সাজা
-রাখী চক্রবর্তী
টিক্ টিক্ টিক্..
সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা। বিরাম নেই, সময়ের পথ চলা। সবাই বলে সময়ের সাথে পা মিলিয়ে চল। কিন্তু কিভাবে, সবাই যদি সময়ের সাথে পা মিলিয়ে চলে তাহলে ব্যর্থতা জীবনে আসে কেন? রকিও তো সময়ের সাথে চলতে চেয়েছিল…
তাহলে ওর জীবনে কেন এই দুর্যোগ এল?
রকি ছোট থেকেই ক্রিকেট খেলতে ভালবাসত। ওদের বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠোনটাকেই মাঠ ভেবে ও খেলত। নিজেই ব্যাট করছে বল করছে। এক একদিন পাড়ার দু’ একটা ছেলে আসত ওর সাথে খেলতে।পাড়ার দুর্গা পুজোতে রকির বাবা এক হাজার টাকা চাঁদা দেয়নি বলে রকির মাঠে খেলা বন্ধ হয়ে গেল ।
রকির পাশের বাড়ির দেবু কাকু উনি দশ হাজার টাকা চাঁদা দেন প্রতি বছর। তাই ওনার দাপট পাড়াতে বেশি।
ওদের বাড়ির আর দেবুকাকুর বাড়ি র দেওয়াল একটাই। এই নিয়ে নিত্যদিনের ঝামেলা লেগেই আছে। রকির বাবা সামান্য মুদির দোকানের কর্মচারি তাই ওনার সব কথাই ফালতু। পাড়ার কেউ শুনতেই চায় না ওনার কথা।
রকির মা সেদিন দেওয়ালে একটা পেরেক ঠুকছিল জামা কাপড় শুকানোর জন্য দড়ি বাঁধবে বলে, সেই দেখে তো দেবুকাকু আর কাকিমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। আবার অশান্তি শুরু হল।
দেবুকাকু বলল- তোদের জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব একদিন।
এই ভাবেই চলছিল রকির জীবনযাত্রা।
এক টুকরো জমিতে খুব কষ্ট করে ঘর বানিয়ে ছিল রকির বাবা। কিন্তু দেবুকাকু এক ইঞ্চিও ছাড়ল না। এই জমির মাপ নিয়ে দেবুকাকু রোজ ঝামেলা পাকায়।
এর মধ্যে একদিন খেলতে খেলতে রকি ক্যমবিস বল এমন ভাবে ছুঁড়লো, সোজা দেবুকাকুর জানালায় গিয়ে লাগল, ব্যাস জানলার কাঁচ ঝড়ঝড় করে ভেঙ্গে গেল।
দেবুকাকু সেদিন রকিকে খুব মেরেছিল। রকির মার খুব শরীর খারাপ হয়ে ছিল তাই ওর বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল ওর মাকে। বাড়ি ফিরে ওনারা অচৈতন্য অবস্থায় রকিকে দেখতে পান।
পাড়ার লোকজন নিয়ে দেবুকাকুর বাড়িতে গিয়ে ও কোন লাভ হল না। সবাই রকির দোষই দিচ্ছে। জানলাটা কেন রকি ভাঙ্গল।
রকি কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার ব্যাট বল নিয়ে খেলা শুরু করল। রকির এখন ক্লাস নাইন হল। বেশ লম্বা রকি। লেখাপড়াতেও ভালো।গরীব ঘরের ছেলে তো তাই কোন চাহিদা নেই কিন্তু একটা ভালো ব্যাট কেনার খুব ইচ্ছে হল ওর। স্কুল থেকে ফিরে মার কানে কানে বলল- একটা বড় ব্যাট কিনে দেবে মা ছুটির পর স্কুলের মাঠে প্র্যাকটিস করব।
ওর মা হেসে বলল- তোর বাবাকে বলি যদি সম্ভব হয় তোকে একটা ব্যাট কিনে দেব।
একমাসের মধ্যে রকির বাবা খুব সুন্দর একটা ব্যাট বল কিনে দিল রকিকে। রকির আনন্দ আর কে দেখে! স্কুল ছুটির পর এক ঘন্টা খেলে তারপর বাড়ি ফেরে রকি।
দেবুকাকুর একমাত্র ছেলে নীল রকির বয়সী। ও নামকরা স্কুলে পড়ে। রকির সাথে তেমন ভাব নেই। সেদিন রকি স্কুলের থেকে বাড়ি ফিরছে নীল রকির হাতের ব্যাটটা দেখে বলল- আমাকে একদিন এই ব্যাটটা দিবি? না থাক, বরং আমরা সবাই একদিন ক্রিকেট্ ম্যাচ খেলব। আমি ব্যাট করব আর তুই ফিল্ডিং দিবি আর ওম বল করবে।
রকি তো খুব খুশি পাড়ার ছেলেদের সাথে ও খেলবে ।
বাড়ি তে ফিরেই রকি মাকে নীলের সব কথা বলল।
মা বলল- বুঝে শুনে খেলিস বাবা। ওরা তো বড়লোক।
রবিবার ছুটির দিন ক্রিকেট খেলা বেশ জমে উঠেছে। নীলের হাতে ব্যাট একটার পর একটা ছক্কা মারছে। লাস্ট ওভারে লাস্ট বল, নীল ব্যাট ঝাঁকিয়ে বলটা এমন মারল সোজা ওদের কাঁচের জানলা ভেদ করে ওর বাবার কপালে গিয়ে লাগল। নীলের বাবা বলের আঘাতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। জানলার ভাঙ্গা কাঁচ ওর বাবার হাতে ফুটে রক্ত বের হতে লাগল।
নীল তড়িঘড়ি করে বাড়িতে এসে ওর বাবার এই অবস্থা দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল। পাড়ার সবাই ছুটে এল নীলদের বাড়িতে।
দেবুকাকুর জ্ঞান ফিরতেই নীল চিৎকার করে বলতে লাগল,সব রকির জন্য হয়েছে ।রকিকে আমরা ছাড়ব না। কেউ রকির কোন কথা শুনল না। দেবুকাকু থানায় গেলেন রকির নামে থানায় এফ.আই.আর. করলেন।
“পাড়ার উঠতি গুন্ডা রকি” এই মর্মে একটা ফর্ম এনে পাড়ার সব লোকেদের সই নিয়ে থানায় জমা দিলেন। দেবুকাকুর হাতের রক্ত, কপাল ফোলা, রকির হাতে ব্যাট এই সব প্রমাণ করল রকি শত্রুতা করে দেবুকাকুকে মেরেছে ।
পুলিশ থানায় নিয়ে গেল রকিকে। জামিনের চল্লিশ হাজার টাকা ওর বাবা জোগাড় করতে পারিনি বলে তিনদিন জেল কাসটাডিতে ছিল রকি।
তারপর জামিন পেল। রকি জেল থেকে বাড়ি ফিরে দেখল ব্যাটটা দু’ টুকরো হয়ে পড়ে আছে। মার চোখ মুখ ফোলা। বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। রকির জীবন পুরো বদলে গেল। ঐ স্কুলে ও আর যেতে পারবে না। গুন্ডা তো তাই ।
এই ভাবে চলতে চলতে রকি নিজের মতো পড়াশুনো করে। প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। ভালো রেজাল্ট করল। এরপর এক ধাপ করে করে রকি এগোচ্ছে আর তাকে সাহায্য করছে সরকারি উকিল মনোতোষ দে।
সরকার পক্ষের উকিল উনি। তবুও রকিকে ওনার নির্দোষ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু উনি তখন অপারগ ছিলেন। রকির সরলতা ওনাকে কাছে টেনেছিল। তিন মাস জেলে ছিল রকি। মানে তিন মাসের জেল হয়েছিল। তখন থেকেই মনোতোষ উকিল রকিকে ভালবাসতে শুরু করেন।রকি এখন বারাসত কোর্টে প্র্যাকটিস করে।নীল যাদবপুরে একটা বড় নার্সিং হোমের সার্জেন ।চিকিৎসার গাফিলতিতে রুগী মৃত্যুর জন্য যেদিন ডক্টর নীলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল সেদিন রকির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল।যতই হোক বন্ধু তো।
নীল এর সাথে থানায় দেখা করতে গিয়ে দেবুকাকুর বাইকে সজোরে ধাক্কা মারে পেছন থেকে আসা এক ট্রাক। দেবুকাকু কোমাতে এখনও। চিকিৎসা চলছে। নীলের জামিন হয়নি, একমাস হয়ে গেল। বড়লোক পার্টি তো, লেজে গোবরে খেলছে।
সময়ের জবাব ওরা পেয়ে গেল বুঝি..
একমাত্র সময়ই ঠিক জবাব দিয়ে দেয়। কে দোষী কে নির্দোষী আমরা তা বুঝতে পারি না। কারণ আমাদের চোখে ধনীদের দোষটা নৈব নৈব চ। আর গরীব মাত্রই দোষী। টাকার খেলাতে এত বেশি সবাই মাততে থাকে যে কোনটা ভুল কোনটা ঠিক তা নির্ধারণ করতে পারে না লোভী মানুষগুলো। কিন্তু সময় মানুষকে যা শিক্ষা দেয় তা হল আসল শিক্ষা। পুঁথি গত শিক্ষায় আমরা যতই শিক্ষিত হই না কেন লোভ, ঘৃণা, অহংকারকে সহজে ছাড়তে পারিনা। তাই তো সময়ের দেওয়া শিক্ষার প্রয়োজন হয় আমাদের।
শুধু সময়ের ব্যবধান অন্যকে আঘাত দেওয়ার তিরটা ঠিক নিজের কাছে ফিরে আসবে…।