বদল

বদল
-পারমিতা চ্যাটার্জী

 

বেশ তো চলছিল সুমেলার আর সৌরভের সংসারটা। রাগ অভিমান আবার ভালোবাসার মিষ্টি মধুর রস নিয়ে চলে গেলো তাদের জীবনের দু’টি বসন্ত।
সৌরভ ওকালতি পাশ করে উকিল হিসেবে বেশ নাম ডাক করে ফেলেছে। সন্ধ্যার পর থেকে তার চেম্বারে প্রচুর ভিড় হয়। উকিল হলেও সৌরভ খুবই রাবীন্দ্রিক মনোভাবাপন্ন। রবীন্দ্রনাথই তার জীবনের জীবনদর্শন । রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতিটি কথার মধ্যে সে এক একটি দার্শনিক তথ্য খুঁজে পায়। এতোই গভীর ভাবনা তার। প্রত্যেক দোলে তার একটি গানের দল আছে যারা প্রায় সবাই সাংস্কৃতিক মনোভাবের, তাদের নিয়ে সে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুড়িতে প্রকৃতি ভবনের আমন্ত্রণে প্রোগ্রাম করতে যায়। স্ক্রিপ্ট সে নিজে লেখে, বাকিরা কেউ গান, কেউ নাচ, কেউ বা আবৃত্তি করে, পাঠে সে নিজে আর নয়না বলে তার এক যৌবনের প্রথম দিকের বান্ধবী দু’জনে মিলে থাকে। আর সুমেলা একটি আইটি সেক্টরে কাজ করে, রাজারহাটে তার অফিস।
সুমেলা গান বাজনা ভালোবাসলেও সৌরভের মতোন অতো উৎসাহী নয়। সে ভালোবাসে তার কাজকে, কাজই তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। কি করে আরও ওপরে ওঠা যায়, কি করে নিজের প্রোজেক্টকে আরও সুন্দর ভাবে প্রেজেন্ট করা যায় সেই নিয়েই চলে তার চিন্তা ভাবনা।
বসন্ত এসে গেছে, মানে সামনে দোল, সৌরভ রিহার্সাল শেষ করে রাত প্রায় এগারোটার বাড়ি ফিরলো। তখনও সে গুণ গুণ করে সুর ভাঁজছে, ” ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়, করেছি যে দান “।
কাজের যে মহিলাটি আছেন মিনতি মাসি তাকে খাবার গরম করতে বলে সে ঘরে এলো।
এখন বসন্ত, রোমান্টিক সৌরভের মনেও বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। ঘরে ঢুকে দেখে সুমেলা গভীর মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কাজ করে চলেছে।
সৌরভ পেছন থেকে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঠেকালো, এরকম সে প্রায় করে থাকে, সুমেলাও হাসিমুখে সৌরভের আদরে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। আজ হঠাৎ সে এক ধাক্কায় সৌরভকে সরিয়ে দিয়ে বললো- “দেখছো একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছি, তুমি কি কিছুই বোঝোনা! “
সৌরভ চমকে উঠলো,” এরকম তো আমি করেই থাকি, আজ হঠাৎ তোমার এতো রাগের কারণ বুঝলামনা তো।”
-কি আবার হবে, কাজের সময় এখন, ভালো লাগছেনা তোমার আদিখ্যেতা,
এতো বাজে ভাবে কথা বলছো তুমি! তুমি না একজন শিক্ষিতা আইটি সেক্টরে চাকরি করা মেয়ে!
– তো? সবসময় কি আমাকে মার্জিত হয়ে থাকতে হবে না কি?
– সৌরভ তাও কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলতে গেলো,” বুঝতে পারছি, তুমি আজ খুব পরিশ্রান্ত, ওকে রেস্ট নাও, আমিও শুয়ে পড়লাম “।
সুলেমা বিছানাটা হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো প্লিজ।
মিনতি মাসি খুব কুণ্ঠিত হয়ে দরজার বাইরে থেকে ডাক দিয়ে বললো দাদা খাবেনি?
– ও হ্যাঁ যাচ্ছি, সুমেলা তুমি খাবে তো না কি?
– উফ্ এবার দেখছি বেডরুম আলাদা করে নিতে হবে, সমানে ডিস্টার্ব করে আমার কনসেন্ট্রেশন নষ্ট করে দিচ্ছে, আমাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয় বুঝেছো! তোমার মতন চোর ডাকাত নিয়ে আমার কারবার নয়। আর আমি না খেয়ে থাকবোই বা কেন অতো আদিখ্যেতা আমার
নেই।
ও এতদিন তো ছিলো, হঠাৎ একদিনেই বদলে গেলো কেন সেটাই বুঝতে পারছিনা, যাক তুমি তোমার কাজ কর, আমি খেয়ে নিয়ে অন্য ঘরে শুয়ে পড়ছি।
– বেশ তাহলে তো ভালোই হলো।
স্তম্ভিত হয়ে গেলো সৌরভ ওর কথা শুনে, কি এমন হল! হঠাৎ একদিনেই সব পাল্টে গেলো। সুমেলা কি কিছু বুঝতে পেরেছে! নাঃ বোঝার তো কথা নয়, সে তো সুমেলার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই চলে, মনের কথা বোঝার মতন অতো সময় তো ওর নেই- তাহলে!
অশান্ত মন নিয়ে সৌরভ শুতে গেলো কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা। খালি মনে হচ্ছে অসম্ভব কাজের চাপে সুমেলা হয়তো রাগ দেখিয়ে ফেলেছে কিন্তু কাজ শেষ হলেই তাকে ডাকতে আসবে শুতে যাবার জন্য।
বেশ কিছুক্ষণ ছটপট করার পর সৌরভ উঠে দেখতে গেলো সুরেলা ঘুমিয়েছে না কি!
গিয়ে দেখলো সে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। তাও ভালো হয়তো ভীষণ ক্লান্ত, কাল সব ঠিক হয়ে যাবে, এই আশা নিয়ে সেও গেলো শুতে কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়েও পড়লো।
সকালে উঠে দেখলো সুমেলা অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে, অবাক হয়ে সৌরভ ভাবলো হঠাৎ একদিনের মধ্যে এতো পরিবর্তন!
দেখলো একটা ছোটো সুটকেসে কিছু জামাকাপড় গোছানো হয়েছে, সৌরভ জানতে চাইলো, “এগুলো কি সুমি? “
সুমেলা বেশ ঝাঁঝের সাথে উত্তর দিল, “আমি অফিস ট্যুরে যাচ্ছি, ফিরতে কদিন সময় লাগবে।”
হ্যাঁ তোমাকে আমার কিছু বলার ছিলো..
– হ্যাঁ বলো আমিও শুনতে চাই, হঠাৎ এই বদলের কারণটা কি?
-আমি তোমার সাথে এতোদিন মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারলাম না..
-মানে!
-মানে তোমার ওই শান্তিনিকেতন, গানের আড্ডা, আমি জাস্ট বোর হয়ে গেছি, ফিরে এসে আমি ফাইনালি চলে যাবো।
-চলে যাবো মানে!
-মানে এখনকার দিনে এতো অ্যডজাস্ট করে চলার কোনো মানে হয়না, এতো মানিয়ে নিতে নিতে আমার ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। তুমি শুধু নিজের আনন্দ, নিজের ভালোলাগা নিয়ে ব্যাস্ত থাকো, কখনও কি জানতে চাও আমার ভালো লাগছে কি না?
সৌরভ অবাক হয়ে বললো ” তুমিও তো কখনও বলো নি, একবার বললেই আমি তোমার ভালোলাগাকেও নিশ্চয়ই প্রাধান্য দিতাম।”
-সব কিছু মুখে বলে হয়না সৌরভ, আমি অনেকবার তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি পাত্তাই দাওনি।
-মানছি তাহলে আমার ভুল হয়েছিল, তাবলে ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে!
-তাই যায় সৌরভ, যদি মনের কোণটা ফাঁকা থেকে যায় তাহলে সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ করে যায়। তুমি তোমার স্মৃতি বউদির দুঃখে কাতর, তার গান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে তোমার কতো চিন্তা ; তার অমন ভালোমানুষ স্বামী সে না কি স্মৃতি বউদির গানের জন্য কোনো চেষ্টাই করেনি, তাই বউদিকে তোমাকে ফাংশনে নিয়ে যেতে হয়, তার চোখের জলের মূল্য তোমার কাছে অনেক বেশি, আর আমি যে একজন ভালো বাচিক শিল্পী, আমার কবিতা বলা, শ্রুতিনাটক যে বন্ধ হয়ে গেছে, তারজন্য তুমি কতটুকু কি করেছো সৌরভ?
নিজের শখ পূরণের জন্য যেমন স্মৃতি বউদিকে তোমার হাত ধরতে হয়েছে তেমনি আমার গুণকে প্রকৃত মর্যাদা দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত বাচিক শিল্পী করার জন্য আমারই অফিসের সিনিয়র ম্যানেজার এগিয়ে এসেছেন, আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমায় অনেক সুযোগ করে দিয়েছেন। তোমার যেমন চেম্বারের পর অনেকক্ষণ ধরে স্মৃতি বউদির গান না শুনে ওর সাথে সময় না কাটিয়ে রাত্রে ঘরে ফিরতে মন লাগেনা, তারপর ফিরে এসে একটু শুকনো আদর দিয়ে কোনরকমে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়, একবারও ভাবোনা আমি কতটা বঞ্চিত হচ্ছি, একে তুমি ভালোবাসা বলো?
কিসের ভালোবাসা সৌরভ! কোনো ভালোবাসা আর অবশিষ্ট নেই। তোমার এই নিষ্প্রাণ ভালোবাসায় আমি ক্লান্ত, এতোদিন বুঝিনি, একদিন হঠাৎ আমার চোখ খুললো, যেদিন আমি অফিস থেকে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসে কাঁপতে কাঁপতে তোমাকে ফোন করলাম, সেদিন তুমি কতো বিরক্ত হয়ে বলেছিলে, ‘কি করে জ্বর বাঁধালে! ডাঃ চক্রবর্তীকে ফোন করে ডেকে নাও”, বলে তোমার কর্তব্য শেষ করে দিলে। রাতে এসেও আমাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেনা যে, আমি ওষুধ খেয়েছি কিনা! ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে তুমিও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লে, সেদিন আমি বুঝতে পারলাম, স্মৃতি বউদির আকর্ষণ তোমার কাছে কতো তীব্র, আমি একটা মেয়ে হয়ে এ অপমানটা মেনে নেবো কেনো বলতে পারো? আমি স্বনির্ভর তাই নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিলাম।
সৌরভ দেখলো সুমেলা তার সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আজ সে সত্যি বাধা দিতে পারছেনা, নিজের কাছে নিজেই এক চরম অপরাধী হয়ে গেলো, মুখ নীচু করে বসে থাকা ছাড়া আজ আর কিছু করার নেই তার।

Loading

Leave A Comment