গল্প- প্রথম স্পর্শ

প্রথম স্পর্শ
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

কয়েকদিন অসহ্য গরমের পর আজ বৃষ্টি নেমেছে। শ্যামশ্রী তাড়াতাড়ি করে ছাদের দিকে ছুটছে একটু বৃষ্টির জল গায়ে মাখবে বলে। ছোটার শক্তি পদযুগলে আজ আর নেই তবুও মনটা ছুটছে সাংঘাতিক জোরে। দীর্ঘ ত্রিশটা বছর সৌরভের স্ত্রী সে, দুই সন্তানের জননী। তবু আজ তার মনটা হঠাৎই এইসব বন্ধনমুক্ত হয়ে কলেজ জীবনের শ্যামশ্রী হয়ে উঠতে চাইছে।

গায়ের রং উজ্জল শ্যামবর্ণ, পাঁচ তিন হাইট, পদ্ম পাতার মতন চোখ দু’খানি, টিকালো নাক ও পান পাতার মতো মুখের গড়ন তার। কলেজের বেশিরভাগ ছেলেদের হার্ট থ্রব ছিল সে। শ্যামশ্রীর এক ঝলক চাহনি ছেলেদের হার্টবিট বাড়িয়ে দিত। সে চিরকালই মৃদুভাষী। শ্যামশ্রীর বাবা ছিলেন তারই কলেজের অধ্যাপক। এহেন মেয়ের সাথে আলাপ জমাতে কে না চায়। কিন্তু শ্যামশ্রীর সাথে আলাপ তো দূর কি বাত তার কাছে পাত্তাই পেত না কেউ। শ্যামশ্রী আর সৌরশ্রী দু’জনে ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড। একদম হরিহর আত্মা বলা চলে। ইতিহাসের অনার্সের এই দু’জন ছাত্রী ছিল সমগ্র কলেজের আকর্ষণ। পার্টির ছেলেরা তো সব সময় সুযোগ খুঁজতো কি করে দু’টো কথা বলা যায়।

এহেন শ্যামশ্রী হঠাৎই দুর্বল হয়ে পড়ে সৌরশ্রীর মামাতো দাদার প্রতি। জলি তার নাম। স্বভাবে ও নামে অসম্ভব সুন্দর তাল মিল। শ্যামশ্রী নিজে কম কথা বললেও টকেটিভ ছেলে পছন্দ করত সে বেশি। শ্যামশ্রী ধারণা যারা বেশি কথা বলে তারা নাকি মনের দিক থেকে খুব পরিষ্কার হয়

মধ্যপ্রাচ্য ইতিহাসের নোট নিতে শ্যামশ্রী আসে সৌরশ্রীদের বাড়িতে। কলিং বেল বাজাতেই এক হ্যান্ডসাম ছেলে এক গাল হাসি হেসে বলে ‘ওয়েল কাম ম্যাম’। শ্যামশ্রী হকচকিয়ে গেলেও ব্যাপারটা বেশ উপলব্ধি করে। ভিতর থেকে সৌরশ্রীর গলার আওয়াজ ‘ভিতরে চলে আয়’। শ্যামশ্রী জলির দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিয়ে ভিতরে চলে যায়। শ্যামশ্রী আসবে বলেই সৌরশ্রী আগেই সব নোট খাতা বিছিয়ে বিছানার ওপরে বসে ছিল। শ্যামশ্রী ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করে নিচু গলায় ‘কে ওটা?’ সৌরশ্রী বলে’ভূত’! আরে ও ওই রকমই। চেনা অচেনা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। ওর সাথে কিছুক্ষণ কাটালেই সকলের মন ভালো হয়ে যায়। ও আমার বড় মামার ছেলে জলিদা। মুম্বাইয়ে থাকে।

নোট লিখতে লিখতে শ্যামশ্রী আর সৌরশ্রী হালকা গল্প করতে থাকে। হঠাৎই চায়ের কাপ ও পকোরা হাতে জলি এসে হাজির। জানায় বাড়িতে পিসিমণি নেই তাই তাকেই কষ্ট করতে হলো। খারাপ হলে বলার দরকার নেই ভালো হলে তারিফ অবশ্যই প্রাপ্য। শ্যামশ্রী জলিকে যতই দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে ফিরে এসে শুধু জলির কথাবার্তা মনে পড়ছে আর নিজের মনে ভেসে চলেছে।

দু’দিন বাদে স্বাধীনতা দিবস। কলেজের প্রোগ্রামের গান গাইবে শ্যামশ্রী। ওর সাথে তবলায় সংগত করেন যিনি তিনি হঠাৎ এই কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। শ্যামশ্রী খুব চিন্তায় পড়েছে। সৌরশ্রী বলে, চিন্তা করিস না। সমস্যা যখন তখন সমাধানও আছে। শ্যামশ্রী অবাক হয়ে বল মানে? জলিদাকে দেখেছিস তুই। ও কিন্তু দারুণ তবলা বাজায়। ওকে একটু চেপে ধরলে ও নিশ্চয় রাজি হবে। শ্যামশ্রী সৌরশ্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে ‘প্লিজ ওকে রাজি করা তুই। তাহলে আমার খুব উপকার হয়।’

চৌদ্দই আগস্ট সৌরশ্রী ফোন করে শ্যামশ্রীকে ওদের বাড়িতে ডেকে পাঠায় গানটা জলির সাথে প্র্যাকটিস করে নেওয়ার জন্য। শ্যামশ্রী তাড়াতাড়ি ইওর ফেভারিট চুড়িদারটা পরে গানের ডায়েরি হাতে নিয়ে সৌরশ্রীদের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। আকাশে ছিল ঘন মেঘ। কিন্তু তাড়াতাড়ির মধ্যে বাইরের আকাশের দিকে না তাকিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে ছিল সে। আসলে একটা প্রচ্ছন্ন ভালোলাগার মেঘ যে তার মনকে ঢেকে রেখেছিল। কয়েক পা আসার পরই মুষলধারায় বৃষ্টি টানা আধ ঘন্টার ওপর। শ্যামশ্রীদের বাড়ি থেকে সৌরশ্রীদের বাড়ি মাত্র দশ‌‌‌ মিনিটের রাস্তা। শ্যামশ্রীর দেরি হচ্ছে দেখে সৌরশ্রী ঝটপট করতে থাকে। শ্যামশ্রীদের বাড়িতে ফোন করে জানতে পারে ও অনেকক্ষণ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।সৌরশ্রী জলিকে বলে, তুমি একবার বাইরে গিয়ে দেখবে জলিদা। বৃষ্টিতে মনে হয় ও কোথাও আটকে পড়েছে। জলি একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শ্যামশ্রীকে খুঁজতে।

কিছুটা আসার পরেই দেখে একটি দোকানের নিচে অনেক ভিড়ের মধ্যে কমলা রঙের সালোয়ার করে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামশ্রী। রাস্তা তো জলে ডুবে গেছে তার মধ্যেই পা চালিয়ে দোকানের সামনে এসে ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে জলি বলে-‘ম্যাম ছাতাটা ধরুন।’ শ্যামশ্রী কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছাতা নিয়ে হাঁটতে শুরু করে জলির সাথে। তার খেয়ালই নেই ছাতাটা একা তার মাথার ওপর আছে জলি ভিজছে। যখন শ্যামশ্রীর খেয়াল হলো তখন অলরেডি তারা সৌরশ্রীদের বাড়ি পৌঁছে গেছে। সৌরশ্রী দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। জলিকে আপাদমস্তক ভিজতে দেখে বলে ওঠে ‘আরে ওর সাথে এক ছাতায় আসতে পারলে না। শুধু শুধু ভিজলে!’ ‘জলি অপরাধীর মতো বলে ‘ছাতার ভাগ চাইলে যদি তোর বন্ধু রেগে যেত। তাইতো ভিজলাম।’ শ্যামশ্রী ওদের কথোপকথনে এতটা লজ্জিত যে মুখ তুলতে পারছে না। সত্যি তো কি স্বার্থপরের মতো কাজ করলো সে।

জামা কাপড় বদলে জলি এসে বসলো তবলা নিয়ে। তবলায় ঠেকা মারতে মারতে বললো ‘একটু চা হলে ভালো হতো’। সৌরশ্রী কিচেনে যায় চা আনতে। শ্যামশ্রী লুকিয়ে আড়চোখে জলিকে দেখতে থাকে। বৃষ্টিতে ভেজার পর জলিকে অদ্ভুত আকর্ষণীয় লাগছে। ফতুয়ার ভিতর থেকে উঁকি মারছে তার বুকের ঘন কালো কেশ রাশি। কী ফর্সা! মনে হয় হালকা কোন বডি স্প্রে লাগিয়েছে সে তারই গন্ধে রুমটা পুরো ম ম করছে। শ্যামশ্রী হঠাৎ হুশ ফিরল জলির পুরুষালি কন্ঠে- ‘কৈ ধরুন’!

পরপর বেশ কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান প্র্যাকটিস করলো শ্যামশ্রী। সৌরশ্রী চা নিয়ে এসে বলে ‘এবার একটা আধুনিক ধর। জলিদা তুমি ও কিন্তু গলা দিও। দেখছো তো গলার আওয়াজ কত কম।’ শ্যামশ্রী ও জলি দু’জনে মিলে গাইলো- ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না যে মন কবে যাবো তবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ তোমার নিমন্ত্রণ।’ রাত্রি প্রায় ন’টা হয়ে গেল। শ্যামশ্রীকে বাড়ি পৌঁছানোর ভার পড়ল জলির হাতে। বৃষ্টি টিপটিপ করে পড়ে চলেছে তখনও। সৌরশ্রী দু’জনকে দু’টো ছাতা দিলো এবার। জলি মজা করে বলল ‘আমি কি এতটাই অস্পৃশ্য যে তোর বান্ধবী আমার সাথে এক ছাতায় যেতে পারবে না।’ শ্যামশ্রী লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। সে ও তাড়াতাড়ি বলে ‘একটা ছাতাতেই হয়ে যাবে রে।’

জলির ছাতার নিচে পরম নিরাপদে চলেছে শ্যামশ্রী। জলি তার সবটা দিয়ে শ্যামশ্রীকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ঠিক যেন অভিভাবকের মতো। বাড়ির দরজায় এসে শ্যামশ্রী বললো ‘ঠিক সকাল সাতটা নাগাদ কলেজের গেটে দাঁড়াবেন। আমরা ওখানে মিট করবো।’

জলি চলে যাওয়ার পর শ্যামশ্রী কিছুক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। কোথাও যেন একটা বিনি সুতোর টান সে অনুভব করল। পরের দিন সকাল সকাল উঠতে হবে। কলেজের প্রোগ্রাম আর আরো একবার জলির সান্নিধ্য। লাল পাড় সাদা শাড়ি, গলায় হালকা সোনার চেইন, কপালে ছোট খয়েরি টিপ, খোঁপাতে দিল বেলফুলের মাল ও ডান হাতে ব্রেসলেট ওয়াচ। অদ্ভুত রকমের সুন্দরী লাগছে তাকে। কলেজের গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল জলি। সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামায় অসাধারণ। একদম ক্লিন শেভড। শ্যামশ্রীকে দেখা মাত্রই হেসে বলে উঠলো ‘শাড়িতে দারুন লাগছে তোমায়।’ একেবারে তুমি সম্বোধন। আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল ওদের পরিচিতি। বেলা দশটা নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হলো। আকাশের পশ্চিম দিকে ঘন কালো মেঘ করেছে। জলি শ্যামশ্রীকে বলল তাড়াতাড়ি চলো এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে। আজ কিন্তু একটাও ছাতা নেই। শ্যামশ্রী ও তাড়াতাড়ি করে পা চালাতে লাগলো জলির সাথে। কিন্তু বৃষ্টি যথারীতি এসে হাজির মুষলধারে। ওরা দু’জনেই একটা ছোট দোকানের সামনে আশ্রয় নিল। হওয়ায় শ্যামশ্রীর বাঁধা চুল ও হালকা উড়ছে। চোখে মুখে চুল সরাতে সরাতে বারবার লক্ষ্য করছে সে জলিকে।

বৃষ্টি পুরোপুরি থামার আগেই জলি বলে আর দেরি করলে চলবে না। ‘আমার দুপুর দু’টো নাগাদ ট্রেন আছে। আজি মুম্বাই চলে যাচ্ছি। শ্যামশ্রী শাড়ির আঁচলটা তুলে ধরার চেষ্টা করে জলির মাথার ওপর। জলিও আঁচলের নিচে মাথাটা দিয়ে নিচু হয়ে হাঁটতে থাকে। অসম্ভব রকমের এক ভালো লাগার আবেশে হারিয়ে যায় দু’টি মন। হঠাৎ শ্যামশ্রী জলির হাত দু’টো ধরে বলে ‘আবার কবে আসবে’। শ্যামশ্রীর প্রথম স্পর্শে জলিও হয়ে ওঠে শিহরিত। শ্যামশ্রীর হাতের ওপর জলি তার শক্ত তালু রেখে বলে ‘খুব তাড়াতাড়ি’। শ্যামশ্রীর দু’চোখ দিয়ে ধেয়ে আসে অশ্রুধারা।

আজও ত্রিশ বছর পর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেই পুরনো স্মৃতি, ভালোলাগার প্রথম স্পর্শ অনুভব করতে পারছে সে। একদম টাটকা, সতেজ ও সুগন্ধময় সেই প্রথম স্পর্শ, সেই ভালোলাগা। হঠাৎই কাজের মাসীর আওয়াজে শ্যামশ্রীর হুঁশ ফিরলো।।

সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment