গল্প

গল্প- অবিশ্বাস্য

অবিশ্বাস্য
– শিলাবৃষ্টি ( করকাশ্রী চট্টোপাধ্যায়)

 

 

গ্রামের বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আজ সন্ধ্যায় রোগীর ভিড় বেশী ছিলনা। মেঘলা আকাশ, খুব বাতাস বইছে, হয়তো কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে রাজু মানে ডঃ রাজেন্দ্র রায়। নদীর পাড়ে গিয়ে বহুদিন বাদে বসে। মনে পড়ে যায় সেই ছেলেবেলার সুন্দর দিনগুলোর কথা। জীবন সায়াহ্নে এসে আজ অনেক ছোট ছোট স্মৃতির সাথে সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ভেসে ওঠে মনের কোণে।
রাজেন্দ্রনাথ রায়- এখন প্রতিষ্ঠিত এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সে। ভবানীপুরে বাড়ি করেছে, একতলায় সুসজ্জিত চেম্বার। ভাবনার পথ ধরে অনেকগুলো দিন পিছিয়ে যায় রাজু ।

তখন জয়েন্ট এনট্রান্স দিয়ে সবে ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে। হোস্টেলে থাকে।বাড়ীতে মাসে একবার যেতেই হয়, টাকা পয়সা আনতে হয়। অনেক খরচ।
শহুরে জীবনে খাপ খাওয়াতে তার একটু সময় লাগছে। হোস্টেলের সিনিয়াররা বিভিন্ন ভাবে raging চালায় মাঝে মধ্যেই।
মনে পড়ে গ্রামের সহপাঠী রতনের কথা। ভীষণ বোকা বোকা মুখ, ইয়ার্কি বুঝতো না। তখন কত ভাবে তাকে হ্যারাস করেছে রাজুরা। মাঝে মাঝে ব্যাগে নিজের টিফিন দেখতে না পেয়ে রতন তো কেঁদেই ফেলতো।হাজার কথা মনে আসে – ঘুম আসতে অনেক দেরী হয়ে যায়। কলকাতা শহরে সারারাতই নানান শব্দ। কখন যেন চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, দরজায় শব্দ- কে যেন ডাকছে।আবার কেউ টোকা দেয়, না ভুল নয়, আজ রুম মেট অশোকও নেই। দরজা খুলে দেয় রাজু। রতন? এতো রাতে!
– আয় আয়।
– চল, ভেতরে চল।
– কি ব্যাপার! কলকাতায় এসেছিলি?
– হ্যাঁ রে, ভাবলাম তোর সাথে দেখা
করে যাই।
– ভালো করেছিস, আমি তো ভোরেই বেরবো, বাড়ী যাব। একসাথে বেরিয়ে
যাব।
– ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না রে রাজু, তার আগেই বেরোব।
– ঠিক আছে। খাবি তো কিছু?
– না, খেয়ে এসেছি। অনেক খেয়েছি আজ। শুয়ে পড়, আমি একটু বসছি।
– তাহলে আয়, বাকি সময়টুকু গল্প করে কাটিয়ে দি।
– বাঃ খুব ভালো হয়। রাজু আমি তোকে খুব ভালোবাসতাম রে, পড়াশুনায় তুই কত ভালো ছিলি! তাই সাহস করে তোর কাছে এগোতে পারিনি। আর তোরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতিস জানি, বোকা ছিলাম তো! সেটাই স্বাভাবিক! আজ সত্যি বলছিরে – তোকে আমার খুব ভালো লাগত, হিংসেও করতাম। তোর মতো বুদ্ধি ভগবান আমাকে
দিল না কেন? অনেক স্বপ্ন ছিল রে, কিছু
পুরণ হল না। জীবনে খুব অবসাদ এসে গেছিল।
– রতন,তুই এভাবে বলছিস কেন? এই তো শুরু জীবনের, অনেক কিছু করার আছে আমাদের।
– না না! আমার দ্বারা আর কিছু হতো না রে, তাইতো সব শেষ করে দিয়েছি। দাদা-বৌদির দিনরাত কথা শোনানো, বাবা-মায়ের আমাকে নিয়ে হতাশা। তার চেয়ে এই ভালো।
– কি ভালো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না রতন। তুই কলকাতায় কেন এসেছিলি? আমাকে খুলে বল।
– তোর জন্যই এসেছিলাম রে বন্ধু। মনে পড়ে তোর- স্কুলে আমাকে নিয়ে কতো মজা করতিস তোরা? আমাকে বোকা বানানো তোদের নিত্যদিনের একটা কাজ ছিল।কতদিন এমন হয়েছে- যে আমি নীরবে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছি। আজ হঠাৎ মনে হল – তোকে একটু চমকে দিই।
হা হা হা ……
রাজু চমকে ওঠে। রতন কি বিকট ভাবে হাসছে। অল্প আলোয় ওর মুখটাও কেমন বীভৎস লাগছে, ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। গা ছমছম করছে কেন?
– নারে উঠি। আরেক জায়গায় কাজ
আছে।
– তার মানে? তুই যে বললি, একসাথে বেরোব?
– না! তুই ঘুমিয়ে নে ঘন্টাখানেক। চললাম রে। খুব ভালো থাকিস, বড় ডাক্তার হয়ে –
গ্রামকে ভুলে যাস না – ভাই, গ্রামের গরীব মানুষগুলোর কাছে পয়সা চাস না কখনও।

আচমকা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় রতন। অবাক লাগে। রতন এত কথাও বলতে পারে? এভাবেও হাসতে পারে?
বাকি রাতটা চোখের পাতা এক করতে পারেনা রাজেন্দ্র। ভোরে বেরিয়ে পড়ে – ফার্স্ট বাসটা ধরেই যাবে।
বাসস্টপ থেকে নেমে প্রায় পাঁচ মাইল রাস্তা। হাঁটতে শুরু করে রাজু। কালী মন্দিরে প্রণাম করে লাল মাটির রাস্তাটা ধরে সে। রাস্তায় লোকজন কম। কাল রাতে রতনের আকস্মিক আগমন – এত কথা – চলে যাওয়া – সব মনে করতে করতে এগোয় সে।
– বল হরি.. হরি বোল্,
বল হরি হরি বোল। থমকে যায়
পা দু’টো, পাশের গ্রামের কেউ মারা গেছে বোধহয়। অনেক মানুষ, মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে।
শ্মশানের দিকে। পরিচিত মুখও অনেক আছে সঙ্গে। রাজু একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করে
– ও কাকা, কে গো? কে মারা গেছে?
– হায় হায় বাবা, কী বলি বলো, তোমাদের বয়সি জোয়ান ছেলেটা কাল রেল লাইনে গলা দিয়েছে,তখন রাত এগারোটাট। সে কি কান্ড সারারাত – গ্রামে কারো চোখে ঘুম নেই।
– কে ? কার কথা বলছ?
– ঐ যে গো – পূব গাঁয়ের হারান মিত্রের ছেলে রতন মিত্র।
– কী? কি বলছো তুমি কাকা, কখন ঘটেছে – এ ঘটনা?
– খবর পেয়েছি আমরা রাত এগারোটায়।তা দশটা হবে হয়তো …
– কী বলছো তুমি? রাজু আর দাঁড়াতে পারে না। তার খুব শরীর খারাপ করছে। তবু বিশ্বাস করতে পারে না সে। টলতে টলতে শ্মশানের দিকে যায়। বডি নামানোর পরে রতনের মুখটা দেখতে পেয়ে – রাজু জ্ঞান হারায়।

এ ঘটনা অবিশ্বাস্য, তাই জনে জনে বলে উপহাসের পাত্র সে হয়নি
সেদিন। তবে পরবর্তী জীবনে রতনের কথা সে যতটা সম্ভব রাখতে চেষ্টা করেছে।
গ্রামে স্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরী করে – সপ্তাহে একদিন গরীব মানুষগুলোর বিনে পয়সায় চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে।

গায়ে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে সম্বিৎ ফেরে রাজেন্দ্রর। নদীর ধারের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগছে । তাড়াতাড়ি বালি ঝেড়ে হাঁটতে শুরু করে সে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে।।

Loading

One Comment

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

<p>You cannot copy content of this page</p>