Site icon আলাপী মন

গল্প- ভোরের স্বপ্ন

ভোরের স্বপ্ন
– তাপসী শতপথী পাহাড়ী

 

 

প্রত্যেকের মধ্যে একটা স্বপ্নের জগৎ থাকে। সেই স্বপ্নকে সে ছোটো বেলা থেকেই লালন করে। আজ খোয়াইও তার স্বপ্ন পূরনে পা বাড়িয়েছে। আজ তার কলেজের প্রথম দিন। বহুদিনের অপেক্ষার পর সেই স্বপ্ন পূরনের সুযোগ এসেছে। সে যখন ছোটো ছিল কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করতো বড় হলে সে কী হতে চায়, সে সপ্রভিত উত্তর দিত- ‘দিদিমনি হবো’। এইভাবে ছোটো থেকেই দিদিমনি
হওয়ার প্রতি একটা অদ্ভুত টান জন্মেছিল তার। এমনকি সে তার খেলার পুতুলগুলোকে ছাত্র বানিয়ে পড়াতে বসে যেত লাঠি নিয়ে। প্রত্যেকটা পুতুলকে এক একটা মিষ্টির নামে ডেকে বলতো,
-এই যে মন্ডা অ আ পড়। এই যে দানা নামতা কর। কচুরি তুই ছড়া বল। এইভাবে সারাদিন পুতুলগুলোর পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সে। আজ দেখতে দেখতে সে খোয়াই কত বড় হয়ে গেল কিন্তু এখনো ও সেই স্বপ্নকে ছাড়েনি। চার বোনের মধ্যে সে-ই ছিল বেশি মেধাবী কিন্তু যখন তার বয়স আঠারো, একটু উঁচু ক্লাসে পড়তে যাবে তখনই তার বাবা মারা যান। তাই পড়াটা তখন তার জীবনে একটা বিলাসিতা হয়ে ওঠে। পরিবারের পক্ষ থেকে নানা বাধা আসে তার পড়ার পথে। এমন কি কলেজে তার ভর্তির ব্যাপারটাও আটকে যায় অর্থের অভাবে। সেদিন সে প্রচুর কেঁদেছিল কিন্তু তার কান্না বদ্ধ ঘরটায় শুধু মাথা কুটে মরেছে, কেউ শোনেনি! সান্ত্বনা দিতে কেউই এগিয়ে আসে নি। তাই বাধ্য হয়েই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছে, আরম্ভ করেছে টিউশন কিন্তু পরের বছর কিছু টাকা জমলে যখন ভর্তির কথা ভাবছে, তখন পড়লো কঠিন অসুখে। বন্ধু সন্দীপকে ডেকে বলল- যা না ফর্মটা পূরন করে দিয়েছি, একটু জমা করে দে।
সেদিন সন্দীপ তার কথামতো ফর্ম জমা করতে গেলেও যখন লিস্ট বেরোয় তখন দেখে তার নাম বেরোয় নি। সে বুঝতে পারে সন্দীপই কিছু করে থাকবে না হলে তার চেয়ে কম নম্বর পাওয়া ছেলে মেয়েদের নাম আছে অথচ তার নেই! পরে জানতে পারে তার কথাই সত্যি, সে ফর্মটাই জমা দেয় নি কারণ তার বাস আসার সময় হয়ে যাচ্ছিল তো। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কে আর ফর্ম জমা দেয়! তাই সে তার অন্য এক বন্ধুকে জমা দিতে বলে ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সে বছর খোয়াই -এর আর কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না! সেদিন খুব কষ্ট পেলো খোয়াই। সাহিত্য নিয়ে পড়ার সমস্ত স্বপ্ন তার ধূলোয় মিশে গেলো। এখন আবার পরের বছরের জন্য অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই কিন্তু তা করতে হলে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু উপায়? হ্যাঁ, তাকে অন্য কলেজে সীট ফাঁকা আছে কিনা দেখতে হবে। তাই আর দেরি না করে সে অন্য কলেজের খোঁজ নিতে গেল কিন্তু কোথাও তেমন সুবিধে করতে পারলো না। অবশেষে যদিও একটা পেলো কিন্তু বাংলায় অনার্স আর হলো না যদিও কলেজের জি.এস বলেছে কয়েক দিনের মধ্যেই সীট ফাঁকা থাকলে ব্যবস্থা করে দেবে। সেই আশায় সে এখন বুক বেঁধে ক্লাসগুলো করছে। কারণ তাকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতেই হবে, সে লেখক হতে চায়, দিদিমনি হতে চায়। এই ভাবে সে কয়েকটা দিন অন্যান্য ক্লাসগুলো করতে থাকে, কিন্তু কিছুতেই যেন মন সায় দিচ্ছে না, যতক্ষন না অনার্স পায়। একদিকে অর্থের চিন্তা অন্য দিকে অনার্সের চিন্তা তাকে যেন অতিষ্ঠ করে তুলছে। তাই সে একদিন বাংলা ডিপার্টমেন্টের স্যারকে বলল- স্যার আমি অনার্সের ক্লাসগুলো করতে চাই, যদিও এই মুহূর্তে আমার অনার্স নেই, তবে পেয়ে যাবো স্যার, প্লিজ আপনি যদি এখন অনুমতি দেন আমি ক্লাসগুলো করতে পারি, না হলে অনেকটা পিছিয়ে যাবো! তার কাতর অনুরোধে সেদিন নিমাই স্যার তার ক্লাসের ব্যবস্থা করে দেন, খুব ভালো প্রফেসর ছিলেন উনি। ওনার কাছে টিউশন ও পড়ার সুযোগ পায় সে। সেযুগে এরকম প্রফেসর পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। সে যাই হোক অবশেষে অপেক্ষার পর স্বপ্ন পূরন হলো। অনার্স পেয়ে সে এখন রাত দিন পড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একদিকে টিউশন অন্যদিকে এতো পড়ার চাপ সব সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হলো। সারাদিন ক্লাস করার পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে টিউশন করা আর যেন কিছুতেই শরীরে সইছিল না তাই সে ঠিক করল সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস করবে। তাই করলো।অনার্সের ক্লাসগুলো করে কোনোমতে বাড়ি ফিরে আসে। একটি মাত্র বাস আর তা যদি না পায় তাহলে ভোগান্তির শেষ নেই, সেই সাত কি.মি. বাস স্ট‍্যান্ড থেকে হাঁটতে হবে। তাই অন্য ক্লাসগুলো অফ করেই তাকে ছুটে আসতে হয়। পরের দিন আবার ভোর বেলাতে ছুটতে হবে, নাহলে ঠিক সময়ে টিউশনে পৌঁছতে পারবে না। তাই খুব ভোরে উঠে একটা সাইকেল ধরে বাসস্ট‍্যান্ড যায়, টিউশন পড়ে, কলেজ করে তারপর বাড়ি ফেরে। এইভাবে সপ্তাহে তিনদিন রুটিনমাফিক ক্লাস করে। একে একে ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ার কাটিয়ে দিয়ে বেশ যোগ্যতার সাথে উত্তীর্ণ হয়। আজ কলেজের সব স্যাররা তার রেজাল্টে খুব খুশি। তাকে সম্বর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়। কিন্তু তার গর্বের সেই চরম মুহূর্তগুলো সে কাছের কোনো মানুষের সাথে ভাগ করতে পারে না, কারণ তার রেজাল্টে বাড়ির লোক যতোটা না উচ্ছ্বসিত তার চেয়ে বেশি চিন্তিত। পড়ার চেয়েও মেয়েকে উপযুক্ত পাত্রে বিয়ে দেওয়াই ছিল মধ্যবিত্তের একমাত্র স্বপ্ন। তাই তার স্বপ্ন যে নিছক একটা বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয় তা তার পরিবার ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয়। মেয়ে হয়ে জন্মেছো অথচ বিয়ে না করে এরকম ধিঙ্গিপনা চলবে না- প্রতিবেশীর এ হেন কথাবার্তা শুনতে নারাজ পরিবার। তাই সময় থাকতে থাকতে বিয়ের ব্যবস্থায় নেমে পড়ে পরিবার। খোয়াই কিছুতেই রাজি হয় না। তাকে যে আরো পড়তে হবে। এম.এ, বি.এড, সাহিত্য নিয়ে চর্চা, হতে হবে দিদিমণি, হতে হবে সাহিত্যিক। এখন বিয়ে করলে কি করে হবে!এখন কিছুতেই সম্ভব না। এ কথা সে বাড়িতে জানিয়েও দিয়েছে, কিন্তু কে কার কথা শোনে। এ নিয়ে তুমুল অশান্তি শুরু হয়ে যায় মা, দাদা, দিদিরা তাকে চারদিক থেকে চেপে ধরে। খোয়াই হাজার চেষ্টা করেও তাদের বোঝাতে পারেনা। তার সব চেষ্টা জলে যায়। রাগে, দুঃখে, অভিমানে বেশ কয়েক দিন সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়, মনমরা হয়ে বসে থাকে। কিন্তু কোনো লাভ নেই। শেষ পর্যন্ত সে তার ভাগ্যের পরিণতিকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। পড়াশোনার সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে এক অনির্দেশ্য পথের পথিক হতে হয় খোয়াইকে। জীবনের স্বপ্নকে খুইয়ে সে এখন রায় পরিবারের ব্যস্ত গৃহিনী। এক একটা স্বপ্নকে এক একটা কুঠুরিতে তালাবন্ধ রেখে আজ সে অনেক দূরে চলে এসেছে। আজ আর কোনো স্বপ্ন দেখতে সাহস পায় না সে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় কি বা স্বপ্ন দেখবে সে। এখন তো তাকে সবাই চেনে সেলাই দিদিমনি হিসেবে। ভাগ্যের এই উপহাস কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারেনা খোয়াই। কিছু একটা করতে হবে, কিছু একটা উপায় কিন্তু কি! কি ভাবে! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সে একটা উপায় বের করে। হ্যাঁ সে দিদিমনিই হবে, আবার পড়াতে হবে তাকে,করতে হবে টিউশন। সে আবার শুরু করে দেয়। দেখতে দেখতে তার ছাত্র সংখ্যাও বেশ বেড়ে যায়। কত বাচ্চারা আজ তার কাছে আসে,পড়ে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত নাই বা হতে পারলো কিন্তু এতো বাচ্চার কাছ থেকে যে ভালোবাসা সে আজ পাচ্ছে সেটাই বা কম কিসে? সে প্রতিজ্ঞা করেছে সবাই কে নিজের মতো করে মানুষের মতো মানুষ করবে। হ্যাঁ সে যে আজ সবার দিদিমনি।…

Exit mobile version