অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
ধৃতরাষ্ট্রের গল্প
-সুনির্মল বসু
প্রায় প্রতিদিন এই সময়ে অর্থাৎ সন্ধ্যার অন্ধকার মাটির পৃথিবী কে স্পর্শ করবার আগেই সূর্যকান্ত বাবু বাড়িতে ফিরে আসেন। আজ বছর সাতেক হল, তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন।
কর্মজীবনে একটা বেসরকারি কারখানার কনিষ্ঠ কেরানি ছিলেন তিনি। এতোকাল অনেক কষ্টের মধ্যেই এত বড় সংসারটা চালিয়ে এসেছেন। তখন তাঁর সামান্য হাতেগোনা আয়। এরইমধ্যে বড় ছেলে শুভব্রতকে এম কম পর্যন্ত পড়িয়েছেন। মেজো ছেলে সুব্রত বিএসসি পর্যন্ত পড়েছে।ছোট ছেলে সুদীপ্ত হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত পড়ে পড়াশুনা ইস্তফা দিয়ে ইদানিং নাট্যচর্চা ও অভিনয়ে মেতে উঠেছে।
শুভব্রত এখন একটা ব্যাংকে ম্যানেজার হয়েছে। সুব্রত চাকরি করছে রাজ্যের সেচ দপ্তরে। একমাত্র মেয়ে তিতলির বিয়ে হয়েছে একজন স্কুল শিক্ষকের
সঙ্গে। এখন সূর্যকান্ত বাবুর যা কিছু চিন্তা, তা ঐ ছোট ছেলে সুদীপ্তকে নিয়েই। সুদীপ্ত আজ পর্যন্ত একটা চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। ছোট ছেলে সুদীপ্তকে নিয়ে ভাবনাটা প্রায় দিন রাতেই তাকে যেন কুরে কুরে খায়। গিন্নী মনীষা দেবী আজ প্রায় দশ বছর হল গত হয়েছেন। তা না হলে, ওরা দুজনেই এই দুশ্চিন্তার অংশীদার হতে পারতেন। তা যখন হবার নয়, তখন এই ভাবনা এখন সূর্যকান্ত বাবুর একার উপরেই ন্যস্ত।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই তিনি সামনের হাতল ভাঙ্গা চেয়ারটিতে বসে পড়লেন। এখন সন্ধ্যের গাঢ় অন্ধকার ঘরে বাইরে জায়গা বিছিয়েছে। আজকাল চোখে ভালো দেখতে পান না তিনি। আই স্পেশালিস্ট তাকে পরামর্শ দিয়েছেন, চশমার পাওয়ারটা বেশ খানিকটা বাড়ানো দরকার। তিনি বড় বউ অনামিকা এবং মেজ ছেলে সুব্রতকে সে কথা জানিয়েও ছিলেন।কিন্তু ওরা মুখের ওপর নেতিবাচক উত্তর না করলেও, এক ধরনের পাশ কাটানো ভাব দেখিয়ে সরে গেছে। আর,বড় ছেলে শুভব্রত অফিস নিয়ে এতই ব্যস্ত যে, রাতে বাড়ি ফিরলে তার সঙ্গে কথা বলা একটা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আজকাল চোখের জন্য বড্ড কষ্ট পাচ্ছেন সূর্যকান্তবাবু। তাই যেখানেই যান , সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসবার চেষ্টা করেন। তাদের এই সার্পেন্টাইন লেনের এই গলিটায় সবসময়ই ব্যস্ততম গাড়ির যাতায়াত। তাই সূর্যকান্ত বাবুর মাঝে মাঝে ভয় হয়, একে চোখে ভালো দেখতে পান না, এভাবেই কোনদিন গাড়ির তলায় বেঘোরে প্রাণ টা আবার যাবে নাতো। তবু কি আর করা যাবে। ইদানিং সূর্যকান্ত বাবু বেশ বুঝতে পারছেন, এ সংসারের পক্ষে তিনি এক প্রয়োজন শূণ্য বাতিল মানুষ। যে সংসারের জন্য তিনি আর মনীষা দেবী
একদিন জীবনপাত করেছিলেন, সেই সংসারে কেউ আর তাঁকে চায়না।
এই কথাটা মনে আসতেই, সূর্যকান্ত বাবু অতীত চারী হলেন।তখন কারখানায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর, প্রতিদিন সংসারটা ভালো চলবে ,ছেলেমেয়েকে বড় করতে হবে, মানুষ করতে হবে ,এই ভেবে দু বাড়ি টিউশনি করে রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরতেন। মনীষা দেবী অনুযোগ করতেন, তুমি যে এমন করে খাটাখাটুনি করছো, তোমার যদি একবার শরীরটা ভেঙে পড়ে তখন কি হবে,
সূর্যকান্ত বাবু তখন বলতেন, দাঁড়াও, আমার শুভ সুব্রত একবার মানুষ হোক, তখন আমাদের আর কষ্ট কি,
আজ বিজ্ঞাপনে দেখা সুখী পরিবারের মতো তাঁর সাজানো সংসার। মনীষাদেবী মারা গেলেন। ঘরে দুটি নতুন বৌ এলো। বড় বউ অনামিকা, আর মেজ বউ ঝুমুর।
এরপর থেকেই ছেলে দুটির সঙ্গে যেন তাঁর এক অদৃশ্য দেয়াল রচিত হয়ে গেছে। ছোট ছেলে সুদীপ্ত বেকার। তাই হয়তো মাঝে-মাঝে বাপের একটু আধটু খবর নেয়।
সূর্যকান্ত বাবু ভাবেন, আজকাল সকালের চা জলখাবার পেতে পেতে তাঁর সকাল সাড়ে দশটা বেজে যায়। চাকরি জীবনে তাঁর অফিসের বেহারা হরিপদ তাঁকে ঠিক দুপুর তিনটের মধ্যে টেবিলে চা দিয়ে যেত। ছুটির দিনে মনীষাও এ কাজে কখনো ভুল করেনি।আর এখন সন্ধ্যে প্রায় সাড়ে সাতটা। চা খাওয়ার কথাটা, একবারও কেউ জিজ্ঞাসা করতে এলো না। ছেলে বউরা এখন টিভি দেখায় ব্যস্ত। তাই সংসারের এই অপ্রয়োজনীয় বুড়ো মানুষটার কথা হয়তো কারো মনে নেই। আগে আগে এসব ঘটনায় তিনি কষ্ট পেতেন। এখন আর বড় একটা মনে করেন না। মনে করলে, বাঁচা যায় না।মনে মনে ভাবেন, যে কদিন আছি ,যেমন তেমন করে কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো, ওরা ভাল থাক, ওরা সুখে থাক, তাহলেই তাঁর সুখ। শুধু ছোট ছেলে সুদীপ্তর একটা চাকরি বাকরি হয়ে গেলে, তিনি নিশ্চিন্তে মরতে পারেন।
অবশেষে সূর্যকান্ত বাবু ভাবলেন,আজ শুভ আর সুব্রত কে একটু সুদীপ্তটাকে কোথাও কোনো কাজে কাজে ঢুকিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করতে বলবেন।
সূর্যকান্ত বাবুর ভাবনার মাঝখানে হঠাৎ ছেদ পড়ল। মেজ বউ ঝুমুর তাঁর ঘরে ঢুকে বেশ ঝাঁঝিয়ে বলল,
আপনাকে কতদিন বলেছি, বিকেলে বেড়াতে যাবার সময় থলেটা নিয়ে কিছু বাজার করে আনবেন।জানেন, আপনার ছেলেরা দারুণ ব্যস্ত ,আর আপনার ছোট ছেলে তো নাটক করে শিশির ভাদুড়ী, নাকি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় হতে চলেছে।
সূর্যকান্ত বাবু আমতা আমতা করে বললেন, গতকাল সকালে যে বাজার করে আনলুম।
ঝুমুর বলল, ওই বাজারে কি রাবণের গুষ্ঠির খাওয়া হয়।
সূর্যকান্ত বাবু আর কথা বাড়ান নি।
খানিক বাদেই সুদীপ্ত ঘরে ফিরল। বলল, ঠিক আছো তো বাবা,
কোথায় থাকিস আজকাল, কি করিস,
নাটক নিয়ে মেতে আছি বাবা,
কোন্ বই করবি তোরা,
মাইথোলজিক্যাল নাটক,
এরপর খানিকটা আবেগের সঙ্গে সুদীপ্ত বলে, জানো বাবা, আমি ধৃতরাষ্ট্রের রোলটা করছি, ডাইরেক্টর জহর দা বলেছেন, আমাকে নাকি এই রোলটায় ভালো মানাবে।
সূর্যকান্ত বাবু নীরব থাকেন।
খানিকবাদে তিনি গুটিগুটি পায়ে বড় ছেলে শুভব্রতর র ঘরে গেলেন। এই ঘরটা বড় সৌখিন করে সাজানো। ভাবলেন, বড় বৌমা অনামিকার রুচি আছে। বড় বাড়ির মেয়ে তো। সূর্যকান্তের মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। সত্যি, আজ কতদিন বাদে বড় ছেলের এত কাছাকাছি এলেন তিনি।
তাঁর মনে পড়ল,একবার ছোটবেলায় শুভ বাজার থেকে নতুন কেনা গামছাটা বাপের কোলে চড়ে আসবার সময় রেললাইনে ধারে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছিল। পরে সূর্যকান্ত আর তা ফিরে পাননি।
বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখে, শুভব্রত ইঙ্গিত পূর্ণ দৃষ্টিতে স্ত্রী অনামিকার দিকে তাকালো।
সূর্যকান্ত বাবু বললেন, দ্যাখ্ শুভ, অনেকদিন ধরে তোকে একটা কথা বলবো মনে করছি।সুদীপ্তর তো পড়াশোনা হল না, তাই যদি তুই তোর অফিসে ওকে একটু চেষ্টা চরিত্র করে ঢুকিয়ে দিতিস্।
শুভব্রত একথা শুনে তেতে উঠলো। বলল, চাকরি কি ছেলের হাতের মোয়া,তাছাড়া থার্ড ডিভিশন এর হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করা ছেলের এখন বেয়ারার চাকরি পাওয়াটাও সহজ ব্যাপার
নয়। আমি কি করতে পারি।
সূর্যকান্ত বাবুর নিজের ঘরে ফিরে এলেন।
পরদিন সকালে সুদীপ্ত এসে বলল, জানো বাবা, এবার আমরা লখনৌতে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় কমপিট করতে যাচ্ছি।
সে বুঝলাম, কিন্তু একটা চাকরি বাকরি যোগাড় কর, ভবিষ্যতে কি করে খাবি তুই,
দ্যাখো না, নাটক নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে কি করি,
সূর্যকান্ত বাবু ছোট ছেলেকে নিয়ে চিন্তা মুক্ত হতে পারছেন না।
সেদিন সন্ধ্যায় তিনি মেজো ছেলে সুব্রতর ঘরে গেলেন। সুদীপ্তর চাকরির ব্যাপারে কিছু করা যায় কিনা। সুব্রত বলল, আমি যেখানে বড় পোস্টে চাকরি করি,সেখানে ওকে ফোর্থ ক্লাস স্টাফ হিসেবে বসাই কি করে, তুমি এমন অবান্তর কথা বলো না।
মেজ বউ ঝুমুর বলল, এই সবে কাজ থেকে ফিরল, সারাদিন পর খেটেখুটে এসেছে, আপনি এখন ওকে এসব না বললেই পারতেন।
সূর্যকান্ত বাবু বেরিয়ে এলেন। নিজের বোকামির জন্য, তিনি যেন নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না।
সংসারের কাজ তিনিও তো কম করেন না। শুভব্রত ছেলে, তাঁর নাতি বুম্বা আর সুব্রতর মেয়ে টুকুনকে স্কুলে দিতে ও আনতে যান। বাজার করেন। বয়সের কারণে যদি ভুলেও যান, মনে করিয়ে দিলে, তা এনে দিয়ে থাকেন।
আসলে, সূর্যকান্ত বাবু সম্প্রতি বড় বেশি টের পাচ্ছেন, তার অস্তিত্ব টাকে ছেলে, ছেলে বউরা আর মোটেই স্বীকার করতে চাইছে না। এ সংসারে তিনি এখন যেন ডানা ভাঙ্গা জটায়ু।
সূর্যকান্ত বাবু এখন নিজের ঘরে ফিরে আসেন।বাইরে সুদীপ্তদের নাটকের ক্লাব থেকে সুদীপ্তর জোরালো অভিনয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সুদীপ্ত এখন ধৃতরাষ্ট্রের সংলাপ আওড়াচ্ছে।
অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বলছেন, যখন অধর্মের স্রোতে মেতেছে কুরু পুত্রগণ, তখন ধর্মের সাথে সন্ধি করা মিছে, পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।
ডাইরেক্টর জহর মুখুজ্জে বললেন, ভালো হচ্ছে সুদীপ্ত, তুই শুধু একটু আপে তুলে বলে যা।
সুদীপ্ত আবার বলে চলে।
সূর্যকান্ত বাবু ভাবেন, সুদীপ্ত এখন কোন্ ধৃতরাষ্ট্রের কথা বলছে, তারপর সহসাই সূর্যকান্ত বাবুর মনে হয়, তিনিও সার্পেন্টাইন লেনের এক অন্ধ ক্ষমতাহীন ধৃতরাষ্ট্র। আজ তামাম কলকাতা, তথা তামাম পশ্চিম বাংলা, এমনকি সারা ভারত নাকি সারা পৃথিবী জুড়ে ধৃতরাষ্ট্রের সংখ্যা কেবল বেড়ে চলেছে।
একদিন বহু আশায় বহুকষ্টে বহু রক্তের বিনিময়ে তারা যাদের বড় করে পালন পোষণ করে এসেছেন, যাদের জন্য স্বপ্ন বয়ে বেড়িয়েছেন সারা জীবন,আজ তারাই তাঁকে বাতিল বলে উপেক্ষার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
নাতি বুম্বা সহসা ডাকলো, দাদু, খেতে এসো। মা খেতে ডাকছে।
সূর্যকান্ত কেমন যেন ঘোরের মধ্যে অসংলগ্ন ভাবে মনে মনে বলে উঠলেন, আমি একালের ধৃতরাষ্ট্র। তাই দুর্যোধনদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতে পারিনা।
সেই রাতে সংসারের এই বাতিল মানুষটি কখন যেন গভীর রাতে অন্য লোকে পাড়ি জমালেন।