প্লেগ
→ ইন্দ্রনীল মজুমদার
করোনার আতঙ্কে গোটা শহর বা গোটা দেশ কেন গোটা বিশ্ব আজ কাঁপছে। বিশ্বজুড়ে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই মারণরোগে, মৃত্যু হচ্ছে কয়েক হাজারেরও বেশি মানুষের। গোটা কলকাতা শহর লকডাউন। কি করি, কি করি তাই এই লেখাটি লিখতে বসলাম। ও হ্যাঁ, এর ফাঁকে আমার পরিচয়টা দিয়ে রাখা ভালো। আমার নাম নীলকমল রায়চৌধুরী, ভৌতিক বা প্যারানরমাল বিষয় চর্চা করতে আমি বেশ আগ্রহী। যাই হোক, এবার মূল ঘটনাটায় আসি। বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। কলেজের সেমিস্টার পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন ছুটি পাওয়া গেল। সেই ছুটিতে এখনকারই মতো বাড়িতে বসে বোর হচ্ছিলাম। হঠাৎ, মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। ফেসবুকে “প্যারানরমাল বাংলা” বলে একটি গ্রুপ চালাই, সেখানে ভূত-সম্পর্কে বেশ কয়েকজন আগ্রহী বন্ধু আছেন। তা সেই গ্রুপে একটি পোস্ট দিলাম- “প্ল্যানচেট করার ইচ্ছা আছে? তাহলে সত্ত্বর আমার মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করুন আর ভূত নামাবার এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি লাভ করুন।” তো বেশ কথা। অনেকেই লাইক, কমেন্ট, রিঅ্যাকশন জানাল। কিন্তু মেসেঞ্জারে ম্যাসেজ এলো মাত্র চারজনের। বাকিরা কি তার মানে ভীতু? হবে হয়তো কিংবা এস্ক্যাপিস্ট। যাকগে, এই চারজনকে আমি আমার যোগাযোগ নম্বর ও বাড়ির ঠিকানা দিয়ে রাখলাম। আর বলে রাখলাম বিকেল পাঁচটার সময় আসতে আসতে।
অধীর আগ্রহ থাকলে বাঙালিও হয়তো সাহেব বনে যায়। ঠিক পাঁচটার সময় কলিংবেল বাজল। কিছুক্ষণ আগেই লোডশেডিং হল। তাই আমিও অতিথিদের জন্য অধীর আগ্রহে বসেছিলাম। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখলাম চারজনের বদলে দু’জন হাজির। তাঁদের পরিচয়টা দিয়ে রাখি- একজন বিশ্বরূপ দাস তিনি পেশায় প্রাইভেট শিক্ষক ও অন্যজন হলেন গৌতম ঘোষ যিনি একজন রিটায়ার্ড সরকারি অফিসার বর্তমানে ভূত ও মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা করেন। বাকি দুজন যাঁরা আসবেন বলেছিলেন তাঁরা বিশ্বরূপবাবুর চেনা। তাঁদের মধ্যে একজন অফিসের কাজে আটকে গেছেন আর অন্যজন প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরে বলেছিলেন, “সর্বনাশ। এভাবে কি সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়?” বিশ্বরূপবাবু যদিও তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, “আরে মশাই, ভয় নেই, আমরা তো আছি। তাছাড়া উল্টোপাল্টা কাউকে নামাব না।” বোঝানো সত্ত্বেও তিনি আসেননি। আমি বললাম, “একদিকে ভালোই হল। কখন যে কি হয়ে যাবে তখন আমাদের ঘাড়েই দোষ পড়বে। আর তাছাড়া প্ল্যানচেটে তো তিনজন লোক লাগে। আমি ইচ্ছে করেই সবাইকে জানিয়ে রেখেছিলাম। জানতাম, এইসব ব্যাপারে লোক কমই আসবে। বিশ্বরূপবাবু বললেন, “তা তো বটেই! আর তাছাড়া লোডশেডিং। শুনলাম কারেন্টের কাজ চলছে তা ঠিক করতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক তো লাগবেই। এরকম জমজমাট রোমহর্ষক পরিবেশ প্লানচেট করার পক্ষে বড়োই শ্রেয়।”
তা, আমরা তিন-পায়া টেবিল, মোমবাতি, কাগজ ও পেন্সিল নিয়ে ছাদের পাশের ঘরটিতে প্লানচেট করতে বসলাম। সমস্ত গুছিয়ে বসলেই তো আর হল না। মূল প্রশ্নটা হচ্ছে ডাকব কাকে? রোজই তো কারুর না কারুর মৃত্যু ঘটছে। আর তাছাড়া ভালো কাউকে তো ডাকতে হবে। এই “ডাকব কাকে?”- হ্যাঁ এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যখন তখন গৌতমবাবু উপদেশ দিলেন, “একজনকে ডাকা যায়। শুনেছি এই অঞ্চলে তারাপদ চট্টোপাধ্যায় বলে একজন থাকতেন বহু বছর আগে। তিনি এক জায়গায় খুব সম্ভবত আত্মীয়র বাড়ি গিয়েছিলেন। তারপর আর ফিরে আসেননি। তাঁর মৃত্যুরহস্য কেউ জানে না। অতএব,চলুন তাঁকেই আহ্বান করা যাক।”
আমি উৎসাহের সাথেই বলে উঠলাম, “হুম্, তাই হোক। দেখা যাক তিনি আসেন কিনা।”
আমরা সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে বসলাম প্ল্যানচেটে। একমনে সময় তারাপদবাবুকে মনে মনে ডাকতে বা স্মরণ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ডাকার পর হঠাৎ দেখি বিশ্বরূপবাবু অস্বাভাবিকভাবে বিড়বিড় করে চলেছেন। বুঝলাম, তাঁর মধ্যে আত্মার আবির্ভাব ঘটেছে। আমি কাগজ ও পেন্সিল এগিয়ে দিলাম আর প্রশ্ন করলাম, “তারাপদবাবু এসেছেন?”
বিশ্বরূপবাবুর চোখ বন্ধ অথচ না দেখে লিখলেন, “হ্যাঁ।”
গৌতম বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মশাই, আপনাকে স্বাগত জানাই। আমরা জানতে চাই যে, আপনার মৃত্যু হয়েছিল কিভাবে? যদি একটু বলেন।”
এই প্রশ্ন শুনে আত্মা বিশ্বরূপবাবুকে মিডিয়াম করে যা লিখলেন, তা জাস্ট একটা রোমাঞ্চকর কাহিনী। আনুমানিক মিনিট পঁচিশ ধরে এই লেখা চলল। তারপর বিশ্বরূপবাবুকে ধাতস্থ ও স্বাভাবিক হতে দেখে বুঝলাম তারাপদবাবুর আত্মা চলে গেছেন। আমরা বিশ্বরূপবাবুকে প্রশ্ন করলাম, “কেমন লাগছে এখন?” বিশ্বরূপবাবু আস্তে আস্তে চোখ খুলে বললেন, “এখন একটু ভালো লাগছে। একটু জল হবে?।
“নিশ্চয়ই।” বলে এক গ্লাস জল দিলাম। বিশ্বরূপবাবু জল খেয়ে বললেন, “একটু আগে হঠাৎ শরীরটা বেশ ভারী লাগছিল আর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম তাই কিছুই মনে নেই।”
তখন সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। কারেন্টও চলে এসেছিল। তাই, আলো জ্বালিয়ে কাগজের লেখাটি পড়লাম। তাতে লেখা আছে-
“২৩ শে মার্চ, ১৯২০।
তখন বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের পরে প্লেগ সারা বিশ্বে মহামারীর আকার ধারণ করে এলো। কাতারে কাতারে লোক মরছে। মহামারীর আঁচ লাগল আমাদের দেশে। এখানেও শহরে, গ্রামে-গঞ্জে ছেয়ে গেল মহামারীতে। লোকে মরতে লাগল। এসবের মধ্যে আমাদের গ্রাম নিশ্চিন্দপুরেও হঠাৎ মহামারী প্লেগের আবির্ভাব হল। সেখানেও চিকিৎসার অভাবে কাতারে কাতারে লোক মরতে লাগল। আমার তিনকুলে কেউ ছিল না। কলকাতায় এক সাহেব কোম্পানিতে কাজ করতাম। তা হঠাৎ একদিন গ্রামের ছেলেবেলাকার বন্ধু মৃন্ময় রায়ের কাছে থেকে চিঠি পেলাম। বন্ধু কেমন আছে?বা তার পরিবারের কোনো খবর চিঠিতে লেখা নেই। কেবল লেখা আছে- “এখানে আসতে হবে, বড়োই জরুরী।” তা ওইসময় প্লেগের দাপট একটু কমেছিল। বড়ো সাহেবকে ব্যাপারটা জানাতে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ছুটি মঞ্জুর করে দিলেন। তা নিশ্চিন্দপুর রওনা দিলাম বন্ধুর সাথে দেখা করতে। নিশ্চিন্দপুর স্টেশনে যখন পৌঁছাই, তখন সেখানকার আবহাওয়ায় কেমন একটা থমথমে ভাব। প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে একটা গরুর গাড়ি ধরার জন্যে এগোলাম। কিন্তু একটা মানুষকেও দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যেবেলা অথচ কোথাও শঙ্খধ্বনির আওয়াজ নেই, মানুষের কোলাহল নেই। সব যেন ফাঁকা, জনমানব শূন্য। তা, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ রেল স্টেশনের দিকে আসছিলেন। তিনি আমাকে দেখে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাওয়া হবে?”
– আজ্ঞে, রায় বাড়ি।
– রায় বাড়ি! ও বাড়ির সকলেই তো……..
পুরোটা শুনলাম না। গটগট করে হাঁটতে লাগলাম। একেই সন্ধ্যা নেমে গেছে তারউপর পথ পুরো ফাঁকা। যেভাবেই হোক, তাড়াতাড়ি বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতেই হবে। রায়বাড়ি কিছু হবে তা আমি বিশ্বাস করি না। বন্ধুর চিঠি যখন পেয়েছি তখন ওরা প্লেগে মারা যায়নি। তা বন্ধুর বাড়ির সামনে যখন এলাম তখন বেশ অবাকই হলাম। ধু-ধু করছে বাড়ির চারপাশ। বাগানে আগাছায় ভর্তি। মনে হচ্ছে, বাড়িতে কেউ নেই। অথচ মাস দুয়েক আগেই এসেছিলাম। বেশ ভালো অবস্থাই ছিল। বাড়ির সদর দরজার কাছে গিয়ে তাজ্জব বনে গেলাম। দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল! যেন আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল এই যে, দরজার সামনে কেউ নেই! ভেতরে বেশ খানিকটা দূরে এক ঘোর অন্ধকারে বন্ধু, ওর মা-বাবা, দাদা-বৌদি ও বাড়ির কাজের লোক সবাই বসে আছে। যেন আমি আজই ও এই সময়টাতেই আসব আর সেজন্যেই সবাই অপেক্ষা করছিল। কিন্তু অন্ধকারে কাউকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না।
বন্ধু অস্বাভাবিক ক্ষীণ গলায় বলল, “এসেছিস। আমি জানতাম তুই ঠিক আসবি।”
আমি বললাম, “তা তোদের দেখতে তো আসবোই। আরে! এভাবে অন্ধকারে এই সন্ধ্যেতে কেউ।বসে থাকে? আলোর ল্যাম্প জ্বালাসনি?”
বন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ক্ষীণ গলায় বলল, “ল্যাম্পের আলো বা যেকোনো আলো এখন আর সহ্য হয় না রে।”
আমি সন্দেহবশতই জিজ্ঞেস করলাম, “তোরা সবাই ঠিক আছিস তো? কিছু মনে করিস না এই বাড়িতে কেমন যেন একটা দুঃখের ছায়া।”
বন্ধু আমার কথায় উত্তর না দিয়ে বলল, “ওই টেবিলটাতে গিয়ে বস। তোকে কিছু খেতে দিই।”
অন্ধকারে আমি কাউকেই ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। বন্ধুর মা যখন আমার কাছে খাবার নিয়ে এলেন আর বলতে লাগলেন, “খা বাবা, অনেকদিন পর এলি যে!” তখন আমার পিঠ দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওই অন্ধকারেই কাছ থেকে যেটুকু দেখা গেল তা হল বন্ধুর মা এক কঙ্কাল ও তাঁর চোখ থেকে ঠিঁকরে যেন আগুন বেরোচ্ছে। বাকিদের দিকে তাকিয়েও দেখি সবার একই অবস্থা। সবাই কঙ্কাল আর সবার চোখের কোটর থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে। আমি ভয়ে দৌড়াতে লাগলাম, পেছন থেকে শুনছিলাম, সবাই বলছিল,- “এই ধর, ধর, পালাচ্ছে, ধরে……।” আমি তো দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছি। ওদের ডাকার উদ্দেশ্যে তাহলে বোঝা গেল। কতক্ষণ দৌড়েছি তার খেয়াল নেই। এমন সময় কোনোরকমে প্লাটফর্মে এসে হাজির হলাম। তাড়াহুড়োতে ট্রেনে উঠতে গিয়ে লাইনে আছড়ে পড়ি। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে দেখি, বেশ ভালোই লাগছে, ভয়ও কেটে গেছে। কিন্তু সামনে কিছু লোকজন ও পুলিশ কেন?
এগিয়ে একজন কুলিকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে দাদা? ওখান ভিড় কেন? আবার পুলিশও দেখতে পাচ্ছি।”
তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, “কে একজন লাইনে পড়ে মাথা ফেটে মারা গিয়েছে। তাই পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল।”
আমার ভেতরটাহঠাৎ ছ্যাৎ করে উঠল। একটু কাছে গিয়ে দেখি, আরে! এই রক্তমাখা দেহটা তো আমারই! এত রক্ত ভেসে আছে যে মুখটা ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে না। এমন সময় হঠাৎ ওপারে দূরে চোখ পড়তেই দেখি বন্ধু ও তার পরিবার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ওদের চেহারা কঙ্কালের নয় বা ওদের চোখ থেকে কোনো আগুনের গোলাও ঠিঁকরে বেরোচ্ছে না। ওরা যেন জ্যান্ত ছায়ামূর্তি। এই আমার মৃত্যু-কাহিনী। এবার আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি এখন আসি। আপনারা ভালো থাকবেন।
ইতি
তারাপদ চট্টোপাধ্যায়
আজ যখন করোনা নামক মহামারী পৃথিবী কাঁপাচ্ছে তখনই মনে পড়ে গেল সেই প্ল্যানচেটের ঘটনা যেখানে উল্লেখ রয়েছে ঠিক একশো বছর আগের প্লেগ মহামারীর কথা।
(কোথাও একটা দেখছিলাম যে, পৃথিবীতে ১৭২০, ১৮২০, ১৯২০ আর ২০২০ অর্থাৎ একশো বছর অন্তর অন্তর মহামারী দেখা দিয়েছে। ব্যাপারটা বড়োই আশ্চর্যের না! এই কঠিন সময় সবাই সাবধানে থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন ও ঘরে থাকুন। সমস্ত সকারি নির্দেশিকা মেনে চলুন।)