যৌবনোঃ ভবঃ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
যেই না কিনা বয়স ঢললো, অমনি কিনা দেহ গললো। দেহ যেন মোমবাতি। যেই জ্বলা শুরু, সেই গলা শুরু।
সারা গা বেয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসছে সরু সরু শিরার মতো মোমের ঝর্ণাধারা। মোমবাতি গলছে, গলিত মোম, বাতির গা বেয়ে নামছে আর বাতি ক্রমশঃ পুড়ে পুড়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছোট হচ্ছে।
ক্রমশঃ বিদিকিচ্ছিরি, কুৎসিত চেহারা পাচ্ছে
মসৃণ নিটোল মোমের গা। তারপর একসময়,
আয়ু শেষ। জ্বলে পুড়ে আলো বিতরণ খতম।
সেদিন এক বিখ্যাত অভিনেত্রীকে টিভিতে দেখলাম। হায় হায়! এ কি হাল! প্রথমে তো চিনতেই পারিনি, পরে যখন লাইফ টাইম এচিভমেন্ট পুরস্কার হাতে তুলে দেবার সময় নাম ঘোষণা হলো, তখন কপাল চাপড়ালাম। গালেও চড় খেতে ইচ্ছে করছিলো।
চোখ কপালে তুলে, মাথা চুলকোতে চুলকোতে ভাবছিলাম, হায়! মাগো, এই সেই নায়িকা। যাকে দ্যাখবার জন্যে, কলেজ কেটে, ব্ল্যাকে টিকিট কেটেছি। ওপেনিং ডে ওপেনিং শো মারবো বলে?
হায় হায় রে…
কোথায় সেই মনোমুগ্ধকর রূপ-লাবণ্যে আকৃষ্ট করা দেহ পল্লব, কাজল নয়না হরিণী!
এ তো, বাসর শেষের বাসি ফুলসজ্জা। রংবাহারি ফুলের ফুলস্টপ।
দেহপট সনে নট, সকলই হারায়..
আরে ভাই, নট হোক বা নটী। পরিণতি একই। শুকনো ফুল, গোলাপও যা গাঁদাও তা।
টুসটুসে রসালো ঝকঝকে আঙুর, কালের নিয়মে শুকিয়ে কিসমিস।
ঠিক এ-ই জায়গায় এসে, বিশ্বাস করুন, ঈশ্বরকে খুব অবিবেচক মনে হচ্ছে। কেন জানেন, আমার মনে হয় এই ব্যাপারটা সত্যিই বড়ো হৃদয়বিদারক।
শুঁয়াপোকা প্রজাপতি হয়ে উঠলে প্রফুল্লতা জাগে। রত্নাকর দস্যুবৃত্তি ছেড়ে জ্ঞানী ঋষি হলে, মনে প্রত্যয় জন্ম নেয়।
কিন্তু ব্যাপারটা যদি উল্টো হয়ে যায়, মানে- প্রজাপতি যদি শুঁয়াপোকা হয়ে যায়, তাহলে কেমন লাগবে?
ঠিক তেমনই একটি লাস্যময়ী হার্টথ্রব, যখন, আম শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়, বুক ভেঙে যায়।
হে রূপ, তুমি কোথা হইতে আসো, কোথায় মিলাইয়া যাও? ঠিকানাটি দিয়া যাও।
এই তো, আমাদের একজন অতি জনপ্রিয় সুন্দরী নায়িকা। ম্যাটিনি আইডল। দীর্ঘদিন যাবৎ নিজেকে চার দেওয়ালের আড়ালে, ইচ্ছাকৃত বন্দীত্ব স্বীকার করে আটকে রাখলেন। কেন?
আমি বলবো, এটা ঈশ্বরের নির্দয় নিয়ম নির্দেশের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ নির্বাক প্রতিবাদ। একটাই জোরালো প্রশ্ন.. দিলে যদি কেড়ে নিলে কেন?
সেই পুরাণকাহিনী মনে আছে?
রাজা যযাতি এক ঋষির অভিশাপে যৌবনের চেকনাই হারিয়ে জরাগ্রস্ত বৃদ্ধতে রুপান্তরিত হয়ে গেলেন।
নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে, হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতে করতে ঋষির কাছে বারংবার নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমাভিক্ষা করে, পুনরায় লোভনীয় আনন্দদায়ক কাম উচ্ছ্বল যৌবন ফিরিয়ে দেবার কাতর প্রার্থনা করতে লাগলেন।
অবশেষে ঋষির মন কিঞ্চিৎ নরম হলো। কিন্তু অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়ার জো নেই। তথাপি, তিনি এক উপায় বাৎলালেন-
যদি কোনও যুবক, তার এই বার্ধক্য স্বেচ্ছায় নিজ শরীরে ধারণ করে, তাহলে রাজা পুনরায় যৌবন ফিরে পাবেন। অর্থাৎ এক্সচেঞ্জ পলিসি।
ঋষি তো নিদান দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন। এদিকে মহা ফাঁপড়ে পড়লেন রাজা।
কে এমন বোকার হদ্দ আছে! যে স্বেচ্ছায় নিজের যৌবনের বিনিময়ে জরাগ্রস্ত বার্ধক্য গ্রহণ করবে?
নিজের যুবক পুত্রদের কাছেও লাজলজ্জার মাথা খেয়ে প্রস্তাব দিলেন।
বুঝুন যৌবনের মায়া কী মারাত্মক।
পিতা নিজের ঔরসজাত সন্তানের জরাগ্রস্ত বার্ধক্য কামনা করছে, শুধুমাত্র নিজে যৌবনের মিষ্ট রসাস্বাদন করবেন, সেই ইচ্ছায়।
তারাও কম সেয়ানা নয়। স্বল্প আয়ুর মধুর সুখ হাতছাড়া করতে তাদের বয়েই গেছে।
মজা লুটবে তুমি, আর আমরা মাথা গোঁজ করে বসে বসে খকখক করে কাশতে কাশতে হেঁপোরুগী হয়ে গলার কফ তুলবো?
হাঁ করে ইল্লি বলো।
সবাই মুখ ঘুরিয়ে কেটে পরলো। শেষে অনেক চেষ্টায় এক পুত্র রাজি হয়ে গেল। ব্যাস, চালাও ফুর্তির গড়ের মাঠ।
যৌবনই উদ্দামতার উষ্ণ ফুয়েল। ফুয়েল শেষ লম্ফঝম্প শেষ। বেতো হাঁটুতে তাল ঠুকে গান ধরো.. ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো..’
যাই হোক, অনেকদিন যৌবনের চরম আনন্দ লাভ করে, একদিন তিনি পুনরায় নিজের সেই পুত্রকে তার দান করা যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে, তার শাপগ্রস্ত জরাজীর্ণ দেহকে স্বীকার করে নিলেন।
নিলেন বটে। কিন্তু তা স্ব-ইচ্ছায় এবং আনন্দ চিত্তে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
এই জন্যেই বলছি, ঈশ্বর ইচ্ছে করলে, এই জায়গাটা নিয়ে আর একটু ভাবনা চিন্তা করে নিয়মটা চালু করলে, এইরকম বুকফাটা আফসোস কারুরই থাকতো না, একথা নির্দ্বিধায় হলফ করে বলা যায়।
আসলে কী জানেন, মনের মৌবনে সদাই বসন্ত। সেখানে শীত ঋতু আসে না। হারামজাদা শরীর সেই সত্য বুঝতেই চায় না।
আচ্ছা, কেমন নিয়ম হলে বুক ফাটতো না? সেলুউসন, আসুন দেখা যাক..
প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মের পর থেকে পর্যায়ক্রমে শারীরিক পরিবর্তন অনিবার্য।
ভালো কথা, হোক। কিন্তু এই পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে থেমে যাবে। সময়টা ধরা যাক ত্রিশ বছর।
এইসময়ের পর থেকে শরীরের আর কোনও পরিবর্তন হবে না। বয়স বাড়বে। আয়ু কমবে। নির্দিষ্ট সময়ে মৃত্যুও হবে। কিন্তু ঐ রকম বদখদ চেহারায় নয়।
যৌবনের জৌলুশ থাকুক আমৃত্যু।
রাজপুত্র, অচেনা অজানা অনভ্যস্ত পথে বেরিয়ে দেখলেন ব্যধি, বার্ধক্য, মৃত্যু।
আশ্চর্য হলেন, ব্যথিত হৃদয়ে স্ত্রী, পুত্র, রাজপ্রাসাদ সবকিছু পরিত্যাগ করে চললেন বোধদয়ের সন্ধানে। হলেন বোধিবৃক্ষ এর নিচে বোধিসত্ত্ব। ভগবান বুদ্ধ।
তাই বলি, ফুল ঝড়ুক, কিন্তু শুকিয়ে যাবে কেন? সে তার সৌন্দর্য নিয়েই যাক না। ক্ষতি কী?
তাই, শুধু আয়ুষ্মান ভবঃ নয়, যৌবনোঃ ভবঃ
এ-ই হোক নব্য যুগের, নব্য আশীর্বাদ।