গল্প

গল্প- ঠিকানা

ঠিকানা
-রাখী চক্রবর্তী

অতনু বাড়িটা কিনেই মাকে বলেছিল এই বাড়িতে অসহায় ভিটে ছাড়া, মা বোনেরা থাকবে, তোমার সাথে মা ।সেদিন লতিকা দেবীর বুক গর্বে ভরে উঠেছিল।
তুমি খুশি তো মা।ছোটবেলায় তুমি বলতে আমাকে মনে আছে মা? শুধু নিজের জন্য ভাবলে হবে না।অসহায় মা বোনেদের কথাও ভাবতে হবে ।আমি তখন অত কিছু বুঝতাম না।আমি ভাবতাম আমার মা ভালো থাকলেই চলবে ।কিন্তু যেদিন আমি কলেজ থেকে আসার সময় সুমনা মাসিকে রাস্তার মোড়ে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম সেদিন ই আমার চোখ খুলে গেছিল মা।সব মা যেন ভালো থাকে ।সেদিন থেকে আমি এটাই চেয়ে এসেছি।আজ মা তোমার ইচ্ছে একটু হলেও আমি পূর্ণ করতে পেরেছি।সবচেয়ে আনন্দের দিন মা আজ।”লতিকা ভবন” লতা পাতায় ভরে যাবে একদিন ।ঘরগুলো আমি নিজের হাতে সাজাবো আজ থেকে ।

অতনুকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছে ওর মা।বাবাকে ওর মনে নেই ।ছোট্ট থেকে শুনে আসছে ওর বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে ।আজও কোনও খোঁজ পায়নি অতনু ওর বাবার।লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করে ছেলেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন লতিকা দেবী।আজ অতনু পুলিশ অফিসার ।মা ছাড়া ওর কাছে কোন কিছুরই মূল্য নেই ।মার ইচ্ছেই শেষ কথা ওর কাছে ।

এদিকে প্রতি দিন “লতিকা ভবনে” আশ্রয় নিচ্ছে অসহায় মা বোনেরা । সেদিন দুপুর বেলায় এক মহিলা এসে বললেন আমাকে থাকতে দেবে বাবা? আজ আমি নিরাশ্রয় ।
অতনু বলল,আপনাদের জন্যই তো লতিকা ভবন সেজে উঠেছে ।আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে এখানে থাকুন ,বলে অতনু ওনার হাতে রাখা একটা বাঁধানো ফটো আর একটা থলি নিয়ে ওনাকে দোতলার ঘরে নিয়ে গেল।ফটোটা দেখে অতনু চমকে উঠল- এটা কার ফটো মাসিমা?
— আমার স্বামীর।উনি গত হয়েছেন দু মাস হল।এর মধ্যেই আমার দু ছেলে তাদের আসল চেহারা দেখিয়ে দিল বাবা।আমি আমার স্বামীর ভিটে ছাড়তে বাধ্য হলাম।ওরা আমার খাবারে বিষ দেবে।আমি জানতে পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।তোমার কথা অনেক শুনেছি তাই তোমার কাছে আশ্রয় নিতে এলাম।তোমার মা রত্ন গর্ভা ।তা নাহলে এমন ছেলে জন্ম দেন।
অতনু নিজের মাকে কখনওই কষ্ট দিতে চায় না।এই ফটোটা দেখলে ওর মা যে ভীষণ কষ্ট পাবে।স্বামীর জন্য প্রতিক্ষা করে আজও বেঁচে আছে মা।এই বয়সে আমি মাকে কষ্ট পেতে দেব না।অতনু আগত ভদ্রমহিলাকে বললেন মাসীমা এই ফটো আপনি আমার কাছে রেখে দিন।যত্ন করে রেখে দেব আমি।
—কেন বাবা দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখলে কোন অসুবিধা হবে ?
–না না এখানে কোন পুরুষের ছবি রাখা যাবে না।বলে অতনু ঐ ছবিটা নিয়ে ওর মার ঘরে চলে গেল। দেওয়ালে টাঙানো ওর বাবার ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছবিটা ভেঙ্গে, কাঁচের টুকরো গুলো ও ছবি দুটো ছিড়ে নর্দমার জলে ফেলে দিল।অতনুর বাবার স্মৃতি নর্দমার নোংরা জলে ভাসছে ।কেউ কিছুটি জানতে পারল না।না ঐ মহিলা না ওর মা।অতনু স্তম্ভিত হয়ে গেল বাবার কথা ভাবতে গিয়ে ।মা যে মানুষ টাকে এত ভালবাসতো সে এত নিষ্ঠুর ।ছেলে বৌ কে ছেড়ে অন্য জায়গায় সংসার পেতেছিল ।লতিকা ভবনে অতনুর বাবার অস্তিত্ব তিনজনের মধ্যে থেকে গেল।কিন্তু সেটা আলাদা ভাবে ।কেউ কারোর মনের কথা জানতে পারলো না।ওর বাবা মরে গিয়েও এক প্রশ্ন চিহ্ন রেখে গেল অতনুর বুকের মধ্যে । সেই রাতে লতিকা ভবনের প্রতিটা ইট প্রতিটা ঘর অতনুর বুক চাপা কান্না শুনতে পেল।লতিকা দেবী খোলা বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে হয়তো স্বামী কে ফিরে পাওয়ার জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছেন।ভবিতব্যের কাছে মানুষ যে হার মানে চিরদিন চিরকাল ।

Loading

One Comment

Leave a Reply to জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদীCancel reply

<p>You cannot copy content of this page</p>