এই মেঘ, এই রোদ্দুর
-সুনির্মল বসু
তিনি এইসবে ক্লাস টুয়েলভে নাটক পড়িয়ে এলেন, সবে এসে স্টাফ রুমে বসেছেন, তখন ছাত্রটি এলো,
আমাকে বাংলা পড়াবেন, স্যার?
-কোথায় বাড়ি?
-পাশেই আদর্শ পল্লী,
-ছুটির পর নিয়ে যেয়ো।
এই স্কুলে শুধু নয়, এই অঞ্চলে শিক্ষক হিসেবে অবিনাশবাবুর খুব নামডাক।একসময় তিনি এখানকারই ছাত্র ছিলেন। ভালো পড়ান, ভালো বলেন, ভালো লেখেন। কাগজে লেখা ছাপা হয়।
ছুটির পর তিনি দেখলেন, সেই ছাত্রটি বাইরে তার জন্য অপেক্ষায়। তিনি পড়ান অনেক, তবু, আরো পড়াতে চান। ভেবেছেন, সাহিত্যটাকে ভালোবাসতে শেখাবেন সবাইকে।
ও বাড়িতে যেতেই, ছাত্রের মা এগিয়ে এলেন,
আসুন স্যার, আপনার নাম শুনি খুব, আপনি পড়ালে, নিশ্চিন্ত হতে পারি। কাগজে আপনার লেখা পড়েছি,
অবিনাশবাবু কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারছেন না, তিনি ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতে পারছেন না।
-আপনার জন্য চা আনছি। তিনি রান্নাঘরে গেলেন।
অবিনাশবাবু ততক্ষণে অতীতে ফিরে গেছেন। বর্ষা কাল। প্রবল বৃষ্টিতে জল থৈ থৈ। পাশের গার্লস স্কুলের মেয়েরা নীল শাড়ি পরে স্কুলে যাচ্ছিল। সমীর বললো, জল ছেটাতে পারবি?
অতি উৎসাহে সেদিনের ক্লাস টেনের অবিনাশ জল ছিটিয়েছিল, যা একটি মেয়ের শাড়িতে লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি স্কুলের হেড মাষ্টারের ঘরে।
অসিত চ্যাটার্জী কড়া মানুষ। এক সপ্তাহ সাসপেন্ড,গারজিয়ান কল।
আজ এত বছর বাদে, সেখানেই পড়াতে আসা।
তিনি চা মিষ্টি দিলেন, তাঁর কবিতা ভদ্রমহিলা নিয়মিত পড়েন, ভালো লাগে, জানালেন।
অবিনাশবাবুর মনে হলো, অতীতের ছোট ছোট চুল কাটা অবিনাশের সঙ্গে উনি বর্তমানের অবিনাশকে মেলাতে পারেন নি। তিনি শিক্ষক অবিনাশে মুগ্ধ।
সুমিতকে পড়াচ্ছেন মাস তিনেক হলো।
পড়ার পর কবিতা নিয়ে কথা হয়, ভদ্রমহিলা সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতার ভক্ত। বুদ্ধদেব গুহ তাঁর প্রিয় লেখক।
বেশ আলাপী, পড়াশুনা আছে ওনার। অবিনাশবাবু রোজ ভাবেন, আজই বলবেন, বলা হয়না।
অবশেষে একদিন বলেই ফেললেন, জানেন, আপনার জন্য আমি একদিন হেডস্যারের কাছে শাস্তি পেয়েছিলাম।
-কি ব্যাপার বলুন তো? ভদ্রমহিলা বেমালুম ভুলে গেছেন, অথচ, অবিনাশ বাবু এতটুকু ভোলেন নি।
অবিনাশবাবু ঘটনাটা বললেন, ভদ্রমহিলা হো হো করে হেসে উঠলেন।
সেদিন ওভাবে পাগলের মতো আপনাদের স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের কাছে নালিশ করাটা আমার একেবারেই উচিত হয় নি। সত্যি কি ছেলেমানুষ ছিলাম, তখন আমরা।
যাক, এতদিনের জমে থাকা মেঘ সরে গেছে, আকাশে এত আলো, এত রোদ্দুর।
সুমিতকে ভালো করে সাহিত্য পড়াতে হবে, সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে, সবার মধ্যে, অবিনাশ বাবু ভাবলেন। আর কোনো উদ্বেগ নেই, খোলা আকাশ আর আলোর নীচে অবিনাশবাবু হেঁটে চললেন।
ভদ্রমহিলার কথা কানে বাজছিল,
সত্যি কি ছেলেমানুষ ছিলাম তখন আমরা।