কবিতা

একলা

একলা
-রাখী সরদার

 

 

বাবলু
তোর মনে আছে আজকের দিনের কথা?
মনে নেই নারে?
আজকেও জানলা গলে একথালা চাঁদের
আলো ঢুকে পড়েছে পশ্চিমের ঘরে।
উঠোনের কোল জুড়ে বেলি ফুলের
ঝকঝকে হাসি
কতকগুলো সিঁদুরে আম অপাংক্তেয় ভাবে
পাঁচিল ঘেষে ঝুলে।
বৃদ্ধ ব‌ইয়ের তাক নির্জীব হয়ে পড়ে আছে
প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় বসবাস করছে—
শুধু তুই এখানে উপস্থিত নেই।

বাবলু
সমুদ্র পারের দেশে তুই এখন কি করছিস?
সেই বড় কালো গাড়িটা কিনেছিস নারে?
ছোটবেলায় কাগজে বিজ্ঞাপন বিভাগে তুই হাঁ করে
বড় কালো গাড়ির ছবি দেখতিস আর বলতিস—
‘মা,বাবা, দেখ বড় হয়ে এই গাড়িটা আমি কিনবো’
তুই হয়তো এখন দামী গাড়িতে বসে ঝকঝকে
শহরের রূপ দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরছিস—
আর আমি—আমার এই ভাঙা মাটির বিশ্বকে
আগলে বসে দিন গুনছি।

প্রতিদিন যখন উত্তর থেকে দক্ষিণে মাথার উপর দিয়ে ছোট্ট একটা দাগ কেটে যাওয়া শব্দ শুনতে
পাই-ছুট্টে বেরিয়ে আসি–ভাবি এই প্লেনেই
হয়তো তুই ফিরে আসছিস।

স্মৃতির পথে আজ একটু বেশিই হাঁটছি বোধ হয়।
এক দূর্গা ষষ্ঠীর সকালে আমার সিঁদুর
চুরি হয়েছিল।
তুই তখন হাঁটি হাঁটি পায়ে উঠোনে জল ফেলে
কাদা মেখে ঘুরে বেড়াতিস।
সেদিন তোর ঠাম্মা বুকে পাথর চাপিয়ে ধবধবে
শাঁখা গুড়িয়ে দিয়েছিল আর বলেছিল–‘ব‌উমা
বাবলুকে যে মানুষ করতে হবে।’

পেটে দাউ দাউ খিদের আগুন জড়িয়ে তোর বড় হয়ে ওঠার স্বপ্নে ঘুমিয়ে পড়তো আমার
প্রতিদিন।
তোর শরীরের একবিন্দু রক্ত ক্ষুধার্ত মশা নিজের
জঠরে যাতে না ঢোকাতে পারে সেদিকে কড়া নজর ছিল তোর ঠাম্মার।
বড় ভালোবাসতো তোকে।
আষাঢ়ের ব্যাঙ ডাকা রাতে তুমুল বৃষ্টি মাথায়
মোড়ের চা দোকানে তোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতো প্রতি বুধবার।

কি আনন্দ সেদিন হয়েছিল কি বলবো
মেসোর চায়ের দোকানে খবরের কাগজে
বাবলু তোর পাতা জোড়া ছবি!
সবাই–সবাই অনেক স্বপ্ন দেখার আশ্বাস দিয়েছিল।
সেই স্বপ্নগুলো আজ দল বেঁধে ব্যঙ্গ করে চলেছে
ঘর জুড়ে।

এখনও মনে পড়ে,
ভাঙা ভাঙা মেঘ ঢাকা ভোর রাতে তুই উড়ে
গিয়েছিলি ওই দূর দেশে।
দম ফেটে যাচ্ছিলো তাও বুক বেঁধে তোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
আর ফিরিস নি,ত্রিশটি বছর ধরে প্রতি পাঁচ’ই জ্যোষ্ঠ রাতে বুকটা নতুন ভাবে মোচড়
দিয়ে ওঠে।

বুড়ি ঠাকুমা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে
পাংশু ঠোঁটে উচ্চারণ করে গেছে—বা–আ–ব–লু–উ
উঃ, সে কি কষ্ট, প্রাণকে শেষ চেষ্টা করে আটকাতে
চেষ্টা করছিল আমার নতুন মা,যাকে বিয়ের পর
থেকে নতুন মা বলে এসেছি—তোর ঠাম্মা।

কখন যে চাঁদ মুখ ঢেকেছে বুঝতে পারিনি,
ঝড় উঠেছে—-ছমছমে বৃষ্টির শব্দে কেঁপে উঠছি,
ঘরের চালে নিদারুণ কান্নায় আছড়ে পড়ছে শিরিষের ডাল।
মনে পড়ে তোর? কত ঝড়ের রাতে বিদ্যুতের
আলোয় তুই কেঁদে ফেলতিস।

কতদিন আর ভিজে স্মৃতি আগলে অন্ধকারে
একা বসে থাকব বলতে পারিস?
কেউ পাশে নেই–আমি যে এখন বৃদ্ধা ন‌ই
তোর মতো শিশু হয়ে গেছি রে,
একলা ঘরে বড় ভয় করে বাবলু, বড় ভয় করে।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page