ধোঁয়া

ধোঁয়া
-রাখী চক্রবর্তী

 

অতনু হালদার

তুই খুব মালদার
–‘এই ই ই না ,না আমি মালদার না। আমার বাবা মালদাতে থাকত। আমাকে টালির ঢিপি বলতে পারিস। হা হা হা।
আমি আর নিশা বইমেলায় যাচ্ছি। ট্রেনে যেতে যেতে স্মৃতি রোমন্থন করছি। কতদিন অতনুর সঙ্গে দেখা হয়নি।
—এই নিশা তোর বিয়েতে অতনুকে বলেছিস তো। না কি চুপিচুপি কাজ সারবি।
–দূর পাগল না কি, অতনু যদি কথায় কথায় বলে দেয় ওর আর আমার সম্পর্কের কথা। বিয়ে বাড়িতে কত লোকজন। রিস্ক নিয়ে কি লাভ।
—না রে এমনি বলছিলাম।
বইমেলা থেকে ফিরতে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেল। রাত আটটা বাজে এখনও ট্রেন পেলাম না। সাউথে লোকাল ট্রেনের খুব ভোগান্তি হয়।
বুঝলি নিশা আজ বাদে কাল তোর বিয়ে, এত রাতে বাড়ির বাইরে থাকাটা ঠিক না।
–হুর,ছাড় তো ও সব। তুই আছিস তো। শোন তুই কিন্তু কাল থেকেই থাকবি। বন্ধু বলতে তো শুধু তুই। আর তো সব হারিয়ে গেছে।
-কেন,অতনু তো আছে। ও তো হারিয়ে যায় নি।তুই হারিয়ে দিয়েছিস ওকে ।
-নে ওঠ ওঠ ট্রেনটা মিস করা যাবে না।
ঝিকঝিক কুউউ, ট্রেন চলছে। আমরা দু’জনে মুখে কুলুপ এঁটেছি।
সুভাষগ্রাম স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে।
আমি অতনু বলে চিৎকার করতেই নিশা আমাকে ধমক দিয়ে বলল, তোর পাগলামি বন্ধ কর।
আমি বললাম ঐ দেখ অতনু দাঁড়িয়ে প্লাটফর্মে।
নিশাও তাই দেখল। চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে অতনু জানলার সামনে এসে বলল- নিশা একটু বাইরে আসবি? একটা কথা বলার ছিল।
নিশা বলল- এখানেই বল
-একটু প্ল্যাটফর্মে আয়। প্লিজ
নিশা একটু ভাবল তারপর আমাকে বলল, ট্রেন হুইসিল দিলেই উঠে পড়ব। চিন্তা করিস না।
মহা জ্বালাতনে পরলাম রে বাবা। ট্রেন কেন ছাড়ছে না!
নিশা উঠে পড় ট্রেন ছাড়ছে। নিশা..নিশা..
অতনু নিশাকে জাপটে ধরে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। নিশা ওর হাত থেকে কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। ট্রেন আস্তে আস্তে তার গতি বাড়াচ্ছে। আমি বাড়িতে গিয়ে কি বলব, কাকিমাকে! আজ বাদে কাল ওর বিয়ে।
ওমা,অতনু আর নিশার মাঝখানে এত ধোঁয়া কেন? কিছুটা অস্বস্তি কিছুটা ভয় নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে বাড়ির দিকে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি নিশার মা ওদের জানলার থেকে মুখ বাড়িয়ে একটু বকার ছলেই আমাকে বলছে তোর এত দেরি হল কেন? নিশা তো কখন বাড়ি চলে এসেছে।
আমি ও বলে দিলাম,আমার একটু কাজ ছিল কাকিমা। আমি বাড়ি এসে একটু বিশ্রাম করছি হঠাৎ নিশা আমার ঘরে এসে কাঁদছে। কিরে তুই আবার এত রাতে এখানে এসে কাঁদছিস কেন?অতনুর চাদরটাও গায়ে দিলি। কি ব্যাপার রে তোর,হুম..
নিশা বলল,অতনু আমাকে বিয়ে করল রে , এই দ্যাখ আমার মাথায় অতনুর দেওয়া সিঁদুর।
আমি নিশার মাথার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। পুরো মুখটাই তো সিঁদুর এ ভর্তি । শুধু চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। নিশা, নিশা… 
আমার মা ঘরে ঢুকে বলছে -কোথায় নিশা আর তোর ঘরে এত ধোঁয়া কিসের? 
তাই তো এতো ধোঁয়া কোথা থেকে এল।
নিশার কান্না, ঘরে ধোঁয়া, অতনুর চাদর এ সব কিছু আমাকে এত ভাবাচ্ছে কেন?  ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি তা নিজেই জানি না। সকাল বেলায় চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল।

মা এসে বলল- তাড়াতাড়ি নিশাদের বাড়িতে চল। নিশা আর বেঁচে নেই। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এক ছুটে নিশার বাড়িতে গিয়ে যা শুনলাম তাতে আমার গা হাত পা এখনও কাঁপছে। ভোর বেলায় রেল কর্মীরা নিশার মৃতদেহ উদ্ধার করে।
ডাক্তার বাবু নিশার ডেড বডি দেখে বলেছেন যে রাত নটার আশেপাশে নিশার মৃত্যু হয়েছে। নিশার গা থেকে একটা চাদর পাওয়া গেছে যাতে কোন রক্তের দাগ নেই। তাছাড়া নিশার জামা মুখ সব রক্তে লাল। নিশার মা এ সব মানতে নারাজ। কাকিমা একই কথা বলে চলেছে ‘রাত নটার সময় নিশা আমার কাছে ছিল।’ 
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। নিশা তো রাতের বেলায় আমার ঘরেও এসে ছিল।সিঁদুরে পুরো মুখ লাল। এর মধ্যে আমাকে অতনুর দাদা ফোন করে বলল,”কাল বিকেল থেকে তোকে আর নিশাকে অনেক বার ফোন করেছি লাইন পাইনি রে। এই এখন পেলাম।
-কি হয়েছে দাদা এত সকালে ফোন করলে?
-অতনু কাল বিকেলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। একটা চিঠি তোর জন্য আছে। অতনু মরার আগে লিখেছে, রাখছি।
আমার কাছে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। অতনু নিশাকে সত্যিই ভালবাসতো। শুধুমাত্র অতনুর আর্থিক অবস্থা ভাল নয় বলে নিশা অতনুকে ছেড়ে ধনী সমরকে বিয়ে করতে রাজি হয়। অতনু প্রতিশোধটা নিয়েই ছাড়ল। নিশার মুখটা লাল।নববিবাহিতা বধুর সিঁথি লালটুকটুক থাকে। নিশার সিঁথি সহ মুখটা লাল টুকটুকে ।বিয়ের লাল বেনারসি শাড়িটা পড়ে শেষ যাত্রায় যাচ্ছে নিশা। অতনুর চাদরটাও আছে। নিশার শেষ যাত্রাটা-ও ধোঁয়াময়। অতনুর হিসাবের খাতা আজ পরিপূর্ণ। আজ অনন্ত আকাশে ওদের মিলনের বাঁশি বাজবে। পৃথিবীর বুকে ওরা একদিন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। আর ধ্বনিত হবে সেই পার্থিব মন্ত্র “যদিদং হৃদং মম,তদিদং হৃদং তব,”

Loading

Leave A Comment