গল্প- সঞ্জু ও টুসি

সঞ্জু ও টুসি
– সোম

 

হায়-হায়, ইলিশ মাছ ভাজাটা খেয়ে নিলো গো! তিনশো টাকা কেজি দরে মাছটা কিনে ছিল। তুই কি না মাছটা খেয়ে নিলি? তোর একদিন কি আমার একদিন। এই বলে একটা মোটা লাঠি নিয়ে তেড়ে গেল।

রান্নাঘর থেকে একটা কালো ছিট-ছিটে বিড়াল ম্যাঁও করে লাফিয়ে পড়লো মশলা রাখার তাকের উপর। মশলার তাকটা গেল উল্টে। এবার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বড়মা মোটা লাঠিটা ছুঁড়ে দিলো বিড়ালটার দিকে, কিন্তু ব্যাটার ভাগ্য বড় জোর। লাগলো না, পালিয়ে গেল। বড়মা দাঁত খিঁচুনি দিয়ে বললো– পালিয়ে যাবি কোথায়? তোকে একবার ধরতে পারি, তারপর দেখবি। এই শান্তবালার কত রাগ!

শান্তবালা হলেন সঞ্জুর জ্যেঠিমা। সঞ্জু এনাকে বড়মা বলেই ডাকে। বড়মার নামটা শান্তবালা হলে কি হবে, ইনি কিন্তু মোটেই শান্ত মহিলা নন। প্রচণ্ড বদরাগী। একবার যে কথা বলে, সেই কাজ করে তবেই শান্ত হন।

সঞ্জু মামার বাড়ি থেকে একটা বিড়ালের বাচ্চা এনেছে। এটা সেই বিড়ালটা নয়তো? না- না, সেটা কালো ছিট-ছিটে নয়। সেটা ধপধপে সাদা রঙের বিড়াল। সে খুব শান্ত স্বভাবের, সঞ্জু আদর করে তার নাম রেখেছে টুসি !

এই টুসিকে নিয়েই যত ঝামেলা। একবার মা বকা দেয়, তো একবার বাবা। বকা দেবে না কেন বলো? ঠিক মতো খাওয়া নেই, নাওয়া নেই; সারাক্ষণ এই বিড়াল বাচ্চাটাকেই নিয়ে ব্যস্ত থাকে সঞ্জু। তাকে খাইয়ে দেওয়া ঘুম পাড়ানো, যেন কত কাজ তার।

রবিবার ছুটির দিন। সঞ্জুর আনন্দের আর সীমা থাকে না। সে সারাদিন টুসিকে নিয়ে খেলতে থাকে, এমনকি রাতে ওকে নিয়ে ঘুমাতে যায়। যত্ন করে খাটের উপর শুইয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, আর বিড়াল বাচ্চাটা কি সুন্দর সঞ্জুর কথা শুনে চুপচাপ শুয়ে থাকে। টু-শব্দটিও করে না। থ্রি ক্লাসে পড়া এই ছোট্ট ছেলে সঞ্জু আর এই টুসি নামে ছোট্ট প্রানীটি যেন এক মায়ের পেটের দু’টি সন্তান। এদের ভালোবাসা অন্তহীন। কেউ কাউকে ছেড়ে একটা দিনের জন্য ও থাকতে পারে না।

সেদিন টুসি ম্যাঁও ম্যাঁও করে ডাকতে ডাকতে সঞ্জুর বাবার কোলের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। বাবা প্রথমে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু বিড়াল বাচ্চাটা কিছুতেই যেতে চাইলো না। সে তাঁর কোলের মধ্যে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। বাবা উপরে উপরে রাগ দেখালে কি হবে, মনে মনে বিড়ালটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল। তাই টুসির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে ডাক পড়লো– সঞ্জু, টুসিকে কিছু খেতে দে, মনে হয় ওর খিদে পেয়েছে।
এই কথা শুনে মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, বাটিতে করে খাবার এনে টুসিকে খেতে দিলো।

এ বাড়িতে সঞ্জু ছাড়া আর কেউ টুসিকে ভালোবাসতো না। এই টুসির জন্যে সঞ্জুকে বাবা-মার কাছে কত না বকা খেতে হয়েছে! কিন্তু এখন আর তাঁরা বকা দেয় না, কারণ এক মাস পূর্ণ না হতেই টুসি এ বাড়ির প্রত্যেকের ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছে।
সে সবার কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠছে। বাবা-মা এখন দু’জনে তাকে খুব ভালোবাসে।

সেদিন ছিল শনিবার। সঞ্জু স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে তার আদরের বিড়াল বাচ্চাটাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। সে বাড়ির আশে পাশে সবদিক খুঁজে দেখলো, কোথাও পাওয়া গেল না। পাশের বাড়ির পানু এসে বললো- তোর বিড়ালটা আমি বড়মাদের বাড়ির দিকে যেতে দেখেছিলুম। চল না, একবার বড়মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি।
চল-চল, এই বলে দু’জনে বড়মার বাড়িতে গেল। বড়মা দু’জনকে দেখে যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। বললো- কি চাই কি, এ্যাঁ?
-আমাদের টুসিকে খুঁজে পাচ্ছিনা বড়মা।
-তা আমি কি করবো? আমি তাকে মেরেছি নাকি, যে তোরা আমার বাড়িতে খুঁজতে এলি।
যা দেখিনি এখান থেকে।
এই বলে ঝাঁটা নিয়ে উঠান ঝাঁট দিতে আরম্ভ করে দিলো। কি জানি, সঞ্জু বড়মার কথায় কি বুঝেছে। সে বাড়িতে এসে মায়ের কাছে কেঁদে বললো- মা মনে হয়, বড়মা আমাদের টুসিকে মেরে ফেলেছে!
তাই আবার হয় নাকি? মা কথাটা বিশ্বাস করলো না, বললো–ভালো করে খুঁজে দেখ, আশেপাশে কোথাও আছে হয়তো!

দেখতে দেখতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। কাজে থেকে বাবা বাড়ি ফিরেছে। মা বসার জন্য মোড়াটা দিয়ে, এক গ্লাস জল এনে বললো- দুপুর থেকে টুসিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সঞ্জু খুব কাঁদছে! জল খেয়ে একবার খুঁজে দেখবে, বিড়ালটা কোথায় গেল?
এই কথা শোনার পর বাবা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে টুসিকে খুঁজতে বেরিয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা বাড়ি ফিরলো। কিন্তু টুসিকে কোথাও পাওয়া গেল না। তাহলে সত্যি কি, বড়মা টুসিকে মেরে ফেলেছে? তা উনি যা বদ মহিলা, মেরেও ফেলতে পারে!

এইভাবে দু’দিন খোঁজাখুঁজির পর বিড়াল বাচ্চাটা অবশেষে পাওয়া গেল, পানুদের ছাই গাদাতে। মাথাটা তার একেবারে থেঁতলানো অবস্থায় পড়ে আছে। সঞ্জু একটু দূর থেকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে গেল, সেই ছাই গাদার কাছে। গিয়ে দেখে, হ্যাঁ সত্যি সত্যি এটাই তো তার সেই বিড়াল বাচ্চাটা। সঞ্জু আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না, দু’হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে সে কি কান্না। কান্না আর কিছুতেই থামে না, কেবলই তার দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল ঝরে পড়ছে। জল তো ঝরবারই কথা। কতো দিনের ভালোবাসা এক নিমিষে কি ভোলা যায়? ওই নিরীহ প্রাণীটা এমনকি অপরাধ করেছে, যে তাকে এভাবে মারতে হবে? কেইবা তাকে মারলো? এই নিয়ে সবার মনে একটা ভাবনা জন্মে গেল। না, ভাববার আর কোনো কারণ নেই! এটা নিশ্চয়ই বড়মারই কাজ। সেদিন রান্না ঘরের ঐ বিড়ালটাকে মারতে না পেরে, ওনার রাগটা অনেক খানি বেড়েই ছিল। এই টুসিকে মাথাটা থেঁতলে, সেই রাগটা মিটিয়ে নিলো। সত্যি ধনী মহিলা বটে।

বাড়িতে ফিরতেই মা ওকে কোলে তুলে কান্না থামাবার চেষ্টা করে বললেন- আর কাঁদিসনে বাবা! সামনের পূজার ছুটিতে মামার বাড়ি থেকে অমন আর একটা বিড়াল বাচ্চা আনবি ক্ষণ। সঞ্জু কাঁদতে কাঁদতে মাথা নেড়ে বললো- না, আমি আর কোনো বিড়াল বাচ্চা চাই না..

 

Loading

Leave A Comment