গল্প

গল্প- মিষ্টি গুজব

মিষ্টি গুজব
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

জগু মিত্র রোডে ঢুকেই বাম পাশের সরু গলিটার শুরুতেই মাধবের মিষ্টির দোকান “সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার”। দোকানটা অনেক পুরোনো। মাধবের বাপ-ঠাকুরদার আমলের। এখন তো মাধবেরও বয়স হয়ে গেছে। ঠিকমত দেখাশুনো করতে পারে না।চাকরীর বাজার খুবই খারাপ। তাই মাধবের ছেলে লেখাপড়া শিখেও মিষ্টির দোকান চালায়। যদিও ওর খুব ইচ্ছে ছিলো চাকরী করে। কিন্তু সে ইচ্ছেয় বালি।

পাড়ায় এই একটামাত্র মিষ্টির দোকান ছিলো আগে। আর চারদিকে পুরোনো একতলা দোতলা বাড়ি ছিলো সব। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই পাল্টে গেলো সবকিছু। ছোট বাড়িগুলো ভেঙে মস্ত ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরী হচ্ছে।আর তাদের একতলায় কত রকমের দোকান! তার মধ্যে যে মিষ্টির দোকানগুলো তৈরী হয়েছে সব ঝাঁ চকচকে। সুন্দর ডেকরেশন করা কাঁচের শোকেসে নানারকম নতুন ধরণের মিষ্টি। আর লোকে ওইসব দোকানেই ভিড় বাড়াচ্ছে।

টাকার অভাবে মাধবের দোকান যে তিমিরে সেই তিমিরেই। সেই আদ্যিকালের অন্ধকার দোকান, তার উপর গলির মধ্যে… কারো নজরেও পড়ে না। পাড়ার ফ্ল্যাটবাড়ির লোকজনও সব নতুন আর আধুনিক। এই পুরোনো দোকানে তাদের ভক্তি নেই। তবে একটা সময় খুব রমরমা ছিলো মাধবের ব্যবসার। তখন প্রতিযোগিতা কম ছিলো।পাড়ায় এত দোকান ছিলো না। আর মাধবের হাতের রসগোল্লা আর দই, সন্দেশের খুব খ্যাতি ছিলো। বিয়ে বাড়ি, শ্রাদ্ধবাড়ি, উপনয়ন সবেতেই মাধব অর্ডার পেতো। কিন্তু এখন সেদিন আর নেই। এখন মাছি তাড়ায় ওর ছেলে সাধন।

সেদিন বন্ধুদের আড্ডায় সাধন দুঃখ করছিলো। এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সংসার চালানোই মুশকিল। সেখানে দোকান সাজানোর কল্পনা করাই বৃথা। আর লোন নিতেও ভরসা হয় না। সব শুনে ওর বন্ধু সুনীল বললো-“দাঁড়া,একটা বুদ্ধি বার করি।”

বন্ধুমহলে সুনীলের বুদ্ধির কদর আছে…শুধু বুদ্ধি নয়, ওর মাথায় দুষ্টবুদ্ধি কিলবিল করে!

যেমন ভাবা তেমন কাজ। পাড়ায় পাড়ায় রটে যেতে দেরী হলো না যে সত্যনারায়ণের দই খুব লাকি। ওই দই খেয়ে বা ফোঁটা লাগিয়ে পরীক্ষা, চাকরী, প্রমোশন এমনকি বিয়ে সব তড়তড়িয়ে উৎরে যাওয়া যায়। ভাগ্যবিশ্বাসী পাঁচ আঙুলে স্টোনের আঙটি পরা মানুষ যে এসবে বিশ্বাস করবে তা বলাইবাহুল্য। আর আরো একটা কথা রটলো। মাধবের দোকানের রসগোল্লাও অমৃত। যা খেলে পেটের রোগ সারবেই, অব্যর্থ।

ব্যস পাড়ায় পাড়ায় এই বার্তাটি রটে গেলো ক্রমে। একেই বলে গুজবের বিজ্ঞাপন। গুজব পাখনা মেলে উড়তে লাগলো! মাধবের দোকানের দই মিষ্টির কদর বাড়লো…বিক্রিও বাড়লো উত্তরোত্তর। মাধবের বুদ্ধিতে কারিগরেরা আরো সুস্বাদু মিষ্টি বানাতে লাগলো। দোকানটা সবার নজরে এলো।সবাই জানলো…মিষ্টির সুখ্যাতি হলো।এতদিন যারা পাশ কাটিয়ে চলে যেত তারাও দই কিনলে মাধবের থেকেই কেনে। দই-এর কল্যাণে কা’র ভাগ্য খুলেছে জানা নেই তবে খারাপ কারো হয়নি!

মাধব আর ওর ছেলে সাধন এবার টাকা পেয়ে দোকানটা সাজাতে শুরু করে। আর সাধনের বন্ধুরা আবদার করে মিষ্টি খাওয়ার জন্য। তাই আগামী পয়লা বৈশাখ ওদের সবার নেমতন্ন সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারে।তাই মধুরেণসমাপয়েৎ। আর গুজব! এমন গুজব কিন্তু ভীষণ মিষ্টি।

Loading

2 Comments

Leave a Reply to AnonymousCancel reply

You cannot copy content of this page