মনসামঙ্গল কাব্য ও দক্ষিণবঙ্গের অরন্ধন উৎসব
গ্রাম বাংলার হিন্দু ঘরে ঘরে লেগে যায় উৎসবের মেজাজ। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। বিশেষ করে বাড়ির মেয়ে-বৌদের মধ্যে ঘরদোর পরিষ্কার করা, শুচিশুভ্র এক পরিবেশ তৈরি করা। লক্ষ্য, মাসের শেষে তাদের আরাধ্যা দেবী মা মনসা পূজা। দেখার মতো- মনসা পূজা নিয়ে এত উৎসাহ। এত শুচিতা। যে প্রতিপদে মনে করিয়ে দেয় এ পূজাতে ভক্তির থেকে ভয় বেশি।
দক্ষিণবঙ্গে সাপের দেবী মনসা। বাংলা নদীমাতৃক ভূমি। চারিদিকে জল-জঙ্গল। তার ফলে সাপের প্রাদুর্ভাব বেশি। আর এখানকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী। সে কারণে মাঠ-ঘাট, জল-জঙ্গল পদচারণ ভূমি। প্রতি বছর বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ মারা যেত সাপের কামড়ে আগে তো এতো উন্নত চিকিৎসা বিদ্যা ছিল না। সে কারণে সে সময় নির্ভর করতে হতো গুনিন ও ওঝার উপর। কিন্তু শেষরক্ষা হতো না। গ্রামবাংলার অন্তজ শ্রেণীর গৃহবধূরা পিঠে-পুলি, পঞ্চব্যঞ্জন, মাছ, চিংড়ি রান্না বসিয়ে দেয় সারারাত। রান্না চলে ভোর পর্যন্ত। সেই সকল খাবার নিয়ে পূজা দেয় মনসাকে। মনসা গাছ মনসা দেবী প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে থাকে। পূজার আরেক উপকরণ দুধ-কলা। মনসার বাহন সাপ নাকি তাতে সন্তুষ্ট হয়।
মনসা পূজা মূলত তখন অন্তজ শ্রেণীর মধ্যে দেখা যেত। যারা বাঁচতে চেয়েছিল অলৌকিক বা অতি ভৌতিক শক্তির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে। এমন এক শক্তির আধার তৈরি করে ফেলেছিল অবৈদিক মনসাকে ঘিরে। সেজন্য মনসা রূপ-গুণ ক্রোধ, হিংসা অধিকারের লড়াইটা অন্তজ শ্রেণীর নারীর মতো। বৈদিক দেব-দেবীর সঙ্গে কোনো মিল নেই। পুরোপুরি অবৈদিক সম্পন্ন। বাংলার লোকায়ত অন্তজ শ্রেণীর মহিলাদের মন থেকে সৃষ্টি। সেজন্য নাম মনসা। মনের আশা, মনসা। বাংলার পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্ত অর্থাৎ সুন্দরবন অঞ্চলের আরাধ্যা দেবী মনসা। মনসা কথা প্রথম পাওয়া যায় মনসামঙ্গল কাব্যগুলিতে। সেগুলিতে মনসার উৎপত্তি, পূজার প্রসার এমনকি তার চরিত্র জানা যায় মঙ্গলকাব্যগুলি থেকে। কাব্যগুলি প্রায় সাত শত বছর আগে রচিত হয়েছিল। সে দিক থেকে বিচার করলে মনসা দেবীর সৃষ্টি সাত শত বছর আগে। প্রথম দিকে মনসা দেবী কেবলমাত্র অন্তজ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যাদের জীবিকা ছিল চাষবাস, মাছ ধরা, পশু শিকার প্রভৃতি। ধীরে ধীরে তা উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের সমাজের নারীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতাদের জানা ছিল এই অবৈদিক আঞ্চলিক দেবীকে যদি না বৈদিক দেবদেবী বিশ্বাসের মধ্যে প্রভাব বিস্তার ঘটানো না যায়, তাহলে দেবীর বিস্তার ঘটানো সম্ভব হবে না। সে কাজ জোর কদমে চালিয়ে যায়। তাদের সাহিত্যে, তাদের গানে, তাদের পাঁচালীতে।
মনসামঙ্গল কাব্য কাহিনীতে এরকম:
চাঁদ সওদাগর শিবের উপাসক। মানে বৈদিক শাস্ত্রে বিশ্বাসী। তার স্ত্রী স্বামীর মঙ্গল কামনায় ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ঘট বসিয়ে মনসা পূজা করছে। সেটা জানতে পেরে চাঁদ সওদাগর লাথি মেরে ঘট উল্টে দেয়। তাতে মনসা দেবী রুষ্ট হয় । প্রতিহিংসায় তার ছেলেদের খাবারের বিষ মিশিয়ে মেরে দেয়। এমনকি বাণিজ্যিক সপ্তডিঙা মধুকর ডুবিয়ে দেয়। সকলকে মেরে দিলেও চাঁদ সওদাগরকে বাঁচিয়ে রাখে। কারণ সে যদি বেঁচে না থাকে, পুজো যদি না দেয়াতে পারে তাহলে দেবীর মহিমা কেবলমাত্র অন্তজ শ্রেণীর মধ্যে থেকে যাবে। সেটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি নয়। তাকে যে উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের পূজা পেতে হবে। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে চাঁদ সওদাগর বাড়ী ফিরে দেখে সনকার গর্ভে সন্তান বড় হয়ে গিয়েছে। বিয়ের উপযুক্ত। এদিকে মনসা প্রতিজ্ঞা করেছে বাসর ঘরের লক্ষিন্দরকে সাপের কামড়ে মারবে। সে কারণে ছেলের জন্য লোহার বাসর ঘর করেছে।
আর চাঁদ সওদাগর পাহারা দিচ্ছে। ঘরের বাইরে হেতাল বাড়ি নিয়ে। তবুও সাপের কামড়ে লখিন্দর মারা গেল। নববধূ বেহুলা কলার ভেলায় স্বামীকে নিয়ে গাঙ্গের জলে ভেসে চললো স্বামীর প্রাণ ফিরে পেতে। অবৈদিক দেবী মনসা ও বৈদিক দেবদেবীর তুষ্ট করে লখিন্দরের প্রাণভিক্ষা পায়। মূল কথা হলো, বেহুলার সঙ্গে চুক্তি হয় স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে শ্বশুরকে দিয়ে পুজো দিতে হবে। পুত্রবধূর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাঁ হাতে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পুজো দিয়েছিল। তাতে মনসা খুশি যে বৈদিক শাস্ত্র বিশ্বাসী উচ্চবর্ণের উচ্চবিত্ত প্রতিনিধি তার পুজো দিয়েছে। তার ফলে উচ্চবর্ণের মহিলাদের হাত ধরে মনসার প্রবেশ ঘটে।
উচ্চবর্ণের মহিলারা নিম্নবর্ণের মহিলাদের সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। পারস্পরিক মেলামেশা ও ভাব আদান প্রদানের মধ্যে সেটা গড়ে উঠেছিল। আর সেই নারী সমাজ পরবর্তীকালে সংসারের মধ্যে পুরুষ সমাজের মধ্যে মনসা দেবী প্রভাব ঘটাতে থাকে। তার ফলে বাংলায় বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে মনসা পূজার বিস্তার লাভ করে।
ভাদ্র মাসের শেষ দিনটা সুন্দরবন ও আশেপাশের জেলাগুলিতে মনসা দেবীর পূজাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় অরন্ধন উৎসব। মনসার পূজায় জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেলা ভাসানো উৎসব লক্ষ্য করার মতো। পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয় পাঁচালী গান। মঙ্গল সুরে মনসা গান। সে কারণে মনসামঙ্গল কাব্য এক সংস্কৃতির সঙ্গে আরেক সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। তা প্রায় সাতশ বছর ধরে একটু একটু করে সমগ্র হিন্দু বাঙালি সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। মনসামঙ্গল কাব্য বাংলায় যেমন নিজস্ব সম্পদ, তেমনই মনসা দেবী হয়ে উঠেছে দক্ষিণবঙ্গের আরাধ্যা দেবী।