বিশ্বপ্রকৃতি আর শ্রীমতী রাধারানী একই নারী
-সত্যেন্দ্রনাথ পাইন
পুরুষ আর প্রকৃতি—-এইতো দুটি রূপ (যদিও শিখণ্ডী বা নপুংসক আরেক যৌথ মিশ্রশিল্প)! তবু পৃথিবীতে যদি
সমগ্র মানব জাতিকে পুরুষ রূপে কল্পনা করি তাহলে কৃষ্ণ হলেন সেই পুরুষ কূলের প্রতিভূ আর নপুংশক আয়ান ঘরণী’ রাধা’ হলেন প্রকৃতির এক এক স্থানের এক এক রূপের নারী স্বরূপ।। কখনো বৃন্দাবনে, কখন মথুরায়, কখনো নবদ্বীপে কখনো বা ব্রজবাসে অনাবৃত লালসার উদাসী হাওয়া।
এমন প্রকৃতিরূপা নারীর জন্যই পুরুষের প্রকাশ— কৃষ্ণের ব্যাকুল বাঁশরীর ‘রাধা রাধা’ নামে ডাকা। বর্ষাস্নাতা প্রকৃতির রূপ আর সদ্য স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে উঠে আসা রাধার শরীর যেন কামনার উচ্ছ্বল তরঙ্গ। চোখের কোনে ক্ষণপ্রভার চমক বারবার পুরুষ চোখকে ধাঁধিয়ে তোলে। মোহিনী রূপা এই নারীর প্রেমে চিরযৌবনভরা কৃষ্ণের এত প্রেম লীলা সেই জন্যই। এমন নারীর সুধাপানে বারবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় দার্জিলিং, মুসৌরি, আগ্রা দিল্লি ,বদ্রী, কেদারনাথ নয়তো ভূস্বর্গ কাশ্মীরে।” একই অঙ্গে এত রূপ” না দেখে কি বা উপায় আছে!?
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ বা পদাবলী পড়তে হলে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস পড়তেই হবে। বিদ্যাপতির বর্ণনায় আধুনিকা নারীর আদিখ্যেতা ভরা অনাবৃত বেহায়াপনা নেই। পাই পদ্মের বিস্তার, মাপাজোপা ফুলের গ্রন্থনায় মনোহারিণী
সুকেশিনী নয়নলোভা আত্মজ রূপের রাগিনীভরা ললিতকলা। যেখানে তিনি বলেছেন—“তাহে অধিক মুখমণ্ডল গোরা পুনসিক চাঁদ কিয়ে করল উজোরা।” মুখ তো নয়, যেন পূর্ণিমার জ্যোৎস্না। চারধারে বিছিয়ে দিচ্ছে আলোর বিতান, আবেদনের চন্দ্রাতপ”।(রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়— প্রতি দিন ১৫ ভাদ্র ১৪১৪) এই মুখের মধ্যেই কামদেবের তীক্ষ্ণ তীর পুরুষ হৃদয়কে বারবার বিদ্ধ করে। নারীর আননে কামের আনন্দ। স্তনযুগল, কটিদেশ, আঁখিযুগল যেন স্বপ্নের মাধুরী বহন করে পুরুষকে এনে দেয় অন্তহীন প্রতীক্ষা। সত্যিই তো এমন নয়নলোভা প্রকৃতির আবেদনে তাই সমগ্র মানব জাতি যেন রাধা প্রেমে ব্যাকুল, মাতোয়ারা। প্রকৃতি যেন কামিনী রাধা। রাধার কেশরাশি যেন প্রকৃতির বনরাজির অন্ধকার, মুখ তার জ্যোৎস্না আলোকিত আর নয়নযুগল যেন চন্দ্রসূর্যের ন্যায় জোড়া পদ্মস্বরূপ।অন্ধকার-আলো-পদ্মের সহবাস ঘটেছে অবিশ্বাস্য রূপে। লুব্ধ পুরুষতূল্য মানবকূল যার প্রেমে সদা চঞ্চল, বিরহ বেদনায় যন্ত্রনা বিদ্ধ ঐ প্রেমিক কৃষ্ণ।চণ্ডী দাসের লেখায় পেয়েছি মিলন শোকাতুর রাধাকে যিনি প্রেমকেই জগৎ বলেছেন। আর বিদ্যাপতির লেখায় পাই স্বপ্নচারীনী রাধাকে- “- অপরূপ দেখিতা জুবতি অবতার।” অর্থাৎ অপরূপা যুবতী এক মর্ত্যধামে অবতীর্ণা।-:” চোখ দুটি তার খঞ্জনা পাখির মতো সর্বদা চঞ্চল। যার চলনে ফোটে চাঁপা ফুল ( চম্পাকে করল পুহবি নিরমান). যে হাসলে মনে হয় ডালিম বীজের সারি (অধর বিম্ব সম দসন দাড়িমবিজু ভ্রু দুটি যেন কামের কামান (কাম কাঞ্চন চান্দ উগি গেল) অশ্রু যেন অঙ্গরাগ মুছে দিয়েও মাধুরী মিশ্রিত অপরূপা।যেখান থেকে দৃষ্টি ফেরানো অপ্রত্যাশিত।তাই বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা, বিদ্যাপতির রাধা আর প্রকৃতিস্বরূপা চিরযৌবনা রাধা চিরন্তনী কামিনী রাধা নারী, কামদেবের কটাক্ষ ভরা কোকিলের সুহাস।কী অপূর্ব সেই দ্যুতি! “যেখানেই তার উপস্থিতির দৃষ্টিপাত সেখানেই ফুটে ওঠে পদ্ম। যেখানে যেখানে হাসির ঝলক সেখানে বিস্তার হয় অমিয়। যেখানে হানে তার কটাক্ষ সেখানেই বর্ষিত হয় লক্ষ মদন শর)”। এহেন ত্রিভূবনবিজয়িনী রমনী রাধা স্বরূপা প্রকৃতিকে একবার দেখার জন্য কার না মন চায়?! শ্রী রাধার তনু আর প্রকৃতির অঙ্গসজ্জা তাই দুর্লভ কামের পরাজিত বাসনার সহমিলন—প্রতীকী উদ্ভাসের হিন্দুস্তানি প্রেম।(রাধার সুচিত্রায়ন- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়) মানব- মানবীয় আন্তরিক প্রেম এবং এই প্রমব্যাথাতুর হৃদয় যন্ত্রনা থেকেই অপার্থিব প্রেমের সৌরভ বাহিত হয় পুরুষ নারীর প্রণয়লীলায়।
বিদ্যাপতি বর্ণিত রাধা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি—‘” রাধা অল্পে অল্পে মুকুলিত, বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। সৌন্দর্য ঢলঢল করিতেছে”! রাধার ভীতি বিহ্বল চাপল্য, যৌবনের উত্তাপ, কৈশোর যৌবনের দ্বন্দ্বে কেশবিন্যাস, কখনো আবৃতা, কখন নিরাবরণা শরীর যেন প্রকৃতির বারমাস্যায় খামখেয়ালিপণা— নারী সত্ত্বার উদ্বেলিত উচ্ছ্বসিত ফল্গুধারা। চাঁদকে না দেখে চকোর যেমন থাকতে পারেনা- রাধাকে না পেয়েও তেমন কৃষ্ণ মিলন -অভিসারের আকাঙ্ক্ষায় অন্ধকার সমাচ্ছন্ন ঝটিকা বিক্ষুব্ধ বর্ষণমুখর সর্পসংকুল রাতেও কামনার দুর্গম পথ পার হতে চায়। এই দুর্গম অভিযাত্রীরা আসলে মানবযাত্রী প্রেমিকা তাপসী নারী প্রকৃতিকেই সম্ভোগ করতে চেয়ে প্রেমের নৈবেদ্য দিতে চেয়েছে। যার বিরহে ব্যথা হয় দ্বিগুণতর কিন্তু পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা যেখানে আরও ব্যাপক ও গভীর শূন্যতায় পরিব্যপ্ত। তাই বিদ্যাপতি বর্ণিত রাধা আর জগৎ প্রকৃতি যেন চেতনাসমৃদ্ধ জীবন্ত বাস্তব– লীলা য়িত জীবনের ” ঝঃকৃত বেগবতী তরঙ্গসংকলা”; নারী। বৈষ্ণব পদাবলী র রাধা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে পরিণতি লাভ করেছে যেমন তেমন ঋতুর বারমাস্যায় গ্রীষ্মের দাবদাহে দহিত হয়ে বিশ্বপ্রকৃতিও শরৎ হেমন্ত কাটিয়ে বসন্ত সমারোহে পরিপূর্ণ লভ্যা এক প্রেমিকা যৌবনা নারী রূপে নন্দিত। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম তাই জৈবিক প্রেম নয়।এ হোল সংস্কারের উর্দ্ধে মুক্ত জীবনধারায় সমগ্র মানবজাতির সাথে প্রকৃতির চিরকালীন বিষাদ- আশা-ভয়- মিলনের অনন্ত এক প্রেম। বৃষ্টিতে প্রেমিক-মন যেমন মিলনেচ্ছায় পাগলপ্রায় তেমনি বর্ষা ঋতুতে মানবসমাজ ও প্রকৃতি প্রেমে ভাবের ডানায় ভর করা মুক্ত বিহঙ্গ সম ‘ রাধাকৃষ্ণের যুগল মুরতি”!
লেখাটা অনেক অনেক বিতর্কের অবতারণা করে গেল।