গল্প

গল্প- বন্ধু তুই

বন্ধু তুই
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

সেই কোন স্কুলবেলায় শ্রেয়ারা পাঁচবন্ধু সবসময় একসঙ্গেই থাকতো…সে ক্লাসরুমই হোক কিংবা খেলার মাঠ বা লাইব্রেরী। পাঁচ জনকে একসঙ্গে সবাই পাঁচফোড়ন বলতো। মনের যা কিছু কথা নিজেদের মধ্যে উজার করে বলতে না পারলে ওদের ভাতই হজম হতোনা। হা হা করে প্রাণখোলা হাসি ভেসে যেত স্কুল বিল্ডিংয়ের করিডোর ছাড়িয়ে…

স্কুল শেষ হলে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও তরী আর শ্রেয়া একসাথেই কলেজে ভর্তি হলো।

ওদের মধ্যের প্রাণের বন্ধনটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো শক্তপোক্ত হলো। দুজনের সব ব্যাপারেই দারুণ মিল। দুজনের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য ছিলো আর্থিক অবস্থার। শ্রেয়ার বাবা সামান্য একটা চাকরী করতেন। আর তরীর বাবা একজন অর্থশালী লোক… শহরে দু-চারটে বাড়ি, গাড়ি, আর্থিক প্রতিপত্তি সবই ছিলো। বিরাট ব্যবসায়ী উনি। কিন্তু ওনাদের স্বভাবে বা ব্যবহারিক প্রকাশে তা কখনোই বোঝা যেত না। আসলে সামান্য পুঁজি থেকে কষ্ট করে দাঁড়ানোর মর্ম তরীর বাবা আশুতোষবাবু বুঝতেন। আর ওনাদের মেয়ে তরীও খুব খোলামেলা স্বভাবের ভালো মেয়ে। অত বড়লোক হয়েও কোন গর্ব ছিলো না ওর। শ্রেয়ার সাথে প্রাণের বন্ধুর মত মিশতো। শ্রেয়ার যে কোনো অসুবিধায় কোনো শর্ত ছাড়াই সাহায্য করতো। অনেক সময় শ্রেয়া অনেক কিছু চেপে যেতো কিন্তু তরী ঠিক টের পেয়ে যেত।

পরিবারে বাবা-মা অনেকসময় যে কথাটা বোঝে না…বন্ধু তার সমবয়সী মন দিয়ে সেটা সহজেই বুঝে যায়। আর বন্ধুত্বের মধ্যে তো কোন শাসন, ধমক, ভয় নেই। তাই বন্ধুর কাছে মন খোলা যায় সহজেই।

সেই স্কুলবেলা থেকেই তরী বেশী করে টিফিন আনতো বন্ধুদের জন্য… শ্রেয়াকে জোর করেই একটু বেশী দিতো। আর শ্রেয়ার আনা রুটি-তরকারীই হোক কিংবা মুড়ি… সেটাও ভালোবেসে খেতো। শ্রেয়ার লজ্জা করতো… ওর নিজের টিফিন শেয়ার করতে। কিন্তু তরী বা অন্য বন্ধুরা এসব গ্রাহ্যই করতো না। কতবার এমন হয়েছে শ্রেয়া রেফারেন্স বই কিনতে পারেনি…তরী নিজের বইটা দিয়ে দিয়েছে। শ্রেয়া নিতে না চাইলেও শোনেনি…মুখ ভার করে থেকেছে। তখন শ্রেয়া বাধ্য হয়েই নিয়েছে। পরে তরী নিজের হাত খরচের টাকা থেকে আবার বই কিনে নিয়েছে। শ্রেয়া টাকা খরচ করে স্পেশাল কোচিং নিতে পারেনি…তরী নিজের গৃহশিক্ষকের নোটস ওকে অবলীলায় দিয়ে দিয়েছে। হিংসার ছিটেফোঁটাও নেই তরীর মনে।

এমন বন্ধুকে কী না’ভালোবেসে থাকা যায়? দুজনের বাড়িতেই দুজনের অবাধ বিচরণ ছিলো। এভাবেই দু’বাড়ির মায়েদের মধ্যেও একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো।

কলেজে বন্ধুদের জন্মদিন লেগেই থাকতো… ওরা ট্রিট দিতো…তরী শ্রেয়ার থেকে কম টাকা নিয়ে নিজে বেশী টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে দিতো গিফট কেনার সময়। সেবার বাকী বন্ধুরা জোর করলো শ্রেয়াকে “কি রে তোর জন্মদিনে খাওয়াবি না?”

তরী পাশ থেকে বললো-কেন নয়? নিশ্চয়ই পার্টি হবে…

শ্রেয়া পরে তরীকে বললো-‌ওদের মত অত দামী রেস্টুরেন্টে আমি খাওয়াতে পারবোনা… তুই তো জানিস! তুই কেন হ্যাঁ বললি?

তরী হেসে বললো- টেনশন নিস’না তো… আমি আছি না। আমি থাকতে প্রিয় বন্ধুর চিন্তা কি? আমি কি আমার বন্ধুত্বের সম্মানে ওদের একদিন খাওয়াতে পারবো না?

শ্রেয়া বললো-আমার জন্মদিনে তুই কেন খাওয়াবি?

তরী বললো-আমি তোর কেউ নই… তাই তো? আমার তোর উপরে কোনো অধিকার নেই…তাই তো? বলে মুখ ফোলালো। অগত্যা শ্রেয়াকে রাজী হতেই হলো…কেউ জানলো না… শ্রেয়ার হয়ে রেস্টুরেন্টের পুরো বিলটাই পে করলো তরী।

আসলে প্রতিমাসে তরী বাবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের হাতখরচ পেতো…কিছুটা খরচ করে বাকীটা জমাতো এইধরণের নানা কাজের জন্য।

মাঝেমধ্যে শ্রেয়া তরীকে বলতো-তোর কাছে আমার এত ঋণ… কি করে শোধ করবো!

তরী মিচকে হেসে বলতো-“আমার দাসী হ’ আর হাত-পা’টা ভালো করে টিপে দে… পরক্ষণেই বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়ে বলতো-ভালোবাসার মন দিয়ে কিছু করলে ঋণ হয় না…

কলেজে পড়াকালীন একবার তরী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো…টাইফয়েড, জ্বর… সেইসময় শ্রেয়া বন্ধুর পাশ থেকে একটুও নড়েনি।

আসলে “বন্ধু পারে হৃদয় দিতে…আর পারেনা কেউ”

দিন চলে গেছে…লেখাপড়া শেষে চাকরী, বিয়ে, বাচ্চার মা হওয়া…এখনও ওরা জড়িয়ে রয়েছে একে অপরকে। শ্রেয়ার বর অর্ণব ডাক্তার …ও মাঝেমধ্যে মজা করে অনুযোগ করে বলে —“তুমি তো আমার থেকেও তরীকে বেশী ভালোবাসো।” শ্রেয়া হেসে বলে –“তুমি একটা হিংসুটে দৈত্য।” যদিও অর্ণব ওদের বন্ধুত্বের সবটাই জানে… তাই বলে–“সত্যিই তরীর মত বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার…তোমার বন্ধুভাগ্যকে আমি হিংসাই করি… সে যতই তুমি আমাকে হিংসুটে বলো’না কেন!” তবে এখন কিন্তু অর্ণবই তরীদের ফ্যামিলির ডাক্তার… ওদের বাড়ির বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার চিকিৎসাই করে শ্রেয়ার বর অর্ণব। এতদিন বাদে তরীর মত এমন বন্ধুর জন্য কিছু করতে পেরে ভালো লাগে শ্রেয়ার। পুজোয় নিজের ছেলেমেয়েকে দেওয়ার আগে তরীর বাচ্চাদের জন্যই দামী ড্রেসটা আগে কিনে রাখে শ্রেয়া। তরীর দুই মেয়ে জানে ওদের জন্মদিনে সেরা উপহারটা কিন্তু দেবে শ্রেয়া মাসিমনি… ইমলি, ঝিমলির যত আবদার এই মাসিমনির কাছে। ওদের নিজের মাসিমনির থেকে কোনো অংশে টান কম নেই শ্রেয়া মাসিমনির।

এখন আবার সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই স্কুলের পাঁচ বন্ধুর পুনর্মিলন হয়েছে… “পাঁচফোড়ন” কে একসাথে দেখা যাচ্ছে শপিং মলে,কফি-শপের আড্ডায়,গল্পে… এখনও ওদের প্রাণখোলা হাসির আওয়াজে আশেপাশের লোক ফিরে ফিরে তাকায়। না ওদের লজ্জা নেই তাতে। ওরা উচ্ছ্বল… ওরা চঞ্চল… ওরা বন্ধুত্বের দূত।

এখন আবার ওদের নতুন এক জিনিস শুরু হয়েছে। বর, বাচ্চাদের বাড়িতে জমা রেখে শুধু পাঁচজন মিলে কাছেপিঠে আউটিং এ যায়। দু’দিন ঘুরে,বেড়িয়ে, খেয়ে, গল্প করে নিজেদের মত সময় কাটিয়ে খুশী মনে বাড়ি ফেরে। ওদের হুল্লোড়, হাসির আওয়াজ তখন খোলা সবুজ মাঠ পেরিয়ে ভেসে যায় আকাশে বাতাসে ঠিক সেই স্কুলবেলার মতোই।।

Loading

One Comment

  • Anonymous

    নস্টালজিক। ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা।
    ।। সুনির্মল বসু।।

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

You cannot copy content of this page