অণু গল্প

অণু গল্প- যাত্রা নাস্তি

যাত্রা নাস্তি
– সুজিত চ্যাটার্জি 

 

বদ্রীনারায়ন থেকে হরিদ্বার ফিরবো। বাসের টিকিট আগেই নেওয়া ছিল। সপরিবার ভ্রমণ, তাই ব্যবস্থা পাকা রাখাই নিরাপদ।
সকাল সাতটায় বাস ছাড়লো। বদ্রীনারায়নের নৈসর্গিক মায়াময় বিচিত্র শোভা আমৃত্যু থাকবে মননে, আর নিলাম আশীর্বাদ, জগৎ রক্ষাকারী শ্রীবিষ্ণু নারায়ণের কাছে।
প্রায় বিশ কিলোমিটার যাবার পর হঠাৎই বাস দাঁড়িয়ে পড়লো। কি ব্যাপার ? বাস বিগড়েছে।
ঘন্টা খানেক টানাহেঁচড়ার পরে জানলাম, এই বাস মেরামত করে রওনা দিতে আরও ঘন্টা তিনেক লাগবে।
যাত্রা নাস্তি। আজকে আর কিছুতেই যাবো না।
আমার পরিবারের প্রতিজ্ঞা। সেই প্রতিজ্ঞা সঞ্চারিত হলো আমার বাকি সদস্যদের মধ্যেও। সংখ্যায় তারা ভারী, সুতরাং গণতান্ত্রিক নিয়মে আমার সমস্ত নাস্তিকতা পরাজিত। পুনরায় বদ্রীনারায়নে ফিরে যাওয়াই সাব্যস্ত হলো।
প্রায় বিশ কিলোমিটার পথ। ফিরতি গাড়ি চাই।
এটা তো শহর নয়, পাহাড় । চাই বললেই মিলছে কোথায়। সপরিবারে পাহাড়ের ধুলো পাথরের ওপর লটবহর সমেত লাট খাচ্ছি , আর পথের পানে লোলুপ নয়নে চেয়ে আছি, ফিরতি গাড়ির চাতক আশায়।
আরও ঘন্টা খানেক কেটে গেছে। যে কটা গাড়ি পেয়ে ছিলাম, তারা আমাদের পাত্তাই দেয় নি। সবেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। কেউ এমন দর হাঁকিয়েছে, অজ্ঞান হবার অবস্থা।
এদিকে বাসের মেরামতি চলছে। নাস্তিক মন সাত্বিক হচ্ছে। হে বদ্রীনারায়ন, তাড়াতাড়ি বাস মেরামত করে দাও বাবা ।
একটা জীপগাড়ি দেখতে পাচ্ছি। কাছে আসতে বুঝলাম পুলিশের জীপ। যা আছে কপালে। বুক চিতিয়ে গিরিশৃঙ্গ হয়ে দাঁড়ালাম সামনে। গাড়ি থামলো।
সামনের সিটেই অফিসার ছিলেন। তাকে বললাম পুরো ব্যাপারটা। উনি শুনলেন , কিন্তু তার গাড়িতে আমাদের তুলতে তার নাকি আইনত বাধা আছে। উনি গন্তব্যে পৌঁছে অন্য গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।
আর ধৈর্য্য নেই। থাকার কথাও না। মেজাজ বিগড়ে গেল। বাঙালির মেজাজ বিগড়ে গেলে ইংরেজিতে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। আমিও ব্যতিক্রম নই। গড়গড় করে ইংরেজি বেরুচ্ছে। পাল্লা দিয়ে চোখ হাত ধেইধেই করে নাচ্ছে।
আজও আমাদের দেশে ইংরেজির কি বিশাল মাহাত্ম্য, আবারও হাতে হাতে টের পেলাম।
অফিসার রাজি হলেন।
সপরিবারে লটবহর সমেত পুলিশের জীপে চড়ে বিশ্বজয়ের নায়ক হয়ে, বদ্রীনারায়ন ফিরে এলাম।
গল্পটা এখানেই শেষ করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু হলো না। নারায়ণের ইচ্ছা অন্য।
পরদিন সকালে পুনরায় বাসে চাপলাম। সেখানেই শুনলাম খবরটা।
কালকের সেই বাসটা যাত্রী সমেত খাদে পড়ে গেছে।
আমার সমস্ত পরিবার একযোগে কপালে হাত তুলে সমস্বরে বললো, জয় বদ্রীনারায়ন।
সেই আকুল করা ডাকে একটাই চাওয়া ছিল।
রক্ষা করো। রাস্তাটুকু ভালোয় ভালোয় পার করে দাও ঠাকুর।

Loading

One Comment

  • Anonymous

    সাহিত্য প্রেমীদের জানাই আমার আন্তরিক শুভকামনা ভালবাসা

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

<p>You cannot copy content of this page</p>