বার্ধক্যে
-শচীদুলাল পাল
মাস ছয়েক আগে নির্মল বাবু অবসর নিয়েছেন। কর্মোদ্যম মানুষটি কাজ ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। শুধু কাজ আর কাজ। সেই মানুষটি এখন এই কয় মাসের মধ্যে অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন। প্রেসার, সুগার বেড়েছে। কিডনি ঠিকঠাক কাজ করে না। প্রস্টেড গ্ল্যান্ডে সমস্যা।
ঘরের সামনে এক পার্কে আসেন আর তার অনেকদিনের প্রতিবেশী বন্ধু তারাপদ বাবুর সাথে বেঞ্চে বসে তার সুখ দুঃখের কথা বলেন। স্মৃতিচারণ করেন। মনটা একটু হালকা করেন।
আজ হন্তদন্ত হয়ে এসে তারাপদ বাবুর পাশে বসে গজরাতে লাগলেন।
– আমি আর সংসারে থাকবো না।
তারাপদবাবু বললেন, কেন কি এমন হলো? কি হয়েছে?
-কোনো ভদ্রলোক সংসার করে?
-বৌদির সাথে কিছু হয়েছে?
-হয়েছে মানে উঠতে-বসতে বাপান্ত করছে। রিটারমেণ্টের পর ভেবেছিলাম ভালো ভালো গান শুনবো। বই পড়বো। শান্তিতে বই পড়তে গেলে হাত থেকে বই কেড়ে নেয়। গান শুনতে গেলে টেপ বন্ধ করে দেয়। ক্লাসিক্যাল গান শুনছি তো মুখের সামনে এসে ভ্যাংচাতে শুরু করলো।
-সেকি কেন?
-তার অনেক অভিযোগ। তাকে কোনো শখ আহ্লাদ করতে দিইনি।
– যাই বলুন। বউদির কিন্তু রাগের কারণ আছে। অনেক অবহেলা করেছেন।
– আপনি বলছেন এই কথা?
– বয়স কম রাখার জন্য দামি দামি ব্রান্ডের ক্লিঞ্জার, টোনার, ময়শ্চেরাইজার কিনে দিয়েছি। আমি নিজে দামী কোনো শার্ট পরিনি। কখনো কোনো নেশা করিনি। নেশা বলতে এক চা। তাও দুধ চিনি ছাড়া। অফিসের পার্টিতে কতবার অফার করেছে ড্রিংকসের জন্য। আমি স্পর্শ করিনি।
– কেন?
-ওই বউ ছেলে মেয়ের জন্য। আমি বয়ে গেলে ওদের কি গতি হবে এই ভেবে। শুধু ওদের জন্যই চিন্তা। ওদের মাথার উপর যেন ছাদ থাকে। দু’মুঠো ডাল-ভাতের অভাব না হয়। অফিস থেকে লোন নিয়ে জমিটা কিনলাম কত কষ্ট করে একটু একটু করে বাড়িটা তুললাম কার জন্য বলুন? কাদের জন্য?
-তা ঠিক। সবুরে মেওয়া ফলে। খাসা হয়েছে বাড়িখানা।
– এত কষ্ট করে যাদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিলাম তাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে থাকতে পারবো না। খুব শিক্ষা হয়েছে। আমি এবার সংসার থেকে বিদায় নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব।
– যাব বললেই কি যাওয়া যায়?
– না যাওয়ার কি কারণ?
– পিছুটান বলে একটা কথা আছে।
– পিছুটান। কাদের জন্য পিছুটান? বন্ধের দিন বা ঝড় জল ওয়াটার লকিং, বাস ট্রাম বন্ধ। সে অবস্থায় অফিসে গিয়েছি। বস বলতেন, এইরকম পরিস্থিতিতেও অফিসে এসেছেন? আমি বলতাম ঘরে বসে থাকলে সিক হয়ে যাব স্যার? সেই অফিসটাকেও মন থেকে ধুয়ে সাফ করে দিয়েছি। রিটায়ার-এর পর আমার ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগতো না। খিদে লাগতো না। ঘুম আসতো না। প্রথম প্রথম রিটায়ার্ডমেন্টের পরও অফিসে গিয়েছি। অফিসের সবাই সমীহ করতো। কাজকর্ম দেখতাম। চা-টা খেতেও দিত। এক দিন বস চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “কি নির্মলবাবু আপনার পাওনাগণ্ডা বাকি আছে নাকি?” আমি তখন বুঝতে পারলাম আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ভাবছে অন্য কোনো মতলব আছে! ঘরে, অফিসে কেউ আর অবসর জীবনে সমীহ করে না। অন্য চোখে দেখে। যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব।
– যাবেন..।যাবেন বলছেন, কোথায় যাবেন?
-রাঁচিতে আমার এক দিদি থাকে জামাইবাবুর মৃত্যুর পর দিদি বড় একা। কতবার ডেকেছে।
দুজনে একসাথে থাকবো।
-কদিন একটু ঘুরে আসুন। মনটা ভালো লাগবে।
-কদিন নয়, জন্মের মতো চলে যাব।
-ছেড়ে গেলে লোকে কি বলবে? বউদির কি হবে?
-মহারানীর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। পি এফ, গ্র্যাটুয়িটির টাকা এম.আই.এস করে দিয়েছি। বসে বসে পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবে।
এরপর অনেকদিন নির্মলবাবু আর পার্কে আসেনি। তারাপদবাবু ভাবলো সত্যিই চলে গেছে। সংসারী মানুষের শেষজীবন বড়োই প্যাথেটিক। মনে মনে বললেন, বিয়ে থা না করে বেশ আছি।
হঠাৎ একদিন পার্কের বেঞ্চে নির্মলবাবু বসে আছে। তারাপদ বাবু বলেন, কি নির্মলবাবু আপনি রাঁচি যান নি?
– না।
-কেন?
-ষড়যন্ত্র। কনসপিরেসি।
-মানে?
-যাব বলে সব ঠিকঠাক, ব্যাগ-ব্যাগেজ গুছিয়ে ফেলেছি ভোরের ট্রেন ধরবো বলে। আপনার বউদি আছাড় খেয়ে পড়লো বাথরুমে। তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। ডাক্তার দেখাও, এক্সরে করো।
-হাড় ভাঙেনি তো?
-লৌহমানবীদের হাড় ভাঙে না। বড়জোর মচকায়। বসে বসে মালিশ করার জন্য এই বান্দা ছাড়া আর কে আছে?
-যাক আছাড় খেয়ে মান ভেঙেছে তাহলে? বউদিকে ক্ষমা করে দিলেন তাহলে?
-না না। কখনো না। বলে কি জানেন আমি নাকি ইচ্ছে করে সাবানজল ফেলে রেখে দিয়েছিলাম। এইরকম বউয়ের সাথে থাকি?
-যেতে দিন। রঙ্গ করেছে।
– রঙ্গই বটে। ছেলেটাকেও কব্জা করে রেখে রেখেছে। এখন ছেলেকে দিয়েও অপমান করাচ্ছে।
– আপনার ছেলে তো ভালো।
– ভালো? জানেন ছেলে কি বলছে। বুড়ো ভাম। যাবে কোথায়? মক্ষিচোষ.. একটা ভালো জামা প্যান্ট কিনে দেয়নি। ভালো মন্দ খেতে দেয়নি। আমি বাপ নয়। চামার।
– কি সব হয়েছে আজকালকার ছেলেরা।
– বলুন। মিতব্যয়ী ছিলাম বলে একটু একটু করে বাড়ি করেছি। যার দাম এখন বিশ পঁচিশ লাখ হবে।
-তা নিজে কামাচ্ছে। নিজের পয়সায় ফুটুনি করুক না?
-সে গুড়ে বালি। মায়ের ট্রেনিং। যত ইচ্ছে বুড়ো গরুটাকে দুইয়ে যা। কিছু বলতে গেলেই মা ঝাঁপিয়ে পড়বে। বলবে ছেলের পয়সায় নজর দাও কেন? বাড়িতে এখনো এল.সি.ডি টিভি এলো না। পুরানো টিভিতে পোষায় না মা -ব্যাটার।
-সত্যিই আপনার কিছুদিনের জন্য বাইরে চলে যাওয়া দরকার।
-যাবই তো। গ্রামে আমার জ্যাঠতুতো ভাই থাকে। সেখানে থাকবো। ছিপ ফেলে পুকুরে মাছ ধরবো। নদীর ধারে বসে থাকবো। ফুরফুরে হাওয়া খাবো।
-আমি একটা কথা বলি, মা ছেলেকে একটু টাইট দিন। টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিন।
-তাহলে তো দিনরাত আরও গালমন্দ করবে। ছেলের হাত খরচা আছে। ওর ওই ইনকামে চলে না।
-বুঝলাম স্নেহ অতি বিষম বস্তু।
-এবার আমি চলেই যাব। বলতে বলতে নির্মলবাবু হাঁটা লাগালেন। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছেন। বয়স অনুযায়ী বেশি বুড়ো বলে মনে হয়। গাল ভেঙ্গে গেছে। হাত কাঁপে। বাতের ব্যথায় নেংচে নেংচে হাঁটছেন।
এরপর মাস খানেক নির্মলবাবুর দেখা নেই। হঠাৎ একদিন তারাপদবাবুর ঘরে হাজির। তারাপদবাবুর বিশাল দোতলা বাড়ি। একাই থাকেন। কাজের মেয়ে থালাবাসন ধুয়ে দিয়ে যায়। রান্নার মাসি এসে রান্না করে রেখে যায়। কাজের মেয়ে লতিকা একদিন বললো, বাবু আপনার সেই বন্ধুটি এসেছে সাথে একটি ফুটফুটে বছর আটের মেয়ে। আমি তাদের সামনের ঘরে বসতে বলেছি।
তারাপদ বাবু সামনের ঘরে এসে মেয়েটিকে আদর করে কেক চকলেট দিল।
-কি নাম তোমার?
-আমি তিতলি।
বলেই তিতলি এ ঘর সে ঘর ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল।
-বলুন নির্মলবাবু, কোথা থেকে ঘুরে এলেন? আপনার শরীর তো একদম ভেঙ্গে গেছে। কেমন যেন দুর্বল লাগছে।
-আর যাওয়া হলো কই? ডেঙ্গুর আক্রমণের শিকার হলাম। ধুম জ্বর আসতো। শয্যাশায়ী। ভেবেছিলাম মরেই যাব। প্রচুর ওষুধ খেয়ে পনেরো দিন পর শয্যা ছেড়ে উঠেছি। এর মধ্যে মেয়ে এসে হাজির।
-এটি মনে হয় মেয়ের মেয়ে। নাতনি?
-হ্যাঁ। মেয়ে পাকাপাকি জামাইকে ছেড়ে চলে এসেছে। ওদের নাকি বনিবনা হচ্ছে না। আর বরের কাছে যাবে না। মাঝখানে একদিন জামাই এসেছিল। আমার সামনেই দুজনের তুলকালাম ঝগড়া।
-মেয়ের কি অভিযোগ?
-জামাই মারধর করে। কথায় কথায় ঝগড়া করে। আরএই যে বনিবনা হচ্ছে না, সব দোষ আমার। আমি নাকি ওকে হায়ার এডুকেশন দিইনি। আরও পড়াশোনা জানলে সে নাকি চাকরি পেত।আমি নাকি ফ্যামিলি দেখিনি। সুন্দর দেখতে বলে বিয়ে ঠিক করে দিয়েছি। যত দোষ নন্দ ঘোষ।
-জামাই কি বলছে?
-তিতলিকে নিয়ে টানাটানি। জামাই তিতলিকে নিয়ে যাবেই। মেয়ে নাছোড়বান্দা। কিছুতেই তিতলিকে দেবে না।
– ঠিকই তো। তিতলি মায়ের কাছেই থাকবে।
– আমারও ওই একই মত।
-আপনিও এক সাথী পেয়ে গেলেন।
-এখন আমার সব ভালোবাসা ওই তিতলি।
-ভালোবাসা নিম্নগামী ও বিতরণী, প্রথম জীবনে ভালোবাসে মা বাবাকে। পরে নেমে আসে স্বামী স্ত্রীতে। আরও নেমে ছেলেমেয়েতে। শেষবেলায় আরও নেমে নাতি নাতনিতে।
-ঠিক বলেছেন।
এমন সময় কাজের মেয়েটি দুজনকে দু’কাপ চা দিয়ে গেছে।
নির্মলবাবু জাস্ট চায়ে চুমুক দিয়েছে হঠাৎ খেয়াল হলো তিতলি নেই। নির্মলবাবু তড়াক করে ছুটে এ ঘর সে ঘর ছুটোছুটি করে তিতলিকে দেখতে না পেয়ে চোখে সরষে ফুল দেখতে লাগলেন।
-আপনার ছাদে তো কার্নিশ খুব ছোট। বলেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠতে লাগলেন। তিনি আর বুড়ো নন। রুগ্ন নন। একদম তরতাজা যুবক। কোথায় গেল তার হাঁটুর ব্যথা। এখন তিনি আর জরাগ্রস্ত নন। পিছনে পিছনে তারাপদবাবু। অনেক কটি সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে। এ মাথা থেকে ও মাথা খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে লাগলেন। নিচের দিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে কার্নিশ প্রান্তে দেখলেন ফুলের মতো তিতলি ফুলেদের সাথে খেলা করছে। তিতলিকে পেয়ে জাপটে ধরে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিতে লাগলেন।
-তুইই আমার শেষ বেলার সাথী। আমার নয়নের মণি। বেঁচে থাকার প্রেরণা। তোকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না।
পিছনে পিছনে তারাপদবাবু। এই দৃশ্য দেখে আনন্দিত হলেন।
জরাগ্রস্থ নির্মলবাবুর চোখে মুখে তারুণ্যের ছাপ। যেন তার বয়স অনেক কমে গেছে।
দারুন লিখেছেন অসাধারণ
আপনার মন্তব্যে ও মুগ্ধতায় আমার লেখনী সার্থক হলো
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানাই
Khub sundor likhechen
অজস্র ধন্যবাদ প্রিয় কবি