গল্প- পেঁয়াজ বিভ্রাট

পেঁয়াজ বিভ্রাট
– তাপসী শতপথী পাহাড়ী

 

 

হরেন বাবুর এ হেন আচরণে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে নিতাই। হবে নাই বা কেন, সে সামান্য সব্জী বিক্রেতা। প্রতিদিন হরেন বাবু একবার করে আসবেন আর পেঁয়াজগুলো টিপতে থাকবেন আর বলবেন,
-এ পেঁয়াজ গুলো মোটেই ভালো নেই, ভেতরগুলো সব কালো। তা কত করে নিচ্ছ হে?
প্রতিদিন একই উত্তর দিতে কার আর ভালো লাগে! তাই নিতাই বেশ বিরক্তির সুরেই বলল-আপনি কি জানেন না? প্রতিদিনই তো এসে একবার করে টিপে যান, কেজি একশো পঞ্চাশ।
– কী বল হে! একি মাংস নিচ্ছি নাকি! দিনের পর দিন যে বাড়িয়েই দিচ্ছো। আবার কোনটা পচা, কোনটা কালো।
-তা আপনাকে নিতে কে বলছে, যান না অন্যখানে, বউনির সময় যত্তসব ঝামেলা!
-নেবো নেবো তাই নেবো। নেহাত তোমার কাছে সব দিন নি, না হলে কে ছুঁতো এই পচা পেঁয়াজ! বলে গজ্ গজ্ করতে করতে তিনি অন্য একটা সব্জী বিক্রেতার দিকে এগিয়ে যান। দেখতে পান পাসের বাড়ির যদুকে।
– কি হে যদু বলি বাজার-টাজার হলো? তা কী কী নিলে? পেঁয়াজ-টেঁয়াজ কিনলে? যদু মাথা নেড়ে সায় দিল।
-দেখি তো কেমন পেঁয়াজ। আমিও একটু কিনবো বলে খপ করে তার থলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন।
– বাঃ বাহ্ বেশ চকচকে তো! আহা হাত দিলেই ঝাঁজ পাওয়া যায়। দেখছো কি সুন্দর গায়ের রং!বলে বেশ কয়েকবার থলের মধ্যে থাকা পেঁয়াজগুলো যেন চটকাতে লাগলেন।
কিন্তু হরেন বাবুর নিত্য দিনের এই বদ অভ্যাস তার আর ভালো লাগে না। একটু বিরক্ত হয়েই থলেটাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যদু। নেহাৎ পাড়া প্রতিবেশী বলে মুখে কিছু বলা যায় না, তা বলে প্রতিদিন এভাবে হাত ঢুকিয়ে পেঁয়াজ টেপা কারই বা পছন্দ হয়! যদু যতটা পারে হেন তেন বলে এড়িয়ে যায়। হরেন বাবু ঠিক জানেন কোথায় ভালো পেঁয়াজ পাওয়া যায়। কিন্তু ওখানে যেতে তাঁর সাহস হয় না। কিছুদিন আগেই দরদাম নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি, তর্কাতর্কি হয়ে গেছে। এমন কি হাতাহাতির পর্যায়েও পৌঁছে যায়। হরেন বাবু হুমকি পর্যন্ত দেন তার নামে F.I.R করবেন। তাই সে মুখো হওয়ার আর উপায় নেই। অগত‍্যা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যান অতিপরিচিত বুড়ি সব্জীওয়ালির কাছে যে কিছু ছোটো ছোটো প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া পেঁয়াজ, কিছু ধসা আলু , লঙ্কা আর সামান্য কিছু পেঁয়াজকলি নিয়ে বসে আছে। হরেন বাবু দেখলেন যা করতে হবে এখানেই করা যাবে, একটু চেপে ধরলে বেশ কম দামেই পাওয়া যাবে পেঁয়াজটা।
-কি বুড়িমা আজও ওই কয়টা পেঁয়াজ নিয়ে বসে আছো! আজ আবার পেঁয়াজ কলিও আছে দেখছি। বেশ ডাঁসা ডাঁসা। কিন্তু পেঁয়াজগুলো কবেকার?এ তো দেখছি পেঁয়াজের চেয়ে খোসাই বেশি! তা কত করে নিচ্ছো?
-দাও না যা দিবে যেমন বাজার দর চলছে।

হরেন বাবু বেশ উৎসাহিত হয়ে বললেন,- বেশ বেশ নাও পঞ্চাশ টাকা দরে দু’শো গ্রাম দাও।
– না না তা হবে না। নব্বই টাকার নিচে হবে না। যাওনা দেখবে সবাই কেমন দেড়শো টাকা হাঁকাবে।
– আরে, এ পেঁয়াজ কি সে পেঁয়াজ নাকি! রেখেছো তো কবেকার পচা, ধসা, শুকনো, যার খোসাই বেশি, দাও দাও হবে হবে বলে যেই না হরেন বাবু পেঁয়াজে হাত দিতে গেছেন বুড়ি খপ করে হাতটা ধরে ফেলেছে।-আরে রাখো রাখো হবে না।
-আরে হবে হবে, দাও তো বলে দু’জনের মধ্যে পেঁয়াজ নিয়ে হূলুস্থূলু বেঁধে গেল। কিছুক্ষণ এ নিয়ে টানাটানি চলল। শেষ পর্যন্ত হরেন বাবুকে পরাস্ত হয়ে বলতে হলো- ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ। অগত‍্যা পেঁয়াজের মায়াভুলে পেঁয়াজকলিতে হাত পড়ে তাঁর।
– ঠিক আছে ঠিক আছে। তোমাকে পেঁয়াজ দিতে হবে না। পেঁয়াজ কলিই দাও । নাকি তাও একশো টাকা কেজি?
বুড়ির পেঁয়াজকলির দাম কম শুনে দু’ আঁটি নিয়ে বাড়ি মুখো হলেন। আর না অনেক হয়েছে। সেদিনও এ পেঁয়াজ নিয়ে তাঁকে কম অপদস্ত হতে হয়নি! পাত্রের বাড়ি তাড়া দিচ্ছে বলে ঘটক এসে শুনিয়ে গেল কথা কিন্তু তারা কি বুঝবে মধ্যবিত্ত পিতার পেঁয়াজের কি জ্বালা! হরেন বাবুও প্রতিজ্ঞা করেছেন যতদিন না পেঁয়াজের দাম কমছে ততদিন মেয়ের বিয়ে দেবেন না। এককেজি মাংসে কতটা পেঁয়াজ লাগে তার হিসেবে যে খরচ হবে সে টাকাটা কে দেবে শুনি! তার উপর আজ আবার ঝামেলা পোয়াতে হলো। কার মুখ দেখে যে আজ উঠলাম? ঠিক ঠিক ওই প্রিয়ংবদা। আহা কি প্রিয় ভাষণ সর্বদা। গিয়েই তো আবার শুনতে হবে, সারা দিনের যত ঝামেলার রোশ এসে পড়লো পত্নী প্রিয়ংবদার উপর। তিনিও উন্মুখ ছিলেন বিস্তর দেরি দেখে। দুরন্ত বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেই বেগ এতো তীব্র ছিলো যে সারা ঘরময় সব্জী ছড়িয়ে পড়লো, কিছু ডাস্টবিনে গেল আর পেঁয়াজকলি দিয়ে মাছের চচ্চড়ি যখন পাতে পড়লো তখন বিকেল চারটে। একে তো সকালের হেনস্থা তার ওপর এতো ঝড় সব মিলিয়ে হরেন বাবুকে বেশ অগ্নিশর্মা করে তোলে। দু’জনের মধ্যে রাত পর্যন্ত বেশ তর্কাতর্কি, ঝগড়া, গিন্নির খাওয়া বন্ধ, দোর বন্ধ। অবশেষে শেষ আশ্রয় স্থল বাপের বাড়ি। এদিকে হরেন বাবুও বেশ কয়েকদিন রাগান্বিত হয়ে আর খোঁজ নিলেন না পত্নীর। কিন্তু খোঁজ তো নিতেই হবে, না হলে চলবে কি করে! চলবে চলবে করে তো এতো দিন চলে গেল, পেঁয়াজ ছাড়া চলতে পারে কিন্তু প্রিয়ংবদা ছাড়া অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়েই পত্র লিখতে হয় তাঁকে-

প্রাণেশ্বরী,
প্রিয়ংবদা
এতদিনে তোমার অত্যুচ্চ ক্রোধ, দম্ভ নিশ্চয়ই নির্বাপিত হইয়াছে। তুমি যত শীঘ্র সম্ভব স্বস্থানে ফিরিয়া আসিবার জন্য প্রস্তুত হও। সুখবর হইল যে এবারে বাজার হইতে তোমার রন্ধনের প্রয়োজনে একসাথে পাঁচ কেজি ঝাঁঝ যুক্ত রসালো পেঁয়াজ আনিয়াছি। তুমি শীঘ্র আসিয়া মহানন্দে রন্ধন কর।
ইতি
হতভাগ্য ,
এই বলে পত্রখানি পত্নীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিলেন।

Loading

Leave A Comment