুরোনো বাড়ী। জোড়া-তক্তপোষের বিছানার ওপরে, জলে ভেজা থেকে রক্ষা করতে, পিতলের কলসী বসিয়ে রাখে, মা-টি, তাই। এতে জল জমে। তিনটে কলসী রাখতে হয়। তিন জায়গায় জল পরে যে! ……. দুচোখ মায়ের জলে ভরে। এভাবেই, সেই সে মা, তার তিন সন্তানকে বড় করতে থাকলো। …….বাবার বাড়ীতে কখনও ভাবে নি, জানেও নি, এ সব, বিয়ের আগে। যাই হোক! …… সন্তানেরা তার সকলেই লেখাপড়াতে খুবই ভালো। মা তাই, আর কষ্টকে মনে করেই না! ……ছেলেটাতো খুবই ভালো পড়া লেখায়! কোলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ পেয়ে এম কম পাস করল। আই সি ডব্লিউ এ তেও ফার্স্ট হল, হাওড়ার মধ্যে। গ্রাম থেকেই যাওয়া আসা করে, পড়ে। দু কাকার জ্বলন হল। মানসিক অত্যাচার করে করেও যখন পারল না, তখন দাদাকে, অর্থাৎ বাবাকে ছেলের বিরুদ্ধে লাগল। তাও ছেলেটি এগিয়ে চলেছে….. হঠাৎ সাইনাস হল। অপারেশন হল। নার্ভের রোগ হল, তাই। কিছু বছর পর, নিজের গ্রামের শোবার ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেল। মা-টি অর্ধ পাগলিনী। চির বর্ষা তার দু আঁখিতে…
গ্রামের নামটি, চৈতন্যবাটী, জেলা, হুগলী। বাংলা। ভারত। ছেলেটির নাম, আশিস নন্দী। মায়ের নাম, সবিতা নন্দী। যদি পার, সেখানে গিয়ে দেখে এসো, সেই সে ছেলে ও মায়ের শোবার ঘর। মাও এখন আর নেই। ছেলের কাছেই চলে গেছে, স্বর্গে। ঘরটি কিন্তু ঠিক আগের মতোই আছে। ছেলেটি যে মৃত্যুর আগে মায়ের কষ্ট দূর করার জন্য সারিয়েছিল। এক বছর তাই আর ছাদ থেকে বর্ষার জল, বিছানায় পড়ত না। আর সারানোর এক বছর পরই সেই সে ঘর হল তার, শেষ শোবার ঘর। তার স্কলারশিপের পাওয়া টাকা মায়ের নামে নমিনি করে, পুত্র রেখে গেছে। মায়ের চক্ষে এক বিন্দুও আর জল নেই। বাবা তো ছেলের মৃত্যুর পর ও চাকরী করত। কারোর বারণ শুনত না। আর মা তো রান্না করে করে গ্রামের সবাইকে নিজের হাতে বাড়ীতে বসিয়ে খাওয়াতো। ছেলের মৃত্যুর সাত বছর পরে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল পিতা। ছেলের মৃত্যুর দশ বছর পর মাও ক্যান্সারে মারা গেল। বেঁচে থাকতে ওরা, কত মানুষকে ক্যান্সারের জন্য নিজেদের খরচায় চিকিৎসা করিয়েছে। আর ছেলেটি তো কত ছাত্রকে বিনা খরচায় নিজে নিজের ঘরে বসিয়ে বি কম-এর পড়া পড়িয়েছে। তাদের জীবন গড়ে দিয়েছে। আর সেই সে ঘরেই সে নিজের হাতেই আপন জীবন শেষ করল…………আজও সেই সে ঘরটি তার কমার্সের বইয়ে ভরা আছে……
Thanks