গল্প

গল্প- পুরুত বিভ্রাট

পুরুত বিভ্রাট
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

গল্পটা আজ থেকে ষাট বছর আগের। অবশ্য এটাকে গল্প বললে ভুল হবে, ঘটনাটা ষোলো আনা সত্যি। তোমরা হয়তো জানো না তখন আমাদের গ্রামের দিকে ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। গ্রামের রাস্তা ছিল কাঁচা। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা হতো। অবশ্য গ্রামের বাইরে দিয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের বাঁধানো রাস্তা এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে চলে যেত। আবার সেই রাস্তা ধরেই শহরে যাওয়া যেত। যানবাহন বলতে গরুর গাড়ি। এমনকি বিয়ে বাড়ীতে বরযাত্রী কনেযাত্রীরাও ওই গরুর গাড়িতেই নেমন্তন্ন খেতে যেত। তখন অবশ্য গরুর গাড়ির উপর ছৈ চাপিয়ে দেওয়া হতো। ছৈ জানো না বুঝি? ছৈ হচ্ছে বেত বা বাঁশের ছিলা দিয়ে তৈরি ওল্টানো নৌকার মতো এক ঢাকনা। কোথাও যাওয়ার সময় সেটা গরুর গাড়ির উপর চাপিয়ে দেওয়া হতো আর তার ভিতরে বসে যাত্রীরা রোদ জল থেকে রক্ষা পেত। আর কখনো সখনো দূরে বিয়ে হলে শহর থেকে ছোট বাস ভাড়া করে আনা হতো। তো সেই রকম এক সময়ে আমাদের গ্রামের কুমোর পাড়ায় কুমোর বাড়ির দুই ছেলে সাধুচরণ আর মধুচরণের বিয়ে লাগলো একই দিনে, তখন তাদের বয়স কুড়ি বছর। সম্পর্কে তারা জাঠতুতো খুড়তুতো ভাই। অবাক হলে না? হ্যাঁ তখন ওইরকমই হতো। গ্রামের ছেলে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যেতো। যাই হোক, বিয়ে তো লেগে গেল। দুই ভাই বন্ধু বান্ধবদের নেমন্তন্ন শুরু করে দিল। আমাদের গ্রামে চিরকালই বামুন, কায়েত, ছূতোর, নাপিত, কুমোর, কামার সব সম্প্রদায়ের মানুষেরই বাস। তাই ছেলেপিলেদের মেলামেশায় জাতপাতের কোন বিধিনিষেধ ছিল না। আমাদের বামুন পাড়ার অমিত আর গোপাল ছিল সাধু আর মধুর বন্ধু। অমিত বয়সে একটু বড় ছিল আর গোপাল ছিল তার আত্মীয় আবার পাড়াতো ভাই। সাধু মধুর আর দশজন বন্ধুর মতো অমিত আর গোপালেরও নেমন্তন্ন এসে গেল দুই ভাইয়ের তরফ থেকেই। সঙ্গে আবার বরযাত্রী। দুই ভাইয়ের একই দিনে বিয়ে তাই বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলো তারা ভাগাভাগি করে দুই ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী যাবে। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে গেল। দুই ভাইয়েরই বিয়ে হচ্ছে অনেক দূরে। তাই শহর থেকে দুটো বাস ভাড়া করে আনা হয়েছে বর, বরযাত্রীদের যাওয়ার জন্য। এলাহি ব্যাপার। অমিতের সঙ্গে মধুচরণের ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি থাকায় সে মধূচরণের সঙ্গেই চললো, আর সে যেখানে গোপাল ও সেখানে। সময় মতো উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনির মধ্যে দুটো বাস ছেড়ে চললো দুদিকে। অমিতদের বাস, মানে মধুর বরযাত্রী চলেছে পশ্চিমে, আর সাধুর বরযাত্রী পূবে। বাস ছুটছে, ছেলে ছোকরারা হৈ হৈ করছে, বয়ষ্করা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, মহিলারা এককোনে জড়ো হয়ে মৃদু স্বরে খুকখুকে হাসির ফোয়ারা তুলছে। কেবলমাত্র বরকর্তা মানে মধুর বাবা বাসের একটি সিটে গুম হয়ে বসে আছেন। না দুঃশ্চিন্তায় নয়, আসলে তিনি একটু নেশাড়ু মানুষ। ছেলের বিয়ের আনন্দে সেদিন দুপুর থেকেই গলায় ঢালতে আরম্ভ করেছেন। না বিলিতি নয় দেশী। তখনকার দিনে গাঁ গঞ্জে বিলিতির বালাই ছিল না। রসমোদীরা দেশীতেই আত্মাতুষ্টি করতেন। অমিত বাবার একটা বেনিয়ান আর ধুতি পড়েছে। ও দুটোই অমিতের বাবাকে জামাই ষষ্ঠীতে অমিতের মামার বাড়ি থেকে দিয়েছে। বেনিয়ানটার দাম নাকি একশো টাকা, ভীষণ দামী। অমিতের বাবা ডাক্তার মানুষ। একবার বলেছিলেন, অতো দামী পোশাক পড়ে ওই অজ পাড়াগাঁয়ে যাওয়ার কি দরকার? জলে কাদায় নষ্ট হবে। অমিত মাকে বলে ম্যানেজ করেছে। হাজার হোক প্রথম বন্ধুর বিয়ে বলে কথা। বাসে যেতে লাগবে চার ঘন্টা। দু ঘন্টা পার হতেই বোঝা গেল বয়ষ্করা সকলেই মধুর বাবার রাস্তা নিয়েছে, কেননা তাঁরাও একই পথের পথিক। বয়ষ্ক মহিলারা ঘোমটার ফাঁক থেকে চোখ মটকে বললেন ‘মরণ’।
অবশেষে বাস গিয়ে থামলো এক রাস্তার মোড়ে। মেয়ের বাড়ির গ্রাম নাকি এসে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার, হ্যাজাক হাতে কয়েক জন লোক অপেক্ষা করছে। ওখান থেকে হাফ মাইল পথ হাঁটতে হবে আলের রাস্তায়, বাস আর যাবে না। বরযাত্রীর দল হ্যাজাকের আলোয়, আলের রাস্তায় টলতে টলতে গিয়ে পৌঁছলো বিয়ে বাড়ীতে। সেখানে আর এক প্রস্থ শঙ্খধ্বনি উলুধ্বনিতে বরযাত্রীদের আপ্যায়ন করে বরকে নিয়ে গিয়ে বসানো হলো টালির চালা মাটির ঘরের বরাসনে। অমিত গোপালকে বললো ‘চল বিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখে আসি’, আর বিয়ে বাড়ীতে ঘুরতে ঘুরতে অমিত আবিষ্কার করলো যে তারা একেবারে মদের ভাটিতে এসে পড়েছে। অতিথি অভ্যাগত থেকে মেয়ের বাড়ির লোকজন, মায় পুরুত পর্যন্ত সকলেই উনিশ বিশ মাতাল। যে দু-এক জন একটু সুস্থ আছে তারাই বিয়ে বাড়ির কাজকর্ম দেখাশোনা করছে। ঠিক তখনই অমিতের কানে এলো একটা হৈচৈ এর আওয়াজ। তার মনে হলো আওয়াজটা আসছে, যে ঘরে বরাসন হয়েছে সেই ঘর থেকে। অমিত গোপালকে নিয়ে ছুটলো সেই ঘরের দিকে। গিয়ে জানতে পারলো, বরের বাড়ির পুরুতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই সবাইকে জিজ্ঞাসা করছে পুরুতকে কেউ দেখেছে কিনা, কিন্তু সবাইকার একটাই উত্তর ‘না দেখিনি’। অবশেষে একজন ছুটলো মধুর বাবার কাছে জানতে কোন পুরুতের আসার কথা। তিনি আধখোলা চোখে উত্তর দিলেন দীনু ঠাকুর, আর ঠিক তখনই বোমাটা ফাটালো কামার বাড়ির ছেলে রামু। সে বললো, যে সে দীনু ঠাকুরকে দেখেছে সাধুচরণের বাসে উঠতে। তার মানে দুজন পুরুতই চলে গেছে ওই বাসে এখানে কেউ আসেনি। আবার হৈচৈ, কেউ ছুটলো কনের বাড়ির পুরুতের কাছে, যে ‘আপনি দুটো পুরুতের কাজই করে দিন, আবার কেউ এসে ধরলো গোপালকে, কেননা, সে একটু আধটু পুজোটুজো করে। একজন মাতাল আর একজন গোঁয়ার। মাতাল পুরুত বললো, সে কারো বাপের চাকর নয় যে সব কাজ তাকেই করতে হবে। এদিকে গোপাল ছিল রাম গোঁয়ার। একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে সে এক পাউন্ড পাঁউরুটি কেরোসিনে ডুবিয়ে খেয়ে নিয়েছিল, আর একবার বইয়ের ব্যবসা করবে বলে কোলকাতা থেকে বই কিনে ফেরার সময় ভুল করে ননস্টপ ট্রেনে উঠে পরেছিল, আর সেই ট্রেন যখন তার স্টেশন পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল, সে বইয়ের বান্ডিল বুকে করে ‘জয় মা তারা’ বলে প্লাটফর্মে লাফ মেরেছিল। তারপর ক্ষতবিক্ষত শরীর কোন রকমে টানতে টানতে মাঝরাতে গিয়ে অমিতের বাবার কাছে চিকিৎসা করিয়েছিল। এ দুটো ছাড়াও এরকম আরও অনেক ঘটনাই গোপালের ছিল। তো সেই গোঁয়ার গোপাল নিদান দিলো যে, সে বিয়ে বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেতে এসেছে পুরুতের কাজ করতে নয়। সে পারবে না। অগত্যা সবাই গিয়ে ধরলো অমিতকে, কেননা বরযাত্রী দলে অমিত আর গোপাল ছাড়া আর কোন ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে আসেনি। অমিতদের বাড়িতে কষ্মিনকালেও কেউ পুরোহিতের কাজ করেনি। তাদের বাড়িতে সবাই উচ্চশিক্ষিত। বাড়িতে বারোজন সদস্যের মধ্যে ছজন ডাক্তার। যদিও অমিত একটু বাড়ি ছাড়া। সে নাটক যাত্রা করে, মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর সেই বিয়ে বাড়ীতেও অমিত এগিয়ে গেল বন্ধুকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে, অর্থাৎ সে রাজি হলো বরের বাড়ির পুরুতের কাজটা করে দিতে। কাজ অবশ্য বিশেষ কিছু নয়, বরের বাড়ির তরফে কনেকে আশির্বাদ করা। অমিত বীরদর্পে এগিয়ে গিয়ে বসলো পুরুতের আসনে। সামনে বন্ধুর ভাবী স্ত্রী, একপাশে কনের বাবা আর এক পাশে কনের বাড়ির পুরুত, দুজনেই গলা অবধি খেয়ে ফিট হয়ে আছে, আর তাদের ঘিরে রেখেছে আর একদল মাতাল। অমিতের একটু অস্বস্তি হতে লাগলো। আশীর্বাদ করাটা কোন ব্যাপার নয়, সে ব্রাহ্মণ সন্তান আশীর্বাদ করাটা তার রক্তে আছে, কিন্তু অতগুলো মাতালের মধ্যে নিজেকে একটু অসহায় মনে হলো তার। মাতাল পুরুতটা তার পোষাক দেখে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বলল, ‘একি বিলিতি পুরুত নাকি, তা কোন উড়োজাহাজে নামলে বাবা’? আশেপাশের মাতালগুলোও খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলো। আর ঠিক তখনই, একটা কথা মনে পড়ে অমিতের মাথায় বজ্রাঘাত হলো, কপালে ঘাম ফুটে উঠল। কাল পুকুরে চান করতে গিয়ে পৈতেটা গলা থেকে খুলে জলে পড়ে গিয়েছিল আর খুঁজে পায়নি। নতুন পৈতে এখনও তৈরী করা হয়নি। ইস্ একটু আগে মনে পরলে গোপালের পৈতেটা চেয়ে আনতো। অবশ্য ও আবার যা গোঁয়ার। এইসব আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় এক আজগুবি বুদ্ধি এলো। সে ঝট করে পাঞ্জাবির তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে নতুন আন্ডার প্যান্টের দড়িটা বুড়ো আঙ্গুলে জড়িয়ে নিয়ে, পেটের কাছে হাত রেখে মন্ত্র পড়ার ভঙ্গীতে মুখে বিড় বিড় করতে লাগলো। কিন্তু ওই মাতাল পুরুত কি চুপ থাকবে? নেশা তখন তার তুঙ্গে। আবার ঝটকা দিল ‘কি বাবা বাউনের ছেলে পৈতে বার করতে লজ্জা করছে নাকি? পরিস্থিতি কঠিন, কিন্তু অমিতও নাটক করা ছেলে। স্টেজ কি করে ম্যানেজ করতে হয় সে ভালোই জানে। অমিত হঠাৎ লাফ মেরে গিয়ে পড়ল মাতাল পুরুতের পায়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরুত মশাই চমকে উঠে বললেন ‘কি হলো বাবা, কি হলো?’ অমিত তার পায়ের ধুলো নিয়ে বলল ‘কি করি বলুন ঠাকুর মশাই, এখন কি কেউ আর পৈতের মর্যাদা দেয় যে পৈতে বার করবো? পুরুত মশাই একে মাতাল তার উপর আকষ্মিক প্রণাম পেয়ে উচ্ছ্বসিত। আবেগ গদগদ গলায় বলে উঠলেন ‘ঠিক বলেছ, এ সব শালারা শুয়োরের বাচ্চা, পৈতের মর্যাদা এরা কি বুঝবে? তুমি একদম পৈতে বার করবে না, ওইখান থেকেই আশীর্বাদ করো।’ এই বলে তিনি নিজেও অমিতের মতো পেটের কাছে হাত রেখে আশীর্বাদ করতে লাগলেন, সভার মাতালরা চুপ।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল অমিতের। ছেলের বাড়ির পুরুতের কাজটা যা হয় উতরে গেল এবার খাওয়াটা সেরে নিতে হবে। গোপালও তাড়া লাগাচ্ছে। তারা দুজনে চললো খাবার জায়গায় পরিস্থিতিটা আঁচ করে নিতে। তখনকার দিনে গাঁ গঞ্জে বিয়ে বাড়ির খাওয়ার জায়গায় চেয়ার টেবিলের বালাই ছিল না। তাল পাতার আসনে, মাটিতে বসে, কলা পাতায় খাওয়া। আর খাওয়া বলতে, হয় ডাল ভাত তরকারি, না হয় লুচি বেগুন ভাজা ছোলার ডাল। অবস্থাপন্ন ঘর হলে পাঁঠার মাংস না হলে পুকুরের মাছ। এখনকার মতো চিকেনের রেওয়াজ মোটেই ছিল না তখনকার দিনে। শেষ পাতে দই আর পানটা অবশ্য ছিল। যাই হোক অমিত আর গোপাল তো উঁকি দিচ্ছে খাবার জায়গায় হঠাৎ তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন মেয়ের বাবা মানে মধুর ভাবী শশুর মশাই। বিনয়ের সঙ্গে বললেন ‘বাবা তোমরা বামুন ঠাকুর না’? অমিত বললো, হ্যাঁ তারা ব্রাহ্মণ, আর সে বরের বাড়ির পুরোহিতের কাজটা করেছে। মেয়ের বাবা তো একেবারে রে রে করে উঠলো, ‘ছি ছি ছি তোমরা এখানে খাবে কি? তোমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, এসো আমার সঙ্গে’। এই বলে তাদের নিয়ে গিয়ে বসালেন একটা ঘরের দাওয়ায়। বললেন, ‘তোমরা এইখানে বসো আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি’। অমিত আর গোপাল বসে রইল। ঘরটা টালির চালা মাটির ঘর। বোঝা গেল ঘরটাকে এখন টেম্পরারি ক্রেস হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘরের মধ্যে একপাল বাচ্চা চ্যাঁ ভ্যাঁ করছে, আর ঘরের দরজায় বসে এক বয়ষ্ক মহিলা, ভাবলেশহীন মুখে হাত পাখায় হাওয়া খেয়ে চলেছেন। অমিত আর গোপাল বসে আছে খাবারের প্রতীক্ষায়। আধঘন্টা, চল্লিশ মিনিট, একঘন্টা, খাবার আর আসে না। হঠাৎ অমিত দেখে মেয়ের বাবা তাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। অমিত উঠে গিয়ে বললো, ‘মেশোমশাই আমাদের খাবারটা?’ তিনি শিবনেত্র হয়ে বললেন, ‘কেন খাবার জায়গায় বসে খাওনি?’ অমিত বললো, ‘না আপনি বললেন ব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, তাই’। মেয়ের বাবা চোখ মুখ কুঁচকে ধমকে উঠলেন, ‘কেন বামুন বলে কি পেড়োর পীর নাকি? খেতে হলে ওখানেই খাও’। (অনেকদিন আগে আমাদের এদিকে পেড়ো বলে একটা দরগা ছিল। সেই দরগার পীর সাহেব ছিলেন খুব গণ্যমান্য ব্যক্তি, সবাই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করতো। পরবর্তী কালে পেড়োর পীর কথাটা ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহার করা হতো।) এই বলে তিনি টলতে টলতে চলে গেলেন। অমিতদের কপাল ভালো মেয়ের বাড়ির একজন হাফ সুস্থ মানুষ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাদের জন্য লুচি, তরকারি, মাছ, দই এনে তাদের খাবার ব্যবস্থা করে দিল। অমিতরা খেতে বসে দেখলো যা খাবার দিয়ে গেছে তাতে একজনেরও পেট ভরবে না। অথচ খাবার দিয়ে লোকটা সেই যে হাওয়া হয়ে গেল আর তার টিকি নেই। অমিত একটা লুচির টুকরো ডাল মাখিয়ে সবে মুখে পুরেছে ঠিক তখনই ঘটলো কান্ডটা। ঘরের ভেতর থেকে একটা বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে বুড়ির পা টপকে বেড়িয়ে এসে ওই দাওয়ার উপরেই প্রাতকৃত্যের দু’ নম্বর কাজটি সেরে দিল। বয়ষ্ক মহিলা সেই দেখে হাঁ হাঁ করে উঠলো। কিন্তু কি আর করা? যা হবার তো হয়ে গেছে। অমিতের গা গুলিয়ে উঠলো। সে গোপালকে বলাতে গোপাল বললো, ‘আরে ও তো ও দিকে করেছে, ও দিকে তাকাচ্ছিস কেন? উল্টোদিকে মুখ করে খেয়ে নে’। অমিতের আর খাওয়া হলো না। অবশ্য তার লুচি গুলোও গোপালের পেটেই গেল।
এবার বাড়ি ফেরার পালা। আবার সেই আলের রাস্তায় টাল খেতে খেতে বড় রাস্তা অবধি আধ মাইল পথ। এবার অবশ্য আর হ্যাজাকের আলো নেই, কেননা হ্যাজাকের আলো দেখাবার মতো কোন ব্যক্তি আর মেয়ের বাড়িতে খাড়া নেই । দু’ একজন কার কাছে টর্চ ছিল তাই রক্ষে। সবাই চলেছে বিষন্ন মুখে। বোঝাই যাচ্ছে সবাই আধপেটা, সেই নিয়ে টুকটাক আলোচনাও চলছে। অমিত তখনও জানেনা যে শেষ ধাক্কাটা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সবাই হাঁটছে। সবার মন আলের রাস্তায়, বেসামাল হলেই গিয়ে পড়তে হবে পাশের চষা জমিতে। অমিতের কাঁধে হাত রেখে টলমল করে চলেছে অর্ধচেতন মধুর বাবা। হঠাৎ তাদের সামনে হাত দশেক দূরে কি একটা বিরাট কালো মতো জিনিস মাটি থেকে লাফিয়ে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ঘোরের মধ্যে মধুর বাবা সেটা দেখে ভূত বলে চেঁচিয়ে উঠে অমিতকে জড়িয়ে ধরলো, আর অমিত টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পরলো চষা জমির মধ্যে। ধুতি বেনিয়ান কাদায় মাখামাখি। তাড়াতাড়ি দু’;একজন টেনে তুললো অমিতকে। ততক্ষণে হৈচৈ পড়ে গেছে ওই ভূতুড়ে জিনিসটাকে নিয়ে। দুএকজন দূর থেকে হম্বিতম্বি করতে লাগলো, কিন্তু কাছে কেউ গেল না। অবশেষে অমিত সেই কাদা মাখা অবস্থায় একটা টর্চ নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল জিনিসটার দিকে। ওটার উপর আলো পরতেই অমিত হাঁফ ছাড়ল। আরে ওটাতো একটা গরুর গাড়ির ছৈ। আসার সময় ওইটার ভেতরে বসেই তো মধু বাস থেকে মেয়ের বাড়ি অবধি গেল। অমিতের সাহসে সাহসী হয়ে সবাই যখন এগিয়ে এলো ঠিক তখনই ছৈটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ধোপা বাড়ির ছেলে তোতলা কেতো। তাকে ধমকধামক দেওয়ার পর যখন সবাই জিজ্ঞাসা করলো যে সে ছৈটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে, কেতো তুতলে উত্তর দিলো, ‘শা-আ-লারা খে-তে দেয়নি, এটাকে ভে-এ-ঙে দিয়ে যাবো। সবাই বললো সে কি রে! এতো দামী জিনিস, ভাঙবি কি রে? জিনিসটা সত্যিই দামী। সুন্দর বেতের নকশা করা ছৈ, দাম অন্ততপক্ষে তিনশো টাকা হবেই। কেতোর সেই এক কথা, ‘কো-ও-নো কথা শু-উ-নবো না। কেতোর খুব মাথা গরম, মারদাঙ্গাতেও ওর জুড়ি নেই, তাই ওকে আর কেউ ঘাঁটালো না। কেতো আবার ঢুকে গেল ছৈ এর নিচে। দুপাশে দুটো হাত লম্বা করে ছৈ এর তলাটা ধরে কেতো ভারী ছৈটাকে একটু করে তোলে দু’পা যায় আবার নামিয়ে রাখে। এই ভাবে চলতে চলতে সে ছৈ টাকে নিয়ে গিয়ে রাখলো বাসের সামনে। তারপর সবাই বাসে উঠলে সে ড্রাইভারকে বললো, ‘চা-আ-লাও’। ড্রাইভার বললো, ‘চালাবো কি মশাই! এতো দামী জিনিস ভেঙে যাবে যে’। কেতো চোখ রাঙিয়ে বললো, ‘ভা-আ-ড়া পাবেনা কিন্তু’। ড্রাইভার আর কি করে, অগত্যা সে বাস ছেড়ে দিলো, আর ছৈ টা বাসের চাকায় পড়ে মড়মড় করে উঠলো।
অমিতের খুব খারাপ লাগলো, তবে মনে মনে সে তিনটে প্রতিজ্ঞা করলো, আর কোনোদিন বাবার জামা পড়ে বিয়ে বাড়ি যাবেনা, বিয়ে বাড়ীতে গিয়ে প্রথম ব্যাচেই খেয়ে নেবে আর বরযাত্রীর বাসে ওঠার আগে দেখে নেবে পুরুত উঠেছে কিনা।

Loading

3 Comments

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

<p>You cannot copy content of this page</p>