জন্মাবে আবার… প্রয়োজনে বারবার

জন্মাবে আবার… প্রয়োজনে বারবার
-রীণা চ্যাটার্জী

…,
ভাবতেও লজ্জা লাগছে আপাত নিরীহ একটা বুলি, জয়ধ্বনি লেগে কেমন করে যে ‘গালাগালি’ হয়ে গেল! তা নাহয় তর্ক ধর্মের কারণে মেনে নিলাম “হলো”, কিন্তু তার প্রতিবাদ এতো অশালীন! এতো দাম্ভিক! প্রতিশোধ এতো কুরুচিপূর্ণ ব্যবহারে!

আমাদের সংবিধান আমাদের হাতে গোনা যে কয়টি মৌলিক অধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে বাক্ স্বাধীনতা মনে হয় আছে! (মনে হয় বলতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে আজকাল। না,না- বয়সের কারণে নয়। সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পেশী আষ্ফালন দেখে) আর মনে হয় আরো একটা কথা কারোর ভাবাবেগে বা শরীরে আঘাত না করে স্বাধীন ধর্মাচরণ করার অধিকারও বিধিসম্মত সার্বভৌম রাষ্ট্রে।

স্বাধীনতার বেশ কয়েক দশক পেরিয়ে এসে আমদের যেন নতুন করে সব শিখতে হবে আবার। রাজনৈতিক পেশী আষ্ফালনের হাত ধরে আবার কি পরাধীনতা নবরূপে আসছে! মতবিরোধ থাকবে- সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছাত্র থেকে সাংবাদিক কোনো স্বার্থ বিরোধী প্রশ্ন সামনে আনলেই তাঁদের ‘বিরোধী দলের দালাল’, ‘উগ্ৰপন্থী’ আখ্যা দেওয়া- এটা কি গণতন্ত্র! মতবিরোধ হলেই শত্রুতা, অশালীনতা, রক্ত ঝরানো, ভিটে ছাড়া করে দেওয়া, আগুন লাগানো- এটাই কি গণতন্ত্র? বিরোধী দলীয় নেতা নেত্রীদের অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করা, তাদের সমাবেশে অযৌক্তিক বাঁধা দেওয়া, ধাঁধার পথে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা- এটাই গণতন্ত্র? ভিন্ন রাজ্যের সাংবিধানিক পদাধিকারীরা রাজ্যে আসতে চাইলে তাঁদের সম্বর্ধনা দেওয়া অনেক দূর, অবতরণের অনুমতি না দেওয়া বারবার, প্রকাশ্যে অপমান করা- এটাই গণতন্ত্র? এটাই কি বাঙলার নতুন সৌজন্য বোধ? একটি ‘সাথী’ বাহার রাজ্য- যে রাজ্যে স্বাস্থ্য নেই, শিক্ষা নেই, ন্যায় নেই,কর্ম নেই সেই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে একটি সন্তানকে মানুষ করার কতো কষ্ট জানেন? অভিভাবকরা কষ্ট করে বড়ো করেও যখন সন্তানের জীবন সংগ্রামের পাহাড় প্রমাণ চাপ মুখ বুজে সহ্য করে, সেই কষ্ট জানেন? কারোর সন্তানকে গলা হেঁকে অবলীলায় ‘বখাটে’ সম্বোধনের অনৈতিক অধিকার কে দিল? এতো স্পর্ধা? এটাই বুঝি গণতন্ত্র! নাকি পরিবর্তিত স্বঘোষিত গণতন্ত্র? এই পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? উন্নয়নের কথা শিকেয় তোলা থাক- সে স্বাদ সবাই পায় নি। পরিবর্তনের নামে ক্ষমতা চেয়েছিলেন সেটা আজ স্পষ্ট, এবং সেই ক্ষমতা ধরে রাখার আপ্রাণ নির্লজ্জ প্রয়াসের সাক্ষী আজকের আতঙ্কিত পশ্চিমবঙ্গ।

পশ্চিমবঙ্গ পরিবর্তন চেয়েছিল, ভুল করেছিল? হ্যাঁ, ভুলই করেছিল- আজ আর বলতে দ্বিধা নেই। আমরা ধর্মঘট, কর্মবিরতি, সমাবেশ, মোড়ে মোড়ে অবস্থান কর্মসূচিতে বেশ শান্তিতে পাশ কাটিয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু নগ্ন হয়ে যায় নি বিশ্বের দরবারে। ভদ্রতার আবরণে সৌজন্য বোধটুকু ছিল তখনো, এইভাবে নিঃস্ব করে দেয়নি। স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার আড়ালে আবডালে হলেও ছিল। ধর্মাচরণ, সংস্কৃতি কোনো কিছুর প্রকাশে এখনকার মতো উদ্দামতা যেমন ছিল না, কারো ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালনে, সংস্কৃতি উদযাপনে বাঁধাও ছিল না। নন্দন চত্বর থেকে শুরু করে আদালত প্রাঙ্গন, শিক্ষাঙ্গন, হাসপাতাল পরিখা, ছাত্র, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিল্পী, চাকরীপ্রার্থী- সব, সবার সুরক্ষা, আবেদন এতো বিশ্রী দাম্ভিকতা দেখে নি। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল- ‘পরিবর্তনের স্বপ্ন’ এর মোড়কে। স্বপ্নের মোহ ভেঙ্গে দিয়ে মোড়ক খুলে সৌজন্যতা বোধ হারিয়ে আজকের পরিবর্তন সম্পূর্ণ ব্যর্থ, ঊলঙ্গ।

পশ্চিমবঙ্গবাসী পরিবর্তনের নেশায় আবারো বদল চাইলো এই লোকসভা নির্বাচনে। কিন্তু যেন মনে হলো শুধু রঙ বদল হলো, বদলার নামাবলী এক থেকে গেল। পুরোহিত, মন্ত্র, উপাচার একই থেকে গেল পরিবর্তন যজ্ঞে। ক্ষত- বিক্ষত, ক্লান্ত আমরা যে রক্তাক্ত হতে চাই না আর। মহামান্যরা রাজনীতি করুন অসুবিধা নেই- তবে একটু ভাবুন আমাদের কথা। আমরা কর্ম চাই, দিনের শেষে সন্তানদের সুরক্ষিত দেখতে চাই। ঘরের চাল ভাঙা আমাদের সয়ে গেছে, ওই টুকরো জ্যোৎস্নায় আমরা শান্তির স্বপ্ন দেখতে চাই, দয়া করে আমাদের ভাঙা চালে আগুন আর দেবেন না। আমরা আজো শুধু একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই ।

আপনারা মুখ লুকিয়ে মুখোশের আড়ালে রাজনীতি করুন, রঙ বদলান। পরিস্থিতি, পরিবেশ বিষিয়ে তুলুন ‘বহিরাগত” মলাটে। আপনাদের নোংরা রাজনীতির হাত থেকে শুধু শান্তি পাবার, পরিত্রাণের উপায় আমাদের বলে দিন। নিজেদের এইটুকু দায়িত্ব পালনের দায়বদ্ধতা আপনাদের আছে, বাঙলার জনগণের কাছে। নাহলে হয়তো এমন দিন পরিবর্তনের আসতে পারে, যেদিন কোনো রঙ ছাড়াই সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপনাদের বদলার পাঠ পড়াতে শুরু করতে পারেন। সেদিন মুখোশের আড়ালে পিঠ বাঁচাতে মনে হয় পারবেন না- ভুলে যাবেন না বাঙলার কোলে জন্মেছে বহু অগ্নি সন্তান। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে জন্মাবে আবার… প্রয়োজনে বারবার।

আলাপী মনে’র স্বজন সাথীদের কলমে এখন জমে আছে চাপা কান্না, আছে বিদ্রোহ, আছে প্রতিবাদ, কালিতে লেগেছে বারুদের গন্ধ। আজ যা রাজনৈতিক, ভবিষ্যতে এটাই সামাজিক প্রতিচ্ছবি- প্রতিবাদী কলমের হাত ধরে ‘আলাপী মন’ সাক্ষী হয়ে থাকলো আগামীর সমাজের কাছে। কৃতজ্ঞতা রইলো আলাপী মনের পক্ষ থেকে।
উষ্ণতার সীমা ছাড়িয়ে আমরা দহন জ্বালায় বিপর্যস্ত। তপ্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো সকলের জন্য।

Loading

Leave A Comment