শাস্তি
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়
রাতের শেষ গাড়ি। সারাটা কামরা এক্কেবারে শুনশান। নাসিরকে নিয়ে বড়জোর, না না, বড়জোর কেন? বেশ গোনা যাচ্ছে। সাকুল্যে সাতজন। একটি যুবতী। স্বভাবতই বাকিরা পুরুষ। নাসিরের চোখ বারবার ওই দিকেই যাচ্ছে ঘুরে ফিরে। কারণ আছে নিশ্চয়ই।
নাসির সুঠাম যুবক। মেয়েটি শুধু সুন্দরী নয়, যথেষ্ট পরিপাটি। রঙ করা বাদামি চুল। নীল জিনস আর সাদা শার্ট। শ্যামলা গায়ের রঙের সাথে চমৎকার মানানসই। আর শরীরের গড়ন। সত্যিই নাসিরের পক্ষে চোখ সরানো দায়। মনোলোভা যুবতীর কিন্তু নজর তার হাতে ধরা মোবাইলে। কিছু একটা চিবিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। সম্ভবত চুইংগাম।
অবশিষ্ট যাত্রীগণ নিতান্তই সাধারণ মানের। নাসির ওদের কাউকেই চেনে না। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সকলকেই চেনা চেনা মনে হয়। এদের কেমন যেন সকলেরই একইরকম পোশাক-আসাক। একইরকম অভিব্যক্তি। উদাসীন অথচ চিন্তিত। বাইরে শান্ত, কিন্তু ভেতরে যেন হুহু ঝড়ের দাপাদাপি। চোখ ঢুলুঢুলু। ব্যর্থতার জীবন্ত লাশ। অনিশ্চিত বর্তমান। ভবিষ্যতের ভয়ে ভীত মানুষগুলো সে ভাবনা থেকে পরিত্রাণ চায়, কিন্তু মুক্তি পায় না। তাই একরাশ বিরক্তি ছেয়ে আছে চোখে মুখে সর্বত্র।
মেয়েটি কিন্তু একেবারে ব্যতিক্রমী। সারা পৃথিবীতে চরম দুর্বিপাক ঘটে গেলেও, যেন তাতে তার ভারী বয়েই গেল। এমনই নিস্পৃহ আর তাচ্ছিল্যের বেড়া টপকে তার নাগাল পাওয়া, সত্যিই দুঃসাধ্য।
ট্রেন ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ষ্টেশনে থেমেছে, আবারও চলেছে। পুরনো যাত্রী গন্তব্যে নেমে গেছেন, নতুন যাত্রী এসেছেন।নাসির অবিরাম তাকেই যেন চোখে চোখে রেখেছে।
এক্ষুনি একটা ষ্টেশনে গাড়িটা থামলো, আর সেই যুবতী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় ট্রেন থেকে নেমে গেল। নাসির কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেন চলতে শুরু করে দিলো। জানালায় চোখ রেখে চলমান হরিণীর দিকে অপলক নয়নে চেয়ে রইল নাসির। দুজনের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে হারিয়ে গেল নাসিরের ভালোলাগা।
কিন্তু মনে গাঁথা হয়ে রইলো। এই নিঃশব্দে পা টিপে টিপে আসা ভাললাগা নাসিরের মনের এমন জায়গায় জায়গা করে নিলো, যা সহজে মুছে যাবার নয়।
চলমান ট্রেনের খোলা জানালায় চোখ রেখে নাসির ভাবছিলো, মেয়েটি একবারও তার দিকে তাকিয়ে দেখেনি। শুধু তার দিকে কেন, মোবাইল ফোন ছাড়া সে কোনও দিকেই তাকায়নি।
কী করছিল ও। চ্যাটিং? বয়ফ্রেন্ড আছে কী? আশ্চর্যের কী আছে। থাকতেই পারে। নিশ্চয়ই তাই। নইলে এতোখানি নিমগ্ন! দূর কীসব ভাবছি, নিজেকে নিজেই নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করলো। ট্রেন পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। নাসিরকে এখানেই নামতে হবে।
আসা যাওয়ার পথের ধারে এমন কতই ভালোলাগা আসে। কিছুদিন বিরাজ করে। তারপর কোনও একসময় মিলিয়েও যায়। যত্নের অভাবে। চারাগাছটি যেমন যত্নের অভাবে শুকিয়ে যায় ফুল ফোটবার আগেই, তেমনই। মরা গাছে ভ্রমর গুনগুন করে না।
মাস তিনেক পরের ঘটনা। সেদিনও নাসিরুদ্দিন, ছোট করে নাসির, একইভাবে রাতের শেষ গাড়িতে ফিরছিলো। একইভাবে সেই যুবতী, একই পোশাকে, একইভাবে মোবাইলে চোখ রেখে বসেছিল।
নাসিরের মনে আছে, আগের দিন মেয়েটি কোন স্টেশনে নেমে গিয়েছিল।
ভালোলাগা কখনো কখনও মানুষকে উন্মাদ করে। চিন্তায় অপরিপক্কতা বা অপরিণামদর্শীতার ছাপ রাখে। এক্ষেত্রেও তেমনই হলো। সেই নির্দিষ্ট স্টেশনে মেয়েটি নামতেই, নাসিরও নেমে গেল। শুধু নেমে গেল না, সামান্য দূরত্ব রেখে মেয়েটির পিছু নিলো।
এ এক আশ্চর্য দিশাহীন চলা। অনেক রাত। অচেনা জায়গা। একটি যুবক, সম্পুর্ণ অজানা কারণে, সম্পূর্ন অচেনা একটি যুবতীর পিছু নিয়েছে। কেন? কোনও উত্তর নেই। কৌতূহল? কিন্তু কেন, কোন অধিকারে? অধিকারের সীমা বাঁধা আছে। লঙ্ঘিত হলে সামাজিক অপরাধের দায় বহন করতে হবে। নাসির কী এসব জানে না, না কি, ভালোলাগার কৌতূহল তাকে বেপরোয়া করে তুলেছে!
মিনিট সাতেক হাঁটা হয়ে গেছে। রেলগেট পেরিয়ে এই জায়গাটা মোটামুটি অন্ধকারই বলা যেতে পারে। স্টেশনের পাশের দোকানগুলো সবই বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার আলোগুলো, এখানকার জমাট অন্ধকারের কাছে নিতান্তই নিস্প্রভ।
রাত অনেক। রাস্তায় মানুষের চলাচল একেবারেই নেই। কয়েকটা পথ কুকুর এদিক ওদিক শুয়ে আছে কুন্ডলী পাকিয়ে। কেউ বা দুলকি চালে চলেছে খাবারের সন্ধানে।
একটা গলি। মেয়েটি ঢুকে গেল গলিতে। ডানদিকের দুটো চালাঘরের পরে একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি। খুবই সাধারণ সাদামাটা বাড়ি। তারই সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। গলির মুখেই দাঁড়িয়ে আছে নাসির।
মেয়েটি এইবার ঘুরে তাকালো নাসিরের দিকে।
মুচকি হেসে বললো, কৌতূহল তো মিটলো। কিন্তু বাড়ি ফিরবেন কীভাবে? শেষ গাড়ি তো চলে গেছে। কী করবেন এখন?
এমন অপ্রস্তুতে কেউ পড়ে? ছি ছি। তার মানে মেয়েটি অনেক আগেই টের পেয়েছিল, তার এই অকারণ নির্লজ্জ পিছু নেওয়া। লজ্জা আর একরাশ অস্বস্তির কারণে গলায় কোনো শব্দ আসছিলো না।
সেই দুঃসহ মানসিক পীড়া থেকে মেয়েটিই তাকে মুক্তি দিলো বলা চলে। মৃদুস্বরে বললো, ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আমার কাছে আসুন।
ঠিকই, নাসির এখানে একেবারেই অপরিচিত মুখ। বহিরাগত। এই গভীর রাতে, মানুষের প্রশ্নের মুখে পড়লে বিপদ অনিবার্য। অনেক আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। কিন্তু এখন উপায়?
নাসির কোনও রকমে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বললো, সত্যিই, খুব ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার কোনও বদ উদ্দেশ্য বা…
মেয়েটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, বোকার মতো কথা বলবেন না। আপনার এইসব ছেলেমানুষি কথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবেন? যাইহোক, এখানে বেশীক্ষণ এইভাবে থাকা নিরাপদ নয়, সেটা কী আপনি বুঝতে পারছেন?
নাসির বুঝলো, মেয়েটি আসলে কী বলতে চাইছে। মেয়েটি ওর কোনও ক্ষতি চায় না। সেই প্রমাণ সে অনেক আগেই দিয়েছে। নইলে ইচ্ছে করলে এতক্ষণে চিৎকার করে পাড়ার লোকজন জড়ো করে, সে এক বিশ্রী ভয়ংকর কান্ড ঘটাতেই পারতো। শেষ ট্রেন চলে গেছে। এখন স্টেশনে ফিরে যাওয়া এবং সেখানে রাত কাটানো, সত্যিই বড্ড বেয়ারা অবস্থায় নাজেহাল হবার যোগাড়।
মেয়েটি দরজায় খুব আস্তে-ধীরে তিনটি টোকা দিলো। কেউ একজন দরজা খুলে দিলো। একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা। বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিয়েই চলে গেছেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে। উনি সম্ভবত মেয়েটির মা।
-আসুন, ভেতরে আসুন।
এই ডাকের জন্যে নাসির মোটেই প্রস্তুত ছিল না। হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, -আমি? মানে..কেন ?
-এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। আগেই বলেছি। স্টেশনে এখন গেলে মস্তান, মাতাল অথবা ছিনতাইবাজদের পাল্লায় পরবেন। আসুন।
নাসিরের নিজের গালে নিজে চড় খেতে ইচ্ছে করছিলো। কৌতুহলের সীমা থাকা উচিৎ। কিন্তু এইটা যা হলো, তাকে কি শুধুই কৌতূহল বলা চলে! নাকি আরও অন্যকিছু। যার ওপর মনের কিংবা মগজের খবরদারি খাটে না। সে চলে আপন পাগল পারা গতিতে। দুরন্ত আবেগে ছুটে চলে মোহানা পেরিয়ে একেবারে আকাশ ছোঁয়া উথাল-পাথাল সমুদ্রের বুকে নিজেকে বিলীন করে দিতে।
দুটি মাত্র ঘর। একটিতে মেয়েটি নাসিরকে এনে চেয়ারে বসতে দিলো। নিজে বসলো খাটের ওপর। চেয়ার একটাই।
– নিন, এবার বলুন। কিসের কৌতুহল? কী জানতে চান? তাছাড়া, জেনে হবেই বা কী? একটা মেয়ে, কখন, কোন অবস্থার তাড়নায় এত রাতে, একেবারে শেষ ট্রেনে বাড়ির রাস্তা ধরে, জানেন? আপনার কী এইটাই কৌতুহল? আশ্চর্য, অথচ দেখুন, আপনিও একইভাবে রাতের শেষ গাড়িতে ফিরছেন কিংবা কোথাও যাচ্ছেন। কই, তা নিয়ে তো কারুর কোনও মাথা ব্যথা নেই। অকারণ কৌতুহল নেই, তাহলে? কেন, আপনি ছেলে তাই? আপনারা নির্দ্বিধায় কৌতুহল মেটাতে মেয়েদের পিছু নিতে পারেন। লুকিয়ে চুরিয়ে তার ঠিকানা জেনে নিতে পারেন। সত্যি কথা বলতে, মনের কোণে অসুর বাসা বাঁধলে আরও অনেক কিছুই করতে পারেন, দৈহিক শক্তির জোরে।
কথা চলার ফাঁকেই, এক মাঝবয়সী মহিলা দুজনের জন্যে দু’টি প্লেটে কিছু খাবার রেখে নিঃশব্দে চলে গেলেন।
-চলুন, হাত ধোবেন তো। আসুন।
নাসির বুঝতেই পারছে না, তার এখন কী করা উচিৎ। কী বলা উচিৎ। এমন অসম্ভব লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে কেউ কখনও পড়েছে কিনা জানা নেই। এখান থেকে পরিত্রাণের উপায়ও নেই। সুতরাং কর্মফল ভোগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
নাসির এবার মনে মনে ভয় পেতে শুরু করেছে। মেয়েটি আসলে কী করতে চায়? হঠাৎ করে তার প্রতি এমন সহৃদয় হয়ে ওঠার কারণ কী? নাসির ভালো করেই জানে, সে ভুল করেছে। একটি অচেনা অজানা মেয়ের পিছু নিয়ে, তার বাড়ি পর্যন্ত আসা। মোটেই ঠিক হয় নি। এতটা বেহিসেবী কৌতুহলের খেসারত বোধহয় এবার চোকাতে হবে।
-কী ভাবছেন, আসুন।
-না, মানে, আমার ঠিক খাবার ইচ্ছে নেই। আপনি খান। আমি ঠিক আছি।
মেয়েটি হেসে বললো, লজ্জা করছে? যাক, সেটা আপনার আছে দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু, ব্যাপার কী জানেন, এইটুকু খাবার খেয়েই আজকের রাতটা কাটাতে হবে।
আমাদের তিনজনের জন্যে রান্না হয়। আমি, আমার শাশুড়ী আর আমার আট বছরের মেয়ের।
আপনি আসবেন তা তো জানা ছিলনা । এতরাতে নতুন করে রান্না করাও সম্ভব নয়। তাই, যা আছে ভাগাভাগি করে, একটাই তো রাত কী বলেন? আসুন, হাত ধুয়ে নিন।
আট বছরের মেয়ে। কথাটা কানে বাঁধলো নাসিরের। একে দেখে বোঝাই যায় না। কে জানে, সত্যি বলছে কিনা। যদিও তার কাছে অহেতুক মিথ্যে বলবেই বা কেন? কে সে? একেবারেই অনাহুত বহিরাগত, দোষী মানুষ। তাকে শাস্তি না দিয়ে, রাত্রিযাপন এবং খাবারের ব্যবস্থা করেছে।
নাসির চেয়ারে মাথা নিচু করে বসেই রইলো। এর চাইতে গুন্ডা, মাতাল, ছিনতাইবাজের পাল্লায় পড়া অনেক ভালো ছিল । এমন অপদস্ত মানুষ হতে পারে?
নাসিরের একবার মনে হলো, ছুটে পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু গভীর রাত আর রাস্তার কুকুরগুলোর কথা মনে হতেই, সেই পরিকল্পনা আপাতত শিকেয় তোলা রইলো।
সাকুল্যে দুটি ঘর। একটি শাশুড়ীর জন্য। অন্যটি, মা আর ছোট্ট মেয়েটির জন্য বরাদ্দ। আজ ওরা সবাই একটা ঘরেই জায়গা করে নিয়েছে। অন্যটি নাসিরের।
এতক্ষণ একসঙ্গে রইলো, অথচ ছেলেটার নামটাই জানা হয়নি। অবিশ্যি তার কোনও প্রয়োজনও নেই।
ঘুম আসছিল না। রাকেয়া অন্ধকার ঘরে তাকিয়েই শুয়ে রইলো। একটাই ভাবনা মাথা থেকে কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছে না। ছেলেটা ওর পিছু নিয়েছিল কেন? মতলব কিছু ছিল, নাকি নেহাৎ কৌতুহল? কী জানতে চায় ও। রাকেয়ার জীবনবৃত্তান্ত? ফেলে আসা দুঃসহ স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলতে চায়? কেন?
না-কি বয়সের বাচালতা। অকারণ ছটফটানি। যা তার জীবনেও ঘটে ছিল, আজ থেকে দশ বছর আগে।
বশিরকে ও ভালোবেসে ছিল। প্রথম প্রথম ভালোলাগা, তারপর..
তখন রাকেয়ার উনিশ। ট্রেনের কামরায় সেঁধিয়ে গিয়েছিল ফুরফুরে প্রেম। নিত্যদিন একসাথে যাওয়া, আসা। কর্মস্থলের সুবাদে। যদিও দুজনের কর্মক্ষেত্র ছিল আলাদা। কিন্তু পথ একই।
তারপরেই বিয়ের প্রস্তাব। সকলেই বোঝাতে চেষ্টা করলো। বিয়ে কোনও খেলা নয়। সারা জীবনের গাঁটছড়া। যতদূর খোঁজ খবর পাওয়া গিয়েছিল। তাতে রাকেয়ার বাবা মা মোটেই খুশী হতে পারেননি। একে অল্প রোজকার, তায় নেশার বহর খুব। রাকেয়া বলেছিল, কিচ্ছু ভেবো না। বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে ।
হয় না। স্বপ্ন আর বাস্তব একই পথে হাঁটে না। কল্পনার প্রলেপ বুলিয়ে বাস্তব দেখতে ভারী ভালো লাগে। কিন্তু, কল্পনার আলপনা ধুয়ে গেলেই বাস্তবতার কঠিন কর্কশ রূপ উলঙ্গ হয়ে যায়।
পরিবারের সকলের অমতেই শুধু নয়, তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন করে, চলে এসেছিল বশিরের হাতে হাত রেখে। পরম বিশ্বাসে। বশির সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দেয় নি। এক বছরের মাথাতেই রাকেয়া গর্ভবতী হয়। বশির রাখতে চায় নি। কিন্তু রাকেয়ার জেদের কাছে, সে সাময়িক ভাবে মেনে নেয় ঠিকই, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার আচরণের পরিবর্তন হলো।
সংসারে নিয়ম করে টাকা দিত না। রাকেয়ার কোনও খোঁজ খবরই রাখতো না। প্রতিটি গর্ভবতী নারী মা হবার প্রাক্কালে তার স্বামীকে পাশে চায়। একটু আদর, একটু সহানুভূতি, একটু সাহস। খুবই কী বেশী চাওয়া?
বশির তখন অন্য ঘাটে প্রেমের নাও বেঁধেছে। সেখানেই এখন তার মন প্রাণ শরীর। সেখানেই মশগুল। পুরাতনের মোহ অস্তমিত।
শিশুকন্যা প্রসবের ভয়ংকর রকমের অপরাধে, তালাক দিয়ে চলে গেল, তার নতুন স্বপ্নের দেশে। নবজাতক ববিতা, বশিরের চক্ষুশূল। চক্ষুশূল রাকেয়াও। নবজাত শিশুকন্যা রাবেয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদে ছিল রাকেয়া। না না, বশিরের জন্যে নয়। কেঁদে ছিল ভয়ে আগামীর আশঙ্কায়।
মাতৃত্বের সুখে, সন্তানের মুখ চেয়ে মায়েরা কতকিছুই হাসিমুখে মেনে নিতে পারে। ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। ঈশ্বরের আশ্চর্য সৃষ্টি, মা। চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবারও নতুন করে চাকরির সন্ধান করতে হবে।
পাশে ছিল কাদের সিদ্দিকী। রাকেয়ার শ্বশুর। রাবেয়াকে সস্নেহে আদর করতে করতে বলেছিলেন, ভয় কি রে মা? আমি তো আছিই। মরে তো যাই নি। আর আছে আমার দর্জির দোকান। আল্লার দোয়ায় দিন গুজরান ঠিকই হয়ে যাবে।
ও আমার ছেলে হ’য়েও, আমার কাছে থাকতে পারলো না। তুমি কিন্তু মেয়ে হয়ে, আমার কাছে থেকো।
মাত্র তিনবছর। কাদের সিদ্দিকী চলে গেলেন। সব মায়া কাটিয়ে.. চিরতরে। রাকেয়া আবারও পথে। একটাই লক্ষ্য। রাবেয়াকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। ভাগ্যিস, শ্বশুরের এই ছোট্ট ভিটে খানি ছিল। মাথায় ওপর পাকাপোক্ত ছাদ। অনেক সাহস যোগায়। নিশ্চিন্ত করে। লড়াই করার রসদ যোগায়।
আল্লার অসীম কৃপা। একটু চেষ্টা করতেই সেই পুরনো চাকরিটাই ফিরে পেয়ে গেল রাকেয়া।
মরুভূমিতে প্রাণসঞ্চারণের জলধারা। আর ভয় নেই। এবার লড়াই। নিজেকে প্রমাণ করার লড়াই। রাবেয়াকে মানুষ করার লড়াই।
এইসব কথা, ও’কে বলে কী হবে? একটা কাপুরুষ। তাছাড়া কী ! নইলে গভীর রাতে একাকিনী একটি মেয়ের পিছু ধাওয়া করে?
হ্যাঁ, চালাকি করে বলা ই যেতে পারে। তোমাকে ঠিক আমার বোনের মতো দেখতে। যে কিনা মাত্র একবছর আগে মারা গেছে।
হাঃ নাটক।
অন্ধকার অচেনা ঘরে নাসিরের ঘুমহীন দুঃসহ কালরাত্রি যাপন। একি উদারতা নাকি শাস্তি? কোনও বিশেষ মতলব নেই তো? কে জানে, হতেও পারে। যদি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেয়। তারপর লোকজন জড়ো করে যদি বলে, কাল রাতে বদ মতলব নিয়ে ঘরে ঢুকে ছিল। ধরা পড়ে কান্নাকাটি করছিলো। সারারাত তালাবদ্ধ করে রেখেছি, এইবার পুলিশ ডাকবো, আপনারা একটু সাহায্য করবেন প্লিজ। সর্বনাশ।
নাঃ, দরজাটা খোলা থাকাই ভালো। কাউকে বিশ্বাস নেই। বিশ্বাসের প্রশ্নই নেই। তার জন্যেই তো এতকিছু। এসবের মূলে তো সে নিজেই। অপরাধী মন কেবলই অন্ধকার পথে হাঁটে।
বিছানা থেকে উঠে, দরজাটা খুলে দিলো। যাক, খোলাই আছে। তালাবদ্ধ করে নি। কিন্তু একি?
সেই মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা এতরাতে বাইরে কেন? তাহলে কী!
-একি বাবা, তুমি ঘুমোওনি?
-না, মানে, মাসিমা ঐ নতুন জায়গা তো, তাই হয়তো ঘুম আসতে চাইছে না, কিন্তু মাসিমা আপনি এখনো জেগে! বাইরে..
ও কিছু নয়। আমার সুগার আছে তো, তাই রাতে বারেবারে বাইরে যেতে হয়। তাছাড়া, এই বয়সে ঘুমও কমে গেছে।
আসুন না মাসিমা। ঘরে আসুন। আপনার সঙ্গে কথা বলে খানিকটা সময় কাটাই। আজ ঘুম আসবে না। আর আপনারও তো, মানে..
নাসির ভেবে নিলো এই ভদ্রমহিলার থেকেই কিছু জানা যেতে পারে। তাছাড়া, ইনি যে সত্যিকথা বলছেন তারই বা কী মানে আছে? হয়তো সময় মতো দরজা খুলে ফেলতেই, আচমকা মুখোমুখি হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। কিছুই আশ্চর্যের নয়। ভদ্রমহিলাকে ঘরে এনে ওনার সঙ্গে আলাপ জমানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
মাসিমা ঘরে এসে চেয়ারে বসলেন। নাসির যথারীতি খাটেই।
-রাকেয়া আমার ছেলের বউ। মানে..
-আপনার পুত্রবধূ। জামাই কী করেন?
-এসব কথা তুলতে ভালো আর ভালো লাগে না। সবই আমাদের কপাল। যদি জানতাম, ছেলেটা বড় হয়ে এইরকম কুলাঙ্গার, শয়তান, বেইমান তৈরী হবে, তাহলে কিছুতেই ওকে যত্নে লালন পালন করে বড় করে তুলতাম না। বিষ দিয়ে মেরে ফেলতাম। আমার বৌমা বড্ড দুঃখী, হতভাগী।
বিয়ের পরেই ঐ মেয়ে হলো। রাবেয়া। ওর একটাই ইচ্ছে। মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে। তার জন্য দিনরাত এক করে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। ওভার টাইম কাজ করলে, কিছু বাড়তি রোজকার হয়। তাই মাঝেমধ্যেই ঐ শেষ গাড়িতে ফেরে। বারণ করলেও শোনে না। বলে, টাকার বড্ড দরকার মা। রাবেয়াকে অনেক অনেক বড়মানুষ করে তুলতে হবে। টাকা ছাড়া, তা কীভাবে সম্ভব হবে মা?
বিশ্বাস করো নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। লজ্জা করে। এমন ছেলে পেটে ধরলাম, যে এমন হীরার মতো বউকে তালাক দিয়ে, অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে চলে গেল।
আমাদের কথা একবারও ভাবলো না। ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু, তার বাপের মুখ দেখতে পেল না। অবিশ্যি অমন বাপের মুখ না দেখাই ভালো।
আসলে কী জানো, আমার বৌমা তো বেশি লেখাপড়া জানে না। খুবই গরীব ঘরের মেয়ে। অনটনের সংসারে ঘরে বসে থাকলে, অন্ন জোটে না। তাই কম বয়স থেকেই পথে বেরুতে হয়েছে। সেটা একরকম ভালোই। লড়াই করার জোর মনে মনে জোরালো, ধারালো হয়। যাক, বাদ দাও। তোমার কথা বলো কিছু, শুনি।
-আমার কথা.. কী বলবো! এইরকমই দিন আনা, দিন গুজরান সংসার। বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতেন। একদিন অফিসের মধ্যেই, কাজ করতে করতেই স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন। কোম্পানির মালিক, বলতে পারেন মানবিকতার খাতিরে, ওখানেই আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। আসলে, আমিও ওভার টাইম পেলে ছাড়ি না। সেই কারণেই অনেক সময় শেষ ট্রেনে ফিরতে হয়।
-মেয়েদের পিছু নেওয়া, সেটাও কী তোমার ওভার টাইমের মধ্যে পড়ে?
-মাথা হেঁট করে বসে রইলো নাসির। আবেগের বশে এইরকম বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। কাউকেই কিছুতেই বিশ্বাস করানো যাবে না, আসলে ও এইরকম বদ স্বভাবের ছেলে নয়।
-দ্যাখো বাবা, দিনকাল তো সেই আগের মতো নেই। প্রয়োজনে মেয়েদের বাইরে বেরুতেই হয়। অথচ আজও কেন জানি না অনেকেই এই ব্যাপারটা সহজ করে নিতে চায় না।
আমি জানি না তোমার বোন বা দিদি কিংবা স্ত্রী আছে কি না, প্রয়োজনে তাদের পথে বেরুতে হয় কি না। তখন যদি তাদের সঙ্গে এমন আচরণ কেউ করে? মানে তুমি যেমন করেছ। তোমার কেমন লাগতো, তুমি কী তাকে আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে আসতে? তার ভালো মন্দের কথা বিবেচনা করে, একটুও বিচলিত না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় তার সব অপরাধ ক্ষমা করে নিরাপদ আশ্রয়ের আয়োজন করতে?
নিশ্চিত করে বলতে পারি, করতে না। বরঞ্চ উল্টোটাই করতে। তাকে শাস্তি দিতে। অপমান করতে। এটাই স্বাভাবিক। এমন না হওয়াই আশ্চর্যের। তাই না?
আসলে কী জানো, মেয়েরা মায়ের জাত। স্নেহ মমতায় ভরা মন। তোমরা সেই ভালোবাসার জায়গাটাকে দুর্বলতা মনে করো।
আমার বৌমা আজ যা করলো, ওর ওপর আমার ভালোবাসা আরও অনেক অনেক বেড়ে গেল।
মায়েরা, বোনেরা, দিদিরা এভাবেই বারে বারে তোমাদের শিক্ষা দিতে চেয়েছে। তোমরা সেটাকে শান্তি মনে করে ভুল করেছ। তোমাদের পৌরষবোধ কিছুতেই অহংকার মুক্ত হতে চায় না। এই অকারণ অহংকার বোধ থেকেই জন্ম নেয় অপরাধ বোধ। তোমার নাম জানি না, জানতেও চাই না। শুধু বলবো, মানুষ হও। সেই হোক তোমার প্রকৃত পরিচয়। যে পরিচয় শুধু তোমার নয়, তোমার পরিবারের এমনকি দেশের মুখও উজ্জ্বল করবে। আসি বাবা। কিছু মনে ক’রো না। গায়ে পড়ে সুযোগ পেয়ে জ্ঞান দিলাম কিনা..
ভদ্রমহিলা ধীর পায়ে চলে গেলেন। রেখে গেলেন একরাশ ধিক্কার।
এখন কেবলই ভোরের আকাশের প্রতীক্ষা। আলো ফুটুক, নতুন আলো। জরাজীর্ণ অন্ধকারের হোক চির অবসান।
ভীষণ ভীষণ ভালো একটি গল্প।দারুণ লিখেছেন কিন্তু শেষ দিকটা এভাবে না লিখলেই পারতেন