ডেড লেটার
-শুভায়ন বসু
“কি সব চিঠি আসে দেখুন অনিলদা, কি যে করব এদের নিয়ে!” বিরক্তির সঙ্গে একটা সুন্দর গোলাপী খাম পোস্টমাস্টার অনিল ঘোষের হাতে প্রায় জোর করে ধরিয়ে দিয়ে পালায় পোস্টম্যান হারু।
অনিল বাবু খামটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে একটু দেখলেন। এরকম বেশ কিছু চিঠি প্রতিদিনই জমা পড়ে, যার হয় ঠিকানা ঠিকমত লেখা নেই বা ভুল লেখা আছে। এসব চিঠি ডেডলেটারের খোপে জমা হয় আর কয়েক বছর পর পর অনেক জমে গেলে, অকশন করে দেওয়া হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এই চিঠিটা হারু কেন যে তার হাতেই দিয়ে গেল বুঝে পেলেন না অনিলবাবু। হাতের লেখাটা4 বাচ্চার আর চিঠিটা লেখা হয়েছে ভগবানকে ।খামের উপর ডাকটিকিটও ঠিকঠাক বসানো ।চিঠিটা পাশে রেখে নিজের কাজে ডুবে গেলেন তিনি। মফস্বলের পোস্টঅফিস হলেও, স্টাফ কম বলে চাপ খুবই বেশি। তার ওপর তিনি আবার পোস্ট মাস্টার। টিফিন টাইমে ভিড় একটু পাতলা হতেই তিনি চিঠিটা হাতে নিয়ে আবারও দেখেন। একটা বাচ্চা ভগবানকে কি চিঠি লিখেছে তা জানতে বড় কৌতুহল হয়। ডেডলেটার বলেই শেষে খামটা আস্তে আস্তে খুলে চিঠিটা বার করে ফেলেন অনিল বাবু। গোটা গোটা অক্ষরে কয়েক লাইনের চিঠি ,একটা বাচ্চারই কান্ড। চিঠিটা এরকম।
প্রিয় ভগবান,
তুমি তো আকাশে থাক, মা বলেছে। আমার বাবাও তো আকাশে চলে গেছে ।সবার বাবা আছে,কিন্তু আমি কখনো আমার বাবাকে দেখিনি ।শুনেছি সে তোমার কাছে আছে ।সবাই নাকি মরে গেলে তোমার কাছে চলে যায়। ভগবান আমার বাবাকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে বাবাকে ।বাবা কেমন আছে ?আমার আর মা’র কথা বলে ?বাবা কি আমাদের কাছে আর কখনো আসবে না ?তুমি বাবাকে আমার কথা বোল, আর বোল আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি। বাবার কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না ?তাহলে আসে না কেন?আমার এবারের জন্মদিনে একবার নেমে আসতে বলো প্লিজ। ভগবান, আমার এই কথাটা বাবাকে জানিও ,তাহলেই বাবা ঠিক চলে আসবে ,আমি জানি। শুভ্র দাস পড়তে পড়তে চোখে জল এসে যায় অনিলবাবুর। চোখটা রুমালে মুছে, চিঠিটা যত্ন করে খামে ভরে রেখে দেন ।ঠিকানাও লেখা আছে ছেলেটার, চিঠির এককোণে। একবার ভাবলেন চিঠিটা ফেরত পাঠিয়ে দেবেন ‘আনডেলিভার্ড’ বলে।
আনমনে ভাবতে থাকেন নিজের জীবনের কথা ।তার বাবাও এইভাবেই একদিন খুব ছোটবেলায়, দুম করে মরে গেলেন। ক্যান্সারে। তখন অনিল বাবুর বয়স মাত্র দশ। সেই থেকে কত খুঁজেছেন বাবাকে, আকাশে নক্ষত্র মন্ডলের দিকে তাকিয়ে, বর্ষার দামাল মেঘের ঘনঘটার মধ্যে বা বাজারে হঠাৎ কারও দিকে চোখ আটকে গেলে। বাবার অল্প চেনা ছবিটা খুঁজে গেছেন কতদিন। যদি পাওয়া যায়! মন মানেনি যে বাবা নেই। এই ছেলেটাও হয়ত তাই। জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছে ।কি জানি কি ভাবে ?হয়তো কোন অ্যাক্সিডেন্টে! বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখেছে, এও বাবার অনুসন্ধান চালাচ্ছে। অবুঝ মনের আর কি দোষ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অনিলবাবু।
বিকেলে পোস্টঅফিস ফাঁকা হতে, যে যার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে উঠতে থাকে। তখনই বন্ধু ও সহকর্মী মাধববাবুকে ডেকে চিঠিটা দেখান তিনি। মাধব চিঠিটা পড়ে হেসে বলল ” যতসব ছেলেমানুষি! নাও, এবার এটা ভগবানের কাছে পাঠাও দেখি! ছেলেটা কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।” বলে উঠে পড়ল।
অনিলবাবু ভাবনায় পড়ে যান ।চিঠিটা ডেডলেটারের খোপে পাঠাতে তারও বাধে। ছেলেটার আশায় তাহলে একরাশ জল ঢেলে দেওয়া হবে। কত আশা করে ,শিশুর নিষ্পাপ ভালোবাসা নিয়ে,না দেখা প্রিয় বাবার জন্য অপেক্ষা ।শেষে তিনি ডেড বাবার মত চিঠিটাও ডেডলেটার করে দেবেন! না, একবার অন্তত, শিশুটির মুখে হাসি ফোটাতেই হবে ।একবার অন্তত, পিতৃহীন ছেলেটিকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করবেন না। নিজের ছোটবেলার যন্ত্রনা মনে পড়ে গেল।
সব স্টাফেরা চলে গেলে, নিজের ডেস্কে একটা সাদা খাম আর সাদা কাগজ টেনে নেন তিনি। চোখের জল আজ বাঁধ মানছে না। চোখটা রুমালে আরো একবার মুছে ফেলে, লেখা শুরু করেন।
প্রিয় শুভ্র,
তোমার চিঠি পেয়েছি। পোস্টম্যান অনেক কষ্টে অনেক তারা আর উল্কা পেরিয়ে, শেষমেষ আমার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। তোমার বাবা আমার কাছেই আছেন। এই আকাশে উনি খুব ভালো আছেন। রোজ4 বিকেলে আমরা এখানে বসে তোমাকে দেখি ।তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ, তোমার কত কথা আমাকে বলেন। তুমি কখন খাও ,কি খাও, কি বই পড়, কখন খেল, মার সঙ্গে কখন দুষ্টুমি কর, আর কখন মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি স্বপ্ন দেখ, সেটাও তোমার বাবা বলেন ।বলেন, তুমি একদিন খুব বড় হবে। তোমার মন হবে উদার, তোমার দৃষ্টি হবে স্বচ্ছ। তুমি গরিবদের, অসহায়দের ভালবাসবে। তোমার বাবা তো আর তোমার কাছে যেতে পারবেন না। শুধু তুমি যখন এক একটা ভালো কাজ করবে, পড়াশোনা- খেলাধূলা- ছবিআঁকা বা যে কোন ভালো কাজে সফল হবে, তখনই তোমার বাবা খুব খুশী হবেন আর তুমি তোমার মন দিয়ে তখনই সেটা বুঝতে পারবে। এই ভাবেই তুমি তোমার বাবাকে পাবে ।তোমার বাবা জানেন, তুমি তাকে কত ভালবাস। তাই তোমার জন্য পৃথিবীতে ,অনেক খুশি, আনন্দ আর ভালোবাসা সাজিয়ে রেখে এসেছেন ।বড় হবার পথে, ধীরে ধীরে ,তুমি সেগুলো খুঁজে পাবে আর বুঝতে পারবে ।তোমার বাবা সব সময় তোমার কাছে আছেন। ভালো থেকো।ইতি,
ভগবান পোস্টঅফিসের দরজা বন্ধ করে ,চিঠিটা লেটারবক্সে ফেলে ,আকাশের দিকে তাকিয়ে অনিলবাবুর মুখে একটা প্রশান্তি ফুটে ওঠে। যদিও তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে, আকাশ অন্ধকার। তবু দূর কোন দেশের কোন দূরতম তারার থেকে একটা মনের বার্তা পান তিনি, তার মনটা ভারি ভালো হয়ে যায়।
বাহ খুব সুন্দর . .
ধন্যবাদ