ভৌতিক গল্প

ভৌতিক গল্প- দুর্ভিক্ষের পরে

দুর্ভিক্ষের পরে

-ইন্দ্রনীল মজুমদার 

“আমার নাম নীলকমল রায়চৌধুরী। আমার বাড়ি কলকাতার গড়িয়াহাটে। নানা অজ গ্রামে ঘুরে বেরানো বলা যেতে পারে আমার এক অভ্যাস। আমাকে ‘ভবঘুরে অভিযাত্রী’ ভাবলে চলবে না কারণ আমি ভবঘুরে নই। বাড়ির লোকের মুখে শুনেছিলাম যে পূর্বে আমরা জমিদার ছিলাম। তাই, বাংলার জমিদারের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য সংকলন করা আমার এক নেশা। বলতে পারা যায়, এই বিষয়ে আমি একজন গবেষক। অন্তত দু’শোর মতো জমিদার বাড়ি দেখেছি দুই বাংলা জুড়ে। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে, অ্যাপের যুগে আমি যা তথ‍্য পেয়েছি এইসব যান্ত্রিক সহায়তায় তার থেকে বেশি পেয়েছি লাইব্রেরীতে পুরনো বই, কাগজপত্র, নথি ঘেঁটে। ভাবছি এরইমধ্যে ‘www.bengalizamindars.in’ নামে একটি ওয়েবসাইট বা জালাধান খুলব। পরে বছরের মধ্যে এই বিষয়ের উপর একটি বই প্রকাশ করব। প্রকাশকের সাথে কথা চলছে। বছর তিন-চারেক আগে শান্তিপুরের একটি জমিদার বাড়ির খবর পেয়েছিলাম বন্ধু স্বাগতর কাছে। গ্রামটি যে কোথায় তা ঠিক বোঝানো যাবে না। তবে কাঁথি থেকে অনেকটা গিয়ে তারপর এই গ্রাম পড়বে। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে রওনা হয়েছিলাম। তা পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা হয়ে গেল। দেরি হয়ে গিয়েছিল কারণ ট্রেন মাঝে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সিগন্যালের গন্ডগোলের জন্য। তা একদিকে ভালোই হলো কারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা রাতে ভালো অনুভব করা যায়। তা জমিদার বাড়িতে যে রহস্যময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটি এখন বলার অপেক্ষা। যাইহোক, প্লাটফর্মে নামলাম কোনোরকমে। কারণ ট্রেন থামতেই সমস্ত লোক হুড়মুড় করে নেমে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। দেখলাম একটি মহিলা দোকান বন্ধ করছে। তার কাছে গেলাম। তাকে ডাকলাম, “এই যে শুনছেন….”। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আজ্ঞে। বলুন আমি এই দোকানের চাওয়ালি।”

– বেশ। তা এখনই দোকান বন্ধ করছেন।
– হ‍্যাঁ। রাত হয়ে গেছে। রাত্রি আটটার পর এতল্লাটে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।

বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলাম, “তা এত তাড়াতাড়িতে?”

– আজ বাবু জ্যোৎস্নার রাত। তাই……। তা আপনি যাবেন কোথায়?

-যোগীন্দ্রনাথ জমিদারের বাড়ি। শুনেছি বাড়িতে আজও আছে তাই সেটি দেখার বড়োই ইচ্ছে।

মহিলাটি হঠাৎ আচমকাই চমকে উঠে বললে, “রাম রাম। আর কোথাও যাবার জায়গা পেলেন না। শেষে কিনা…..” কথাটি শেষও করলো না তাড়াতাড়ি পালালো।

ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক মনে হলো। একটা পুরনো জমিদার বাড়ির নাম শুনে ওই মহিলার এরকম হলো কেনো? কে জানে? এরপর দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একটি আলো প্ল‍্যাটফর্মের ওদিকে দেখা যায়। আমি সেই আলোর দিকে এগোই এবং দেখি একটি ভ্যানরিকশা। আমি থামাবার ইঙ্গিত করি। সেটি থামে। দেখি অল্পবয়স্ক এক রিকশা চালক। সে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাবেন বাবু?”

– আমি কলকাতার লোক। শুনেছি এখানকার এককালের ডাকসাইটে জমিদার শ্রীযোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর বাড়িটি আজও নাকি আছে।

চালকটি হঠাৎ ভয় ভয় ভাব নিয়ে বলে ওঠে, “তা তো আছেই। আপনাকে গাঁয়ে আগে কখনো দেখিনি। কিন্তু খামোকা সেখানে যাবেন কেন?”

– এমনি দেখার জন্য এসেছি। তোমার নাম কি?

-যে আজ্ঞে অম্লান। অম্লান বারুই।

-তা বেশ। রাত্রি আটটার পর এখানে সব ফাঁকা হয়ে যায়। ব্যাপার কি? আর তোমার মুখ জমিদার বাড়ির নাম শুনে শুকিয়ে গেল যে!

অম্লান এবার হেসে বলল, “আজ পূর্ণিমার রাত কি না। আমিও ন’টার পর আর চালাব না।”

আমি হেসে বলি, “পূর্ণিমার রাত তো কি হয়েছে?”

-বুঝবেন বাবু, বুঝবেন। সময় হলে সব বুঝবেন। আমি মুখ‍্যু মানুষ। আমি আপনাকে আর কি বুঝাব? বরং এখানকার আর্য তরফদার বলতে পারবে।

-কে তিনি?

-গ্রামের বয়স্ক মানুষ। পণ্ডিত লোক। নিজের স্কুল আছে। নামী স্কুল। উনি অনেক পুরনো কথা জানেন।

রিকশা চলতে থাকে ক্ষেতের মাঝপথ দিয়ে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোই যা ভরসা। জব্বর সুন্দর দৃশ্য তৈরি করেছে এই জোৎস্না। এই ‘Romantic moments’-কে কিনা এরা দোষ দেয়। গাঁয়ের লোক হয়তো কুসংস্কারী। একটু পরে রিকশা থামে।

অম্লান বলে উঠলো, “বাবু, এইটে জমিদার বাড়ি। ত্রিশ টাকা দেন।”

আমি ভাড়া মেটাই।

অম্লান জিজ্ঞেস করে, “বাবু, এখানে থাকবেন কোথায়? এখানে তো কেউ থাকে না। এই রাত্তিরে টর্চ, দেশলাই, খাবার সব আছে তো?”

আমি হেসে জানাই যে-“সব আছে আর সঙ্গে কার্বলিক অ্যাসিড-ও আছে। এর ফলে সাপের কোনো ভয় থাকবে না।”

বাড়িটাকে দেখলাম এতক্ষণে। সর্বাঙ্গ ভেঙে পড়েছে এমনকি গেটটাও। বাড়িটা বড়োই রহস্যময় ও বিচিত্রময় বলে মনে হল কেন জানি না।

অম্লান বলে উঠলো, “এখানে রাত্রে দোকান পাবেন না তাই আমার বাড়িতে খাবেন না হয়।”

-আচ্ছা। আমার সার্ভে করতে ঘন্টাখানেক লাগবে। তারপর না হয় এসো।

-আচ্ছা বাবু। তবে যাই। সাবধানে থাকবেন। হরি হরি….

বুঝতে পারলাম না কেন অম্লান সাবধানে থাকতে বলল। হয়তো রাত বলেই। তা যাক গে। আমার কাজ শুরু করা যাক। বাড়িটাকে দেখলাম বেশ পুরনো বাড়ি। তাছাড়া কতকাল যে কারুর চরণের ধুলো পড়েনি তা কেবল ভগবানই জানেন। ক্যামেরা ছিল তা দিয়ে একখানা ছবি তুললাম বাড়িটার। এরপর গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। গেটে মরচে পড়ে গেছে। সামনের সিংহ মূর্তিগুলোও ভাঙ্গা। ভেতরে ঢুকলাম। এমনিতে অন্ধকার হলেও জ্যোৎস্নার আলোয় বাড়িটাকে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে। পেটের খিদের জ্বালাটা বেশ বেড়ে গিয়েছিল, তাই বাড়ির থেকে আনা টিফিন খেয়ে নিলাম। খেয়েও মনে হল খিদেটা এখনো মেটেনি। যাক অম্লানের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সারা যাবে খন। তারপর সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর দরজায় অল্প ঠেলা দিতেই আচমকা একটা ‘খ‍্যাঁচ’ করা আওয়াজে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে আমি অবাক। দেখলাম মোমবাতি রাখা আছে। মেঝেতে খান কয়েক বস্তা। আশ্চর্য ব্যাপার!

বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। এমন সময় হঠাৎ বাইরে কুকুরের তারস্বরে চিৎকার উঠলো। কি ব্যাপার? এমন সময় মনে হলো যে দমকা হাওয়া বাইরে থেকে এসে পেছনে লাগল। ঠিক তখনই রোম-খাঁড়া হয়ে যাওয়া এক ঘড়ঘড়ে গলায় অচেনা ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

– মহাশয়ের বুঝি কলকাতা থেকে আসা হয়?

আমি শিহরিত হয় চমকে পিছনে ফিরে বলি- “হ্যাঁ।”

দেখলাম অচেনা ব্যক্তিটি পৌঢ়। বয়স আনুমানিক ষাট। পরণে ধুতি-পাঞ্জাবী। পায়ে নাগরাই চটি। বেশভূষা তো জমিদারের মতোন। তবে কণ্ঠস্বর ভারী রহস্যময় এবং চোখ দুটো বড়ো বড়ো এবং রহস্যময় ও ভূতুড়ে ভাব স্পষ্ট।

আমি ভয় ভয় জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কে?”

-আমি এখানেই থাকি। আজ রাত্রে এলাম। আসলে পূর্ণিমা রাতে আমি আসি। আজ নয় বহুদিন…….

আমি কথা থামিয়ে ভয় ভয় জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু লোকে যে বলে এই বাড়িতে কেউ থাকে না। অনেকদিন আগে জমিদার যোগীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। তাঁর পরিবারও কেউ নেই। আর থাকলেও আপনি কেবল পূর্ণিমার রাতে আসেন কেন?

-মায়ায়। হ‍্যাঁ, বড়ো মায়া। এই বাড়িতে লোক আছে। গাঁয়ের লোক সব বাজে কথা বলে। বিশ্বাস যদি না হয় তবে আসুন আমার সাথে। সব দেখলেই বুঝতে পারবেন।

লোকটির কথা বড়োই অদ্ভুত। আমি ওঁর সাথে বাইরে গেলাম। আর গিয়েই চমকে উঠলাম। একি! এ যে নতুন ঝকঝকে তকতকে বাড়ি। সিংহমূর্তি দুটোও অক্ষত। বাইরে এক পুরোনো মডেলের গাড়ি। কোথায় সেই ভাঙা বাড়ি? কোথায় মরচে ধরা গেট? এই ভদ্রলোক কি জাদুকর? না আমারই মনের ভুল? না দিবাস্বপ্ন? দিবাস্বপ্ন যে আমি দেখছি না তা হলফ করে বলতে পারি।

-বুঝতে পারবেন না মশাই। যা দেখেছেন সবই সত্যি।

-বটে। (আশ্চর্য হলাম উনি আমার মনের কথা ধরতে পেরেছেন দেখে)

অচেনা ব্যক্তি এবার দুঃখের স্বরে বললেন, “কি জানেন আমার ছেলেটা আমারই সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। আমার গুদামের সমস্ত চাল, ডাল বিলিয়ে দেয় কাঙাল বা না খেতে পারা লোকেদের।”

-কবে?

-কেন দুর্ভিক্ষের সময়, মন্বন্তরের দিনগুলিতে…..

আমি চমকে ঢোক গিলে বললাম, “মানে, ১৩৫০ বঙ্গাব্দে বা ১৯৪৩ সালে?আপনি এতোকাল আগে……

– ভাবছেন মশকরা করছি। সাহেবদের সাথে আমার ভালোই ওঠাবাসা ছিল। ওই বস্তাগুলিতে (বস্তার দিকে আঙুল করে) চাল ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্যে। আমার ছেলেটি করেছিল কি ওগুলো এই গরীব কাঙালদের বিলিয়ে দিয়েছিল। আমার মান আর রাখলো কোথায়?

-ভালোই তো করেছিল। যারা খেতে পারছিল না তাদেরকে খেতে দিয়েছিল। এতে ক্ষতি কোথায়?

-সব শেষ হয়ে গেল। (কিছুক্ষণ অন‍্যমনস্ক হয়ে বললেন) চলুন। একটু বাড়ির আশপাশটায় ঘুরে আসা যাক। একটু ওপরে চলি।

অতএব, চললাম দুজনে। এঘর-ওঘর দেখতে দেখতে ওপরে চলে এলাম। আসার সময় নানা ঘরে ভদ্রলোক দেখালেন এটা হুঁকো, এটা জমিদারের পাইপ, নানা অসাধারণ পেন্টিং, মূর্তি ও বিভিন্ন বিষয়ের দুষ্প্রাপ্য বই এবং শিকার করা বাঘ, হরিণের চামড়া ইত্যাদি। তারপর ওপরের কোণের একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন, “এবার যা দেখবেন তা দেখে কোনোদিন আর এখানে আসার বাসনা থাকবে না আশা করা যায়।”

তাঁর কথাগুলো বেশ রহস্যময় শোনাল। আরও অবাক করার ব্যাপার হল এই যে দরজাটা যেন আপনি আপনি খুলে গেল। আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। সামনের খাটের দিকে তাকালাম। ওপরের ঝাড়লন্ঠনের আলোয় বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে যা, তা দেখে আমার পিঠের ওপর দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। রক্ত যেন জল হয়ে এলো। একি! যে ভদ্রলোক এতক্ষণ কথা বলছিলেন তাঁরই মৃতদেহ খাটে পড়ে আছে। চোখ বড়ো বড়ো করে, হাতে বিষের বোতল, মুখ দিয়ে ফ‍্যানা বেরিয়ে আছে। এইরকম মর্মান্তিক দৃশ্য কি দেখা যায়? আর ঠিক তখনি সারা বাড়িময় জুড়ে “হা হা হা হা…….হা” করে বাঁজখাই হাসি যা কোনোদিনও ভোলার নয়।

কোথায় সেই ভদ্রলোক? পাশে তো কেউ নেই! এমন সময় দৌড়ে নীচে এসে দেখলাম যে ঘরটায় বস্তাগুলো রাখা ছিল, সেই ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে এক সু-পুরুষ চেহারার যুবক। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোগা-হাড় বেরানো, প্রায় বস্ত্রহীন কয়েকজন ‘না-মানুষ’ চেহারার মানুষ। একটি মহিলার কাঁধে একটি শিশু কাঁদছে আর বলছে- “মা খেতে দাও, খেতে দাও না।” তার মা তার পিঠ চাপড়ে বলছে- “এই তো বাবা, এইবারই খাওয়া হবে, আর কাঁদিসনি।” শিশুটি না খেয়ে প্রায় কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে।

সকলে কাঁদো কাঁদো ভাবে বলছে, “শহরে গিয়ে কিছু পেলাম না বাবু। সব নিষ্ঠুর। না খেতে পেয়ে মরব। শহুরে বাবুরা ভাত তো নয়ই এমনকি ফ‍্যানও দিলে না। শরীর বড়োই অবসন্ন তাই লাইনে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই আর। তাছাড়া সেখানকার চাল,ডালও অতি অল্প, ভালো নয়। ভাত না দাও বাবা, অন্তত ফ‍্যান দাও।”

যুবক ওই অসহায় মানুষদের আশ্বস্ত করে বললেন, “গুদাম ঘর তো খোলা হয়েছে  তোমাদেরই জন্যে। এখানে চাল,ডাল ভালোই পরিমাণে আছে তাই বেশি করে দিচ্ছি, পরিবারের সবার পেট পুরে খাওয়া হয়ে যাবে।”

এমন সময় ওপর থেকে ভেসে এলো সেই অচেনা ভদ্রলোকের তারস্বরে চিৎকার, “নাআআআআ…..”

আমি তখনই বাড়ি থেকে দৌড়াই। তখন আমার দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই। ছুটতে ছুটতে রাস্তায় আসি। একটি ভ‍্যান-রিকশার সাথে ধাক্কা খাই। দেখি সেটার চালক অম্লান।

আমি হাঁফাতে হাঁফাতে বলি,”চলো, চলো, নিয়ে চলো, শিগগির এখান থেকে।”

অম্লান বলল, ” তাড়াতাড়ি উঠে বসেন। ওই বাড়িতে আপনি কেন গেলেন বাবুমশাই? ওখানে কেউ যায় না। ওটা একেবারে অভিশপ্ত বাড়ি বুঝলেন কিনা।”

আমি আধো-আধো ভাবে ঘটনাটা বলার চেষ্টা করলাম।অম্লান চমকে উঠে বলে, “সর্বনাশ। আমার বাড়ি চলুন।”

রিকশায় উঠে দেখি কঙ্কাল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে আর বলছে, “ভাত না দাও, ফ্যান দাও। ভাত না দাও ফ‍্যান অন্তত দাও।” আমি ভয়ে আত্মহারা হয়ে যাই।

অম্লান বলে ওঠে, “ওদিকে তাকাবেন না বাবু। আপনি আমার দিকে মুখ করুন।” এই বলে সে দ্রুত রিকশা চালায়।

অবশেষে অম্লানের বাড়িতে পৌঁছলাম।অম্লানের ছেলে আমাকে দেখে বলে উঠলো, “মা, বাবা একজন কাকুকে নিয়ে এসেছে।”

অম্লান তার স্ত্রীকে সবকিছু বলল। বাড়িতে ছিলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তিনি আমাকে নমস্কার জানালেন। আমিও প্রতি নমস্কার জানালাম।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, “আমি আর্যবাবু- আর্য তরফদার। হরণাথ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলটা আমারই। অম্লানের মুখে আপনি ওই অভিশপ্ত বাড়িতে গেছেন শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। অম্লানকে ধমক দিয়ে আপনাকে তক্ষুনি নিতে পাঠাই। ওকে বলি, “আর পরে যেতে হবে না তুই এখনই যা, দেখ এরমধ্যে কোনো অঘটন না ঘটে যায়।” আর আমিও এখানে চলে আসি।”

আমি দু-গ্লাস জল খেয়ে একটু ধাতস্থ বোধ করি। কিছুক্ষণ পরে আমরা খেতে বসি। অম্লানের বউয়ের হাতের রান্না ভারি চমৎকার। তা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাড়ির উঠোনে বসে গল্প আরম্ভ করি।

অম্লানের স্ত্রী হেসে বলল,”ঠাকুরের কৃপায় বড়োজোর প্রাণ নিয়ে বেঁচে গেছেন।”

আমি হেসে জানাই, “সেই। ভাগ্যিস অম্লান তখন এসেছিল। অসংখ্য ধন্যবাদ অম্লানকে, আর্যবাবু সহ আপনাদের সবাইকে।”

আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া ওই ভৌতিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে আর্যবাবুকে জিজ্ঞেস করি, ” আর্যবাবু, আপনি প্রবীণ ও জ্ঞানী ব্যক্তি। তা ঘটনার মূল কাহিনীটা কি? একটু যদি বলেন।”

আর্যবাবু গল্প আরম্ভ করলেন, “আমার আশীতিপর বয়স। আমি একজন ইতিহাসবিদ। গ্রামের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করি। ১৯৪৩ সালে এক ভয়াবহ ও প্রবল দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে গোটা বাংলা। জানেন তো তাতে ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এই দুর্ভিক্ষ আসলে এক কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। চাল,ডাল ভালো পরিমাণেই পাওয়া যেত অন্তত ১৯৪১, ১৯৪২-এর থেকেও। ব্রিটিশ সরকার ‘৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ সহ্য করতে না পেরে এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। তার সাথে যোগ দেয় এই যোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মতো আড়তদার ও কালোবাজারিরা। সেই সময় বাংলার সব গ্রামের মতো এই গ্রামও জনশূন্য হয়ে যায়। বটতলায় সন্ধ্যেবেলায় আর আড্ডা বসে না, বাড়ির তুলসী-তলায় জল পড়ে না, চণ্ডীমণ্ডপ ফাঁকা, মন্দিরে পুজো বন্ধ এমনকি প্রদীপ জ্বালাবারও কেউ নেই। খেতে না পেয়ে রোগাটি হয়ে যায় সবাই। শহরে যায় কিন্তু সেখানে সামান্য ফ‍্যানটুকুও না পেয়ে গ্রামে ফিরে আসে। জমিদার যোগী বা যোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর বাড়িতে চাল, ডাল সবই ছিল তবে তা নিজেদের জন্যে বা সরকারি লোকেদের জন্যে। তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর, স্বার্থপর। তাঁর ছেলে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী বিদেশ থেকে শিক্ষালাভ করে দেশে এসে যখন দেখেন এই শোচনীয় অবস্থা অথচ বিদেশি সরকারের কোনো হেলদোল নেই। তারা যেন বিপ্লবীদের অন‍্যতম উৎপাদন ক্ষেত্র বাংলাকে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর তখন তিনি কৌশলে গুদামের সমস্ত চাল,ডাল ওইসব মানুষের জাত-ভাইদের বিলিয়ে দেন। উপেন ছিলেন নিঃস্বার্থপর, সরল, উদার, সাহসী ও বুদ্ধিমান এক যুবক। কিন্তু ছেলের এরূপ আচরণ মেনে নিতে পারেননি পিতা যোগীন্দ্রনাথ। পরে সরকারের কাছে হেনস্থা হবার ভয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আর ছেলে উপেন্দ্রনাথ?”

-তিনি পরে ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারান কিছু উগ্র অ-মানুষের হাতে। তবে বলা হয় তাঁকে চক্রান্ত করেই সরকার মেরেছিল কারণ তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বিপ্লবী।

-যাক, অশেষ ধন্যবাদ। আপনাদের কাছে আমি অনেক ঋণী। আপনাদের জন‍্যই আমি আজ রক্ষা পেলাম,সুস্বাদু খাবার পেট পুরে খেতেও পেলাম। কাল সকালেই আমি রওনা দেব। সত্যিই বলতে কি, এ এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হল যা কোনোদিনও ভোলা যাবে না। কথা দিচ্ছি, এখানে পরে আবার আসব তবে ওই বাড়িটার ত্রিসীমানা মারাবো না। আজ যদি অম্লান না আসত, তবে হয়তো……

আর্যবাবু হেসে বললেন, “তা তো নিশ্চয়ই। অম্লানই আপনাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো। আপনি আমাদের অতিথি আর ‘অতিথি দেব ভব’। আর তাই বিপদগ্রস্ত অতিথির পাশে দাঁড়ানোই তো আমাদের প্রধান কর্তব্য। যাক,আপনি আবার আসলে ভালোই লাগবে।”

অম্লান বলল,” কাল বাবু, সূর্য উঠার পরই বেরিয়ে যাব।”

পরদিন সকালে অম্লানের স্ত্রী, ছেলে সবাই হাসিমুখে বিদায় জানাল। বারবার অনুরোধ করতে লাগলো তাদের বাড়ি আবার আসার জন্যে। আমিও অম্লানের পরিবারকে আমার কলকাতার বাড়িতে আহ্বান করি, সাথে আর্যবাবুকেও নিয়ে আসতে অনুরোধ করি। অম্লানে রিকশা করে এগোতে লাগলাম স্টেশনের দিকে। মাঝপথে সেই ভূতুড়ে জমিদার বাড়িটা দেখলাম। সেই জমিদার বাড়ি……

যাক, মনে মনে ভাবলাম, ‘ইতিহাস মানে তো অতীত। আর অতীত মানে তো ভূত। আজও কিছু মানুষ স্বার্থপর ও লোভী। তাদের বিপুল ধনসম্পত্তি থাকা সত্বেও তারা সমাজকে কিছু দেয় না, মানুষের কোনো উপকার করে না। অন্যের ক্ষতি দেখলেই তাদের যেন আনন্দ। অন্যকে খেতে না দিয়ে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়াই যেন আজকের এইসব বর্বর লোকেদের কাজ। আর যেদিন এই শোষক শ্রেণী আরও চাইবে সমস্ত রক্ত চুষতে সেদিন সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে, তার জন্য কোন অ্যাটম বোমা লাগবে না।

রেল-স্টেশনে পৌঁছালাম। অম্লান ভাড়া নিয়ে বিদায় নিলো।

-ধন্যবাদ বাবু,আবার আসবেন।

আমি সেই চায়ের দোকানের কাছে গেলাম। চায়ের দোকানটা সবই খোলা হয়েছে। অম্লানের বাড়িতে চা খেয়েছি। তাই, আর চা পান করবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই চায়ের দোকানের মহিলাটি আমায় দেখে এক্কেবারে ‘থ’। হয়ত জীবিত যে দেখবে ভাবতে পারেনি।

সে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো একাধিক প্রশ্ন- “ভাল আছেন বাবু? কোনো অসুবিধা হয়নি তো? বেঁচে গেছেন তাহলে? যাক ভালোই হলো। ঠাকুর কৃপা করেছেন।” এইসব বলে সে দু-হাত উঠিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম ঠুকল।

আমি হেসে বললাম, “দিব্যি আছি। বলতে পারো নতুন এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হলো…..”

এমন সময় ট্রেনের আওয়াজ হলো। আমি চায়ের দোকান থেকে বিদায়  নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। আসার সময় ভাবতে লাগলাম যে বাড়িতে গিয়ে লিখে ফেলতে হবে জমিদার বাড়ির ভূতুড়ে অভিজ্ঞতাটি। ওয়েবসাইটে দেবো- ‘A Haunted Zamindar House’ অর্থাৎ ‘এক ভূতুড়ে জমিদার বাড়ি’। ফেসবুকেও এর সম্বন্ধে লিখবো। সাথে ছবিটাও দেব। দেখি কটা ‘Like’, ‘Share’ ও ‘Comments’ পাওয়া যায়।

Loading

4 Comments

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

You cannot copy content of this page