গল্প

গল্প- পুণ্যি … জলে!

পুণ্যি … জলে!

-অমল দাস

কথাসাহিত্যিক শরৎ চন্দ্রের শহর ছেড়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের শহরে ট্রেনটি প্রবেশের পথে ঐতিহাসিক জুবিলি সেতুটি পাড় করতে হয়। দুই শহরের মধ্যে একটা আত্মিক টান তৈরি করেছে এই সেতু। এটি উনবিংশ শতকের নব্বইয়ের দশকে নির্মিত। এখন বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। তাই সমস্ত ট্রেনই অতি ধীর ও সন্তর্পণে চলে। সেতুটির শিল্পশৈলী, ঝনঝন আওয়াজ, পুরনো গার্ডরেলিং, নিচে নদী, জেলেদের নৌকা, ঘাটে স্নানরত মানুষ দেখতে দেখতে ক্ষণিকের সময়ে মনটা নস্টালজিক হয়ে যায়।

তবে এই নস্টালজিক পরিবেশ বেশি সময়ের নয়। বর্তমানে ফিরিয়ে আনে  হঠাৎ টুং টাং কিছু শব্দ। নিবারনেরও অন্যথা হয়নি। ব্রিজের লোহার পাতে কয়েনের সংঘর্ষে এই আওয়াজ। কয়েন কোথা থেকে এলো তা বলার অপেক্ষা বোধহয় দরকার নেই। এপথের যাত্রীরা জানেন। তাঁরাও হয়তো কখনো কখনো হুগলী নদীতে এক-দু’টাকার কয়েন ছুঁড়ে দিয়েছেন। ভাবছেন বৃথা! না বৃথা কেউ একাজ করেন না। এর পিছনে লুকিয়ে থাকে পুণ্য লাভের গভীর অভিসন্ধি।

নিবারন পাশের যাত্রীকে কয়েন ছুঁড়তে দেখে জানতে চাইলো, ক’টাকা ফেলে দিলেন জলে?

পাশের যাত্রীটি, প্রশ্নে আশ্চর্য হয়ে গেলেন- সে কি! জলে ফেলতে যাবো কেন? মা গঙ্গাকে দান করলাম তো!

-দান করলেন? ভগবানকে দান করা যায়? ভগবান বলে যদি কিছু থাকে, তবে আমারই তো তাঁর দান! আমরা তাঁকে কী দান করতে পারি?

-মশাই কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। এ হলো গিয়ে এক প্রকার পুণ্যি কামানো। তাই ওই দু’টাকাটা! এ আর এমন কি…?

অবশ্যই এ যুক্তিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ নিবারন জানে যাঁরা এই পথের পথিক তাঁরা সকলেই প্রায় একই ভাবনায় চলেন। সে জিজ্ঞাস করলো, আচ্ছা এই যে সবাই টাকা জলে ফেলে, তাতে গঙ্গা মায়ের উপকারটা কি? মানে তিনি করবেন কি পয়সা দিয়ে? জলের তলায় তো আর দোকান বাজার নেই! প্রসাধনী সামগ্রী কেনারও মায়ের আশা করি কোনরূপ ইচ্ছা নেই! ছবি অনুযায়ী তিনি অপূর্ব রূপসী। সে রূপে যে কোন প্রসাধনী ম্লান হয়ে যায়। তাহলে কেন এই লাখ লাখ কয়েন শতক ধরে মানুষ ফেলে আসছে জলে!  আমাদের কি ভাবতে নেই এই অর্থ দেশের সম্পদ, যা জলে দিয়ে নষ্ট করা ছাড়া অন্য কিছু হচ্ছে না?

-ধুর মশাই! অতো কথা কেন? আপনার ভালো লাগেনি আপনি ফেলেন নি! আমার মনে হয়েছে আমি ফেলেছি.. অতশত ভাববার সময় নেই আমার…

এই বলে পাশের ভদ্রলোকটি একটু বিদ্রূপ দৃষ্টিতে নিবারনের দিকে তাকালেন। আশেপাশের দু’চারজন যাত্রীও, আপাত দৃষ্টিতে মনে হওয়া জ্ঞানদাতাকে একটু তাচ্ছিল্যের চোখে মুখ ঘুরিয়ে দেখেনিলেন।

নিবারন যাত্রীদের মনোভাব অনুভব করতে পেরে আর কিছু বললো না। নিজের ব্যাগ থেকে জলখাবারের কেক দুটি বার করে কাগজ ছাড়িয়ে ছুঁড়ে দিলো নদীতে। তখন ট্রেনটি জুবিলি পার করার শেষ মুহূর্তে। অনুমান করা যায় কেক দুটি জলেই পড়েছে।

এই দেখে পাশের যাত্রীটি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাস করলেন, কি করলেন মশাই ? কেক দুটি ফেলে দিলেন যে? ওগুলো কী নষ্ট হয়ে গেছে?

-না নষ্ট কেন হবে! এইতো প্যাকেট খুললাম আপনার সামনে।

-তবে ফেলে দিলেন যে বড়ো!

আসলে সবাই পুণ্যি কামাচ্ছেন, আমারও ইচ্ছে হলো! আমি ভাবলাম কয়েন ফেলে তো পলিতে চাপা দেওয়া ছাড়া কিচ্ছু হবেনা, কারণ জলজ প্রাণী গুলিও ওই কয়েন চিবোতে পারবে না। মা গঙ্গাও পয়সা নিয়ে নৈহাটি বা ব্যান্ডেলের বাজারে যাবেন না। কিন্তু কেক দুটি ফেলে কয়েকটি জলজ প্রাণের খিদে কিছুটা হয়তো মেটানো যাবে। এটাই ওদের জন্য উপকার। আর যেটা উপকার সেটাই আমার পুণ্যি বলে মনে হয়…

পাশের যাত্রী আর সাড়া দিতে পারলেন না। তিনি চোখ নামিয়ে নিলেন, মুখটি কেমন যেন শুকিয়ে গেলো। আর পাশের যাঁরা কিছুক্ষণ আগে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেছিলেন তাঁরাও আর ফিরে তাকাবার সাহস পাচ্ছিলেন না।

-সমাপ্ত –

Loading

4 Comments

  • Anonymous

    পুণ্যির নামে সমাজে চলে নানান কুসংস্কার, ক্ষতি হয় প্রকৃতির। অবুঝ মনের সেই অবাধ্যতার পুকুরে এক টুকরো ঢিল গল্পটি, যদি তরঙ্গ তুলে চেতনায় আঘাত আনতে পারে। অন্যরকম, অন্য স্বাদের গল্প

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

You cannot copy content of this page