বিজয়িনী
– গৌতমী ভট্টাচার্য
ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে ট্রেনে উঠে কোনোরকমে একটু বসার জায়গা পেল সীমা। দু’টো তো ষ্টেশন যা হোক করে চলে যাওয়া যাবে।ব্যাগ থেকে গল্পের বইটা বার করে পড়তে শুরু করল সীমা, এটা ওর অনেক দিনের অভ্যাস ট্রেনের মধ্যে বসে কিছু পড়া। আজ কিছুতেই মন বসাতে পারছে না ভিড়ের জন্য। বারেবারে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। আর তখনই ঠিক দেখতে পেল উলটো দিকের সিটে বসা ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দুটি চোখ তার দিকে চেয়ে আছে।
অস্বস্তিতে মুখটা ফিরিয়ে নিল সীমা।কিন্তু বুঝতে পারছে চোখ দু’টো তার দিকেই নিবদ্ধ একই ভাবে। আড়চোখে আবার হাসিমুখে মহিলার দিকে তাকাতেই এক ঝটকায় মুখটা ঘুরিয়ে নিল। মুখ ঘুরিয়ে নেবার ভঙ্গিমাটা চোখের দৃষ্টি যেন খুব চেনা কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলো না সীমা কোথায় দেখেছে বা কে ওই মহিলা, হবে হয়তো বাজারে বা প্রতিদিনের চলাফেরার পথে কোনো কেউ। ভাবতে ভাবতে এসে গেল গন্তব্য ষ্টেশন।আবার ভিড় ঠেলে নামা। তাড়তাড়ি যেতে হবে।
কন্যা রিমির স্কুলবাস ওদের বাড়ীর ষ্টপেজে এসে যাবে ঠিক সাড়ে চারটেতে। রিমি এখন ক্লাস ফোর। সীমাকেই কলেজ ফেরত রিমিকে বাস থেকে নামিয়ে নিতে হয়। দায়িত্বটা ওরই। রিমির বাবাও ওর কলেজ নিয়ে ব্যস্ত। কখনো সখনো দায়িত্বটা পালন করে ঠিকই তবে সেটা নেহাত দায়ে পড়ে।
রিক্সাটা স্টপেজে আসতেই দেখতে পেলো নীল বর্ডার দেওয়া হলুদ রঙের স্কুল বাসটাকে। অনেক ছেলেমেয়েদের সাথে রিমিও নামছে। মাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে রিক্সায় বসে স্কুলের গল্প অনর্গল করে যেতে থাকলো।
বাড়ীর দরজার চাবি খুলে রিমিকে ব্যাগ রেখে জুতো খুলতে বলে সীমা নিজেও জামাকাপড় পালটিয়ে রিমির বইয়ের ব্যাগ থেকে টিফিন বাক্স নিতে গিয়ে দেখলো গলে যাওয়া ক্যাডবেরীটাকে। ‘রিমি আজ আবার কার জন্ম দিন ছিল রে?’
‘না তো মা আজ তো কারুর জন্ম দিন ছিল না।’ মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিল রিমি।
‘তাহলে কার কাছের থেকে ক্যাডবেরী নিয়েছিস। তুই তো জানিস আমি কারুর টিফিনে ভাগ বসানো পছন্দ করি না’। সীমা রিমিকে বকতে শুরু করল।
‘নাা মা আমি কারুর টিফিনে ভাগ বসাই নি, আজ না সেই দিদাটা স্কুলে যাবার সময়ই তো আমাকে গেটে ক্যাডবেরীটা দিল’।
সীমা ভুরু কুঁচকে তাকালো!
‘তোমাকে তো বলেছিলাম আগেও তো দুদিন এসেছিল। আমাকে আজ অনেক আদর করলো’।
ছোট্ট আট ন’বছরের মেয়ে মিথ্যা কথাটা রপ্ত করতে পারে নি এখনো। মা অচেনা কারুর কাছ থেকে কিছু নিয়ে খেলে বকবে জেনেও সত্যি কথাটা বলে ফেলল।
মেয়ের কথা শুনে অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল সীমার। কে ওই মহিলা তার মেয়েকে আদর করে ক্যাডবেরী দিচ্ছে । ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। এই নিয়ে তিন দিন হলো। না এবার ব্যবস্থা নিতেই হবে। স্কুলের প্রিন্সিপাল কে বলতেই হবে। কত রকমের কিডন্যাপিং এর ঘটনা কাগজে উঠছে বা অনেকের থেকে শোনা যাচ্ছে।
রাত্রে খাবার টেবিলে রিমির বাবা শুভকে বলতেই হেসে উড়িয়ে দিল। ‘কে তোমার মেয়েকে দিনের বেলা স্কুল গেট থেকে কিডন্যাপ করবে। তোমার বা আমার কারুর সঙ্গে কি শত্রুতা আছে, নাকি আমাদের কোটি কোটি টাকা আছে মেয়ের বিনিময়ে অনেক মুক্তিপণ পাবে। রিমিকে ভালো করে জিজ্ঞাসা করো হয়তো ওরই কোন বন্ধুর ঠাকুমা বা দিদিমা।
‘ রিমির বন্ধুর এমন কে ঠাকুমা বা দিদিমা আছে যাকে রিমি চেনে আমি চিনি না। শুভর সবটাই হালকা চালে নেওয়া। কোনো কিছুই গভীর ভাবে ভাববে না। যা কিছু করার আমাকেই করতে হবে।
কলেজে ক্লাস নিয়ে বেড়িয়ে মোবাইলের সুইচ অন করতেই পরপর বেশ কয়েকটা মিস কল।রিমির স্কুলের প্রিন্সিপাল আর শুভর। গতকালই ঘটনা জানিয়ে স্কুলে রিপোর্ট করে এসেছিল সীমা।আবার মোবাইলে শুভর গলা, স্কুলে তাড়তাড়ি চলে আসার জন্য। মহিলা ধরা পড়েছে এবং স্কুল অথরিটি পুলিশেও খবর দিয়েছে।
তাড়াতাড়ি সীমা আর শুভ স্কুলে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল ওই মহিলা নাকি রিমির অনেক দিনের পরিচিত। রিমিকে ভালোবাসে তাই দেখতে আসে। ভয়ে ভয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকতেই সীমা দেখলো ট্রেনের কামরার মহিলাকে। কয়েকদিনের টেনশনে ওই ট্রেনের কামরার তাকিয়ে থাকা মহিলার কথা ভুলেই গেছিল সীমা। এরকম তো কতই হয়। চেনা অচেনা কত কেউই তো রাস্তায় তাকিয়ে থাকে। সবার কথা কি মনে থাকে।
‘কিগো বৌদিমনি আমাকে চিনতে পারো নি তো?’
চমকে গেল সীমা গলার স্বরে বলার ভঙ্গিমায়।
‘তাহলে তোমার কানের দুল দু’টো আমি চুরি করি নি বলো।’
অজান্তেই সীমার হাত দু’টো দু’কানের দুল স্পর্শ করল। শুভ আর সীমা দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। একদম স্তব্ধ হয়ে গেল।
কি করে ভুলে গেল সীমা কয়েক বছর আগের রিমির শিশুবেলার আয়া মাসীকে- যে পরম আদরে যত্নে রিমিকে দেখভালের কাজ করতো। সঙ্গে সঙ্গে সংসারের অনেক কাজ করে দিতো।ওকে না পেলে চাকরী, সংসার, রিমি সবকিছু এক সঙ্গে বজায় রাখা সম্ভবই ছিল না সীমার পক্ষে। রিমিকে এই আয়া মাসীই সীমাকে মা বলতে শিখিয়ে ছিল। রিমি যত বড় হচ্ছিল আয়া মাসীর সঙ্গে লেপটে থাকত সর্বক্ষণ। সীমার কাছে আসতে চাইত না যা ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। সীমার প্রয়োজনটাকে এতোটাই পুষিয়ে দিচ্ছিল মুখে চট করে কিছু বলতে পারতো না।রিমির বাবা অবশ্য এসব ব্যাপারে পাত্তাই দিত না।সংসারের অনেক বিষয়ে ছেলেরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে। উপরন্তু সীমা মা অথচ ওর কাছে রিমি থাকতে ভালো বাসে না আয়া মাসীর কাছে থাকতে চায়, এই জন্য সীমা আয়ার উপর জেলাস বলে ঠাট্টা করতো। হয়তো কথাটা অনেকটাই ঠিক। কাজের লোকের এতটা ন্যাওটা হয়ে যাওয়া সীমার না পছন্দ। এটা সীমার ইগোতে লাগতো। আয়া মাসীও ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে পারছিলো। কিন্তু কিছু করার নেই দুপক্ষেরই প্রয়োজন। ভদ্র অথচ দুঃস্থ বাড়ীর মহিলা অভাবের তাড়নায় কাজ করতে এসেছে। আর সীমার অভাব তো সীমাহীন।
আয়াকে তাড়ানোর একটা অজুহাত পেয়ে গেল সীমা। সবসময়ের ব্যবহার করা দুল দু’টো কোনোসময়ে খুলে রেখে ছিল। খুঁজে পাওয়া গেল না। সম্ভাব্য জায়গা আলমারীর আনাচে কানাচে খুঁজেও না। এই সময় আমরা ভদ্রলোকেরা বাড়ীর গরীব কাজের মানুষের দিকেই সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করি সীমাও তার ব্যতিক্রম নয়। “আমি চুরি করি নি, অভাব থাকতে পারে কিন্তু চোর নই”।অনেক অনুনয় বিনয়ও সীমাকে টলাতে পারলো না। কৃতজ্ঞতার বদলে চোর অপবাদের শিরোপা নিয়ে আয়া মাসীর প্রস্থান ঘটলো সীমার বাড়ী থেকে। রিমি প্রথম প্রথম কান্নাকাটি করলেও ভুলে যেতেও সময় লাগলো না। আস্তে আস্তে সীমার ঘনিষ্ঠ হতে শুরু হলো। সীমার মনে শান্তি ফিরে এলো। এরপর একদিন ব্যবহার না করা একটি ছোট্ট বাক্সে হারিয়ে যাওয়া দুল দু’টো খুঁজে পেল সীমা। মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার অপরাধে বিবেকের দহনে জ্বলতে থাকলেও কখনো মনে হয় নি সীমার আয়ার কাছে অন্যায় ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নি। তাহলে সীমার অহমিকাবোধ আত্মমর্যাদার পদস্থলন ঘটবে। ক্রমশ জ্বালাটা প্রশমিত হয়ে ঘটনাটা চাপা পড়ে গেছে।
এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সীমা কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি। সীমার কানে আজ সেই দুল দু’টো। আয়ার দুল দু’টো চিনতে একটুও ভুল হয় নি। সীমা আয়ার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো ঠোঁটের কোনে এক টুকরো বিদ্রুপেের হাসি। চোখ দু’টো বিজয়িনীর অহমিকার দম্ভে জ্বলজ্বল করছে, বলতে চাইছে, কেমন অপদস্থ করলাম সবার মাঝে? প্রমাণ করে দিলাম তো আমি চোর নই। অপমানে মুখ কালো হয়ে গেল শুভর। সীমা রিমির স্কুলের প্রিন্সিপাল বা অন্য কারুর দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারলো না। এক ঘর লোকের মাঝে লজ্জায় সীমা কুঁকড়ে যেতে লাগলো।