এলোকেশী
– রাখী চক্রবর্তী
এক মাস হল অর্নব টালিগঞ্জের সটুডিও পাড়ায় ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। অবশ্যই কাজের সুবাদে। তা না হলে মাকে ছেড়ে পুরী থেকে কলকাতায় ও আসত না।যাইহোক কাজের থেকে বাড়ি ফিরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দোতলার ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্নব দেখে উঠতি নায়ক নায়িকাদের।
সাজসজ্জা তেমন না। সবাই যে রকম ভাবে ওরা কিন্তু তেমন না। একদম সাধারণ। অর্নবের বেশ ভালো লাগে, মাঝে মাঝে ইজিচেয়ারে বসে বা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা বেলায় চা খেতে খেতে উর্বশী রম্ভাদের দেখতে। তারপরই মনে দোলা লাগিয়ে ধাঁ হয়ে যায় সুন্দরী মেয়েগুলো।
গত পরশু অর্নব মর্নিং ওয়াকে গিয়ে ফেরার সময় ওদের বাড়ির উল্টো দিকের বাড়ির ঝুল বারান্দায় চোখ যেতেই অর্নব হাঁ হয়ে গেল। এতদিন তো হয়ে গেল এই মহিলাকে তো দেখতে পাই নি। তবে কি নতুন এসেছেন। এলোকেশী হয়ে দু হাত বারান্দার গ্রিলে রেখে আকাশের দিকে কি দারুণ ভঙ্গিমায় তাকিয়ে আছেন। এমন নিষ্পাপ চাউনি অর্নব জীবনে দেখেনি ।
সবুজ রঙের ওভার কোটের ওপর ও এলোকেশী মহিলার মুখের ওপর সূর্যের হাল্কা রশ্মি পড়েছে তাতে রূপের বাহার ফেটে পড়ছে ওনার।
অর্নব অনেক ক্ষণ ধরে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে পেপার দাদা হাল্কা সুরে বললো, কি হল অর্নব বাবু পেপার নিয়ে ঘরে যাও। আবহাওয়া ও চরিত্র খারাপ হতে টাইম লাগে না। হা হা হা।
অর্নব মাথা চুলকে বললো, চেনো না কি ওনাকে। আমি তো আজ দেখলাম ।
-মাথা ঘামিও না এসবে ব্যাপারে। বাচ্চা ছেলে তুমি।
– বত্রিশ বছর হল দাদা। মেঘে মেঘে বয়স বাড়ছে টের পাবে না। বলেই অর্নব ঘরে চলে গেল ।
সারাদিনে কাজ কর্মের মধ্যেও নয় নয় করে হাজার বার এলোকেশী মহিলার চুলের ঝাপটায় অর্নবের চোখ মুখ, গা কেঁপে উঠেছে ।
অর্নব বিকেলে বাড়ি ফিরে ঐ ঝুল বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকলো। না কেউ এল না।মানে ও যাকে খুঁজছিল।
ভোরের অপেক্ষাতে অর্নব রইলো। সারারাত এলোকেশীর হাওয়ার দাপটে অর্নব ছটফট করতে লাগল। ফলে ঘুম তেমন হলো না ওর।ভোরবেলা মর্নিং ওয়াকে গিয়ে বাড়ি ফেরার সময় হতাশ হয়ে গেল অর্নব। আজ আর নেই। কি হল ব্যাপারটা জানতে হবে তো। মনে মনে ভাবতে ভাবতে বাড়ি এল অর্নব।অফিস আজ ছুটি নিয়েছে অর্নব। টিফিন খেয়ে সামনের চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গেল। গল্প গুজব চলছে এর মধ্যে একটা টাটাসুমো থেকে হাল্কা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ে এক মহিলা নামলেন অর্নব যার খোঁজ পাওয়ার জন্য এত উতলা হয়েছিল তাকে এত কাছ থেকে দেখবে ও ভাবতেই পারছে না। অর্নবের চোখ দু’টো মহিলার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিখুঁত করে দেখছে। গাড়ি থেকে নেমে মহিলা চলে গেলেন। অর্নব জানে এইবার উনি দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াবেন।চায়ের দাম দিয়ে তড়িঘড়ি বাড়ি এসে দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে পড়ল অর্নব।
না! দু’ ঘণ্টা হয়ে গেল উনি আসেননি।
বিকেল বেলায় বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেছে, মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে। ঝড়কে ভীষণ ভয় পায় অর্নব। ঝড় উঠলে অর্নব ওর মার কোলে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকত।
অর্নব বারান্দার গ্রিলের সাটার বন্ধ করে ছাদে গেল। ছাদে গিয়ে থমকে গেল। ঐ তো কালো গাউন পড়ে এলো চুলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে পরমা সুন্দরী সেই মহিলা। যার হাত চুলের গোছা সামলাতে ব্যস্ত। চোখ দু’টো যেন অর্নবকেই খুজছে। আলতো হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে যেই পেছন ফিরতে যাবে ঠিক তখনই প্রচণ্ড ঝড়ের দাপটে এলোকেশী মহিলার চুল মাথার থেকে খুলে নিচে ড্রেনের সামনে গিয়ে পড়ল।
অর্নব কাঁপছে থরথর করে এই দৃশ্য দেখার পর।তবে কি অর্নবের স্বপ্ন এলোকেশী মহিলার মুণ্ডিত মস্তকে আছাড়ে পড়লো?
এক ছুটে মহিলা ঘরে চলে গেলেন ।
অর্নবের ঘামার্ত শরীর হিসাব মিলাতে পারছে না। রূপ তবে নারীর চুলে অবস্থান করে।সুন্দর চোখ সুন্দর মুখের কোন দাম নেই।রূপের বর্ণনা দিতে গেলে মাথার চুলকেও ধরতে হবে? অর্নব ভেবে পাচ্ছে না কাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবে ঐ মহিলার কথা। কে উনি? কি নাম তাঁর?
অনেক ভেবে ঠিক করল সকালে যে পেপার দেয় মানে বিশ্বদাকে জিজ্ঞাসা করবে,
অপেক্ষা ভোরের। রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না অর্নব। ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে এক গোছা চুল। অর্নব ধরতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আবার উঠে দাঁড়ালো অর্নব। জাগরণ ও বাস্তবের এই খেলা খেলতে খেলতে অর্নব দেখলো পুব আকাশে হাল্কা লাল রঙের আভাস দেখা যাচ্ছে।
পাড়াটা নিস্তব্ধ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পাড়ার সবাই। অর্নব ঝুল বারান্দায় এসে ইজিচেয়ারে বসে এলোকেশী মহিলার বারান্দার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যদি বাইরে আসেন উনি।
বিশ্বদা পেপার নিয়ে আসতেই অর্নব দৌড়ে গিয়ে জানতে চাইল ঐ মহিলার কথা। কে উনি বিশ্বদা?
বিশ্বদা বললো,
বাংলাদেশ থেকে উনি চিকিৎসা করাতে এসেছেন কোলকাতায়। নাম পরবীন সুলতানা। ক্যানসার লাস্ট স্টেজ।
ওনার স্বামী সপ্তাহের শেষে এখানে আসেন।
কাল রাতের বেলায় হসপিটালে নিয়ে গেছেন ওনার স্বামী। পেপার দিতে এসে শুনলাম আর নেই উনি। কাল রাতেই..
অর্নব মুখে কিছু না বলে ঘরে চলে এলো। ভালোলাগা ভালবাসার পরশ তো মিথ্যা হতে পারে না।
ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে অর্নব আজও দেখতে পায় হাওয়ার দাপট উপেক্ষা করেও কি সুন্দর চুলের গোছা সামলাচ্ছেন এলোকেশী মহিলা। যার ছবি অন্তরে সযত্ন করে রেখে দিয়েছে।
অর্নব এখন আর মেয়েদের মুখের দিকে আর থাকায় না। শুধু চুলের দিকে নজর দেয়। যে কোনো মেয়ে ওর সামনে দিয়ে গেলে ও চুলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, এই মেয়েটা বাঁচবে তো? না কি এলোকেশীর মতো..
সমাপ্ত