বিবর্ণ ক্যানভাস
– নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
সাত বছর আগের একটা পাতা
প্রতিবছর জুন মাসের পাঁচ তারিখে,
ঠিক সামনে চলে আসে লাবন্যর —
মনে করতে না চাইলেও, মনে পড়ে যায় ;
বিবর্ণ হয়ে যাওয়া,
জীবনের একটি রঙিন পাতা;
মন থেকে অনেক দুরের পথে,
কোন আবর্জনা ফেলে দেবার জায়গায়
পাতাটিকে রেখে আসতে চাইলেও,
যা পারেনা সে –
অদৃশ্য সিন্দুকের মুক্তকক্ষে,
তাকে আজও বড় যত্নে,
সাজিয়ে রেখে,
লালন করে যায় লাবন্য —
মাঝেমাঝে যখন সে নিজের সাথে
একান্তে কথা বলে,
সেই গোপন অথচ মুক্তকক্ষে
লাবন্যর তখন অবাধ বিচরণ । ।
রক্তাক্ত মনের সাথে,
অসম লড়াইয়ের টানাপোড়েনে
আজ লাবন্য বড় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত-
সব লাবন্যদের অমিত থাকেনা;
থাকতে পারেনা –
হারিয়ে যায় জীবনের কোন একটা সাইক্লোনে,
অথবা মধ্যবিত্ত জীবনের প্রাত্যহিকতায়
হাজারো নিয়ম, নিষেধ, ভয়,
আর পাঁজিপুঁথির আস্ফালনে!
উত্তাল জীবন তরঙ্গের অবাধ্যতায়,
আটপৌরে জীবনের অদৃশ্য বেড়িতে
তারা হারিয়ে যায়, জীবনের কানাগলিতে।
এই লাবন্যদের ইচ্ছে না থাকলেও,
রাত জেগে পার্টিতে যেতে হয়,
মন না চাইলেও কথা বলতে হয়,
সমাজের ইঁদুর দৌঁড়ে থাকা মানুষজনের সাথে,
যেখানে সাফল্য মানেই প্রাচুর্য,
যেখানে সাফল্য মানেই প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার
নির্লজ্জ প্রদর্শন!
ইচ্ছে না থাকলেও বাড়িতে আসা,
অতিথি, অভ্যাগতদের
মন জুগিয়ে দু চারটে ভাল কথা বলতে হয়,
মন কাঁদলেও সবার সামনে
হাসি হাসি মুখে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হয়!
আসলে ইচ্ছে থাকলেও এই লাবণ্যরা,
শরতের নীল আকাশ দেখতে পায়না,
দেখতে পায়না সাদা মেঘের ভেলায়
ভেসে যাওয়া বকের নিরুদ্দেশ যাত্রা!
লিখতে পারেনা কবি কালিদাসের মত “মেঘদূতম”
ইচ্ছে করলেও প্রকৃতির বুকে হারিয়ে যেতে পারেনা-
পারেনা সমুদ্র হৃদয় মানুষের হৃৎস্পন্দন শুনতে ;
নিজের শুকিয়ে যাওয়া বুকটাতে,
এক হিমেল দমকা ঝড়ের একটুকরো আভাস দিতে!
লাবণ্যদের অনেক কিছু করতে নেই,
নিন্দে হয়।
লাবন্যদের গান গাইতে ইচ্ছে করলেও
ঘর বন্ধ করে, সুরের আঙিনায়
সসঙ্কোচে প্রবেশ করতে হয় ;
পাছে অন্য কেউ তার প্রতিভার বিচ্ছুরণে
মুগ্ধ হয় ;
আলোকিত হয়ে কোন ঝর্ণাধারার,
সন্ধান পেয়ে যায়!
তবু এই না পাওয়ার মাঝেই তাঁদের
প্রাপ্তির ভাঁড়ার পরিপূর্ণ,
মনটাকে তাঁরা তানপুরার তারে,
সেভাবেই নাড়া বেঁধে রেখেছে-
আজীবনের সন্তুষ্টিতে,
ইমন, কাফী, তোড়ি আর মল্লারের সাথে,
বেহাগের মধুময় সহাবস্থানে
শ্রাবণের আকাশেও রোদের ঝিলিক খেলে।।
একটু পেলেই লাবণ্যদের
অনেক পাওয়া হয়ে যায়,
পার্থিব মোহ -মুক্তি,
ওদের কবেই হয়ে গেছে!
ওরা এখন কোন কিছুই আর আশা করে
আশাহত হয়না –
অনেকের মতো অনেক কিছু না পেয়েও
ওরা “সব পেয়েছির দেশে”–
খুব অনায়াসে পৌঁছে যায়,
হাসিমুখে,
ফেলে আসা কোন ক্যানভাসে আঁকা
তাঁদের রঙিন ছবিগুলি,
শুধু বিবর্ণ হতে থাকে,
একেকটা দিন এভাবেই কেটে যায়;
কেটে যাবে,
বুক ভেঙে যাবে –
তবু ওদের মুখ ফুটবেনা আগামীতে ;
বিবর্ণ হতে চাওয়া, সেই রঙিন পাতাটিকে
হৃদয়ে ঠিক আগের মতোই
যত্নে রেখে দিয়ে, হাসবে সবার সামনে
চোখের কোনায় দু’ ফোটা জল নিয়ে।