কৃষ্ণকলি
-পারমিতা ভট্টাচার্য
মেয়েটির নাম কৃষ্ণকলি। সে নামেই শুধু নয়, সত্যি সে কৃষ্ণকলি। বি.এ. ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী, ফিজিক্স অনার্স। অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট সে। তাই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার হলেও তার চেষ্টার কোনো খামতি নেই জীবনে। বাবা – দাদার সংসারে সে যে কিছুটা অপাংক্তেয়ই, সেটা সে ভালোই বোঝে। পাড়া ঘরের মেয়েরা ইচ্ছে মতো ডানা মেলতে পারে না, তাও যদি কৃষ্ণকলি হয়। বাবা, দাদারা এদের পাত্রস্থ করার নামে ঘাড় থেকে নামতে পারলেই বাঁচেন খানিকটা। কৃষ্ণকলির জীবনের ইতিহাসটাও খানিকটা একই। কিন্তু মেয়েটির এক জেদ, পড়াশোনা সে করবেই। পাটকাঠির মতো হাড় জিরজিরে চেহারা, তার পর আবার কালো গায়ের রং – কে পছন্দ করবে? এই নিয়ে বাড়ির লোকের চিন্তার অন্তর নেই। তাও যদি কুড়ি পেরোতেই বিয়ে হয়, তবু কিছুটা লালিত্য থাকেই।
-‘পড়াশোনা করতে করতে বুড়ি হয় গেলে কে বিয়ে করবে শুনি? সারা জীবন ঘাড়ে নিয়ে বসে থাকবো নাকি?’ এই বলে বৌদি প্রায়ই খোঁচা দিয়ে দিয়ে বিদ্ধ করে মেয়েটিকে।
অপারক মা শুধু এই সব মুখ বুঝে শোনে আর শাড়ির আঁচলের খুঁটে চোখ মোছে।
আজ পরীক্ষার ফিস জমা দেওয়ার শেষ দিন, 750 টাকা চাই-ই আজ। টিউশন করে পুরো টাকাটা জামাতে পারে না সে। মায়ের হাতে সে কিছু টাকা দেয়, হাত খরচা হিসেবে। নিজের টিউশন , যাতায়াত খরচা নিজেই চালায় সে। বাড়ির থেকে একটা পয়সাও হাত পেতে সে নেয় না। তবু আজকাল বড্ড অসহায় লাগে নিজেকে। কোথায় পাবে সে এতো টাকা? বাবা – দাদাকে আগেই যদিও সে বলে রেখেছিল, কিন্তু আজ বাবার চোখের অসহায় দৃষ্টি বুঝিয়ে দিলো তিনিও অপারক। আর দাদা? বৌদির কথায় সে আজ কপর্দকশূন্য।
মাথা তার কাজ করছিল না কিছুতেই। কী করবে সে? তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের একটা বছর এভাবে শেষ হয় যাবে? অভাব যে তার স্বপ্নে এমন করে ছুরিকাঘাত করবে, তা সে ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত তার কাঁধে মৃদু স্পর্শ করলো। সে চকিতে পেছনে তাকিয়ে দেখে, তার মা। হাসি মুখের মাঝে মায়ের কপালের লাল টিপটা যেন আত্মবিশ্বাসে ঝলমল করছে আজ। হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে মা তাকে বসালো নড়বড়ে তক্তপোষটাতে। তাই দেখে পাশের ঘর থেকে ছেলের বৌ বলে গেলো -‘আদিখ্যেতা।’
কানে তা শুনেও আজ মায়ের মুখে হাসি অম্লান। মা কোথা থেকে এতো শক্তি পায় সেটা সে নিজেও বোঝে না। হঠাৎ তার হাতে মা ধরিয়ে দিলো একটা খাম। কী এটা? কী আছে এতে? খুলে দেখে, টাকা – আটশ টাকা! ! আজ পাড়ার রতনদাকে দিয়ে মেয়ের জন্য নিজের শেষ সম্বল, তার মায়ের দেওয়া ফুলকারী কানেরটা বেচে দিয়েছে সে। বৃদ্ধার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে। মা-মেয়ের চোখের জলের হিসেব কেউ রাখবে না। একটু মুড়ি আলু সেদ্ধ দিয়ে মেখে মেয়েকে খাওয়াতে খাওয়াতে তার মনের পড়ে নিজের কথা। সেও ক্লাস এইটে পড়ার সময় তার বাবা-দাদা বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল জোর করে। তার মায়েরও কোনো বাধা ধোপে টেকেনি।
-‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয় নে মা। কাঁদলে কি চলে? অনেক রাস্তা পারি দিতে হবে।’ মা তার মুখে মুড়ি দিতে দিতে বলে।
চোখের জল আজ যেন বাগ মানতেই চায় না সে দিনের কথা ভেবে। আজ আর মা নেই, কিন্তু আগুনটা মা তার মনে জালিয়ে দিয়েই গেছে। আজ সে নেট পরীক্ষায় সফল। পি.এইচ.ডি. টাও মা তার অনেক কষ্ট করে, জমি বিক্রি করে দাদার সাথে বহু বিবাদ করে তাকে করিয়েছে। মা শেষে কেমন যেন ভাবলেশ শূন্য হয় গিয়েছিল। দাদা-বৌদি আসলে প্রচুর অত্যাচার করতো তো মায়ের ওপর। বাবা গত হতেও তাকে কোনো খবর দেয়নি দাদা, মা মারা যেতেও তাই।
মেয়েটি আজও পড়াশোনায় ডুবেই থাকে। তাই বিয়ে করার ফুরসত পায়নি সে। সে এখন কৃষ্ণকলি হলেও উইমেন্স কলেজের প্রিন্সিপাল। গায়ের রং কালো হওয়াটা তার জীবনের পথে কাঁটা হয় দাঁড়ায়নি কখনোই। বেহারা এসে হাতে একটা কাগজ দিয়ে গেলো। মোটা পুরু চশমার ভিতর দিয়ে কাগজে লেখা নামটা দেখতেই অস্ফুট ভাবে বলে উঠল – ‘দাদা!’
বেহারাকে নিয়ে আসতে বলল। জীর্ণ-শীর্ণ, কংকালসার একটা দেহ। চোখ দু’টো কোন অতীত কোটরে বসানো। মুখ ভর্তি দাড়ি, গোঁফ, মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। প্রথমে চিনতেই পারেনি সে তার দুর্দণ্ডপ্রতাপ দাদাকে। আসলে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর যেহেতু তাকে কোনো বাড়ির থেকে খবর দেওয়া হয়নি, তাই পরবর্তী কালে সেও আর বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। বাড়ির থেকে বহু দূরে নিজেকে সব কিছুর থেকে সরিয়ে রেখেছিল। আসলে লুকিয়ে রেখেছিল সে নিজেকে নিজের থেকে।
‘কী ব্যাপার?’ ভিতরে সমস্ত আবেগকে পাথর চাপা দিয়ে সে বলে উঠল।
শীর্ণকায় লোকটি বলল – ‘বনু, আমি তোর দাদা।’
মেয়েটি বলল – ‘তো?’
লোকটি বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল – ‘বনু, আমি ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে করাতে কপর্দকশূন্য। আমার তুই ছাড়া আর কে নিজের আছে বল?’
দৃঢ় চোয়াল আর ঘৃণা মেশানো দৃষ্টিতে মেয়েটির থুতু ছিটিয়ে দিতে মন চাইছিল বারবার, আর ভাবছিল- কি দিন তার গেছে এক সময়। কি ব্যবহার নিজের দাদা তার সাথে করেছে। মায়ের ওপর কি অকথ্য নির্যাতনটাই না সে করেছে।
-‘আপনি আজ আসুন। আপনার একাউন্ট নম্বরটা দিয়ে যান, টাকা পাঠিয়ে দেবো।’
সামনে বসা লোকটি আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো এবং লোকটি যাওয়ার রাস্তা ধরলো। ঠিক তখনই বজ্র গম্ভীর গলায় কিছুটা ঝাঁঝিয়ে বলে উঠল মেয়েটি- ‘আমি কারুর “বনু” নই। যদি কখনো দেখা করতে আসেন, আমায় ডক্টর কাকলী সেন বলে সম্বোধন করবেন। আমি আপনাকে কতোটা দয়া করতে পারি দেখবো। আর এখানে যতোই না আসেন, ততোই ভালো। কারণ, আমি আমার জীবনের অন্ধকার দিকটাকে কখনোই মনে করতে চাই না। আর কখনোই আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না।’
আজ কিছুতেই দু’চোখের জল তার সীমা রেখা মানছে না। বহু বার বেসিনে গিয়ে নিজের চোখে মুখে জল দিয়ে এসেছে সে। টেবিলে মাথা নিচু করে বসে ছেলে বেলার কতো কি স্মৃতি ভিড় করে আসছে তার মনে, আর ভারী বোঝা হয় যাচ্ছে তার স্মৃতির ভার। হঠাৎ কিছু মেয়ে চিৎকার করে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে ম্যাডামের অফিসে।
‘ম্যাডাম, ম্যাডাম! সোনালীকে জোর করে ওর বাবা-দাদা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আপনি কিছু করুন।’ ফিজিক্স অনার্সের ছাত্রীরা এসে খবর দেয় তাকে।
সাথে সাথেই সে ফোন করে বি.ডি.ও. রত্না বসুকে। আধা ঘন্টার মধ্যেই বি.ডি.ও. কে নিয়ে সে রওনা দেয় সোনালীর বাড়ি। ভরপুর একটা বিয়ে বাড়ি। সোনালীর গায়ে হলুদ হচ্ছে আর বেচারী কেঁদেই চলেছে অনবরত। ডক্টর কাকলী সেন এগিয়ে আসে। চোখের জল মুছিয়ে দিতেই ম্যাডামের বুকে মাথা রেখে সে চিৎকার করে বলতে থাকে – ‘আমি বাঁচতে চাই, পড়তে চাই, আমার স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই …. আমাকে বাঁচান ম্যাডাম।’
নিজের সে দিনের আর্তনাদের কথা মনে পড়ে যায় ডক্টর কাকলী সেনের। মেয়েটির বাবা-মাকে বোঝাতে থাকে জীবনে ছেঁকা খাওয়া দুই মহিলা। সোনালীর পড়ার দায়িত্ব নেয় ডক্টর কাকলী সেন। অনেক মেয়েকেই এভাবে সে জীবনের স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে। স্কুলছুট মেয়েদের স্কুলমুখী করেছে। আজ বড্ড মাকে বলতে ইচ্ছে করছে ডক্টর কাকলী দেবীর – ‘মা, আমি তোমার বিক্রি করা কানের দুল আর ভিক্ষে করে আমাকে লেখাপড়া শেখানোর মর্যাদা আজ রাখতে পেরেছি। শুধু তোমার দেওয়া মনের জোর আর উপর থেকে আশীর্বাদটুকু থেকে আমায় কখনও বঞ্চিত করো না, মা।’
সমাপ্ত
………….