ফিরিয়া যদি সে আসে
-কুমার প্রণবেশ
(১)
সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা বাজে। সমীর এস.বি.আই. ব্যাংকের লিটল রাসেল স্ট্রিট ব্রাঞ্চের নিজের চেম্বারে বসে আছে। আজই সে জয়েন করেছে প্রবেশনারী অফিসার হিসেবে। প্রথম দিনটা ভালোই কাটলো। আজকের কাজ শেষ। কিন্তু বেরোতে পারছে না। ব্রাঞ্চের চিফ ম্যানেজার, তার সাথে বিশেষ কিছু আলোচনা করবেন। তাই অপেক্ষা করতে বলেছেন। সমীর সেই ম্যানেজার কখন ডাকবেন, তার জন্য অপেক্ষা করছে।
আজ তার খুব মনে পড়ছে সুদীপ্তার কথা। আজকের এই দিনটা যদি পাঁচ বছর আগে হতো, তাহলে সে নিশ্চয়ই আজ সুদীপ্তার বাড়িতে যেত, সুদীপ্তার মার সাথে কথা বলতো। কে জানে, সুদীপ্তা এখন কোথায়? কেমন আছে? তার বিয়ে হয়েছে কিনা?
সমীরের বাবা যখন বার বছর আগে হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে মারা যান, তখন সমীরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। সমীরের দিদি কলেজের সেকেন্ড ইয়ার বি.এ. পড়ে আর ছোট দুই বোন ক্লাস নাইন আর সেভেনে পড়ে। বাবা মারা যেতে সমীর যেন চোখে অন্ধকার দেখলো। বিশেষ করে শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ মিটে যাওয়ার পরের রবিবার।
বেলা এগারোটা হবে। বাড়ির বারান্দায় পাড়ার ক্লাবের সভাপতি নিরঞ্জন কাকুর সাথে মা কথা বলছেন। সমীর বুঝেছিল যে মা-ই দিদিকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন। সমীর তখন ঘরে বসে খবরের কাগজের খেলার পাতা দেখছিল। মা আর নিরঞ্জন কাকুর কথা গুলো সমীরের কানে আসতে, সে খেলার খবর পড়া বন্ধ করে, কান খাঁড়া করে তাদের কথা শুনতে লাগল।
সমীরের মা বলছেন, ‘অফিস থেকে লোন করে এই বাড়িটা সবে শেষ করেছিলেন। সবে লোনের ছ’ কিস্তি মাইনে থেকে কেটেছিল। ফলে বুঝতেই পারছেন বলতে গেলে বাড়ির লোন বাবদ প্রায় পুরো পাঁচ লাখ টাকাই লোন শোধ বাকি। এছাড়া প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিয়েছিলেন দু লাখ টাকা। তাই এখন শুনছি, ওই সব লোনের টাকা গ্রাচুইটি আর প্রভিডেন্ট ফান্ডের জমা টাকা থেকেই বাদ দিয়ে ব্যালেন্স টাকা আমার এ্যাকাউন্টে ওনার অফিস পাঠাবেন। গতকাল ওনার অফিসের জীবনবাবু এসেছিলেন। তিনি যা বললেন তাতে বুঝলাম, সব কেটে কুটে হয়তো লাখ চারেক টাকা পেতে পারি। বুঝতেই পারছেন, ওই টাকা ভেঙ্গে খরচ করলে আর কত দিন চলবে! আবার ব্যাঙ্কে রেখে সুদের ওই কটা টাকায় ঘর চলবে না। ছেলে মেয়েরা এখনো বড় হয়নি যে চাকরি করবে। সেই জন্যই আপনাকে ডেকেছি। দেখুন না, আমার জন্য যদি কোন চাকরির ব্যবস্থা হয়। আমি বি.এ. পাশ।’ নিরঞ্জন কাকু সমীরের মায়ের কথা সব শুনলেন। তারপর ভেবে বললেন, ‘আপনি এতো দুশ্চিন্তা করবেন না। কিছু না কিছু উপায় একটা বেরিয়েই যাবে। আমি দেখছি, আমাদের কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে যদি আপনার কিছু ব্যবস্থা করা যায়।’ এই কথা বলে নিরঞ্জন কাকু চলে গেলেন। সমীরের মা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চোখে তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সমীরের মায়ের সেই কথাগুলো রাতে সমীরকে ঘুমোতে দিল না। পরদিন সকালে সে ভেবে নিল সেই এমন কিছু করবে যাতে ঘরে দুটো পয়সা আসে। কিন্তু ভেবে পায় না, সে কি করবে! বিকেল বেলা সে চলে গেল অমিত স্যারের কাছে। অমিত স্যার তাকে খুব ভালোবাসে। শত হলেও সমীর চিরকাল স্কুলের ফার্স্ট বয়।
বিকেল সাড়ে চারটে। অমিত স্যার, তার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে গল্পের বই পড়ছিলেন। সমীরকে দেখেই সমীরের মাথা ন্যাড়া দেখে চমকে উঠলেন। তিনি উঠে বারান্দার গ্রিলের দরজা খুলে বারান্দার চেয়ারে বসতে বললেন। তারপর বইটা বন্ধ করে কোলের ওপর রেখে বললেন,’ বল, কি ব্যাপার! তুই ন্যাড়া কেন?’ সমীর বলল,’ বাবা, হঠাৎ করে হার্ট এটাকে মারা গেছেন।’ সমীর স্যার বলল,’ সে কি রে! খুব খারাপ খবর শোনালি রে! গত মাসে আমার সাথে মাছের বাজারে দেখা হয়েছিল। তোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিল। ওকে কি পড়ানো উচিত, তাও জিজ্ঞেস করছিল।’ তারপর অমিত স্যার চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কাকারা তো এখানে থাকেন না, তাইনা?’ সমীর ঘাড় নাড়লো। আবার অমিত স্যার বললেন, ‘খুব চিন্তার বিষয়! তোদের এখন ঘর চলাই তো মুশকিল হয়ে পড়বে।’ সমীর বলে ফেলল,’ স্যার! আমি এই কারণেই আপনার কাছে এসেছি। আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু করতে চাই, যাতে ঘরে মার হাতে দু’ পয়সা দিতে পারি। আমি কি করতে পারি বলুন তো?’
অমিত স্যার খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বললেন, ‘অন্য সাধারণ ছেলে হলে বলতাম, পড়াশোনা ছেড়ে কাজে লেগে পর। কিছু না কিছু কাজ তো জুটে যাবেই। কিন্তু তোকে সে কথা কি করে বলি। তুই যে লেখাপড়ায় খুব ভালো। তোর একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। তোকে লেখা পড়া চালিয়ে যেতেই হবে।’ তারপর আবার কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘এক কাজ কর। তোকে আমি কয়েকটা স্টুডেন্ট দিচ্ছি। তুই টিউশন শুরু করে দে। আর হ্যাঁ, কাল থেকেই তুই আমার মেয়ে সমুকে পড়ানো শুরু করে দে। সমু নাইনে উঠেছে। আমি ছাত্র পড়ালেও, নিজের মেয়েকে পড়ানোর সময় পাই না। তোকে আমি পাঁচশো টাকা করে মাইনে দেব।’ স্যারের মুখে মাইনের কথা শুনে আমি লজ্জা পেলাম। মুখ নামিয়ে নিলাম। সেটা দেখে অমিত স্যার বললেন, ‘এতে লজ্জার কিছু নেই। আমি তোকে বেশি দক্ষিণা দিচ্ছি না। এখন বাড়িতে এসে নাইন টেনের ছাত্র পড়ানোর পাঁচশো টাকাই রেট। তুই কাল থেকে শুরু করে দে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আমি তোকে ক্লাস নাইন টেনের চার পাঁচটা ছেলের একটা ব্যাচ দিচ্ছি। সাইন্সটা পড়াবি, ভালো পয়সা পেতে শুরু করবি। কিন্তু খবরদার! নিজের পড়া শোনার ক্ষতি বিন্দুমাত্র করবি না।
পরদিন বিকেল বেলা থেকে সমীরের অমিত স্যারের মেয়ে সমুকে টিউশন পড়ানো শুরু হয়ে গেল। প্রথম দিনই সমীর জানতে পারলো সমুর ভালো নাম সুদীপ্তা। পরের সপ্তাহ থেকে সুদীপ্তাকে বিকেলে টিউশন দেওয়ার সাথে সাথে সমীর নিজের বাড়িতে ক্লাস নাইনের পাঁচ ছাত্রের একটা ব্যাচ শুরু করে দিল। ওই ব্যাচটা থেকে মাসে হাজার টাকা পেত আর অমিত স্যার দিত মাসে পাঁচশো টাকা। সমীরকে দেখে, সমীরের দিদিও উৎসাহিত হয়ে সেও ছাত্রী পড়ানো শুরু করে দিল। সে পড়াতো ইংরেজি আর বাংলা। সমীর আর তার দিদির টিউশনির টাকা আর সামান্য ব্যাঙ্কে ফিক্সডে রাখা টাকা থেকে যে সুদ আসতো, তাতেই কোনোক্রমে সমীরদের ঘর চলতো।
কষ্ট আর টানাটানির সংসারে থেকেও সমীর কলেজে ভর্তি হলো। ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে সমীর পড়তো। বেশ চলছিল। সমীরের পার্ট ওয়ানে রেজাল্ট খুব ভালো হল। তখন সুদীপ্তা উচ্চ মাধ্যমিক পড়ছে। সমীর তখনও সুদীপ্তাকে পড়াতো। অমিত স্যার, মাইনে পাঁচশো থেকে সাতশো করে দিয়েছিলেন। পার্ট ওয়ানের পর অমিত স্যারের উৎসাহে সমীর উচ্চ মাধ্যমিকেরও একটা ব্যাচ পড়ানো শুরু করে দিয়েছিল। ততদিনে সমীরের দিদি বি.এ. পাশ করে, আরও ছাত্রী পড়াতে শুরু করে দিয়েছিল। আর্থিক দৈন্য তখন যেন অনেকটা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু আর্থিক স্বাচ্ছল্য বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না।
বেশ চলছিল। হটাহ সব যেন কেমন ওলট পালট হয়ে গেল। ওলটপালট করে দিল সুদীপ্তা। যদিও তার জন্য সুদীপ্তা ঠিক প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী ছিল না। দায়ী ছিল সমীর নিজেই। সমীর একদিন অনুভব করলো যে সে সুদীপ্তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এই অনুভূতিটা এলো ঠিক দুর্গা পূজার পঞ্চমীর দিন। পঞ্চমী থেকে লক্ষ্মী পুজো পর্যন্ত টিউশন বন্ধ। সন্ধ্যে বেলা সমীর বসে ছিল বাড়ির ছাদে। বাড়ির ছাদ বসে সে পাড়ার পুজো মণ্ডপের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। সমীরের বাড়ির ছাদ থেকে পাড়ার পুজো মণ্ডপটা খুব সুন্দর দেখায়। তার বার বার সুদীপ্তার কথা মনে হতে লাগলো। আজ আর সুদীপ্তার সাথে দেখা হবে না! একবার সমীর ভাবলো যে অমিত স্যারের সাথে গল্প করার অজুহাতে সে গিয়ে সুদীপ্তার সাথে দেখা করে আসবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, সেটা কি ঠিক হবে! ভাবতে ভাবতে সে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো। প্যান্ট-শার্টটা চেঞ্জ করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
অমিত স্যারের বাড়ি পৌঁছে দেখলো বারান্দায় কেউ নেই। সে কলিং বেল টিপল। বেরিয়ে এলো সুদীপ্তা। সে দেখেই বলল, ‘আজকেও পড়াবেন?’ সমীর বলল,’না, আমি পড়াতে আসিনি। আমি এসেছিলাম স্যারের কাছে। অনেক দিন স্যারের সাথে গল্প করা হয়নি, তাই।’ সুদীপ্তা হেসে বলল, ‘আপনার স্যার তো নেই। মাকে নিয়ে মামা বাড়ি গেছে। তবে আমার সাথে গল্প করতে চাইলে, দরজা খুলতে পারি। সুদীপ্তার কথায়, সমীর এতটাই ঘাবড়ে গেল, যে সে হতভম্বের মতো সুদীপ্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সুদীপ্তা গ্রিলের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘ভেতরে আসুন।’ সমীর ভেতরে গিয়ে বসল। সুদীপ্তা বলল, ‘বসুন আজ মায়ের কাজটাও আমিই করি। চা বানিয়ে আনছি।’ এই কথা বলে সুদীপ্তা রান্না ঘরে চলে গেল। সমীর ভাবতে লাগলো, সুদীপ্তাও কি বুঝে গেছে তার মনের কথা! বুঝে গেলে তো ক্ষতি নেই। কিন্তু সে তো সমীরকে নাও ভালোবাসতে পারে। সমীরের খুব হতাশ লাগছিল। দরিদ্রতা তার মনের শক্তিটাই কেড়ে নিয়েছে। তার ইচ্ছা থাকলেও, সে তার মনের কথা সুদীপ্তাকে বলতে পারবে না। তার পায়ের নিচে যে মাটি নেই। এই সব যখন সমীর ভাবছে, ঠিক তখন সুদীপ্তা চাটা এনে টেবিলের ওপর রেখে নিজে খাটে পা ঝুলিয়ে বসলো। সমীর চায়ে একটা চুমুক দেওয়ার পর সুদীপ্তা বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? মনে কিছু করবেন না তো?’ সমীর আবার একটু ঘাবড়ে গেল। কিন্তু মুখে তার ভাব লুকিয়ে রেখে বলল, ‘না, না, বলো না।’ সুদীপ্তা বলল,’সত্যিই কি আপনি বাবার সাথে গল্প করতে এসেছেন, না আমার সাথে?’ সমীরের হাতের কাপের চা চলকে উঠলো। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘না, মানে আমি! স্যারের সাথে, মানে রোজ তোমাকে দেখি! আজ হঠাৎ মনে হল..’ সুদীপ্তা বলল, ‘থাক, থাক হয়েছে। আমি বুঝে গেছি।’ সমীর চমকে উঠে বলল, ‘কি বুঝেছো?’ সুদীপ্তা বলল, ‘সেটা তো আপনি আমার থেকেও ভালো জানেন।’ সমীর সেদিন আর একটাও কথা বলতে পারে নি, গল্প করা তো দূর।
এরপর থেকে সুদীপ্তাকে পড়ানোর সাথে গল্পও করতো সমীর। তারা যে একে অপরকে ভালোবাসে, সেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
দেখতে দেখতে সমীর বি.এস.সি. পাশ করে গেল। ভালো রেজাল্ট করেও সে এম.এস.সি.তে ভর্তি হলো না। এর আগেও জয়েন্টে ভালো রেজাল্ট করেও পয়সার এভাবে তার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হয়নি। সে জানতো চাকরির খুব দরকার। দিদির বয়েস বেড়ে যাচ্ছে, বিয়ে দিতে হবে। তার মায়ের এই নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েই যাচ্ছে। তাই সে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় বসতে শুরু করলো। খুব সহজেই সে পি.এস.সি. পরীক্ষায় পাস করে কেরানির চাকরি পেল। কেরানির চাকরি সমীরের পছন্দ ছিল না কিন্তু তার বাড়ির কথা, মা বোনের কথা চিন্তা করে, সে মেনেই নিল কেরানির চাকরি। যদিও সে মনে মনে ঠিক করল যে সে আরও ভালো ভালো চাকরির চেষ্টায় থাকবে। চাকরি জয়েন করতে সে চলে গেল শিলিগুড়ি।
(২)
শিলিগুড়িতে চাকরি করতে করতেই সমীর ভালো ভালো চাকরির জন্য দরখাস্ত দিতে শুরু করল। রাত্রে চাকরির পরীক্ষার জন্য পড়া শোনা করতো। প্রায়ই রাত্রের দিকে সুদীপ্তাকে ফোন করে তার খবরাখবর নিত। কিছুদিনের মধ্যেই সুদীপ্তার সাথে ফোনে যোগাযোগ কমতে শুরু করলো। সুদীপ্তাও পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। সে মেডিকেলে চান্স পেল। কলকাতায় হোস্টেলে থেকে পড়ছিল। ওর হোস্টেলে রুম মেট ছিল। তাছাড়া হোস্টেলে ফেরার ঠিকানা থাকতো না। তাই সুদীপ্তা সমীরকে ফোন করতে বারণ করেছিল। সুদীপ্তাই মাঝে মধ্যে ফোন করতো। এই ভাবেই চলছিল। সমীরের দিদির বিয়ের ঠিক হলো। ছেলে সরকারি চাকরি করে। কোনো দাবি দাওয়া ছিল না। কিন্তু বেশ বড় ঘরের ছেলে। তাই সমীর তার এক বছরের সঞ্চয়ের পুরোটাই সে বিয়ের জন্য খরচ করলো। সমীরের দিদি খুব রাগ করে সমীরকে বলেছিল, ‘মনে রাখিস আমি তোর দিদি হলেও, আরও দুটো তোর বোন আছে।’ সমীর বলেছিল, ‘দিদি! তুই চিন্তা করিস না। ওদের বিয়ের এখনো অনেক দেরি আছে। ততদিনে আবার পয়সা কড়ি জমিয়ে নেব।’
সমীর তার দিদির বিয়েতে ছুটি নিয়ে এসেছিল। সুদীপ্তাও এসেছিল। বিয়েতে সবাই খুব আনন্দ করলেও, সমীর কাজকর্মের মধ্যেই ব্যস্ত ছিল। তবে বৌভাতের পরদিন সমীর অনেকটা ফ্রি ছিল। সে চলে গিয়েছিল মেডিকেল কলেজে। সেখানে ঘন্টা দুয়েক চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছিল।
এই ভাবেই আরো তিনটে বছর কেটে গেল। সুদীপ্তার এম.বি.বি.এস.এর ফাইনাল ইয়ার। সমীর বাড়ি এসেছিল, সমীরের মেজ বোনের আশীর্বাদ উপলক্ষে। আশীর্বাদের পরদিন সে গিয়েছিল সুদীপ্তাদের বাড়িতে। সেদিন সুদীপ্তার বাড়িতেই থাকার কথা ছিল। সেই জন্যই গিয়েছিল।
তখন সকাল সাড়ে দশটা। সুদীপ্তার বাড়িতে গিয়ে দেখে সুদীপ্তা, তার বাবার সাথে বাজারে গেছে। সুদীপ্তার মা, দরজা খুলে বারান্দায় বসতে বলল। একটু পরেই সুদীপ্তার মা চা নিয়ে ফিরে এলো। সমীরকে চাটা হাতে দিয়ে, সুদীপ্তার মা, ইজি চেয়ারটায় বসলো। সমীর চায়ে চুমুক দিতে লাগলো। সুদীপ্তার মা বললেন,’ভালো কোথাও আর চাকরির চেষ্টা করছো না? তোমার এই চাকরিটা খুব সাধারণ চাকরি। একটু ভালো চাকরির চেষ্টা করো। বুঝতেই পারছো, সুদীপ্তা এম.বি.বি.এস. করে, হয়তো এম.ডি. করবে। সেক্ষেত্রে তোমার এতো একটা সাধারণ চাকরি! লোকে কি ভাববে! তাছাড়া, ভবিষ্যতে তোমার মনেও ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স আসতে পারে। সুদীপ্তার জন্য এখন থেকেই বেশ ভালো ভালো ডাক্তার পাত্রের বিয়ের প্রস্তাব আসছে। আমার ভয় হয়, সুদীপ্তার মাথাটা ঘুরে না যায়!’ সুদীপ্তার মায়ের কথা শুনতে শুনতে, সমীরের চা খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে চায়ের কাপটা ইতিমধ্যেই পাশে বেঞ্চের ওপর রেখে দিয়েছিল। সমীরের কেন যেন, সুদীপ্তার মায়ের কথায় নিজেকে খুব অপমানিত মনে হচ্ছিল। সে হঠাৎই বলল,’কাকিমা! বাবা-মেয়ে বাজারে গিয়েছে অনেক দিন পর। ওদের অনেক সময় লাগবে। আমারও একটু জরুরি কাজ আছে। আমি নেক্সট টাইম সুদীপ্তা আর স্যারের সাথে দেখা করে যাবো।
সেই সমীর শেষ গিয়েছিল সুদীপ্তাদের বাড়িতে। সেবার সুদীপ্তার সাথেও দেখা হয়নি। তারপরও আর দেখা হয়নি। সমীর নিজের মনেই সুদীপ্তাকে ভুলতে চেষ্টা করা শুরু করে দিয়েছিল। এরপরে সুদীপ্তা বেশ কয়েকবার সমীরকে ফোন করলেও, সমীর আর কোনদিন ফোন করে নি। সমীরের ভাগ্যটাও খুব একটা তার সহায় ছিল না। ভালো ভালো চাকরি যে একদমই পাচ্ছিল না, তা নয়, ঠিক মনের মতো পাচ্ছিল না।
এরপর মেজ বোনের বিয়ের সময় সমীর আবার বাড়ি গিয়েছিল ছুটি নিয়ে। বড় ভাইয়ের দায়িত্ব সে ভালো করেই পালন করেছিল। সমীরের মা নিজে অমিত স্যারের বাড়ি গিয়ে কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছিলেন। তাও অমিত স্যার, কাকিমা এমনকি সুদীপ্তাও সমীরের বোনের বিয়েতে আসে নি। সুদীপ্তার এই না আসাটা, সমীরকে আরো বেশি আঘাত করেছিল।
তবে সমীরেরও পরে মনে হয়েছিল যে কাকিমার কথায় তো কোনো ভুল ছিল না। কয়েক বছর পর সুদীপ্তা এম.ডি. হয়ে যাবে। তখন সুদীপ্তার তো লোককে তার হাসব্যান্ডের পরিচয় দিতে লজ্জা লাগবে। তার বলতেও হয়তো খারাপ লাগবে যে তার হ্যাসব্যান্ড একজন সরকারি কেরানি। এই সব ভেবেই সমীর সুদীপ্তার সাথে সম্পর্কটা কাট করে দিয়েছিল।
কেরানির চাকরির তখন পাঁচ বছর হয়ে গেছে। সমীর চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছে। আর বছর দুয়েকের মধ্যেই তার সরকারি চাকরির বয়সটা সে পেরিয়ে যাবে। ঠিক এরকম সময়ই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে লাগলো। বছর খানেক আগে সে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের স্টাফ সিলেকশনের পরীক্ষা দিয়েছিল। তারই ইন্টাভিউ লেটার পেল। কলকাতায় গিয়ে সে ইন্টারভিউ দিল। মাস খানেকের মধ্যেই সে ইনকাম ট্যাক্সে ইনস্পেক্টরের চাকরি পেল। পোস্টিং হলো পাটনায়। সে চলে গেল পাটনায়।
পাটনায় যাওয়ার পর থেকে তার কলকাতা বা হুগলির সাথে যোগাযোগ কমে গেল। পাটনায় বছর তিনেক চাকরি করে ফিরে ট্রান্সফার পেয়ে ফিরে এলো কলকাতায়। কলকাতায় আসার পর পরই ছোট বোনের বিয়ে হলো। বিয়ের সময়ই আত্মীয় স্বজনরা সমীরের মাকে সমীরের বিয়ের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে বললেন।
বিয়ের কাজকর্ম মিটে যেতে সমীরের মা একদিন রাত্রে সমীরকে খেতে দিতে দিতে বললেন, ‘দ্যাখ! আমার বয়েস হয়েছে। এবার ঘরে আর একটা লোক আসা দরকার। তুই বললে, পাত্রী দেখি। তোর দিদির ননদের মেয়েটিকে রুনুর বিয়েতে দেখলাম। বেশ ভালো লাগলো মেয়েটিকে। তোর দিদির ননদ ইতিমধ্যে তার মেয়ের সাথে তোর বিয়ের প্রস্তাব তোর দিদিকে দিয়েছে। তোর দিদি আমাকে তোর সাথে কথা বলতে বলেছে। বল! তোর দিদিকে কি বলবো।’ সমীর মাথা নিচু করেই খেতে খেতে উত্তর দিল,’ আপাতত কিছুই বলোনা। কারণ, এই মুহূর্তে আমার বিয়ের কোন ইচ্ছে নেই।’
কলকাতায় এসেই সমীর শুনেছিল যে অমিত স্যার রিটায়ার করে নিজের বাড়ি বিক্রি করে রাজার হাটে ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছেন। সমীরের কেন যেন আর সুদীপ্তার সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছে হয়নি। তার সেই সুদীপ্তার মায়ের কথাটাই মনে পড়ছিল, ‘সুদীপ্তার মাথাটাও ঘুরে না যায়!’ সত্যিই হয়তো ডাক্তার হয়ে তার মাথা ঘুরে গেছে। সে আর সমীরের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়না। আর গত পাঁচ বছর ধরে সুদীপ্তা তো সত্যিই যোগাযোগ করেনি। কে জানে, তার জীবনে নতুন কেউ হয়তো ঢুকে পড়েছে। এই সব ভাবতে ভাবতেই সমীরের জীবন কাটছিল।
ইনকাম ট্যাক্সে চাকরির বয়েস তখন ছমাস ও হয়নি। আবার নতুন চাকরি। এবার বেশ ভালো চাকরি। লোককে বলা যায়, এমন চাকরি। সে এস.বি.আই.তে প্রবেশনারী অফিসারের চাকরি পেল।
সমীরের চিন্তায় বাঁধা পড়লো ইন্টারকম টেলিফোনটা বেজে উঠতেই। সমীর ফোন তুলতেই চিফ ম্যানেজারের গলা, ‘এসে যান।’
চিফ ম্যানেজারের সাথে কথা বলে, অফিস থেকে বেরিয়ে সমীর হেঁটে হেঁটে যখন পার্ক স্ট্রিটে বাস ধরার জন্য এসে দাঁড়ালো, তখন বাজে প্রায় সোয়া সাতটা। বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সে যাবে হাওড়া। সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে বৈদ্যবাটি। হঠাৎই একটা হাওড়ার বাস দেখে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই পেছন থেকে একটা ট্যাক্সি বাসটাকে ওভারটেক করে সামনে এসে পড়ল। সমীর পিছিয়ে আসার সময় পেলো না। ট্যাক্সিটা এসে সমীরকে ধাক্কা মারলো। সমীর ছিটকে পড়লো পাশের ফুটপাথের ওপর। মাথায় একটা আঘাত লাগল। সমীরের চোখে অন্ধকার নেমে এলো।
(৩)
রাত ন’টা। সমীরের জ্ঞান ফিরলো। সমীরের জ্ঞান ফিরতে সে দেখলো সে হসপিটালের বেড়ে শুয়ে আছে। জ্ঞান ফিরতে, সে চোখ মেলে চেয়ে কিছুই বুঝতে পারছিল না। তার মাথা যেন ব্ল্যাঙ্ক। এমনকি সে তার নিজের নামও মনে করতে পারছিল না। সে জল চেয়েছিল। কেউ একজন তার মুখটা ফাঁক করে দুু’ফোঁটা জল তার মুখে দিয়েছিল। যে জল খাওয়াছিল, তার মুখটাও ছিল অস্পষ্ট, যেন সমীর ঝাপসা দেখছিল। ধীরে ধীরে সমীর তার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেল। বুঝলো কোনো হসপিটালের বেড়ে শুয়ে আছে। এবার তার চোখে পড়লো পাশে জামাইবাবু কল্যাণদা বসে আছে। কল্যাণদাই বোধ হয় সিস্টারদের খবর দিয়েছিল জ্ঞান আসার। দু’জন সিস্টার এসে দাঁড়ালো সমীরের বেডের পাশে। তারা দুজনেই ভালো করে সমীরকে দেখলো। তারপর একজন সিস্টার অপর সিস্টারকে বলল, ‘ডক্টর মিস ব্যানার্জীকে খবর দে।’ অপর সিস্টার বলল, ‘উনি তো এই মাত্র খেতে গেলেন। ঘন্টা খানেক পরে ফোন করি?’ প্রথম সিস্টার বলল, ‘না, না, তুই এক্ষুনি কল দে। উনি কড়া ইন্সট্রাকশন দিয়ে গেছেন। পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলেই যেন ওনাকে খবর দেওয়া হয়।’ দ্বিতীয় সিস্টার চলে গেলেন ফোন করতে। প্রথমজন সমীরের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। সমীর বুঝতে পারলো তার মাথায় ভারী ব্যান্ডেজ বাঁধা, ডান পা ভারী লাগছে, বোধ হয় সেটাও ব্যান্ডেজ বাঁধা। বুকেও কি সব জড়িয়ে রেখেছে।
হটাৎ কল্যাণদা বলতে শুরু করলেন, ‘আমার কাছে তোর মার ফোন এলো যখন, তখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। আমি সোজা আমার পরিচিত পাড়ার এক ভদ্রলোককে অনুরোধ করি আমাকে তার গাড়িতে এই হসপিটালে পৌঁছে দিতে। কারণ অত রাত্রে আমাদের পাড়ায় ট্যাক্সি পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমি এসে পৌঁছলাম রাত সাড়ে বারোটায়। তখনও তোর মা এসে পৌঁছাননি। তোর মাকে নিয়ে তোর পাড়ার ছেলেরা যখন এলো তখন বাজে রাত দুটো। ততক্ষণে তোকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লোকের মুখে শুনলাম যে একটা ট্যাক্সি তোকে ধাক্কা মেরেছিল। তুই নাকি ছিটকে গিয়ে ফুটপাথের ওপর পড়েছিলি। তোর মাথা ফেটে গিয়েছিল। ডান পায়ের গোড়ালির ওপর ফ্র্যাকচার হয়েছে। পাঁজরের দুটো রিবেও নাকি হেয়ার ক্র্যাক। রাস্তার লোকেরাই তোকে গাড়িতে তুলে এনে হসপিটালে ভর্তি করেছিল। তোর পকেটের পার্সে আধার কার্ড আর ভোটার আই ডির ফটো কপি দেখে পুলিশ তোর মায়ের সাথে যোগাযোগ করেন। তার মা আমাকে ফোন করেই পাড়ার ছেলেদের খবর দিয়েছিল। গত দু দিন তোর জ্ঞান ছিল না। আমি আর তোর দিদি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হসপিটালে আছি। তোর মাকে আর বৈদ্যবাটি যেতে দিইনি। যাদবপুরে আমার বাড়িতেই রেখে দিয়েছি। তবে যে ডাক্তার মেয়েটি তোকে দেখছেন, তিনি খুব তোর খেয়াল রেখেছেন। তিনিও দু’দিন ধরে প্রায়ই এসে তোর বেডের কাছে বসে থেকেছেন। এই একটু আগেই খেতে গেলেন।’ কল্যাণদার কথা শুনতে শুনতে সমীর আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
সমীরের ঘুম ভাঙ্গতে মনে হলো তার হাতটা কেউ ধরে পাশে বসে আছে। মুখ ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু মাথার ভারী ব্যান্ডেজ, পায়ে প্লাস্টার আর বুক আর পিঠ জড়িয়ে প্যাড এমন ভাবে লাগানো, যে সে পাশ ফিরতে পারলো না। কিন্তু সে পাশ ফেরার চেষ্টা করতেই, শরীরটা একটু নড়ে উঠেছিল। কেউ বলে উঠলো, ‘কি অসুবিধা হচ্ছে কিছু?’ সমীর দেখলো তার মুখের কাছে একজন মহিলা ডাক্তার, গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সমীর চমকে উঠলো। তার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ‘সুদীপ্তা!’ সুদীপ্তার একটা হাত তখনও সমীরের হাতে। সে আর একটা হাত, সমীরের কপালে রেখে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি!’ এখন কথা বলো না। পরে কথা হবে। দাঁড়াও, আর একটা ইনজেকশন দেওয়া বাকি আছে।’ এই কথা বলে সুদীপ্তা সমীরের কপাল থেকে হাত তুলে নিল, আর একটা হাতও ছেড়ে দিল। ইনজেকশন রেডি করে তারপর সমীরকে ইনজেকশন দিল। আবার পাশে বসে কপালে হাত রেখে বলল, ‘একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। তুমি ঠিক হয়ে গেছ। শুধু রেস্ট দরকার।’ সুদীপ্তা সমীরের কপালে হাত বুলোতে লাগলো।
আজ পনের দিন হয়ে গেল, সমীর হসপিটালে আছে। আজ নাকি সমীর হসপিটাল থেকে ছাড়া পাবে। সকালে সিস্টার সেরকমই বলছিল। যদিও সুদীপ্তা তাকে কিছুই বলে নি। সমীর এখন উঠে বসতে পারে, ওয়াকার নিয়ে হাঁটতে পারে। মাথার ভারী ব্যান্ডেজটা আর নেই। হালকা একটা পট্টি এখনো লাগানো আছে। মাথার স্টিচ নাকি আরও চার পাঁচ দিন পর কাটবে। রোজ সকালে বিকেল সবাই আসে। দিদি, কল্যাণদা, মা, দুই ছোট বোন আর তাদের হাসব্যান্ডরাও আসে। সমীর সুস্থ থাকায়, সবাই এসে গল্প করে যায়। সমীরের বস, চিফ ম্যানেজারও বেশ কয়েক বার দেখা করে গেছেন। তিনি বলে গেছেন, ‘তোমার এই এ্যবসেন্সটা ইনজুরি লিভ হিসাবেই ধরা হবে। কারণ তোমার এক্সিডেন্টটা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথেই হয়েছে।তোমার জন্য এক মাসের ইনজুরি লিভ মুঞ্জুর করতে আমি প্রস্তাব জোনাল অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। আগে পুরো সুস্থ হয়ে নিন। তারপর আসুন অফিসে।’
বেলা এগারোটা বাজে। সুদীপ্তা এলো। ডাক্তারের ড্রেস মানে এ্যপ্রন, স্টেথো নেই। সাধারণ একটা শাড়ি পরা। বলল,’চলো, এবার বাড়ি চলো। বাড়ি গিয়ে গল্প করা যাবে। ওয়াকার নিয়েই সমীর লিফট পর্যন্ত গেল। লিফট থেকে নেমে, হেঁটে হসপিটালের মেন গেট পর্যন্ত পৌঁছতেই দেখে একটা ট্যাক্সি আগে থেকেই তার জন্য ডেকে রাখা হয়েছে। সুদীপ্তার কাঁধে ভর দিয়ে সমীর ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসলো। পাশে সুদীপ্তা। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।
গাড়িটা কিছুদূর যাওয়ার পর, সমীরের মনে খটকা লাগলো। তাকে নিয়ে সুদীপ্তা কোথায় যাচ্ছে। এটা তো হাওড়ার দিকে যাচ্ছে না! সে সুদীপ্তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,’ আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ সুদীপ্তা হেসে বলল,’দেখোই না, তোমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। শুধু জেনে রাখো, এখন থেকে তুমি আমার কাছেই থাকবে।’
গাড়িটা এসে দাঁড়ালো একটা বিশ পঁচিশ তলা ফ্ল্যাট বিল্ডিংয়ের নীচে। আবার সুদীপ্তার কাঁধে ভর দিয়ে গাড়ি থেকে নামলো সমীর। লিফটে করে উঠে গেল সাত তলায়। একটা ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাতেই, দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সমীরের মা। সমীর অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল,’তুমি! তুমি এখানে?’ সমীরের মা বললেন,’ ভেতরে এসে বোস। সব কথা তোকে সুদীপ্তাই বলবে।’
সমীর বুঝে গিয়েছিল যে এই ফ্ল্যাটটা পিক নিক গার্ডের আশেপাশের কোন জায়গায়। এটাও দেখলো যে ফ্ল্যাটটা টু বি এইচ কে ফ্ল্যাট। বেড রুম, ড্রইং রুম, রান্নাঘর বেশ বড় বড় সাইজের। দুপুর বেলা সমীরকে খাটের ওপর বসিয়ে, সুদীপ্তা নিজের হাতে মায়ের রান্না করা খাবার খাইয়ে দিল। তারপর সুদীপ্তা রান্না ঘরে সমীরের মার সাথে বসে খেয়ে, সমীরের বিছানায় সমীরের পাশে বসলো।
কিছুক্ষণ কারো মুখেই কোন কথা নেই। তারপর সুদীপ্তা বলতে শুরু করলো :
তারপর! যে ছেলেটা অমিত স্যারের সাথে গল্প করার বাহানা দিয়ে আমার সাথে গল্প করতে চাইতো, সেই ছেলেটা আমার মায়ের কথায় অভিমান করে আমাকে ছেড়েই পালাবার চেষ্টায় ছিল। আসলে মা, তোমাকে আঘাত করেছিল আমারই কথায়। আমি জানতাম, তুমি কত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলে। বাবাও বলতেন যে সমীরের মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র তিনিও খুব বেশি দেখেন নি। আমার মনে হয়েছিল, সংসারের দায় কাঁধে নিয়ে তুমি তোমার ক্যারিয়ারটা নষ্ট করছিলে। তাই আমি চাইতাম, তুমি কিছু বড় একটা করো। আবার ভেবো না, যে আমি তোমার থেকে, তোমার ক্যারিয়ারকে বেশি ভালোবাসতে চেয়েছি। আমি তো তোমার হয়ে গিয়েছিলাম সেই ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। আমি তোমাকে ফোন না করে, তোমাকে বেশি করে উত্তেজিত করতে চাইতাম। কিন্তু তোমার সব খবর রাখতাম। আমার বিশ্বাস ছিল, তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
এবার সুদীপ্তা একটু চুপ করে গেল। সমীর কোনো কথা বলছিল না। সে শুধু অবাক হয়ে সুদীপ্তার কথা শুনেছিল। সে যেন আবার নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছিল। সুদীপ্তা আবার বলতে শুরু করল :
তোমার এক্সিডেন্টটা কিন্তু মারাত্মক ছিল। সময় মতো চিকিৎসা শুরু না হলে, বিপদ হতে পারতো। কিন্তু উপরওয়ালা বোধ হয় তোমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়নি। হয়তো আমার ভালোবাসায় শক্তি ছিল। তাই সেদিন আমি এমার্জেন্সিতে ছিলাম। জানো! তোমার মাথার সিটি স্ক্যান, মাথার স্টিচ, পায়ে অপারেট করে স্টিলের প্লেট আমি সেদিন, সব কিছু নিজের হাতেই করেছিলাম। অন্য ডাক্তাররা আমায় অবাক হয়ে দেখছিলেন। সব কিছু নির্বিঘ্নে হয়ে যাওয়ার পর আমি আমার কলিগদের বলেছিলাম যে এই পেসেন্টের সাথেই আমার বিয়ে হবে, খুব শীঘ্রই। তোমার সাথে আমার যোগাযোগ না থাকলেও কাকিমার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি প্রায়ই, বিশেষ করে তোমার ছোট বোনের বিয়ের পর থেকে কাকিমাকে ফোন করে তার খবরা খবর নিতাম। কাকিমা একা থাকতেন, আমার চিন্তা হতো। তুমি যে সেদিন এস বি আই তে জয়েন করেছো, তাও কাকিমা আমাকে বলেছিল। সেদিনই আমি সকালে গিয়ে কালীঘাটে পুজো দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু হয়তো বাঁধা ছিল। তাই এরকম হলো।
এই যে এই ফ্ল্যাটটা দেখছো, এটাও কাকিমা বুক করেছেন। যদিও শুধু এডভান্স দিয়েছেন। চল্লিশ লাখ টাকা, আগামী এক বছরের মধ্যে, তোমাকে আর আমাকে লোন নিয়ে পেমেন্ট করতে হবে।
সুদীপ্তা কথা বলতে বলতে চুপ করে গেল। সে মাথা নিচু করে বসে রইলো। সমীর বুঝলো সুদীপ্তা কাঁদছে। সমীর উঠে বসে সুদীপ্তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। বলল,’কেঁদো না, আর কোনো দিন তোমাকে ছেড়ে যাবো না।’
….সমাপ্ত…….