গোপালের মা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
-কি গো বোস দিদা কেমন আছো তুমি? মায়ের কাছে শুনলাম তুমি নাকি একাই থাকো এই বয়সে।
-না না একা তো আমি থাকি না। সঙ্গে আমার গোপাল থাকে।
-গোপালটা আবার কে গো? তোমার কোনো নিকট আত্মীয়?
বোস দিদা খিলখিল করে হেসে বলে, নিকট বলে নিকট। গোপাল হচ্ছে পরম আত্মীয় আমার। শুধু আমার কেন গোপাল সবার নিকট আত্মীয়।
-ও দিদা হেঁয়ালি করা বন্ধ করে বলো না কোন গোপালের কথা বলছো।
বোস দিদা আমার হাত দু’টো ধরে বলে, আমার গোপাল হচ্ছে তোদের শ্রীকৃষ্ণ।
-ওওওও, তুমি কৃষ্ণ ঠাকুরের কথা বলছো!
হ্যা৬ গো দিদা তোমার তো চারটে ছেলে তাই না? সবার তো বিয়ে থাওয়া হয়ে গেছে। তারা তোমার খোঁজ খবর নিতে আসে না?
বোস দিদা একটু মুচকি হেসে বলে, আসে তো ছেলে, বৌমা, নাতি নাতনি সকলেই আসে। যখন আমি খাওয়া দাওয়ার নেমন্তন্ন করি।
সকলে মিলে এসে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে যায়।ব্যাস তারপর আর মায়ের কোনো খোঁজ খবর রাখে না।
-সেকি গো দিদা! তোমার ছেলেগুলো তো মোটেই সুবিধার নয়।
– সে কথা আর বলতে। সারাদিন সবাই আমার মৃত্যুর দিন গুনছে। আমি চোখ বুজলেই বাড়িটা বিক্রি করে টাকাগুলো চার ভাগে করে নেবে। এই আশাতেই বসে আছে কুলাঙ্গারগুলো।
আমি কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করি, দিদা তোমার তো আশির কাছাকাছি বয়স। এই বয়সে নিজে রেঁধে খাচ্ছো কি ভাবে? তোমার বাজার হাট, ওষুধ পত্র কে এনে দেয়?
বোস দিদা বলে, সবই গোপাল ব্যবস্থা করে দেয়।
আমার দুচার জন গুরু ভাই বোন আছে তারাই দোকান, বাজার, ওষুধ পত্র সবের জোগাড় করে দেয়। আর আমি দু’মুঠো ফুটিয়ে নিই ।
-এটা তোমার একটা সুরাহা হয়েছে বেশ। কিন্তু এই বয়সে পেনশন তুলতে যেতে পারো একা একা?
-ওরে আমার তনু সোনা বয়স যতই বাড়ুক যদি কারোর মনের জোর আর টাকার জোর থাকে তাহলে তাকে ছেলে মেয়েদের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হয় না।
আমি যেদিন পেনশন তুলতে যাই অটো ওয়ালা সমুকে ডেকে পাঠাই। ও যত্ন করে আমাকে অটোতে তোলে আবার নামিয়েও দেয়। তারপর আমাকে ধরে ধরে পেনশন অফিসে নিয়ে যায়। আমার কাজ মিটে গেলে আবার যত্ন করে অটোতে বসিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
আমিও ওকে ওর অটোর যা ভাড়া তার থেকে আরো বেশি কিছু টাকা দিয়ে দিই। সত্যি বলছি দিদিভাই সমু গরীব হতে পারে কিন্তু লোভী নয়। বরং ভাড়ার অতিরিক্ত যে টাকা দিই তা নিতে চায় না মোটেই। আমিই বলি, তোর বউ-এর হাতে দিবি। বলবি বোস দিদা পাঠিয়েছে।
এইসব কথা শুনে আমি শুধাই, তোমার ছেলেরা পেনশনের টাকা দাবি করে না?
দিদা খানিক চুপ থাকে তারপর বলে, সেও এক লড়াই বুঝলি। তোর বোস দাদু প্রথমে আর্মিতে চাকরি করতো। ওখান থেকে রিটায়ারমেন্ট নেওয়ার পর ডিভিসিতে আবার চাকরি করে। তাই তোর দাদুর দু’টো পেনশন ছিল। তোর দাদু মারা যাওয়ার পর হাফ করে এই দুটো পেনশনের টাকাই আমি পাই।
এই নিয়ে একদিন ছেলেরা আলোচনা সভা বসালো। বড় ছেলে স্কুলের কেরানি সে হিসেবে কষে বললো, মা তুমি যে টাকা পেনশন পাবে তাতে তুমি চার ভাইয়ের ঘরে ঘুরে পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারবে। তোমার থাকা খাওয়ার জন্য কাউকে কোনো টাকা দিতে হবে না। তবে আমাদের ছেলে মেয়েগুলোর লেখাপড়া, শখ আহ্লাদের দায়িত্বটা তুমি নিও।
আমি তো মনে মনে খুব খুশি হলাম। নাতি নাতনিগুলোকে কাছে পাবো। আর ভাবলাম লেখা পড়াতে আর কটা খরচা হয়। আসলে আমার তো জ্ঞানই ছিল না ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মাইনে হয় হাজার হাজার টাকা। তারপর নাতি নাতনিদের নিত্য মোটা মোটা চাহিদা। আমার পেনশন তো প্রায় পুরোটাই শেষ হয়ে যেত।
তারপর আমার গোপাল সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে। আমি কাঁসর বাজিয়ে গোপালকে ঘুম থেকে তুলি। এইসব করলে ওদের ঘুমের ব্যঘাত ঘটতো খুব। তাই নিয়ে বৌমা, ছেলে বিরক্তি প্রকাশ করতো।
তাছাড়া আরো একটা বড় ঝামেলা হচ্ছে আমার খাওয়া দাওয়া। আমি নিরামিষ খাই আর চারবেলা গোপালকে ভোগ নিবেদন করি। ছেলেদের বাড়িতে এইসব কাজের খুব অসুবিধা হতে লাগলো।
তখন আমি স্থির করলাম ছেলেদের সংসারে না থেকে নিজের বাড়িতেই ফিরে যাওয়া ভালো। একটা বছর চার ছেলের ঘরে ভাগের মা হিসাবে থেকে অবশেষে গোপালের মা হয়ে নিজের বাড়িতে আমার পাকা পোক্ত অবস্থান।
আমার শরীর টরীর খারাপ হলে গুরু ভাই বোন রা এসে রাতে থাকে। আর মাঝে মধ্যে আশ্রমের লোকেদের সঙ্গে তীর্থ করতে বেরিয়ে পড়ি।
তনু তোকে কি বলবো কি যত্ন করে আশ্রমের লোকজন বেড়াতে নিয়ে যায়। সঙ্গে একজন ডাক্তারও থাকে।
আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম আশি বছরের বয়ষ্কা এই মহিলাটার কথা। যার চার চারটে ছেলে। কিন্তু সে কারোর মুখাপেক্ষি নয়। সে কি সুন্দর নিজের মনের জোরে আজও ঈশ্বরের সাধনায় মগ্ন হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে দিন।
অনেক ক্ষণ গল্প করার পর বোস দিদার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বলি, তোমার মতো করে তুমি বর্তমানকে নিয়ে আনন্দ করে কাটিয়ে দাও দিদা। আজকের বর্তমান সমাজে বেশিরভাগ মানুষের যে নৈতিক অবক্ষয় তাতে সন্তানদের অবহেলাকে তুচ্ছ জ্ঞান করার বোস দিদার মতো শক্ত মনোবল যেসব মায়েদের থাকবে তারা জীবনের শেষ মুহূর্তটাও সুখে কাটিয়ে দিতে পারবে।