“অতিথি পাখি”
– সোমা কর্মকার
অফিস যাওয়ার সূত্র ধরে ট্রেনে ডেইলী প্যাসেঞ্জারী করা। সেই সময় বছরের পর বছর একই কামরায় যাতায়াতের ফলে বেশকিছু লোকের সঙ্গে একটা সখ্যতা গড়ে উঠছে। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকজনের সঙ্গে একটু বেশী আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে একজন হলো প্রিয়াঙ্কা। ফর্সা, সুন্দরী, প্রাণবন্ত, হাসিখুসি একটা মিষ্টি মেয়ে প্রিয়াঙ্কা। বেশ পরিপাটি করে সাজাতো ও, হাসি, ঠাট্টা আর দুষ্টুমিতে ভরিয়ে রাখতো পুরো কামরাটাকে। খুব অল্প সময়েই ও আমার মনপাড়ার বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল। কোন কারণে যদি আমাদের মধ্যে কেউ একটু আগে পরের কামরায় উঠে পরতাম তাহলে আমরা একে অপরকে ফোন করে আবার পাশাপাশি চলে আসতাম। এমনকি কেউ অনুপস্থিত থাকলেও আমরা একে অপরকে ফোন করে না আসার কারণটা জেনে নিতাম। এভাবেই চলছিল হঠাৎ দেখলাম বেশ কয়েকদিন প্রিয়াঙ্কা আসছে না। আশেপাশের আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করাতে কোয়েরী নামের আমার আরেকটা বন্ধু (ওর সঙ্গেও প্রীয়াঙ্কার সুত্র ধরেই চেনা, যদিও এখন ও আমার খুব কাছের বন্ধু) বললো ওকে ফোন করা হয়েছিল ও বলল ওর কোন আত্মীয় (দাদা) অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে তাই ও আসছে না। সে কথা শুনে দু’দিন পরে আমি ওকে ফোন করি আমাকেও একই কথা বলল আর বললো দু’দিন পর থেকে ও আসবে। আমি বললাম ঠিক আছে তুমি এসো তার পর কথা হবে। কথামতো ঠিক দু’দিন পরে ও ঠিক ফিরে এলো, কিন্তু ওর মধ্যে কিছুতেই আমি সেই প্রিয়াঙ্কাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ও যেন কাউকে চেনেই না, আমাদের কারো সাথে কোন কথা নেই। সাজ নেই, গোজ নেই, একদৃষ্টে জানালা দিয়ে বাইরে আনমনে তাকিয়ে থাকছে। আর ওর স্টেশন আসলে নেমে যায়। এ যেন অন্য কোন প্রিয়াঙ্কা। ভাবলাম যেহেতু সদ্য সদ্য ওর বাড়ীতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে তাই হয়তো একটু আপসেট, দু’ দিন পরে আবার ঠিক হয়ে যাবে এই ভেবে দু’দিন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। দু’ দিন পরেও কোন পরিবর্তন নেই। তখন একে সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল, কি হয়েছে? সাজগোজ কেন করছো না? আমাদের সঙ্গে কথা বলছো না কেন?ইত্যাদি নানা রকম প্রশ্ন। কিন্তু এইসময় আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি, আসলে সত্যি কথা বলতে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি, পাছে ও কি ভাবে। তবে মনে মনে খুব বুঝতে পারছিলাম, যে মারা গেছে সে ওর খুব কাছের কেউ। আর সেই বিষয়টা ও ভুলতে ও পারছে না, কাউকে বলতেও পারছিল না হয়তো। কিন্তু যে কোন দুঃখের কথাই কাউকে না কাউকে শেয়ার করলে বোধহয় মনটা একটু হালকা হয়। একদিন অনেক সাহস করে ওর পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলাম প্রিয়াঙ্কা কি হল কথা বলছো না কেন? আমাদের সাথে কথা বলো মন ভালো লাগবে। কি হয়েছে? ওর খালি একটাই কথা কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি। আগ বাড়িয়ে আর কিছু বলতে পারিনি, শত হলেও সবার একটা পার্সোনাল স্পেস থাকে, আর সবাই তো সমান হয় না। এর পর আবার বেশকিছু দিন ও এলো না। কোন এক শুক্রবার ওকে ফোন করতে বললো ওর জ্বর হয়েছে তাই আসছে না। সোমবার থেকে আবার আসবে। কিন্তু সোমবার’ও আসলো না। কারো কাছে শুনলাম যে ওকে অন্য বগিতে দেখেছে। তখন বুঝতে পারলাম যে ও একটু একা একা থাকতে চাইছে। দেখতে দেখতে আবার বেশ কিছু দিন হয়ে গেল কিন্তু মনটা খুব খারাপ লাগছিল তাই না পেরে একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ট্রেনে বসেই ওকে ফোন করে ফেললাম, দেখলাম ওর ফোনটা সুইচ অফ বলছে, মনটা আরো বেশী উতলা হয়ে উঠলো। মনে পড়লো বেশ কিছু দিন আগে একটা নতুন নাম্বার থেকে আমাকে ফোন করে ছিল। আমার কি মনে হলো সেই নম্বরটা সেভ করে রেখেছিলাম, সেই নম্বরটিতে ফোন করতে ফোনটা রিসিভ করল। আমি বললাম কে প্রিয়াঙ্কা? অপরদিক থেকে উত্তর আসলো না আমি প্রিয়াঙ্কার মা বলছি, তুমি কে? আমি বললাম, ওহ্ কাকিমা, আমি সোমা বলছি, ওর সাথে একসঙ্গে যাতায়াত করি। কাকিমা বললো, বলো। আমি বললাম প্রিয়াঙ্কা আছে? কদিন ধরে আসছে না… বলতে বলতেই বললো, না প্রিয়াঙ্কা তো নেই! ও তো মারা গেছে!!
কথাটা শুনেই আকাশ পাতাল ভেবে আমার মাথা ঘুরে গেলো। আমি বললাম কি বলছো তুমি এসব? বললো কেন তোমরা কিছু জানো না? ওর যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল সে ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। তারপর থেকে ও কেমন একটা হয়ে গেছিলো। আমি তখন বললাম যে, আমরা অতো কিছু জানিনা। তবে প্রিয়ঙ্কা বলেছিল ওর কোন এক দাদা মারা গেছে, তবে বুঝতে পারছিলাম যে ওর কাছের কেউ মারা গেছে। কিন্তু ও তো আমাকে দু’ দিন আগে বললো ওর জ্বর হয়েছে, ও সোমবার থেকে আসবে। হ্যাঁ, সোমবার অফিস গিয়েছিলো, বাড়ী এসে ও অ্যাসিড খেয়ে নিয়েছিল। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, দুই দিন ছিল হাসপাতালে দু’ দিন পরে বাড়িতে ফিরে আসলো তারপর দিন ও মারা গেলো। কথাগুলো শুনে ফোনটা রাখবো নাকি, কথা বলব, বসবো, না দাঁড়াবো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। কোন ক্রমে ট্রেন থেকে নেমে টোটো করে বাড়ী ফিরে আসলাম। সবার প্রথমে মার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করলাম। কিন্তু কিছুতেই আমি ভুলতে পারছিলাম না। রাতে ঘুমাতে পারছিলাম না, খেতে পারছিলাম না, রাতদিন শুধু ওর কথাই মনে পড়ত ওর হাসি, ওর কথা, ওর মুখ ইত্যাদি নানা স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে আসছিলো। অনেকদিন সময় লেগেছিল বিষয়টা স্বাভাবিক হতে। মাঝে মাঝে মনে হতো ওর তো বাবা ছিলো না, ও কি ওর মার কথাও একবার ভাবলো না? আবার ভাবি সবসময় হয়তো সব পরিস্থিতিতে সবার পক্ষে সব কিছু মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। যার যার বিষয়টা হয়তো, সেই ভালো বুঝতে পারে, একেই হয়তো ভালোবাসা বলে। যাই হোক, ও যেখানেই থাকুক ওর আত্মার শান্তি কামনা করি। তবে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি কারো সাথে যেন এমনটা না হয়, সবাই যেন তার কাছের ভালোবাসার মানুষটিকে পায়।