ভাল ছেলে
-ডাঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
দেখতে দেখতে আমাদের রূপা,
বিবাহযোগ্যা হয়ে গেলো-
যেন এই কিছুদিন আগের কথা, বলে মনে হয়-
অন্নপ্রাশন, ইস্কুলের প্রথম দিন,
ইস্কুলের শেষ পরীক্ষায়,
ছোট্ট মেয়েটির সাথে নিজেকে
চব্বিশ ঘন্টার রুটিনে
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা।
আমার হাত ধরে, নাটকের মঞ্চে
প্রথম গান গাওয়া,সব যেন-
সেদিনের কথা!
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ;
কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে চাকরি-
দেখতে দেখতে ছাব্বিশটা বসন্ত,
যেন দৌড়তে দৌড়তে পেরিয়ে গেলো-
অনেক বড় হয়ে গেল ছোট্ট মেয়েটা,
হঠাৎ করে!
২
সেই রূপা আজ অনেক বড় হয়ে গেলো
সে আজ তার জীবনের
এক বড় পরীক্ষার সামনে;
মেয়েরা বড় হলে বাপ,মায়ের মনে
সবচেয়ে আগে যে ভাবনার কালো মেঘ,
ছেয়ে ফেলে মনের আকাশ-
সুপাত্রস্থ করবার ভাবনা,
আমিই বা তার ব্যতিক্রম হই কি করে!
পাত্র দেখা শুরু হল, মামা, মাসী, জ্যাঠা,পিসী
কেউ পিছিয়ে থাকলো না-
ভালো পাত্রর তালিকা দীর্ঘায়িত হতে থাকলো
সবাই একটা করে সম্বন্ধ নিয়ে আসে,
মায়ের পছন্দ হয় তো মেয়ের হয়না
মেয়ের পছন্দ হয়তো,মাসী আর মামারা-
লাল পতাকা নেড়ে, নাকচ করে দেয়
ঠিক পাকা কথা বলবার দিনেই,
এভাবেই যবনিকা পড়ে,
সাত সাতটি বাড়িতে
বিয়ের মাচা বাঁধার সব সম্ভাবনা
কখনো সলতে পাকাতে পাকাতে,
কখনো তার আগেই।
৩
সেদিন উদভ্রান্ত অবস্থায় নীচের বারান্দায় বসেছিলাম-
পাশের বাড়ির অমলেশ এসে বললো
দাদা- এত চিন্তা করছেন কেনো!
রুপু কি আমাদের ফেলনা মেয়ে-
আইন নিয়ে পড়েছে, এখন ভালো চাকরি করছে-
ওর বিয়ে কে আটকায়!
দেখবেন একেবারে হৈহৈ করে,
হয়ে যাবে ওর বিয়ে-
আপনি সানাই বাজাবার তোড়জোড় শুরু করে দিন।
অসহায় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার দৃষ্টির সামনে,
যে কথা রসিকতার মতো,
বড় বেমানান।
অমলেশ বললো,”আমার এক চেনা ছেলে আছে
আমার বন্ধুপুত্র-
সুপাত্র বললেও কম বলা হয়” ;
আমেরিকায় থাকে- সুদর্শন
প্রচুর টাকা,গাড়ী, বাড়ি, সম্পত্তির ছড়াছড়ি!
খুব সুখে থাকবে মেয়ে আপনার।
পিতৃহৃদয়ের খরাক্লিষ্ট মাটিতে,
এ যেন আষাঢ়ের ধারা, চোত, বৈশাখ পেরিয়ে
শীতলতার ছোঁয়া দিয়ে যায়, তৃষ্ণার্ত মাটিকে।
পিতার বোবা দৃষ্টিতে শিকড় আকড়ে,
জল থেকে-
পাড়ে উঠবার একটা ইঙ্গিত ছিল;
আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোক অমলেশ
সেটা পড়তে পেরেছিলো।
সে বললো,দু’টি রোববার পরে চলুন দাদা-
ছেলেটি, দেশে তিন দিন আগেই ফিরেছে,
আজ শুক্কুরবার, কাল বাদ দিয়ে পরশু-
ছেলের বাড়িতে রূপাকে নিয়ে যাবো।
আমি বললাম, এখন কেন,
দিন দশেক পরে আমরাই তো যাবো!
এখন ছেলে মেয়েরা, নিজেরাই,
নিজেদেরকে বুঝে নিতে চায়-
তারপর পাকাকথা, সিন্দূরদান, সংসার,
ওসব অনেক পরে,
প্রতিবেশীর যুক্তি এড়ানো, ভার।।
৪
সাতসকালেই অতি উৎসাহে,
আমরা পাঁচজন, হাজির-
সাউদার্ন এভিনিউর, ঝাঁ চকচকে বহুতলে
একটা এম্বাসেডরে, ভাড়া করা গাড়ি-
ওখানে গাড়ি ছাড়া যেতে নেই,
এমনই অলিখিত নিয়ম,
বলেছিল আমার ক্লাস টুয়েলভে পড়া ছোটমেয়ে
মাথা নেড়েছিলাম
সায় দিয়ে।।
ছেলে বিদেশে থাকে, ইঞ্জিনিয়ার-
মস্ত বাড়ি, বিদেশী গাড়ি, আসবাব দামী,
অনেক বেতন পায়, কোটি অধিক।
কথা এগোল, তবে মুল কথাটা হল
খাবার থালা হাতে ধরাবার পর;
বরপণের তালিকাটা চলে এলো সাথে সাথেই।
৷ ৫ ।
“পঞ্চাশ ভরি গয়না, নমস্কারি, দু’ লাখ টাকা নগদ,
ফ্রিজ, টিভি, ঘর ঠাণ্ডা করবার যন্ত্র,
এই কয়েকটা মাত্র জিনিষ, সারাজীবনের জন্য
মেয়েকে দিতে পারবেন তো-“
একটি মহিলা কন্ঠের, সুরেলা বান,
বিদ্ধ করলো আমায়।
ছেলের মাসী বললো, “ওরা দু’জন দু’জনকে,
ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে,
আপনারা দেনা পাওনায়
রাজি হলেই আর কিসের দেরী!
অঘ্রাণেই হয়ে যাক চার হাত এক,
এই শ্রাবণেই সব হয়ে যাক পাকা
কি বলে আপনাদের মন!”৷
হঠাৎ বজ্রপাত হল মাথায়,
একাত্তর বছরের বাবার,
বাবার মলিন মুখটা কেমন যেন,
ঘোর লাগিয়ে দিলো মাথায়,
হঠাৎ নিজেকে হারিয়ে ফেলে,
চীৎকার করে উঠলাম-
“শুধু আমার এই জন্মে কেন!
আরো পাঁচটা জন্মও যদি হয়-
এভাবেই কেটে যাক, আমার জীবন ;
অবিবাহিতা রয়ে যাবো, শুনবো গঞ্জনা
বলুক না হয় আমায়
বাবা,মায়ের গলগ্রহ হয়ে আছি আমি
তবু সীমন্তে আর রাঙাবো না সিন্দুর
“নিজের ঘর” না হয় হবে না আমার ,
কোন ভিক্ষুকের বাসায় নিজের বাকী জীবনটা,
কাটাবোনা, এভাবেই রয়ে যাব, অন্যভাবে
আমার জীবনকে দেবো, নতুন পরিচয়!
যদি পাই “মানুষ”,
তবেই রাঙবে সিঁথি লাল সিঁদুরে-“।
একটু দুরেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল
আমার অমলেশ কাকা-
কাছে গিয়ে তাঁর হাতটা ধরে বললাম,
কাকা তুমি তো কোন ভুল করোনি,
সবাই ভাল পাত্র বলতে তো শুধু,
গাড়ি, বাড়ি, ধন-দৌলত
এইসব কিছুকেই সবার উপর
রেখে দিয়ে, ভাল আর খারাপের গন্ডী টেনে দেয়-
মনের মূল্যায়ন কেউ করেনা!
তাই তোমাদের সবারই কষ্টিপাথরে
এরাই সোনার টুকরো, “ভাল ছেলে”।।