মুখের কথা
-রাখী চক্রবর্তী
পিকন রাতে ঘুমানোর আগে বিছানায় বসে পঁচিশ মিনিট মতো প্রার্থনা করে। শুধু ওর মা যেন ভালো থাকে। আর কিছু চাওয়ার নেই পিকনের ভগবানের কাছ থেকে।
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পিকন দেখে মা জলের বোতল, গামলা, হাঁড়ি সব রাস্তার কল থেকে ভরে নিয়ে আসছে। খুব কষ্ট হয় ওর। মা-র হাড়গিলে চেহারা, ব্লাউজের ঢলঢলে হাতা এতটাই বড় যে ওর মা’র দশটা হাত ঢোকালেও ঠিক হবে না। অচিন্ত্যর মা’র কি সুন্দর চেহারা। দেবী মনে হয়। আর আমার মা, খেংড়া কাঠি যেন। ভীষণ লজ্জা লাগে সবার মা কত সুন্দর।
সুমির দিদির বিয়েতে মাকে নিয়ে গেছিলাম কি অপমানই না হতে হলো।
“মা’র খাবারটাও তুই খাস নাকি পিকন। নিজে হাতী হচ্ছিস। আরে মা’র দিকটা দেখ একবার”।
ঠাকুর কেন আমার মাকেই এমন!
-“এই বাঁদর ছেলে, মা খেটে মরছে আর তুই বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছিস”
বাবার শব্দ বাণে পিকন হুঁশে এল।
যা জলের বালতি নিয়ে আয়। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অফিসে না গেলে না, দানা পানি জুটবে না কপালে। খাচ্ছে দাচ্ছে আর বকবকম্ করছে।
-মা জল বইতে বারণ করেছে।
-ওহো..মা বারণ করেছে..
-আহা ওকে বকছে কেন? সবে ঘুম থেকে উঠলো ছেলেটা। পিকনের মা জলের হাঁড়িটা নামিয়ে বললো।
পিকন ওর মার হাতের রগগুলো দেখছে। শাঁখা পলা চুড়ি ঝুলছে হাতে।
অচিন্ত্যর মার হাত লক্ষ্মী ঠাকুরের মতো নিটোল।চুড়ি বালাতে মানানসই।
পিকন আমি বাথরুমে গেলে আর ঢুকতে পারবি না। যা করার করে আয়।
পিকন মাথা চুলকে বললো, মাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না।
পিকনের বাবা ছেলের কথা শুনে রান্না ঘরের দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো আবার বেশ কিছুক্ষণ।
ওর মা’র চোখে জল। মাঝে মধ্যেই পিকন এমন কথা বলে।
ভাতের হাঁড়ি উনুনে চাপিয়ে ওর মা বললো,
সবই কপাল আমার। পিকনের বাবা বাথরুমে গেল।
বি.এ. থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট পিকন। মা বাবার একটি সন্তান। পাড়া প্রতিবেশীরা নিজের ছেলেপুলেদের বলে পিকনের মতো হতে পারিস না। দেখ ভক্তি শ্রদ্ধা কাকে বলে। শেখ ওর থেকে শেখ ।
পিকন বাড়ির বাইরে বাবা মার বাধ্য সন্তান। ঘরেও তাই। কিন্তু মাঝে মধ্যেই ওর মার ওপর খুব রাগ হয়। মুখে কিছু বলে না। তবে থেকে থেকে এই একটা কথাই বলে, মাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না..
গত মাসে পিকনের কলেজে বিশাল ঝামেলা হয়েছিল ইট পাটকেলের ঝড় উঠেছিল। পিকন মা’র কথা ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। আচমকাই একটা থান ইট পড়লো পিকনের মাথায়। রক্ত আর রক্ত। হসপিটালে ভর্তি ছিল পনেরো দিন। পিকনের মা এক মুহূর্তের জন্যও ছেলের সঙ্গ ছাড়ে নি। ছেলে যেমনটিই হোক, মা তো মা।
পনেরো দিন পর পিকন বাড়ি এল। জ্ঞান আসছে চলে যাচ্ছে। তবে ভয়ের কিছু নেই ডাক্তার বাবু বলেছেন।
রাত দশটা বাজে পিকনের মাথার কাছে ওর মা বাবা বসে আছে। পিকনের মা ওর গায়ে মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“ঠাকুর আমার মাকে ভালো রেখো। কিছু তো চাই না আর। আমার মাকে একদম দেখতে ইচ্ছে করে না। আমার মা তো দেবী। দেবী কখনও হাড়গিলে হয়? মার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। প্রকাশ করতে পারি না। ভাবি এক আর বলি আর এক। কেন এমন হয় ঠাকুর? আমি বলতে চাই মার এই চেহারা ভালো লাগে না। মা কেন বেশি করে খায় না? কিন্তু বলতে গিয়ে বলি মাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। অন্তরের কথা প্রকাশ করতে পারি না। মুখের কথা সবাই শোনে। কিন্তু অন্তরের কথা কেউ বুঝতে পারে না। কেন ঠাকুর কেন? এই মা যেন প্রতি জন্মে পাই- দেখো ঠাকুর। আমার মাকে নিয়ে ওরা হাসাহাসি করে। আমার ভালো লাগে না।”
শোনো পিকনের মা ছেলের কথা শোনো।
পিকনের মা চোখ মুছতে মুছতে বললো, “আমার সোনা। তুই সুস্থ হয়ে যা আমি নিজের যত্ন নেবো।সময় মতো খাবো।”
পিকনের ঘুমের ঘোরে বলা সব কথা ওর মা বুকে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। সকালে পিকনের ঘুম ভাঙতেই ওর মা বললো, “জলের লাইন নেব, জলের ট্যাঙ্ক হবে বাবা, তোর মা আর কষ্ট করে জল তুলবে না। রাণীর মতো থাকবে তোর মা।কাজের দিদি আসবে কাল থেকে।”
পিকনের বাবা বললো, “জানি তোমার খুব পরিশ্রম হয়। যা মাইনা পাই তোমাকে দু’দণ্ড ভালো রাখতে পারি না। কাজের লোক রাখলে তোমার তো একটু বিশ্রাম হতো।
জানো তো আজকাল কেউ মানুষের মনের খোঁজ রাখে না। চেহারাটাই আসল। সত্যি বলতে আমারও তোমার হাড়গিলে চেহারা দেখতে ভালো লাগে না। ছেলের মনের কথা যখন জানতে পেরেছি। আর দেরি না।”
-এই শোন না কাজের দিদিকে মাস গেলে দুশো টাকা দিতে হবে। সামলাতে পারবে তো মাসের শেষে? ছেলের লেখা পড়া সংসার খরচ!
-আরে হ্যাঁ, পিকন ঠাকুরকে ডাকে তুমি যাতে ভালো থাকো। সংসার ঠিক চলে যাবে। তুমি বিশ্রাম নাও। নিজের যত্ন নাও। খাও বেশি বেশি করে। সেন বৌদিকে দেখিয়ে দেব।
-সেন বৌদি কোথা থেকে এল?
-না কিছু না। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, কাজে না গেলে না- দানা পানিও জুটবে না।
পিকন বিছানায় শুয়ে মা বাবার কথা শুনে ফিকফিক করে হাসছে আর ভাবছে এবার বলি মা তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু যদি উল্টোটা বলে ফেলি। থাক কিচ্ছু বলবো না।অন্তরের কথা অন্তরে থাক। মুখের কথা মুখে থাক। কিচ্ছুটি বলার দরকার নেই। শুধু তুমি ভালো থেকো মা।
গল্পটি দারুণ