Site icon আলাপী মন

কবিতা- জননী জন্মভূমিশ্চ –

জননী জন্মভূমিশ্চ 
– ডঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 

 


৷ ৷ ১ । ।

মা আছেন অজ গাঁয়েতে, একটি ভাঙা ঘরে,
বর্ষাকালে ঘর ভেসে যায়
ফাটে চাঁদি ভাদ্দরে।
মায়ের বাছা পায়না সময়-
সময় কাটে পার্টিতে,
কুচকায় নাক “ভিলেজ” বলে,
বলে, “ওসব জায়গা আমার পছন্দ নয়”
ওসব ভীষন নাকি “ডার্টি” যে,!
চারিদিকে বন্ধু স্বজন, আলো ঝলমল –
ভাবে আত্মজ, মায়ের আঁচল,
এত ধরবার কি প্রয়োজন!
অনাদরে, অনাহারে মায়ের শরীর,
যায়, ক্ষয়ে যায়,
ছেলের পথের দিকে চেয়ে-
নিষ্পলকে মায়ের চোখ ;
অশ্রু ঝরে পড়ে,
দু গাল বেয়ে,চিবুক ছুঁয়ে।।

৷৷৷ ৷ ২ । ৷

দিনও রাত কাটলো কত-
মায়ের কান শুনলো অনেক, অনেক কথা –
মাকে না দেখবার শত বাহানা;
মা কি এসব শুনতে চায়,
মা যে প্রানভরে দেখতে চায়
একটিবার ছেলের মুখ,
একবারটি ইচ্ছে করে বলতে কথা-
দূরে থাকলেও,
কল্পলোকে ঘুমিয়ে আছে,
মা ও ছেলে একই সাথে।
মায়ের ভালবাসা, হয় না যে ক্ষয়-
ছেলের জন্য মায়ের বুকে স্নেহ ফল্গু-
তেমন করেই যায়, বয়ে যায়।।

৷ ৩ ।

অপেক্ষা আর অপেক্ষা –
ছেলের পথের দিকে চেয়ে, অপেক্ষা তো অনেক হোলো!
আসেনি ছেলে ; কাটছে সময় কড়িকাঠের দিকে চেয়ে;
মা শুনেছে, তাঁর বাছা অনেক বড় চাকরি করে-
গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, কলকেতায় বড় অফিস –
লোক লস্কর অনেক আছে,-!
ব্যস্ত ভীষন, অনেক কাজে,
তবু মায়ের জন্য, হয়না সময়
সময় বড় কম!
জননী আর জন্মভূমির আছে কি শুধুই,
দেওয়ার অধিকার!
চোখের জলে লেখা হলো অনেক কবিতা
মায়ের বুকের মাঝে ব্যাথার প্রদীপ
জ্বলছে অনিবার।।

৷৷ ৷৷ ৷ ৪ । ।

চেনা, অচেনা কতজনের কাছে,
মা শুধোলেন জনে জনে–
” তোমরা কেউ খবর দিতে পার, আমার ছেলেটাকে,
যদি একবার এসে চোখের দেখা , দেখে যায়
এই বুড়ি মা টাকে”– সবাই নিরুত্তর,
কারো দুচোখ ভেসে, যায় চোখের জলে;
কারো কথা বলতে গলা কাঁপে;
“আমার ছেলের জন্য ,
নারকেল নাড়ু,পুলি করে রেখেছি,
কোমরের ব্যাথা নিয়ে পাটিসাপটাও করেছি
সব রেখে দিয়েছি, কৌটোয়;
বড্ড ভালোবাসে খেতে”, মায়ের সবটুকু সোহাগ
ঝরে পড়ে; শিশিরবিন্দুর মতো যা, স্নিগ্ধ,পবিত্র –
তাঁর শুন্য দৃষ্টি, সামনের পথ ছাড়িয়ে আরও দূরে,
অস্তগামী সূর্যর রক্তিম আলোয় মাখামাখি হয়ে যায়।।

৷ ৷৷ ৷ ৫ । ৷ ৷

এলো ছেলে দুমাস পরে, সেদিন সাঁঝে,চুকিয়ে পার্টি,
আর সব কাজ; সাথে বান্ধব, অফিসের লোক-
বাড়ি ভরপুর, রাস্তায় নিওনের আলোয় স্তব্ধতা ,
কুড়েঘরের উঠোনে তখন শুধুই অন্ধকার-
আছে সবাই, আছে ঘর, আছে যা ছিল এই ছোট্ট ঘরে,
সবই আছে ঠিক তেমনই,
শুধু মানুষটা আজ নেই-
হাজার বাতির রোশনাইতেও,
এ ঘর আজ চির অন্ধকারের আবর্তে –
পৃথিবীতে আজ ছেলের কাছে সবই আছে,
শুধু নেই তাঁর মা!
পাটিসাপটা, নাড়ু, পুলি
ছোট্ট ঘরে, খোকার জন্য এককোনেতে ;
তেমন করেই রাখা।।

। ৷ ৬ ।।

দাউদাউ ওই চিতার আগুন-
জ্বলছে ঐ মায়ের চিতা,
চাইছে আগুন ছুঁতে, উদার আকাশটাকে,
বড় আপন করে-।
রইবেনা মা আর কখনও, দাঁড়িয়ে ওই জানলা ধরে,
ছেলের পথের দিকে চেয়ে-
বলবে না মা, আর কারোকে –
“সময় করে তোমরা কেউ খবর দিও আমার ছেলেটাকে,
একবারটি সময় করে আসতে বোলো তাকে”–
চিতার আগুন পুড়িয়ে দিল সকল স্বপ্ন, আশা,
শুধু মায়ের সাথেই রয়ে গেল মায়ের ভালোবাসা;
বলবেনা মা আর কখনও, “আয়না খোকা আমার কাছে,
থাকনা বাছা,কাছে আমার একটা, দুটো দিন-
যাসনে, ওরে যাসনে এখন, আমায় ছেড়ে;
এখনই তুই যাসনে কলকেতা “।।



Exit mobile version