অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
বিপত্তির ভ্রমণ
– প্রদীপ দে
শরীর আর মন দুই চাইছে এবার বেড়িয়ে পড়ি।
আর বলবেন না ঘরে বসে বসে একেবার বোর হয়ে গেছি। একটা গোপন সূত্রে খবর পেয়েই অনলাইনে ফ্লাইটের টিকিট বুক করে নিলাম। আর পারা যাচ্ছে না। এখন আশে পাশেও যেতে অনেক ঝামেলা, এই করোনাকালীন সময়ে। যাক টিকিট বুক হয়ে গেছে, গোছগাছ করে বেড়িয়ে পড়লাম, একেবারে ক্যাবে সোজা এয়ারপোর্ট।
সেই ঝামেলা আর ঝামেলা। ঝামেলার শেষ নেই। গেটেই আটকে দিল। দেখাও ভাক্সিনাইজেশন সার্টিফিকেট না হলে যাও টেস্টে। আমিও কম যাই না তৈরি ছিলাম। মোবাইলে ডাউনলোড করা মোদীর ছবি লাগানো সার্টিফিকেট দেখিয়ে দিলাম।
সুন্দরী যুবতী আমাকে হেসে জানালো, —
— বাব্বা আপনি কি স্মার্ট! এই বয়সেও?
আমিও হেসে ওয়েলকাম জানালাম।পিছনে ঘুরে যে আরো একবার ওই মহিলাটিকে দেখবো সে সুযোগ আর নিলাম না স্বেচ্ছায়, কারণ যম আছে পিছে –
মানে আমার সহধর্মিনী!
যথাসময়ে প্লেন ছেড়ে দিল । হু হু করে ছুটে-মুটে আকাশ ছুঁলো। আমরা তো আকশেই যাচ্ছি বেড়াতে। কোথায় জানেন? জানেন না? ও সেটাই তো লিখিনি।
সেটা হল স্বর্গপুর!
তেরো ঘন্টা উনপঞ্চাশ মিনিট আটান্ন সেকেন্ডে আমাদের বিমান স্বর্গের পাথর ছুঁলো। সহধর্মিনী নেমেই পাথর ছুঁয়ে চারদিক ঘুরেফিরে নমস্কার সারতেই ব্যস্ত। আমি চারিধারের প্রকৃতির রূপালী ঝলমলে ঝলকানি মুগ্ধ নয়নে উপলব্ধি করে যাচ্ছি।
এয়ারপোর্টের বাইরেই ফুলে মোড়া ক্যাব দাঁড়িয়ে ছিল ইশারায় ডাকতেই উঠে পড়লাম।
পাক্কা ড্রাইভার খাসা রাষ্ট্রীয় ভাষায় পুছলো — কিধার যায়েঙ্গে?
আমি দাঁত বার করে জানালাম, — ইন্দ্রপুরী —
বাঁ হাতে বেশ জোরে চিমটি খেলাম, সন্দেহ হতেই পিছন ফিরে দেখি সহধর্মিনী কটকট করে আমার দিকে চেয়ে,–
— এখানে এক্কেবারে ভদ্র সেজে থাকবে বলে রাখলুম।
ইচ্ছা ছিল প্রথমেই ইন্দ্রপুরীতে গিয়ে মেনকা অপ্সরার নাচ দেখবো। ভয়ে বাতিল করতেই হলো।
ওই চেঁচালো, — ভোলাপিতা কি পাশ লে চলো।
— ঠিক হ্যায় ভাতিজি — চলিয়ে …
আমি অবাক হয়ে ওর ভাতিজি কথা মানে খুঁজছি। ও বোধহয় বুঝতে পেরেছে। জানালো, —
— ইধার একভি মাইজি হ্যায় -একইভি!
মালুম হয়ে চুপসে গেলাম। কি শৃঙ্খলা !
হিমালয়ের সিড়ির মুখে গিয়ে ক্যাব ক্যাচ-ক্যাচ করে আওয়াজ তুলে থামলে দক্ষিনা গুনে গুনে দিতে হল।
উপড়ে তাকিয়ে দেখি সিঁড়ি খাঁড়া চলে গেছে স্বর্গ ছাড়িয়ে। কি তার জৌলুস! আর নিচে তাকিয়ে দেখি মর্ত অন্ধকারে……।
চারিধার শৈল্পিক শুভ্রতা মুড়ে দিয়েছে একাধারে।
অনন্ত আলোয় ভরা চতুর্মাত্রিক। তবুও আমি অন্য কিছু চাইছিলাম। সহধর্মিণী হাত ধরে টান দিয়ে সিঁড়িতে চড়িয়ে ছাড়লো।
উঠছি আর উঠছি। যেন তার শেষ নাই। আমার দম শেষ। ওর মানে সহধর্মিণীর পুরো ভরাট।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওং বং শব্দ ভেসে এল। নন্দী ভৃঙ্গি গেটে আটকালো। পুরো সংস্কৃত ভাষা আওড়ে দিল। কিছুই মালুম হলো না। হাঁ- হয়ে দুজনায় মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
সহধর্মিণী মুখ ভেঙচালো — খুব যে বড়াই করো পুরোনো দিনের ছাত্র -কত ভাল শিক্ষা তোমার — আর সংস্কৃত ভাষা জানো না ?
না পারলাম না কিচ্ছু।’ ভবন্তু ‘ নামক একটি শব্দই কানে এসেছে মাত্র। সহধর্মিনী একেবারে পাক্কা।
ঠিক আকার ইঙ্গিতে কি সব বোঝালো। আর ওরাই আমাদের একজন দোভাষী দিয়ে দিল -কিন্তু ভালো দাম মানে দক্ষিণা দেওয়ার শর্তে। বুঝলাম এটা এই চালাকগুলোর চালাকি!
দুনম্বরি আয়ের পাক্কা ব্যবস্থা আর কি!
আমাদের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দিল।
সুন্দর পরিবেশ কিন্তু বাসস্থান একেবারে অপরিচ্ছন্ন নটগট!
ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম মাইজি মানে মা দূর্গা
দশ হাত বার করে নিজের গা থেকে ময়লা বার করছে।
দোভাষী বললে মা এখন খুবই রেগে আছেন। আর রেগে গেলেই উনি দশ হাত বার করেন। না হলে দুহাতেই কাজ চালান।
আমরা এখনকার রাগের কারণ জানতে চাইলাম।
— গনেশের ইচ্ছা হয়েছে মোবাইল কিনবে। শুনেছে ভারতে ডিজিটাল ইন্ডিয়া চালু হয়েছে। পুজোয় যাওয়ার আগেই মোবাইল শিখে নিতে চায়। তাহলে গিয়ে অনেক সুবিধা পাবে। টাকা পয়সার লেনদেন করতে সুবিধা অনেক। আর থলে বইতে হবে না। কার্ত্তিক মোবাইল কিনে ফেলেছে -ওর ধান্দা খারাপ।
হয়েছে কি গনেশের চার হাত। আর চার হাতেই অস্ত্র আর চার হাতে কাজ লেগেই থাকে, তাই মায়ের কাছে কেঁদে অস্থির…।
মা ভেবে চিন্তে আরো একটি হাত বানাচ্ছেন। পঞ্চম হাতেই মোবাইল ধরবেন পুত্র গনশা বাবাজীবন।
কিন্তু মায়ের গায়ে তো এখন আর তেমন ময়লাই জমে না যে — এখন সব শ্যাম্পুর যুগ না? ময়লা সব ধুয়ে জলে গলে যায় যে! মায়ের তাই দশ হাত থেকে যদি কিছু বের হয় তারই আপ্রান এই প্রয়াস!
দোভাষী আমাদের সরিয়ে নিলো। আমরা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে উনি জানালেন সংস্কৃত ভাষা জেনে আসতে হবে। বুঝলাম সব চালাকি!
বাবা ভোলা অন্তর প্রান সহধর্মিণীর। দোভাষী কে পেড়াপিড়ি করলো। কাজ হলো মহিলার কথায়। সবাই ওকে যাও পাত্তা দিচ্ছে আমাকে চেয়েও দেখছে না কেউ।
মেঘের এক পাহাড়ের আড়াল থেকে দেখে অবাক।
ইনি শিব বাবা? কি দশা? হাড় লিকলিকে চেহারা? সব্বাই যে বলে শিব বিশাল মোটাসোটা ভগবান? ধুৎ! কিচ্ছু না।
সহধর্মিনী চোখের জল আঁচলে মুছে নিল। ব্যাটার ছেলে দোভাষী ঠিক বুঝে গেছে, বললে, —
— মা ঠাকুরণ ওনাকে টাইট মেরে দিয়েছেন। গাঁজা খাওয়ার পর দুধ বন্ধ করে দিয়েছেন। গাঁজা সেবনের পর দুধ না পেলে শরীর ক্ষয়ে যায়! মা চান ওনার স্লিম ফিগার।
মনে কষ্ট নিয়েই নামছি সিঁড়ি বেয়ে, পিছন থেকে গুরুগম্ভীর আওয়াজ এলো — হুং বুং চং —
সঙ্গে সংস্কৃত শ্লোক।
দোভাষীর চোখের দিকে তাকাচ্ছি দেখি সামনে মহাদেব ত্রিশুল হাতে দন্ডায়মান। ভয়ে পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়। উনি নানান কথা বললেন, তার কিছুই বুঝলাম না। সহধর্মিনী ওনার পায়ে লুটিয়ে পড়লো।
দোভাষী জানালো উনি আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। আর জানতে চাইছেন আমরা কি বর চাই।
সুযোগ কাজে লাগালাম। দোভাষীকে বললাম ,–
— ইন্দ্রের সভায় অপ্সরা মেনকা উর্বশী দের চকচকে উঠতি নাচ দেখতে চাই।
মহাদেব কিছু বুঝলে না। দোভাষী অং বং কি সব বলতেই উনি ত্রিশূল ফেলে দিয়ে দুহাত তুলে জানালে —
— তথাস্তু!
এটা একেবারে বোঝা গেল!
সহধর্মিণী তো রেগে লাল। এদিকে ত্রিশূল পড়ে যাওয়ায় মা দৌড়ে চলে এলেন আর কি সব বলতে থাকলেন।
দোভাষীও কিসব বললে বঝালো মাকে। মা কিছুটা শান্ত হলেন।
দোভাষী মারফত জানলাম মা কলকাতার করোনা পরিস্থিতি শেষ আপডেট জানতে চাইছেন।
আমরা দুজনে গদগদ কন্ঠে দোভাষীর মারফত সব নিবেদন করলে, মা শেষ অস্ত্রেই আমাদের ঘায়েল করে ছাড়লেন, আমরা কি ওনাদের জন্য ভ্যাক্সিন স্বর্গে পাঠিয়ছি?
নচেৎ মায়ের আসা যে অনিশ্চিত এবং ভীতির কারণ হয়ে যাবে- তাঁর পরিবারের কাছে।