লক ডাউনের ফাঁদে
-সুমিতা বেরা
কলকাতার সবচেয়ে নামি বেশ্যালয় সোনাগাছি এখন শুনশান! অথচ আগে সন্ধ্যে হতেই সোনাগাছি সেজে হয়ে উঠতো তিলোত্তমা..
জানলায় কে যেন ঠকঠক করে মিহি আওয়াজ করলো! মাধবী আধো ঘুমে আধো ঘুমে ছিল.. তাই অস্পষ্ট শুনলো! কাল ছেলেটা সারারাত কেঁদেছে.. কি যে হয়েছে?
গায়ে তেমন জ্বর নেই, পেট ব্যথা নাকি খিদের জ্বালা মাধবী বুঝতেই পারছে না! কাউকে যে ডাকবে..তারও উপায় নেই..এখন লক ডাউন চলছে। কলকাতার সবচেয়ে নামকরা সেরা যৌনপল্লী সোনাগাছি এখন শুনশান! কোথাও কোনো আওয়াজ নেই..! হাসাহাসি নেই, ঢলাঢলি নেই, খিস্তি খেউর নেই…আশেপাশের সব মদের দোকান বন্ধ! ফুল দিয়ে যায় যে ছেলেটা.. সেও আর আসছে না। সোনাগাছিতে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা! সোনাগাছির মাসি কড়া করে সবাইকে শুনিয়ে গেছে- শোনো সবাই, দূর্বার মহিলা সমিতির থেকে নোটিস দিয়ে গেছে।ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, কেউ কারোর ঘরে যাবে না। ঘরে খদ্দের ঢোকাবে না। যেখানে সেখানে থুতু, পানের পিক ফেলবে না, যে যার ঘরে থাকবে। পরিষ্কার পরিছন্ন থাকতে হবে মুখে মাস্ক লাগাতে হবে। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। ডেটল ব্যবহার করবে। আরও কতো কতো…
ঠক..ঠক.. আবার জানলায় কে যেন আওয়াজ করছে! আর চাপা স্বরে ডাকছে-মাধবী.. এই মাধবী.. ঘর অন্ধকার! এখনো ভোরের আলো স্পষ্ট হয়নি…. মাধবী চৌকি থেকে নামতে গিয়ে বুঝলো ওর মাথা টলছে। দুদিন ধরে শুধু জলমুড়ি খেয়ে আছে সে, ছেলেটা সারা রাত কেঁদেছে, মাধবীর ঘুম হয়নি, অবসন্ন শরীর….মাধবী জানলার সামনে গিয়ে আস্তে করে জানলাটা খুলতেই দেখে- আধো অন্ধকারে মুখে মাস্ক লাগিয়ে টগর দাঁড়িয়ে.. কিরে টগরী তুই? এখন!
টগর ফিসফিস করে বললো- কি করবো! এখনো কেউ ওঠেনি ..তাই চুপিচুপি তোর কাছে এলাম..হ্যাঁ রে ছেলেটা খুব কাঁদছিলো রাতে তাই না? কি করবে বেচারা! খিদের জ্বালায়….আচ্ছা শোন এই লাউটা রাখ, আমার ঘরের ছাদ মাচায় হয়েছিলো, তুলে আনলাম। বলে টগর জানলার ছেঁড়া জালের ফাঁক দিয়ে লাউটা ঢুকিয়ে দিলো। কি রে ধর- টগরী চাপা স্বরে বললো। মাধবীও চাপা স্বরে জিগ্যেস করলো-কিন্তু তোর? আমার কালকের খানিকটা আছে, দুদিন চলে যাবে ‘খন। তারপর আরও চাপা স্বরে বললো-আমি যাই বুঝলি.. কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে…ও.. হ্যাঁ ভালো কথা অজিত বাবুকে ফোন করেছিলি?
মাধবী আস্তে করে বললো-না। টগরী চাপা ক্ষোভে ফেটে পড়লো- তা কেন করবি পোড়ারমুখী? ঘরে একদানা চাল নাই.. ছেলের দুধ নাই.. তাও ঘামন্ডি যায় না হতচ্ছাড়ি মাগির…বলতে বলতে টগরী আধো অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। মাধবী জানলাটা বন্ধ করে লাউটা ঘরের একপাশে রেখে ঘুমন্ত ছেলের পাশে এসে বসলো। অনেক কেঁদে শেষ রাতে ঘুমিয়েছে ছেলেটা। ঘুমোক, এই ফাঁকে স্নান পুজোটা সেরে নি। কিন্তু শরীর যেন বয় না..না খাওয়া অবসন্ন শরীর মাধবীলতার…. কিন্তু উপায় নেই, সদ্য ভোর হয়েছে.. এখনো সবাই ঘুমোচ্ছে। এই ফাঁকে প্রাতঃকাজ সেরে ফেলা ভালো।
মাধবী ভাবলো- সত্যি এখন কারোর যেনও কোনো তাড়া নেই! এখন এখানে সকাল সন্ধ্যে রাত একই রকম! অথচ এই সোনাগাছি আগে সন্ধ্যে হলেই তিলোত্তমা হয়ে উঠতো! গন্ধরাজ, গোলাপ, বেল ফুলের গন্ধে.. সূরার আমেজে! নাচ গান, হারমোনিয়াম, নুপুর ছন্দে! পানের পিকে সারারাত চলতো শরীরী খেলা..ঘন্টা হিসেবে ফূর্তি, চলতো শুধু দেহের কেনাবেচা। নানান ধরণের খদ্দের, দালালের আনাগোনা! রঙিন ঠোঁট, গালে চড়া রঙ আর পাতলা রংবাহারি শাড়ি পড়া মেয়েদের মনমোহিনী লাস্যময়ী মুখ আর মিঠা পান ভর্তি মুখে মাসির সেই ঝমঝমে গলার মিঠা বাজখাঁই গলা.. লক ডাউন-এ এখন সব বন্ধ। এখানে এখন আর কোনো খদ্দের আসে না! ভুখা পেটে রঙ মেখে সোনাগাছির বেশ্যারা ঘুরছে খদ্দের ধরার জন্য! সন্ধ্যে থেকে তারা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে গলিরমুখে….কাউকে দেখলেই ছুটে যায়, বাবু আসুন ..আসুন…যা পয়সা দেবেন তাই নেবো। যতক্ষণ বলবেন ততক্ষণ দেবো। শুধু একবার আসুন। কিন্তু কোনো খদ্দের আসে না..করোনা ভাইরাসের ভয়ে আসে না। চারিদিকে মুখে মাস্ক লাগিয়ে পুলিশ পাহারা। চারিদিকে শুনশান! কেউ বোঝে না সারা দেশ জুড়ে চলা লক ডাউন-এ যৌনকর্মীদের ব্যবসা লাটে উঠেছে! ওদের পেট চলবে কি করে? ওদের কাছে যে যৌনতা মানে একমুঠো ভাত! লক ডাউন-এ সেই ভাতের আকাল সোনাগাছির চারিদিকে।
নাহ বসে থেকে এসব ভেবে লাভ নেই। মাধবী শীর্ণ শরীরে উঠে পড়লো-মনে পড়লো অল্প কিছু চাল ডাল রয়েছে। আজ একটু ভাত ডাল আর লাউ-এর তরকারি করবে। তরকারির ঝুড়ি খুঁজে খুঁজে কটা আলু আর শুকনো কাঁচা লঙ্কা পেলো-ব্যস ব্যস ওতেই হয়ে যাবে। বড়ো খিদে পেয়েছে যে..
মাধবী ঘুমন্ত ছেলেটার পাশে একটা বালিশ দিয়ে একটা শুকনো নিমডাল মুখে গুঁজে গামছাটা গায়ে ফেলে দরজা খুলে বেরোলো.. একটু দূরে টিউবয়েল, দু’চার জন এসেছে। সবাই ছাড়া ছাড়া দাঁড়িয়ে আছে। একজন জল টিপে টিপে মুখ ধুচ্ছে। বাদ বাকি জন অনেক দূরে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে। দুর্বার মহিলা সমিতি থেকে একটা কাগজ মাসিকে ধরিয়ে দিয়ে গেছে, তাতে নাকি নেখা আছে- কেউ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করবে না জমায়েত হবে না.. কি জানি বাপু .. এমন অভিজ্ঞতা তো আগে কখনো হয়নি! ওকে আসতে দেখে কে যেন একটা কাঁচা খিস্তি মারলো..
মাধবী গায়ে মাখলো না.. এ জায়গায় এসব খিস্তি খেউর রোজকার ব্যাপার..তাছাড়া যেদিন থেকে অজিত বাবু ওর ঘরে আসে আর কারোর ঘরে যায় না! সেদিন থেকে অনেকে ওকে বাঁকা চোখে দেখে। ও খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁতে আপনমনে নিমডাল ঘষতে লাগলো। কল ফাঁকা হলে মুখ ধোবে। ছেলেটাকে একা রেখে এসেছে তাই ওর মন ওদিকে, এমন সময় দেখলো দুর থেকে টগরী আসছে কলের দিকে। ওর হাতে একটা প্লাস্টিকের বালতি, তাতে সার্ফ এর জলে কিছু জামাকাপড় ভেজানো। ততক্ষণে কল ফাঁকা হতে মাধবী কল টিপে টিপে মুখ ধুতে লাগলো। টগরী কলের একটু দূরে বালতিটা রেখে মাধবীকে জিগ্যেস করলো- হ্যাঁ রে ছেলে কেমন আছে রে? ভালো আছে রে, ঘুমোচ্ছে এখন। টগর আবার জিগ্যেস করলো- ছেলের দুধ আছে তো? না রে, বার্লি জ্বাল দিয়ে খাওয়াচ্ছি। দুধ কেনার পয়সা নেই রে! দেখি নিমাই দালালটাকে বলেছি, কিছু পয়সা ধার দিতে, আর না হলে কোনো খদ্দের ধরে আনতে… যদি পয়সা পাই তবে খোকার দুধের প্যাকেট কিনবো। কথাটা শুনেই টগর হিহিহিহি করে হাসতে লাগলো-শালা মাগি, লক ডাউন চলছে জানিস না! রেড জোনে রয়েছে এখন কলকাতার সোনা গাছি এলাকাও!
একটা মাছিও বসবে না লো গতরে.. আর ওই নিমাই দালাল! ওকে বেশি পাত্তা দিসনা বলে দিলাম রে, ও মাস্ক পরে তোর গতর খাবে শালা বলে দিলাম। যা যা ঘরে যা.. লাউ ঝোল করে ভাত খাগা যা। দেখি আমি কিছু করতে পারি নাকি….
মাধবী ঘরে আসতে আসতে ভাবলো- সত্যি এই টগরী! ওপরটা তার যেমন খরখরে ভিতরটা তেমন নরম তুলতুলে..আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। ও যা উপকার করেছে একসময়! কোনোদিন ভুলতে পারবোনা। থাক ওসব পুরোনো দিনের বীভৎস কথা আর মনে আনতে চাই না, ও ঘরের দিকে এগোতে লাগলো।
.
ঘরে এসে দেখলো ছেলে তখনো ঘুমোচ্ছে ও তাড়াতাড়ি স্টোভটা জ্বালিয়ে ভাত বসাতে যাবে, দরজায় খট খট.. এখন ! এখন আবার কে এলো? দরজা খুলতেই দেখে মাসি দাঁড়িয়ে মুখে মাস্ক হাতে গ্লাভস পরে। মাসি তুমি! এসো এসো.. ধুর মাগি… ভুলে গেছিস এখন লক ডাউন চলছে..তোর ছেলের খবর নিতে এলাম- তা কেমন আছে সে? ভালো আছে গো মাসি.. ঘুমোচ্ছে। তারপর একটু সঙ্কুচিত হয়ে মাধবী বললো- মাসি এই মাসে ঘর ভাড়া দিতে দেরি হয়ে যাবে গো..একটাও পয়সা নেই কাছে।
শুনেই তো মাসির চিৎকার- সে তো তোর নিজের দোষে। ঘরে লোক ঢোকাবি না। ওই হতচ্ছাড়া অজিত! কি দেখলি ওর ভিতর! প্রেমে গদগদ হয়ে গেলি? ও রে আমরা হলাম সোনাগাছির বেবুশ্যে, আমাদের প্রেমপিরিতি করতে নাই রে.. নিজের দেহটাকে প্রেম কর.. খদ্দেরের সাথে মিথ্যা প্রেম কর। খদ্দের আমাদের লক্ষী, আমাদের অন্ন। আমাদের বেঁচে থাকার রসদ, তুই হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলিস … তাই তোর কষ্ট বেশি। মিথ্যা নাটুকে- প্রেম ছেড়ে তুই ওই অজিত বাবুর সাথে সত্যি প্রেমে মজেছিস! তোর কপালে কষ্ট আছে রে মাগি। হ্যাঁ রে ও কি তোকে বে করবে? যে তুই ওর প্রেমে ডুবে আছিস? সবাই তো কিছু কিছু পয়সা বেশ্যা সমবায় সমিতি ব্যাংকে জমিয়েছিল তাই দিয়ে কষ্টেসৃষ্ঠে চালাচ্ছে। তুই তো সমবায় সমিতি ব্যাংকে এক পয়সাও জমা দিস না। কই! দরকারে অজিত বাবু খোঁজ নিয়েছে তোর?
তারপর আপন মনেই মাসি বলতে লাগলো-
কি বিপদ হলো রে আমাদের! হায় হায়.. একটা খদ্দেরও আসে না আর সোনাগাছিতে ভয়ে! জানিস তো দূর্বা মহিলা সমিতি থেকে নাকি আমাদের চাল ডাল আলু ত্রাণসামগ্রী দেবে। এখন কবে দেবে খোঁজ নিতে হবে….
যাক গে.. খেয়েছিস কিছু? মাধবী মুখ নিচু করে, মাসি একটা কাগজের ঠোঙা দরজার সামনে নামিয়ে রেখে বললো-নে খা… চারটে মুড়ি লঙ্কা দিয়ে ভেজেছিলাম…কি আর খাবো! তোর জন্য কটা এনেছি, নে.. গরম আছে খেয়ে নে রে… চলি।
মাসিমা মানুষটা ভালো,দরদী.. সব মেয়েদের খুব খেয়াল করে। মাধবী গরম মুড়িগুলো খেতে খেতে ভাবলো, না এই ভাবে আর চলছে না ! অজিত বাবু একটা ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল-খুব দরকার পড়লে ফোন কোরো …এতদিন দরকার পড়েনি। উনি আসতেন.. আমার আর ছেলের খেয়াল রাখতেন। কিন্তু এখন লক ডাউন চলছে তাই আসা বন্ধ হয়ে গেছে, কোনো যোগাযোগও নেই! কেমন আছেন? কিভাবে আছেন? কিছুই জানা যাচ্ছে না। বলেছিলেন খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোন না করতে, তাই ফোন করবো মনে করেও করা হয়নি কিন্তু আর যে ভালো লাগছে না, কতদিন কতদিন মানুষটাকে দেখিনি !
হ্যাঁ, বয়েসে মাধবীর থেকে অনেকটাই বড়ো অজিত বাবু। কিন্তু শান্ত, ভদ্র পরিচ্ছন্ন বিপত্নীক মানুষটাকে প্রথম দিন দেখেই কেন জানি না ওর ভালো লেগেছিলো। অন্য খদ্দেরদের মতো ঘন্টা হিসাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। ফেলো কড়ি ষ মাখো তেল-এ বিশ্বাস করে না। মনে আছে প্রথম দিন যখন এলো তখন ঘরে ঢুকেই আমার একটি অল্প বয়েসি বাঁধানো ছবির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল।
তারপর জিগ্যেস করেছিলো- আপনার ছবি? বলেছিলাম-হ্যাঁ, তারপর আর কিছুই জিগ্যেস করেনি। বিছানায় বসে অনেকক্ষণ আমার হাতদুটো ধরে মুখের দিকে চেয়ে বসেছিল। আমার মন উসখুস করছিলো, সময় চলে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ বললো- একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ বাইরে থেকে আসছে! বলেছিলাম- হ্যাঁ, আমার ছেলে। মাসির কাছে আছে। শরীরটা ভালো না, তাই বোধ হয়.. উনি আর কিছুই না বলে টাকাটা বিছানায় রেখে বললেন-আজ চলি, কাল আসবো।
সেই শুরু! তারপর থেকে মাঝে মাঝে আসতেন। ব্যবসার জন্য রোজ আসতেন না। ধীরে ধীরে অসম বয়সী দুজনের মনে ভালোবাসার জন্ম হলো। আমার পাপ মাখা শরীরটা প্রেম মাখা হলো.. মনটা ভালোবাসা ভালোলাগায় পরিপূর্ণ হলো। অনেক পরে জানা গেছিলো জন্ম দিতে গিয়ে ওনার স্ত্রী অপারেশন রুমেই বাচ্চা সমেত মারা গেছিলেন, সেই দুঃখ ভুলতেই এক বন্ধুর সাথে প্রথম এসেছিলেন এই সোনাগাছিতে.. বাকিটা ইতিহাস..
মুড়ি খাওয়া হয়ে গেছিলো। মাধবী তাড়াতাড়ি স্টোভ ধরিয়ে সাবু বার্লি পাতলা করে জ্বাল দিয়ে .. হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দিলো.. যা চাল ছিল আজ পর্যন্তই চলবে.. মাধবী মোবাইলটা খুঁজতে লাগলো। ছেলে ঘুম থেকে ওঠার আগেই অজিত বাবুকে একখানা ফোন করতে হবে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা খুঁজে নিয়ে ও বিছানার এককোনে বসলো। অজিত বাবুর নম্বরটা সেভ করাই আছে।
হ্যালো… হ্যালো… হ্যাঁ হ্যাঁ… কে বলছেন? বলুন.. ও প্রান্ত থেকে পুরুষ কণ্ঠস্বর.. এক মুহূর্তের জন্য মাধবীর বুকটা কেঁপে উঠলো.. গলা শুকিয়ে এলো.. অজিত বাবুর গলা.. এই স্বর ভোলার নয়… মাধবী নিজেকে সংযত করলো। আমি মাধবী বলছি- সোনাগাছি থে….কথা শেষ হলো না..ও মাধু! তুমি! অজিত বাবুর গলা দিয়ে উৎকণ্ঠা ঝরছে… হ্যাঁ আমি মাধু, কেমন আছেন? বলছি, তার আগে বলো- তুমি কেমন আছো মাধু? তোমার ছেলে কেমন আছে? তোমার ফোন নম্বর নেই আমার কাছে, তাই ফোন করতে পারি নি, এই রকম পরিস্থিতি হবে কে জানতো! প্রথম দিকে ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ভীষণ পুলিশি কড়াকড়ি.. লাঠির বাড়ি, কোনো দালালও চোখে পড়ে নি.. যার মারফত তোমার খোঁজ নেবো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অজিত বাবু আবার বললেন- আর এখন তো আমার অশৌচ চলছে গো, যেতে পারবো না। অশৌচ? মাধবী চমকে ওঠে!
– হ্যাঁ, দুদিন আগে আমার বাবা মারা গেলেন, তাই!
-কি হয়েছিল? মাধবীর উদগ্রীব গলা!
-কিছু না তেমন.. বার্ধক্য জনিত রোগ। আমাদের এলাকা এখন রেড জোন..রাস্তায় বেরোতে দিচ্ছে না কাউকে, ফলে ঠিকমতো চেক আপ হচ্ছিলো না বাবার। কোনো ডাক্তার ঘরে আসতে চাইছে না এখন।ডাক্তারের কাছে বার বার নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছিলো না। রাতে ঘুমের ঘোরেই.. অজিত বাবুর গলা কান্নায় কেঁপে গেলো। কিছুক্ষন দুদিকেই চুপচাপ…
-জানো মাধু, বাবা এই লক ডাউন-এ একা একা নিঃশব্দে চলে গেলো! একটা আত্মীয় স্বজনও আসতে পারে নি শেষ দেখা দেখতে..
পুলিশের কড়া পাহারায় কাঁচের শব গাড়িতে বাবা চলে গেলো.. শেষ মুহূর্তে একটা ফুলের মালা পর্যন্ত পরাতে পারিনি! আতর ছেটাতে পারিনি.. একটি নতুন সাদা কাপড়ে বাবার শরীরটা মুড়ে দিতে পারিনি মাধু! এমন অভিজ্ঞতা! অজিত বাবু কাঁদছে নিঃশব্দে…. মাধবী ক্রন্দন মাখা গলায় বললো- শক্ত হন অজিত বাবু। এখন কে আছে আপনার সাথে?
-কেউ না, মা তো সেই কবেই চলে গেছেন! বাবাকে যে দেখাশোনা করতো সেই রঘুদা আছে.. জানো মাধু অন্তিম যাত্রাতেও বাবা একটা কাঁধ পেলো না! চার কাঁধ জোগাড় হয়নি..আমার একার কাঁধ…
-বুঝেছি, বুঝেছি অজিত বাবু শান্ত হন… কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাধবী আবার জিগ্যেস করলো- ঘাট কাজ কিভাবে করবেন? অজিত বাবু বললেন- সামনে একটা আশ্রম মতো আছে.. ঘাট কাজ সম্পন্ন করে পাঁচজন ব্রাহ্মণ খাইয়ে দেবো। সেটাও পুলিশি পাহারায় যথাযথ লক ডাউন এর নিয়ম মেনেই করতে হবে। রঘুদা সব ঠিক করে রেখেছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অজিত বাবু বললো- লক ডাউন মিটে গেলে তোমার কাছে যাবো মাধু। ভালো লাগছে না গো। তোমায় কাছে পেতে ইচ্ছে করছে খুব। শোনো মাধু তুমি ছেলে নিয়ে সাবধানে থেকো। জানি তোমার খুব আর্থিক টানাটানি চলছে। মাধু তোমার একাউন্ট নম্বরটা দাও। আমি কিছু টাকা জমা করে দেবো। এই লক ডাউন এ আমার ব্যবসাও বন্ধ যে!
-অজিত বাবু আমি সব বুঝতে পারছি। নিজের জন্য না, শুধু ওই ছোট ছেলেটার জন্য.. দুধের কৌটো কিনতে পারছি না যে… বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মাধবী।
ফোনের দু’প্রান্তে দু’টো সামাজিক আর অসামাজিক ভালোবাসা তাদের সুখদুঃখ, মান-অভিমান, প্রেম মোহনায় মিশিয়ে দিচ্ছে..ওরা একান্ত হতে চাইছে….দুজন দুজনের কাঁধ চাইছে একটু কেঁদে হালকা হওয়ার জন্য…
সমাপ্ত
.