গল্প- অস্তরাগ

অস্তরাগ
– সুনির্মল বসু

 

 

এখন বিকেল। আকাশে দিনান্তের শেষ লাল রোদ্দুর। সামনে নদী। পাড়ে নিম গাছ। নদীর ধারে নোঙর করা নৌকা। চারদিক শুনশান। দূরে দু-একটা ডিঙি নৌকো। দিন শেষ হয়ে আসছে। নদীর জলে রোদ্দুরের লাল আভা।
অবসর নেবার পর আজকাল প্রতিদিন অমলেশ এই সময়ে এখানে আসে। নদীর পাড়ে বসে। জলের ঢেউ গোনে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। পাখিরা ঘরে ফেরে। আকাশে চাঁদ ওঠে। দূরের গাঁয়ে শঙ্খ ধ্বনি বাজে। তারারা মিটিমিটি চায়। অমলেশ উঠে পড়ে। বাড়ির দিকে এগোয়।
পথে হাঁটতে হাঁটতে অতীতের দিনগুলি চোখের সামনে ছায়াছবির ফুটে ওঠে। মা বাবা, কাকা, ভাই বোন, পিসী, ঠাকুমা, সবাইকে নিয়ে ওদের যৌথ পরিবার। সে বড় অভাবের দিন। মাটির বাড়ি, টালির চাল। সবুজ পৃথিবীতে অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠা। অমলেশ আজও সেই দিনগুলোর মধ্যে বারে বারে ফিরে যেতে চায়। জ্যোৎস্না রাতে উঠোনে মাদুর পেতে বসে পড়া তৈরি করা, ঠাকুমার কাছে বক রাক্ষসের গল্প শোনা, তালপাতার পাখায় বাতাস খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়া, মায়ের জাগিয়ে তুলে খাওয়ানো, সকাল হলেই পড়া, স্কুল যাওয়া, বিশ্বনাথ কাকুর নির্দেশে প্যারেড করা, বন্ধুদের সঙ্গে মাটির মিষ্টির দোকান করা, সব মনে পড়ে।
ওর মা বলতেন, বাবু আমরা খুব গরীব, তুই বড়। তোকে বাবুর পাশে দাঁড়াতে হবে।
জীবনে দারিদ্র কাকে বলে, অমলেশ নিজের চোখে তা দেখেছে, তাই একদিন পড়াশুনা করে একটা স্কুলে বাংলা ভাষার শিক্ষক হল ও। বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দিতে চাইল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। অবস্থা ফিরে গেল ওদের। মা-বাবার পাশে সত্যি সত্যি একদিন দাঁড়ালো অমলেশ।
কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় ভালোবাসা এসেছিল ওর জীবনে। বাড়ির কথা ভেবে, সংসারের কথা ভেবে, অমলেশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মনে মনে বলেছে, এ মনিহার আমায় নাহি সাজে।
বাবা মা দাঁড়িয়ে থেকে একদিন ওর বিয়ে দিলেন শুভশ্রীর সঙ্গে। বাবা চাকরি থেকে অবসর নিলেন। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো অমলেশের উপর।
অমলেশ বরাবর মূল্যবোধ নিয়ে চলা মানুষ। সংসারের প্রতি বরাবর দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে এসেছে। প্রতিটি সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সংসারকে স্থিতি দিতে চেয়েছে। ও সারাদিন টাকার পিছনে ছুটেছে। বরাবর ওকে পূর্ণ সহযোগিতা করে গিয়েছে শুভশ্রী।
মা বলতেন, বাবু, তুমি সবার বড়। তোমাকে সবাইকে দেখতে হবে।
মা-বাবা একদিন মারা গেলেন। ভাই বোনের জন্য প্রতি পদক্ষেপে নিজের সর্বশেষ চেষ্টাটুকু করেছে অমলেশ। নিজের জন্য আলাদা করে কিছু করেনি কখনো।
একমাত্র মেয়ে ললিতার বিয়ে দিয়েছেন। জামাই ইঞ্জিনিয়ার। ছোট্ট একটি নাতনি। কথার সাগর। ও বাড়ি এলে, সময় সহজে পেরিয়ে যায়।

এই আদর্শহীনতার যুগে অমলেশ একজন বাতিল মানুষ।
বাড়ি ফিরতেই, শুভশ্রীর অনুযোগ, কোথায় ছিলে এতোক্ষণ, আমি চা করে নিয়ে বসে আছি।
অমলেশ ঘরে ঢুকে চায়ের কাপ নিয়ে বসলেন।
শুভশ্রী বললেন, কি ভাবছো,
যে কাজের জন্য আমার প্রশংসা পাবার কথা ছিল, সেই কাজের জন্য আজ আমি সংসারের সবার কাছে অবহেলার পাত্র।
– ভাগ্যিস তুমি অন্যের মত হওনি,
– তাহলে কি হতো?
– তোমার বাড়ি হতো, শ্বশুর বাড়ীর আদর হোত, সমাজে তালেবর একটা কেউ হতে,
কিছুই হতে পারিনি তো,
-কে বলেছে!
-:দেখতেই তো পেলে,
– যে বাবা-মাকে দেখেনি, ছেলেও তো তাকে সেই শিক্ষাই দিল,
– চারদিকে এখন ভাঙ্গনের সময়, নদীর পাড় ভাঙছে, সম্পর্কের পাড় ভাঙছে, জীবনের সম্পর্কগুলো প্রতিদিন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
– আসলে সুখ কোথায় মানুষ জানে না,
– স্বার্থপরতা যদি সুখ হয়, আমি কখনোই তার মধ্যে নেই,
– জানি তো,
– শুভশ্রী, আমরা বড় অল্পে খুশি ছিলাম,
সময় বদলেছে, ভাবনা বদলে যাচ্ছে,
এই সময়ের পক্ষে আমরা মানানসই নই,
জানো, আজ নদীতে সূর্যাস্ত দেখলাম। আমরা এখন অস্তাচলের পথে। কি পেলাম কি পেলাম না, তার হিসেব করতে চায় না মন।
– ভালোই তো আছি, কোথাও তো কোনো অসুবিধে নেই,
– মূল্যবোধ বিসর্জন দিলে, অনেক কিছু হয়তো পাওয়া যেত, কিছু বিবেকটা কেঁদে মরতো যে,
– ঠিক বলেছো, আমরা হারিনি, আমরা হারবো না,
– একদম ঠিক। এ কাজের বিচার হবে একদিন।
– না, কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই, আসলে, যে মূল্যবোধের শিক্ষা আমি বাবা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলাম, এত বছর শিক্ষা দিতে গিয়ে যা আমি ছেলেদের বারবার বলেছি, সেখান থেকে কখনো সরে যেতে পারি না,
– জানি তো,
– আমার সঙ্গে জীবনে চলতে গিয়ে অজস্র কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে তোমাকে,
– তার জন্য দুঃখ নেই, আসলে, এই দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবীতে আমরা একেবারে বাতিল মানুষ।
শুভশ্রী টিভিটা চালিয়ে দিলেন। সিরিয়াল চলছিলো,
অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বলছিলেন,
যখন পাপের স্রোতে মেতেছে কুরু পুত্রগণ,
তখন ধর্মের সঙ্গে সন্ধি করা মিছে,
পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।
-রাতে কি খাবে?
+ ক্ষিধে নেই,
ভালোবাসার ছড়াও, পৃথিবীটা মরুভূমি হয়ে যায়নি,
তুমি ঠিক বলেছো শুভশ্রী, স্বার্থপর মানুষেরা কখনো মানবিক পৃথিবীর উদাহরণ হতে পারে না,
আকাশে কত তারা আছে, সবাই ধ্রুবতারা হতে পারে না।
অমলেশের জানালায় তখন রাতের দুধেল জ্যোৎস্না এসে পড়েছে। সুপারি গাছের মাথা দুলছে। অমলেশের চোখে ঘুম এলো।
রান্নাঘরে শুভশ্রী তখন বাসন মাজছে। কখন যে ও পাশে এসে শুয়ে পড়েছে, অমলেশ টেরও পায় নি।

Loading

Leave A Comment