গল্প- এটলাস

এটলাস
-পারমিতা ভট্টাচার্য

 

 

রাঁচিতে শীতকালে কলকাতার চেয়ে অনেক গুন বেশি শীত পড়ে। এখানে জলহাওয়াও শরীরের পক্ষে খুব ভালো।ভোলানাথ বাবুর শরীরটা রিটায়ার করার পর থেকেই খুব একটা ভালো যাচ্ছিলনা।বয়স হলে যা হয় আর কি।অফিস থাকার সময় সকালে দুটো নাকেমুখে গুঁজেই দৌড় দিতে হতো। চাকরি জীবনে তপ্ত জ্বলন্ত খাবার খেয়ে খেয়ে এখন গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বিরাট আকার ধারণ করেছে।অকৃতদার মানুষ ভোলাবাবু।নিজেই রান্না করে খেতেন,এখনও খান,তবে কিছুই আর হজম করতে পারেননা।পাড়ার মোড়ে পাঁঠার ঠ্যাং ঝুলতে দেখে সেদিন আর লোভ সামলাতে না পেরে একটু বাড়ি নিয়ে আসেন।ব্যাস ,সেই শুরু।সেই যে পেটে অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হলো এক্কেবারে হসপিটালের বেডে নিয়ে হাজির করলো তাকে।

ভোলাবাবুর প্রাণের বন্ধু হৃষিকেশ বাবু থাকেন রাঁচিতে।ওখানের একটা স্কুলে সারাজীবন ছেলে পড়িয়েই জীবন কাটিয়ে দিলেন।এখনও হৃষিকেশ বাবুর এক বছর চাকরি আছে।তবে চাকরি শেষে উনি আর কলকাতায় ফিরতে চাননা।ওখানের মনোরম জল হাওয়া আর সুন্দর করে গোছানো বাড়ি ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে চাননা বড় একটা।তবে ভোলাবাবু সময় পেলেই কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়েন বন্ধুর কাছে।বন্ধুর বাড়িতে তার কোনো দ্বিধা নেই।কলকাতা থেকে রাঁচি দূরত্ব অনেক হলেও বন্ধুত্বে কোনোদিনই ভাঁটা পড়তে দেননি দুজনেই।আগে চিঠি ছিল,এখন তো স্মার্ট ফোন।দুজনে ওই ফোনেই এখন চ্যাটিং,ভিডিও কল করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান আর কি। ভোলাবাবুর শরীর ক্রমেই খারাপের খবর শুনে হৃষিকেশবাবু তাকে রাঁচি চলে আসার পরামর্শ দেয়।হৃষিকেশবাবুর একটাই ছেলে,বিদেশে থাকে।বুড়ো বুড়ির সংসারে ভোলাবাবু গেলে তারা খুশিই হবে বলেই জানায়। ভোলাবাবু প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করেও শেষমেশ রাজি হয়ে যায়।

” ভারী চমৎকার জানিস রাঁচির জল।আমার রোগ এমনিতেই অর্ধেক কমে গেছে মনে হচ্ছে এই দুইমাসে।” -কাঁকর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বললেন ভোলাবাবু।সকাল,বিকেল দুই বন্ধুতে অনেকটা পাথুরে পথ ধরে পিছনে শাল বন ফেলে,পাশে পাহাড়টাকে নিয়ে হাঁটেন দুই বন্ধুতে। হৃষিকেশবাবু এমনিতেই কর্মঠ মানুষ এই বয়সেও।মনের জোর আর কি। এবার পাশে বন্ধুকে পেয়ে সে আরও মনের স্ফূর্তি খুঁজে পেয়েছে।কিন্তু সময় চিরকাল সবার একরকম যায়না। তার কাছে নতিস্বীকার সবাইকেই করতে হয়। হঠাৎ একদিন সুস্থ সবল হৃষিকেশ বাবুর বুকে ব্যথা শুরু।ছেলের বন্ধু হার্ট স্পেশালিস্ট বিতান দত্তকে দেখালেন তিনি।ডক্টর বললেন মাইল্ড হার্ট ব্লক করছে। ওষুধ খেতে হবে, সাথে বিশ্রাম।ভারী কাজ চলবেনা।কিছুটা দমে গেলো হৃষিকেশ বাবু।তো এমন পরিস্থিতিতে ভোলাবাবু সকাল সন্ধ্যা একাই হাঁটতে বেরোন।আর তার স্বভাব ছিল চারিদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা,অনুধাবন করা।যা হৃষিকেশ বাবুর একদম নেই।সবেতেই তাড়াহুড়ো।ফলে বন্ধুর সাথে হাঁটতে বেরিয়ে শরীরচর্চা হতো বটে,কিন্তু পাশের কোনও কিছুই মনে দিয়ে দেখা হয়ে উঠেনি এই কয়মাসে ভোলাবাবুর।এবার একা বেরিয়ে প্রথমেই ঠিক করলেন শালবনের ভিতর তিনি যাবেন।ঘন শাল সেগুনের জঙ্গল তাকে ছেলেমানুষ করে দেয়। তিনি এরপর থেকেই শালবন ধরে হাঁটার সময় কিছুটা সেখান থেকে ঘুরে আসে। অনেক স্থানীয় লোকজন শালপাতা কুড়োতে সেখানে যায় বটে,কিন্তু বিকেলের দিকে সে যখন যায় সবাই তখন বাড়ি ফিরে যায়।একদিন এক মহিলা শালপাতা কুড়িয়ে টুকরিতে জমা করছে সেই সময় ভোলাবাবু তার পাশে দিয়ে যাবার সময় সেই মহিলা তাকে জঙ্গলের বেশি গভীরে যেতে বারণ করলেন।ভোলাবাবু ভাবলেন হয়তো কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার আছে ,ওরা স্থানীয় মানুষজন জানেন তাই হয়তো বারণ করছে।তাও সেদিন সে একটু গভীরেই গেলেন শালবনের। বসন্তের হাওয়ায় শালপাতা নিরন্তর খসে পড়ছে অরণ্যের বুকে। সেই পাতার উপর দিয়ে হাঁটার সময় খসখস আওয়াজে মুখর হয়ে উঠছে অরণ্যের বাতাস।সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শালবনের প্রতিটি গাছে।কচি কচি শাল পাতা জানান দিচ্ছে আগামী দিনের।এই সব ভাবতে ভাবতে ভোলাবাবু একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কতদূর এসে পড়েছে তা ঠিক করতে পারলনা।এমন সময় একটা তীব্র কিন্তু সুমিষ্ট গন্ধ তার নাকে এলো।মরা একটা অর্জুন গাছের নিচটা কেমন যেন একটু গা ছমছমে। চারিদিকে বাসায় ফেরা পাখির কাকলিতে ভরে ছিল চারিদিক এতক্ষণ।কিন্তু এই জায়গায় কোনো পাখির ডাক নেই।শুধু হাওয়া বয়ে যাওয়ার একটানা শন শন শব্দ ছাড়া কোনো শব্দই কানে আসছেনা ভোলাবাবুর।এদিকে সন্ধেও নেমে আসছে।দ্রুত পায়ে সে জঙ্গল থেকে বেরোবার পথ ধরলেন।এদিকটায় মানুষের তেমন যাতায়াত নেই।তাই জঙ্গল থেকে বেরোবার কোনো জনপথের সরু রেখাটুকুও চোখে পড়ছেনা।এবার একটু ভয় ভয় করলো তার।সন্ধ্যে নেমে আসছে,পথ হারিয়ে ফেললে এই জঙ্গলে সারারাত এখানেই কাটাতে হবে যে।এদিক ওদিক করে অবশেষে মিলল সরু পায়ে হাঁটা একটি পথের রেখা।যেদিকেই যাক জঙ্গল থেকে বেরোবার একটা পথ তো পাওয়া গেছে।এদিকে দিনের আলোও ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে দ্রুত পায়ে জঙ্গল থেকে বেরোতে থাকে।এমন সময় প্রায় তার কান ঘেঁষে কি যেন একটা প্রচন্ড গতিতে উড়ে গেল।তার ডানার একটু অংশ ছুঁয়েও গেল তার কান।নরম ছোঁয়া যদিও,কিন্তু কানে হাত দিয়ে মৃদু আলোয় সে দেখল কানে গুঁড়ো গুঁড়ো কিসব যেন লেগে আছে।খয়েরি রঙের এই জিনিস আসলে কি? কোথা থেকেই বা এলো? আর ওই অতবড় উড়ন্ত প্রাণীটাই বা কি?এই জন্যই কি ওই আদিবাসী মহিলা তাকে জঙ্গলের গভীরে যেতে বারণ করেছিল?তার মাথা আর কাজ করছেনা।শেষে এই বয়সে বিদেশ বিভুঁয়ে এভাবে প্রাণ হারাতে হবে?মরার পর তার আধ খাওয়া দেহ দেখে চিনতেই পারবেনা কেউ।হা ঈশ্বর, একটা পথ দেখাও।

” আরে ওটা কি? একটা আলো দেখতে পাচ্ছি।বাঁচাও বাঁচাও!! হ্যাঁ, আলোটা এদিকেই এগিয়ে আসছে।” মনে মনে বললেন ভোলাবাবু।সামনে এগিয়ে এলো এক স্থানীয় যুবক,হাতে পাওয়ার ফুল টর্চ,পরনে খাঁকি পোশাক।
“আপনি এই অন্ধকারে এই জঙ্গলে কী করছেন?বুঝেছি,তা কোথায় আপনার দলবল?কাজে লেগে পড়েছে নাকি?” স্থানীয় যুবকটি বললেন।
ভোলাবাবু কিছু বোঝার আগেই আরও বেশ কয়েকজন এসে ঘিরে ধরলেন তাকে।ভোলাবাবু জঙ্গলের ঘন দিকটায় লাইট দেখিয়ে কিছু বোঝাবার আগেই দুজন যুবক চাপা গলায় বলে উঠলো “করছেন কি আপনি?নিজেও মরবেন আর আমাদেরও মারবার প্ল্যান করছেন?জানেননা দিনের আলো নিভলে এই জঙ্গলের গভীরে আলো জ্বালা মানা ।ওরা জেগে উঠলে কতবড় বিপদ জানেন?”
ভোলাবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।ও কিছুই বুঝতে পারছেনা আলো জ্বললে কারা জেগে উঠবে?বিপদটাই বা কোথা থেকে আসবে?

যাইহোক, স্থানীয় ছেলেদের আসলে শাল সেগুনের চোরাশিকার বন্ধ করতেই পুলিশ নিয়োগ করেছে।এরা পালা করে সন্ধ্যা নামলে জঙ্গল পাহারা দেয়।তবে গভীর জঙ্গলে এরা কেউ যায়না।ওরাই ভোলাবাবুকে বড়োরাস্তায় নিয়ে এলো এবং থানায় নিয়ে যাবার জন্য উদ্যত হলো।ভোলাবাবু তখন ফোন করলেন হৃষিকেশ বাবুকে।বহুদিন এই অঞ্চলে থাকার সুবাদে এবং পড়শী হিসাবে পুলিশের বড়বাবু তিলক নারায়ণ ব্যানার্জির সাথে ভালোই খাতির ছিল হৃষিকেশবাবুর।তিনি তাই বন্ধুর এই বিপদে ফোন করলেন বড়বাবু তিলক নারায়ণ ব্যানার্জিকে।অচিরেই থানা থেকে ব্যানার্জি বাবু এসে স্থানীয় যুবকদের হাত থেকে রক্ষা করে হৃষিকেশ বাবুর বাড়ি পৌঁছে দেবার কথা বললেন ভোলাবাবুকে।

গাড়িরপিছনের সিটেই বসেছিলেন দুজনে।ব্যানার্জি বাবুর ও বয়স হবে পঞ্চান্নর এদিক ওদিক।কিছু কথা হলো দুজনের মধ্যে।
“কতদিন আছেন এখানে ইনচার্জে?” ভোলাবাবু জিজ্ঞেস করল ব্যানার্জি সাহেবকে।
” তা প্রায় ২৭ বছর ।” বললেন ব্যানার্জি বাবু।
“তা আপনি এই জঙ্গলে সন্ধ্যে অবধি কী করছিলেন?আপনাকে জঙ্গলে যেতে বারণ করেনি হৃষিকেশ বাবু?” বেশ একটু কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন ব্যানার্জি বাবু।
“বিরাট ওই ডানার ঝাপটা খাওয়ার কথাটা বেমালুম চেপে গিয়ে ভোলাবাবু বললেন,” বারণ ও বহুবার করেছে,আমিই একটু এডভেঞ্চার করতে গিয়েছিলাম।জঙ্গলের গভীরে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলি।আসলে ওখান থেকে ফিরে আসার পায়ে হাঁটা কোনো পথের রেখা নেই কিনা , তাই।আচ্চা সাহেব জঙ্গলের গভীরে আলো জ্বালা নিষেধ কেন?”
“সে অনেক ব্যাপার,পরে বলবো।এখন বাড়ি এসে গেছে।আসুন আজ।পরে দেখা হবে নিশ্চয়ই।” ব্যানার্জি বাবু বললেন।

বাড়িতে ফিরেও ভোলাবাবু কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলেন।সেই সন্ধ্যায় আসলে ঠিক কি ঘটেছিল সব কথাই চেপে গেলেন হৃষিকেশ বাবুদের কাছে। হৃষিকেশ বাবুর একদফা ঝাড় খেয়েও সে প্রতিউত্তরে কোনো কথাই বললেন না।মাথায় খালি চিন্তা আর অজানাকে জানার নেশা এই বয়সেও তাকে ব্যস্ত করে তুললো।তিনি রাতের খাবার টেবিলে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেলেন দেখে হৃষিকেশ বাবু আর তার স্ত্রী মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন।একটু পরে হৃষিকেশ বাবু ভোলাবাবুর ঘরে আধ ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে নাইট ল্যাম্পের ক্ষীণ আলোয় দেখলেন সে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

দিন সাতেক পর একদিন সকালে উঠে ভোলা বাবুকে ঘরে এমনকি বাড়িতেই পাওয়া গেলোনা।হৃষিকেশ বাবুর বাড়ির চাকর বললেন তিনি অনেক ভোরেই হাঁটতে বেরিয়ে গেছে।তাকে দরজা বন্ধ করতে বলেছে ।এরপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো ভোলাবাবুর পাত্তা নেই দেখে থানার বড়বাবু ব্যানার্জিকে ফোন করে হৃষিকেশ বাবু।থানার বড়বাবু তৎক্ষণাৎ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন।যে রাস্তায় হাঁটতো সে সেখানে নেই এটা আন্দাজ করেছিল ব্যানার্জি।সে আরও আন্দাজ করেছিল ওই শালবনের গভীরেই তাকে আজও পাওয়া যাবে।কেন জানি ব্যানার্জি ভাবছিল একটা বিপদের কথা।যা সে জেনেও এই স্থানীয় মানুষদের থেকে সে বারবার লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।তবে কি ভোলাবাবু সেই রহস্যের সন্ধান পেয়েছে?না,না তাকে যে করেই হোক আটকাতেই হবে।” মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলো সে। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে ,ড্রাইভারকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে ,কোমরে গোঁজা পিস্তল একবার দেখে নিয়ে ব্যানার্জি বাবু রওনা দিলো শালবনের গভীরে।
কোথাও কেউ নেই,শুধু শালবনে শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটার খসখস শব্দ। একমনে চারিদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছে সে ।ভোলাবাবুকে যদি দেখতে পায়।একটা মরা অর্জুন গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো ব্যানার্জি বাবু।এটা কি? এত ভোলাবাবুর টুপি।তবে কি তার সন্দেহই ঠিক!! সন্ধ্যা নেমে আসছে,তাদের আসার সময় হচ্ছে।হঠাৎ একটা কি যেন তার পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে উড়ে গেল।হালকা আলোয় তেমন বোঝা গেলোনা।হাত দিয়ে মাথা ঝেড়ে নেবার পরই কি একটা তার ঝাঁকড়া মাথায় এসে বসলো।কি এটা?তার উড়ন্ত দুটো ডানা থেকে ঝরা রেনু ঝরে পড়তে লাগলো তার জামার কাঁধে,বুকে,পিঠে।হাত দিয়ে ধরতেও ভয় লাগছে,যদি কামড়ে দেয়,তার বিষক্রিয়ায় যদি মৃত্যু ঘটে!! তারপর ব্যানার্জি বাবু ভয়ে ধপ করে একটা গাছের গোড়ায় বসে পড়তেই সেই প্রাণীটি দ্রুত বেগে উড়ে চলে গেল।এরপর যা ঘটলো তার জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেননা।আতঙ্কে,ভয়ে,ঘেন্নায় তার সারা শরীর কেঁপে উঠলো।যে গাছটিতে হেলান দিয়ে তিনি বসে ছিলেন তার মোটা গুঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে অসংখ্য শুয়া পোকার মতো বড়বড় পোকা।সেগুলো গাছের গুঁড়ি বেয়ে ব্যানার্জি বাবুর সারা গায়ে উঠতে লাগলো।মাথার চুল আঁকড়ে, ঘাড় বেয়ে জামার ভিতর ঢুকতে লাগলো।তিনি চিৎকার করতে করতে,তাদের ফেলার চেষ্টা করতে গেলে আরো বিপত্তি দেখা দিল।কিছু হাতের আঘাতে চটকে গেল শরীরে।ফলে চামড়া সেই পোকার সারা শরীরের কাঁটা আর এসিডে ফুলে লাল হয়ে অসম্ভব জ্বলতে লাগলো।শেষে তিনি অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।

হসপিটালে ব্যানার্জি বাবুর বেডের পাশে বসে ভোলাবাবু।চোখ খুলেই ব্যানার্জিবাবু আতঁকে উঠলেন।ভোলাবাবু তাকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বললেন “আপনি এখন একদম বিপদমুক্ত।কিন্তু আপনি কেন আমাকে খুঁজতে ওই গভীর জঙ্গলেই গেলেন মিঃ ব্যানার্জি?আমি তো ওখানে ছিলাম না।এতো বড় জায়গা এই রাঁচি,তবু শালবনের গভীর জঙ্গলে আমি থাকবো এই অনুমানটি আপনি করলেন কেন?”পাশে দাঁড়িয়ে আছেন হৃষিকেশ বাবু,পুলিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা,ডক্টর, নার্স,আর একজন প্রাণীবিদ।কথা বলার ক্ষমতা সত্যিই নেই ব্যানার্জি বাবুর।তার থেকেও বেশি তিনি অসুস্থতার ভান করলেন।একটি কথারও জবাব তিনি দিলেন না।চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন।”আসলে শারীরিক অসুস্থতার চেয়ে ব্যানার্জি বাবুর মানসিক অসুস্থতা বেশি।উনি ভীষণ ভাবেই মুষড়ে পড়েছেন।আসলে আমি ওনার ধান্দাটা খুব সহজেই ধরতে পেরে গিয়েছিলাম।” বললেন ভোলাবাবু।
পুলিশের উর্ধতন অফিসারটি বললেন,”সেটা কি রকম? বিস্তারিত ব্যাখ্যা করুন।আমরা সকলেই জানতে চাই ঘটনাটি আসলে কি ঘটেছিল?”
ভোলাবাবু বলতে শুরু করল,”অভয় দিচ্ছেন যখন বলি তাহলে,আমি প্রথম দিন সত্যিই আমার কান ঘেঁষে উড়ে যাওয়া প্রাণীটি কী, বুঝতে পারিনি।পরে ব্যানার্জি বাবুর সাথে গাড়িতে যাওয়ার সময় ওনাকে গভীর জঙ্গলে আলো জ্বালাতে নেই কেন জিজ্ঞেস করলে পরে বলবে বলেন।কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড় এটা জানার জন্য।আমি একদিন সন্ধ্যায় ওনার গাড়ির আওয়াজ পেয়ে কিছুক্ষণ পর বাড়িতে যাই।উনি আমার বন্ধুর পড়শী।চা খেতে খেতে জঙ্গলে আলো না জ্বালার কারণ জানতে চাইলে উনি আমাকে ভুতের ভয় দেখান।আমি বিশ্বাস করিনা।পরে আড়ি পাতি আমি ওনার বাড়িতে।গভীর রাতে দুটি একই নম্বরের গাড়ি দুদিন পরপর আসতে দেখে আমিও রাতে ওনার পাঁচিল টপকে ঘরের জানলায় কান দিয়ে যা শুনি তাতে আমার লোম খাড়া হয়ে যায়।আসলে জঙ্গলের গভীরে যা আছে সেটা আমাদের দেশের সম্পদ। ‘এটলাস মথ’।যা সারা বিশ্বের সব থেকে বড় মথ। এটি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায় ।এই মথের থেকে লালা থেকে তৈরি হয় বহুমূল্য সিল্ক বা রেশম সুতো। মিঃ ব্যানার্জি তার বিদেশী বন্ধুর সাহায্যে ওই মথ ও তার লার্ভা বিদেশে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বিদেশে পাচার করে ব্যবসা করতেন।এই ব্যবসা ছিল কয়েক কোটি টাকার। এই মথের থেকে পাওয়া রেশম সুতোর বিপুল চাহিদা বিদেশের বাজারে।আমাদের সরকার এই জঙ্গলে মথের বসবাসের ব্যাপারে কিছুই জানেননা নিশ্চয়ই।আর মিঃ ব্যানার্জি একজন সরকারি অফিসার হয়েও এই ব্যাপারে সরকারকে কোনো সন্ধান জানাননি।এটাও কি একপ্রকার চোরা কারবার নয়?সব থেকে বড় কথা এই সব কথা ফরেস্ট অফিসারও জানতেন।ব্যবসার একটা অংশ তাকে পাইয়ে দিয়ে তার মুখও বন্ধ রেখেছিলেন উনি।আর জঙ্গলে যে স্থানীয় ছেলের দল আমায় উদ্ধার করেছিল তারাও ওনার পোষা গুন্ডা।তারা ওনার চর।পয়সা দিয়ে পুষে রেখেছেন ওদের,যাতে কেউ গভীর জঙ্গলে প্রবেশ না করতে পারে।আসলে ওনার নামে একটা গভীর ভয় ছিল স্থানীয় মানুষ জনের মধ্যে।উনি এনটাউন্টার ফার্স্ট পুলিশ অফিসার।আর এই ভীতিকেই কাজে লাগিয়ে এত বড় ব্যবসা সবার সামনে অথচ গোপনে ফেঁদে বসেছিলেন। এখন আপনারা বলতেই পারেন আমি জানলাম কী করে এসব।এই নিন আমার ফোন, দেখুন ওনাদের রাতের সব কথা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। গভীর রাতে যখনই এত গাড়ি আসতো ওনার বাড়ি সন্দেহ আমার তখনই জেগেছিল।পরে ওনাদের কথোপকথনে সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের সামনে।হ্যাঁ, অন্যায় আমিও করেছি।অন্যের বাড়ি ঢুকে ওনাদের গোপন কথা আমি শুনেছি,তাতে যদি আমায় শাস্তি দেন আমি মাথা পেতে নেব।আমি সারাজীবন সরকারের নিমক খেয়েছি।কি করে এত বড় অন্যায় মেনে নিই বলুন?আর এই জন্যই অপদেবতা,ভুত, ভ্যাম্পায়ারের ভয় দেখিয়ে স্থানীয় মানুষজনকে গভীর শালবনে ঢুকতে দেওয়া হতোনা,লোক জানাজানির কারণে।আমি কাল ভোরে বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে শালবনের গভীর জঙ্গলে যাই।সেখানে দেখি প্রকান্ড প্রকান্ড প্রজাপতি গাছের কাণ্ডে, ডালে, পাতায় বসে আছে।অসংখ্য ওদের ডিম ,লার্ভা ছড়াছড়ি যাচ্ছে শাল,সেগুন অর্জুনের ডালে পালায় কাণ্ডে।আমি প্রথমে হতবাক হয়ে যাই।পরে সম্বিৎ ফিরে এলে সাবধানে জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে এসে যাই হৃষিকেশের বন্ধু বিখ্যাত প্রাণীবিদ ও অধ্যাপক আর.এস.মুন্ডার কাছে। তার সাথে পরিচয় ঋষিকেশই করিয়ে দিয়েছিলেন।তাকে বলতেই সে দেখতে চায়।একটা এন্ড্রয়েড ফোন সাথেই ছিল।ছবিও তুলেছিলাম কটা।সেগুলো দেখে মিঃ মুন্ডা বনবিভাগের অধিকর্তাকে ফোন করে সব বলে।ছবিও পাঠায়।আজ তারা সেখানে গেছেন খতিয়ে দেখতে এবং জঙ্গলটিতে প্রজাপতির অবস্থান সুনিশ্চিত করতে।আর মিঃ ব্যানার্জিকে আজ হসপিটালের বেডে থাকতে হচ্ছে তা ওনার কৃতকর্মের ফল। “
হৃষিকেশ বাবু বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“রোগ সারাতে এসে আবিষ্কার করে বসলি যে এই বয়সে !!”
ভোলাবাবু মজা করে হাসতে হাসতে বললো,”ভাগ্যিস তোর হার্ট এট্যাক হলো।”

হাসিতে ফেটে পড়লো হসপিটাল করিডোর।

Loading

Leave A Comment